Tuesday, February 27, 2018

গুচ্ছকবিতা  
মঈনুস সুলতান

১. আঁধারের রূপালী ঝাড়



হয়তো আমার চাই বল্গাহরিণ
নতুবা কেন যে পথ চলি ভলগা উপত্যকায়,
পায়ের নীচে তুহিন তুষার, ফারের টুপি
শ্বেত ভালুকের চামড়ার বিশাল চাপকান,
হাতে চকচকে বর্শা-
হিমেল নিঃসঙ্গতায় পিছনে একাকী অনুসরণ করে
কৃষ্ণ লোমশ আফগান হাউন্ড!

অথবা যেন বসে আছি অনন্তকাল স্পেনিশ প্রস্তরে
মুর রূপসীর মতো চপল উর্বশী ঝর্ণায়
গহীন রজনীতে তৃষ্ণার্থ হরিণের মতো দল বেঁধে নেমে আসে
নক্ষত্রের সুবর্ণনীল কমলালেবু রঙ ছায়াপথ
আমি বসে থাকি প্রস্তরবৎ!

কেথায় যেন ফেরাউনের কফিন ঘিরে
কোলাহল করে কথা কয় কতিপয়
প্রত্নতাত্ত্বিক বাদুড়

অই মমীর মিশরী স্মৃতি, অই কুহক কল্পনা
আমার চোখের শিশিরে আঁকে-
জেব্রার মতো নক্সাকাটা স্বপ্ন!

পৌরাণিক নিঃসঙ্গতায় আমার চাই বল্গাহরিণ
অথচ আফগান হাউন্ডের জ্বলজ্বলে সবুজ চোখ
চেতনার সৌরলোকে জ্বালিয়ে রাখে
আঁধারের রূপালি ঝাড়!

২. আবহাওয়ার রোজনামচা

সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে- ভেবে চিন্তে তৈরী করা
কাঠের লোহিত বরণে বার্নিশ সেতুটির মতো
রূপালি সলিলে ভাসা নির্ঝর সঙ্গীত,
যার শ্রবণে জোৎস্নার জাফরি গলে আমরা
ফিরে দেখতে পারি- ঐতিহ্যে মোড়া আমাদের অতীত,
মহাশূণ্যের প্রতিফলনে ঋদ্ধ বর্ণের সমাহারে
সৃজিত কিছু চিত্র,
অগ্নিকুন্ড ঘিরে বসার বৈঠকি পরিবেশ
গুল্পগুজব করার মতো কতিপয় মিত্র;

জাহাজ সমুদ্রে না-ও ভাসতে পারে
ঝলসাবে না হয়তো সোনালি-নীলাভ আলো বাতিঘরে,
জরুরি হচ্ছে- আবহাওয়ার রোজনামচা লেখা হররোজ বিশুদ্ধ অক্ষরে।

আগামির ময়নাতদন্তে ওঠে আসবে
সাতটি আগুন পাহাড়ে যুগপৎ বিষ্ফোরণের সংবাদ
ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা গড়বে রাজ্য বিস্তৃত হবে জ্বালানীর বিবাদ,
কৃষ্ণপক্ষের কৃষ্ণাভ নীলিমায় উৎক্ষিপ্ত হবে
তপ্ত লাভার কমলালেবু রঙের ফানুস,
জরুরি হচ্ছে- জনপদে খোঁজা
রঙধনুর আবিরে সিক্ত মানুষ।

৩. বৃক্ষ হ্রদ ও পাহাড়

বালুকা ও নুড়িপাথরের সয়লাবে নিমগ্ন হ্রদের পাড়ে
কটনউডের দীঘল বৃক্ষ এক-প্রেক্ষাপটে তার বাসন্তী পাহাড়,
সনোরা ডেজার্টের প্রান্তিক গুহাতে আদিবাসিদের হাড়ে
বিভ্রান্ত পর্যটক খুঁজে জীবাষ্ম- নাবাহো চিত্রকরের আঁকা ষাড়।

পত্রালিতে হাওয়ার কম্পন ছুঁয়ে নওল হয়েছে তরুবর
আমি তার অটাম সিগ্ধ সোনালি সহবতে বসি ছায়াতলে,
উড়ে যাওয়ার অভিলাস- উত্তর মেরুতে বাঁধতে চায় ঘর
পরিযায়ী হতে চায় বৃক্ষপুত্র হাওয়াই মেঘের বিবাগি ছলে।

হ্রদটিও পরিকল্পনা করছে- বিমুখ মাছের অনুরাগীরা
জলতলে গড়ে তুলবে সম্পূর্ণ সাবমার্জ এক নগর,
স্কুবা ডাইভিংয়ের গিয়ার পরে ডুবুরিরা
তালাশ করবে নাবাহো রাজকুমারের রৌপ্যবাসর।

প্রেক্ষাপটে সটান দাঁড়িয়ে মাউন্ট সান হোয়ান
টিলা বেয়ে উঠে পড়ি তার শীলাদন্ত মিনারে,
জগদ্দল পাথরে ছড়ানো ক্যকটাস অফুরান,
বলে-আঁকো আমাকে তুমি
তুলির নিশিডাকে নিয়ে যাও রঙের অভিসারে।


৪. ঘরে ফেরা

কীভাবে ফিরি বলো
সমুদ্রের রূপালি নীল আরশি
ছায়া ফেলে মেঘের আরশ,
বসে থাকি ছাতাতলে.. ছুঁয়ে যায় বাউরি বিভাস
সৈকতে ঝিনুক খোঁজে পরিযায়ী সারস,
জলের গৌরবে হাসে স্নানের বালিয়াড়ি নিবাস
হরেক অন্তর্জালে আহত আত্মা যে পথ হারালো;

তারপর দেখো ভেবে
মেহগিনির স্মৃতিমেঘে গড়ে ওঠছে
আমার বিনম্র ইমারত,
চন্দন কাঠের কুরসিতে মেধা ও মেহনতের দাসখত,
আঙিনায় নিসিন্দা বৃক্ষের সজীব তরবারী
দালানের দ্বিতলের কাজ এখনো হয়নি সম্পন্ন,
ছাদে টাঙ্গায়ে কুয়াশার কুহক মশারি
পারস্য ফরাস আর মর্মরের মোখতসর অন্ন;

কীভাবে ফিরি বলো
দোলাচলের আখ নিংড়ে
সংসারের শর্করা সরনীতে সন্ধ্যা যে হলো;

সাপের খোলসের মতো অতঃপর খুলে ফেলে
গৃহে ফেরার মসলিন খোয়াব,
অবগাহনে মাতি.. অন্তরে আফ্রিকার অতলান্ত আঁব
তুলটে তিতমধুর নওল আখর-আঁকি সময়ের স্মৃতিরঙ্গ,
মননের মেহরাবে দাঁড়িয়ে শুনি
বাজায় মোসাফির.. .. মৃদু স্বরে মৃদঙ্গ।

৫. কাচের বয়ামে প্রজাপতি

কুঠিবাড়ির নোনা ধরা ঘাটে
পড়ে আছে জরাজীর্ণ পানসি
তার ভাঙ্গা হাল মৃদু স্রোতে দোলে,
রণপায়ে হেঁটে যায় সন্ন্যাসি এক
শিশির ঝলসে তার কড়ি গাঁথা জটাজুট চুলে;

চলতে হয় আজ-তাই নদীর পাড় ধরে ধীরে চলি
এ শরীর দেখেছে সুরুজ ঘুণপোকা
তার তরমুজ জারকে আর আসে না গতি,
আমার হাতে কাচের বয়াম
তার দেয়ালে পাখনা কুটে রঙবাহার প্রজাপতি;

সন্ন্যাসির হাতে সুতোয় বাঁধা
রামায়ন নৃত্যের পাপেট,
কুচকাওয়াজ করে পেছনে টেরাকোটা সেপাই
বাজায় তারা ট্রামপেট;

প্রজাপতির ছিল না রঙনহরে চাঁদনী জ্বলা
তুতের সবুজ পাতায় কৌতূহলি শোঁয়াপোকা,
বৃষ্টিবন হয়েছে উজাড়
সন্ন্যাসি কেন পথ চলে দ্রুত
খুঁজে কী নীড়হারা কাকাতুয়া?

আমার গন্থব্য কোথায়
যাবো কী আজ বৃষ্টির সংসারে?
মন হয়ে আছে খিন্ন স্যাঁতসেঁতে,
খরায় পুড়েছে শস্য
ফড়িং উড়ে জোড়ায় জোড়ায় বিরাণ ধানক্ষেতে;

সন্ন্যাসি চলে গেছে বহুদূর,
এখনো যায় যে শোনা

৬. ট্রাম্পেটের মৃদু সুর..

কে সৃষ্টি করে খরাবৃষ্টি শীলাঝড়,
অপার নীলিমা থেকে ফেরেশতারা কখন
ছুড়ে মারে বরফের ঝকঝকে পাটকেল,
কেন আমলকি ঝরা আমার গ্রামে
আজ বসেছে ব্রথেল?

চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ি
ধানশালিকের আঙ্গিনায়
এখানে গড়া শস্যহীনতায়
নিদানের নিদমহল,
বয়ামের প্রজাপতি পাখনা কুটে কুটে
অক্লান্ত চঞ্চল।

No comments:

Post a Comment