Tuesday, February 27, 2018

সব্যসাচী হাজরার চোখে উমাপদ করের "রবীন্দ্রকবিতা: আজকের উঠোনে"


অনেকসময় ভালোবাসার উপরে উঠে আসে প্রয়োজন। নিজেকে জানার, চেনার। আত্মানুসন্ধানের। আমরা পড়ি। পাঠক হিসেবে প্রথম যা প্রয়োজন তা পাঠের আনন্দ। আর তার সাথে? বা তার পরে? হ্যাঁ সাথে-সাথেই অথবা পরে-পরেই চলে আসে সেই খোঁজ এবং চলতে চলতে তাকে খুঁড়ে আনা। আমার এই বইটি পড়তে পড়তে মনে হোলো সত্যিই এই বইটি আমাদের পাঠের প্রয়োজন। আমি তার তাগিদ থেকেই পাতার পর পাতা প’ড়ে ফেললাম ‘রবীন্দ্রকবিতা: আজকের উঠোনে’। কয়েকদিন ধরেই পড়ছি এই বইটা। আর ভাবছি, বলা যায় ভাবাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গান মূলত তার প্রয়োগের গুণে কমবেশি আমাদের শোনা হয়। ভালো, মন্দের উপরে উঠে সেই চর্চা, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে তাঁর গানের সামনে নিয়ে আসে। কেউ কেউ সুরের মোহে দুলতে থাকে। কেউ কেউ শুনতে শুনতেই কথার গভীরে আটকে যায়। কেউ কেউ অম্লান দত্তের সেই কথায় যা পীযূষ কান্তি সরকারের প্রাইভেট রেকর্ডে তাঁর স্মৃতিচারণে  শোনা  ‘কথা ও সুরারের বিবাহে’ আচ্ছন্ন হয়। গীতবিতান খুলে কবিতার মতো পাঠ করে। তার সুর, লয়, গীতিময়তা, রাগ-রাগিনী, কথার জীবন, দর্শন ভাব, অভাব, আবেদন , নিবেদনে সমৃদ্ধ হয়। টের পায় সেই রবীন্দ্রনাথ যতনা আমার ভাবে তার চেয়েও আমার অভাবে বড়। সে বাঁচতোই তার বেঁচে থাকার গুণে। সে ছড়িয়ে পড়তোই তার ছড়িয়ে পড়ার আবেদনে। এ গান আজ যতনা তাঁর তার থেকে বেশি আমার/আমাদের। তাই বারবার উঠে আসে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। হ্যাঁ কথাগুলো সাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রোতার দৃষ্টিকোণ থেকে বললাম। আরো অনেক কিছু আছে সেসব কথা এখানে নয়।

কিন্তু রবীন্দ্রকবিতা? সত্যিই আমরা কজন ভেবে দেখি সেভাবে? তিনি কি আজও কবিতায় ততোটাই প্রাসঙ্গিক যতোটা গানে? তিনি কি এভাবেই তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে সজীব বা থাকলেও তা আর কতোদিন? থাকলেও তা কোথায় কোথায়? হ্যাঁ উত্তর নিরন্তর খুঁজে গ্যাছেন একটা বড় সময় ধ’রে যে লেখক তার নাম উমাপদ কর। কোনো রেফারেন্স নয় যেন মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ ও সে। রবীন্দ্রনাথের কথা, কবিতা আর নিজের ভাবনার আলোয় তার প্রশ্ন, খোঁজ ও পর্যালোচনা। আর তার সাথে সাথেই উঠে আসছে কবিতার প্রতি এই সময়ের একজন কবির বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গী। উমাপদ কর বিজ্ঞানের লোক, ফলে তার লেখাতে পাই সামগ্রিক রবীন্দ্রকবিতা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত এক হায়ারার্কিকাল অ্যাপ্রোচ। না বিজ্ঞানের কথা নয় দৃষ্টিকোণের কথা বলছি। লেখার জটিলতা সৃষ্টি নয় সহজ ভাবে তাকে পৌঁছে দেওয়ার  চেষ্টা। লেখকের কথায় “আমি দায়ভার মন থেকে মুছে ফেলে অকুতোভয় হয়েই এই কাজটি করেছি। বলতে গেলে প্রাণের আনন্দে। বস্তুত আমি কারও লেখার দিকে আকৃষ্ট না হয়ে বা আগ্রহ প্রকাশ না করে শুধুমাত্র কবির কাব্য সংকলনগুলি ও কিছু গদ্যকে উপজীব্য করে আমার নিজস্ব চিন্তা চেতনায় এই কাজটি করেছি।”
বইটির প্রথম অংশেই রয়েছে একটি তালিকা ক্র. নং, কাব্যগ্রন্থের(গানসহ)নাম, প্রথম প্রকাশ, রচনাকাল(আনু)। তার পরেই শুরু হয়েছে বাছাই। সেখানেই লেখক তার নির্বাচন নিয়ে সাজিয়েছে অসামান্য কিছু যুক্তি। যেমন আলোচনার ক্ষেত্রে বাদ দিয়েছে ‘সন্ধ্যা সংগীত’, ‘প্রভাত সংগীত’, ‘ছবিও গান’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’, ‘কড়ি ও কোমল’ কবির মক্সো পিরিয়ডের কাব্যগ্রন্থ হিসেবে যাদের স্বয়ং স্রষ্টাই কাব্যপদবাচ্য বলে মনে করেন নি। তেমনই ‘নদী’, ‘কথা’, ‘কাহিনি’, ‘শিশু’,শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘লেখন’, ‘কণিকা’,’স্ফুলিঙ্গ’ আরও কিছু কিছু আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে নানান কারণে।

বিকাশ পর্ব দিয়েই শুরু যেখানে আলোচনায় স্থান পেয়েছে ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’ ও ‘কল্পনা’। কাব্য নির্মাণ ও ভাবনায় কিভাবে বদলেছেন কবি এখানে লেখক তারই আভাস দিয়েছেন নিজস্ব সন্ধানের মধ্য দিয়ে। নির্বাচিতও হয়েছে তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতার অংশ।
ভাব-ভাবনা-ভাষায় পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ এর পরবর্তী পর্বে। ‘নৈবেদ্য’, স্মরণ’, ‘খেয়া’, ‘বলাকা’, ‘পূরবী’, ‘মহুয়া’। আহা কি চমৎকার ব্যাখ্যা। আমিও এই সুযোগে উদ্ধৃত কবিতাংশ গুলোর পথ ধরে আবার পড়ে ফেললাম তার সম্পূর্ণকে। ‘নৈবেদ্য’ অংশের শেষে উমাপদ কর লিখছে “আমি মনে করি আজও যাঁরা কবিতা লেখেন , এই নিসর্গ, প্রকৃতি, প্রাণ ও প্রাণী, মানুষ, মানুষের গড়ে তোলা সব কিছুই তাঁদের কবিতার মূল উপাদান আর উপকরণ। ভাবে, ভাবনায়, চেতনায়, কল্পনায়, ভাষায়, প্রকাশভঙ্গিতে, মাত্রায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, গঠনে, নির্মাণে আলাদা, স্বতন্ত্র। এই মাত্র।” যদিও এই ‘মাত্র’ও কম নয় কারণ এই উপাদানগুলোই আমাদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা হিসেবে চিনিয়ে দেয় সেটাই তো মানুষের গড়ে তোলা। কিন্তু সত্যিই নিসর্গ, প্রকৃতি, প্রাণ ও প্রাণী এর বাইরে আমরা কেউ কি?ভাবায়।

‘শাজাহান’ কবিতাটি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে উমাপদ কর লিখছে “ভাব ও ভাবনায় কীর্তি আর কীর্তিমানের সম্বন্ধ, প্রেমের অন্তহীন যাত্রা সম্ভোগ আর প্রাচুর্যে শেষ হয় না, এমনকি কোনো এক ক্ষণকালীন অস্তিত্বেও তাকে বাঁধা যায় না এই অনুভবই এখানে মুখ্য”। অসধারণ কিছু রবীন্দ্রনাথের চিঠি এখানে তুলে এনেছে লেখক। যেমন প্রমথনাথ বিশীকে একটি চিঠিতে শাজাহানের শেষ অংশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন “আমি জানি শাজাহানের এই অংশটি দুর্বোধ্য।তাই একসময় এটাকে বর্জন করেছিলুম। পরে ভাবলুম , কে বোঝে কে না-বোঝে সে-কথার বিচার আমি করতে যাব কেন-তোমাদের মতো অধ্যাপকদের আক্কেলদাঁতের চর্ব্য পদার্থ না রেখে গেলে ছাত্রমণ্ডলীদের ধাঁধা লাগবে কী উপায়ে।” ভাবুনতো একবার, কী শ্লেষ কী ব্যাঙ্গাত্মক!, এরপরেও রবীন্দ্রকবিতা পাঠ্যপুস্তকের? হ্যাঁ একটা বড় অংশের কাছে তাই যারা “ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা” বলে শুধুই চিল্লোচ্ছে কবিতার মর্মে পৌঁছনোর সময় তাদের নেই। উমাপদ করকে অনেক ধন্যবাদ এই অসাধারণ চিঠিটি সিলেকশনের জন্য।ওহ্ ভাবা যায় না। আমি এখানে চিঠির একটা অংশ তুলে দিলাম মাত্র।

পরবর্তী পর্বে লেখক তুলে এনেছে ‘বনবাণী’, ‘পরিশেষ’, ‘পুনশ্চ’, ‘শেষ সপ্তক’, ‘পত্রপুট’, ‘শ্যামলী’, ‘প্রান্তিক’, ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘নবজাতক’, ‘রোগশয্যায়’ , ‘আরোগ্য’, ‘জন্মদিনে’, ‘শেষলেখা’ -মূলত এই কাব্যগ্রন্থগুলোর নির্বাচিত কিছু কবিতার অংশ। পড়তে গিয়ে কারুর মনে হতেই পারে ‘ওই’, ‘ওই’ কবিতাগুলোও স্থান পেতে পারতো(কারণ ব্যক্তি বিশেষে ভালোলাগার বদল ঘটবেই), কিন্তু যা পেয়েছে আমার বিচারে সেগুলো এই আলোচনায় প্রয়োজনীয়ভাবে স্থান পাওয়ার।

যেমন নির্বাচিত ‘পত্রপুট’-এর বিস্ময় কবিতাটা চিরকালই আমার আলাদা করে পছন্দের। যেমন ‘শ্যামলী’র ‘আমি’ কবিতাটি বহুশ্রুত তবুও যেন এর আয়ু ফুরোবার নয়। ‘রোগশয্যায়’ কাব্যগ্রন্থের ১৩ নং কবিতা এক দুর্দান্ত নির্বাচণ। তেমনই ‘শেষলেখা’র ১৫নং কবিতা। আলাদা ক’রে ‘পুনশ্চ’র ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটির নির্বাচণ ও তা নিয়ে আলোচনা। লেখকের কথায় ‘এই কবিতা এখনও অনেকদিন অন্ধকার থেকে আলো দেখাবে বলেই আমার বিশ্বাস’।

লেখক, চিন্তক উমাপদ কর শুধু ভালোলাগার জায়গা থেকে নয়, তার পাঠের বিচারে রবীন্দ্রকবিতার মননে বেজে ওঠার জায়গাটা যেমন উপভোগ করেছে তেমনই তার নির্মাণ, প্রকাশ এমনকি দুর্বলতার জায়গাগুলোকেও নিজস্ব বুদ্ধিতে, যুক্তিতে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এ সত্যি এ সময় দাঁড়িয়ে আমাদেরকে আবার রবীন্দ্রকবিতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি বসায়।

লেখক লিখছে এক জায়গায় “ ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৩২৫ সালে(১৯১৮)।‘মুক্তি’, ‘ফাঁকি’ মূলত গল্প, কাব্যি করে লেখা। চলতি ভাষায় কথকতার মত বলা। অন্ত্যমিল সমৃদ্ধ। স্পেসের ব্যবহারে পংক্তিতে ভিন্ন সংখ্যার বর্ণ। ‘মায়ের সম্মান’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘মালা’, ‘কালোমেয়ে’, ‘আসল’ সবই গল্প। সামাজিক বিভিন্ন বার্তা নিয়ে কথাবার্তা। এগুলি কবিতা নয়। সাময়িক ভাল-লাগা না-লাগার বিষয়... ” 

রবীন্দ্রনাথের গদ্য থেকেও যে অংশবিশেষ তুলে আনা হয়েছে তা এই আলোচনাগ্রন্থের জন্য যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রগদ্য থেকে উমাপদ করের তুলে আনা মুক্তোগুলোর মধ্যে একটি “অনেকদিন থেকেই লিখে আসছি, জীবনের নানা পর্বে নানা অবস্থায়। শুরু করেছি কাঁচা বয়সে তখনো নিজেকে বুঝিনি। তাই আমার লেখার মধ্যে বাহুল্য এবং বর্জনীয় জিনিষ ভুরি ভুরি আছে তাতে সন্দেহ নেই। এ-সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার মধ্যে এই ঘোষণাটি স্পষ্ট, যে আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে-”
এর পরে আর কি বলার থাকে? আমি সৌভাগ্যবান যে এরকম একটি বই-এর উৎসর্গ তালিকায় আমার নাম। এখন ২১-এ মেলা চলছে বন্ধুদের বলবো ‘খড়িমাটি’ প্রকাশনী থেকে উমাপদ করের ‘রবীন্দ্রকবিতা: আজকের উঠোনে’ বইটি সংগ্রহ করুন। এটি শুধু সংগ্রহযোগ্য নয়, নিবিড় পাঠের দাবি রাখে এই বই। ধন্যবাদ জানাই ‘মনিরুল মনির’ কে সুন্দর প্রচ্ছদে ও গঠনে এই বইটি প্রকাশের জন্য।

No comments:

Post a Comment