Tuesday, February 27, 2018

কবিতার একাল-সেকাল-সমকাল ( প্রবন্ধ ) 
মহসীন হাবিব


সমসাময়িক বাংলা কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসে কবিতা কী আর সমসাময়িক  কবিতা-ই বা কী; কবিতাকে সময়ের ফ্রেমে বেঁধে দিলে তা বৈশিষ্ট্যচ্যুত হয় কি না?     
আমরা জানি প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতি, ক্ষুধা, যৌনতা, জন্ম, মৃত্যু, মমত্ব, মহানুভূতি, সহানুভূতি সব নিয়েই মানুষের জীবন আবর্তিত। আর এইসব বিষয়ের এক আবেগঘন ধারা বর্ণনার নাম কবিতা। তারমানে কবিতা হল মানুষেরই জীবনের উপস্থাপন। কবিতা শব্দের চিত্র, কবিতা সঙ্গীত, যা নান্দনিকতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কবিতা কুয়াশার মত; দেখা যায়, উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু মুঠিতে পুড়ে প্রেমিকার খোপায় ছড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই সুইডিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান কবি   কার্ল স্যান্ডবার্গ বলেছেন, ‘কবিতা হল প্রতিধ্বণি বিশেষ, সে ছায়াকে নাচায়।’  সত্যিই তাই। কবিতা কোনো অতীন্দ্রিয় স্বত্বা নয়। আবার বাহ্যিক জীবনেও তার দেখা  পাওয়া যায় না।  কবিতা মনন-চর্চার বহিঃপ্রকাশ; মানুষের নান্দনিক দৃষ্টির সুর-সৌরভ। নিঃসন্দেহে কবিতা দর্শন প্রকাশের সহজতর মাধ্যম। 
পক্ষান্তরে কবি নিজে দাশর্নিক; উপমার নির্মাতা, রূপকের কারিগর। তাই আমেরিকার কবি জেমস টেইট বলেছেন, ‘সর্বত্র কবিতা বিরাজমান। তাকে শুধু সঠিকভাবে নামিয়ে আনতে হয়।’ এই নামিয়ে আনার কাজটি কবির। কবি কে এবং কবি’র কী কাজ তা নিয়ে অমিয় চক্রবর্তীর ব্যাখ্যাটি মনে রাখবার মতো। বলেছেন,‘রাষ্ট্রিক ও ধর্মতাত্তি¡কের খÐিত ব্যাখ্যায় যখন জীবনের সমগ্র ছবি চোখের ভিড়ে হারিয়ে যায়, সেই ছিন্নদর্শীর ভিড়ে এসে দাঁড়ান করি, যিনি চক্ষুস্মান্। সম্পূর্ণতার বোধ ফিরিয়ে আনেন তিনি। সৌমনস্যের একটি স্বচ্ছ পটে প্রাত্যহিকের যথাযথ রূপ নিরীক্ষণ করা শিল্পীর স্বধর্ম। তিনি দেখান ঘটনার আবর্ত, বিচিত্রের সংঘাত সমন্বয় অথচ স্থায়ী ভ‚মিকার উপরে নীলাম্বর, দৃশ্যে-অদৃশ্যে মিলিয়ে এই পার্থিব আশ্চর্যতা। কিছুকে বাদ দিয়ে নয়, সবকে নিয়ে এই শিল্পধারণা, ধ্যানের বিলীনতায় প্রত্যক্ষকে হারিয়ে যে-ধরণের আধ্যাত্মিক দূরদর্শিতা তা নয়। অথচ কাছের অসংখ্যকে কেবলমাত্র স্বার্থের ও তথ্যের বন্দিশালা বানিয়ে যে-বাস্তব তাকেও দূরে রাখা।’
এই লেখার বিষয়বস্তু সমসাময়িক কবিতা। এ বিষয় নিয়ে উপলব্ধি ব্যক্ত করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়, কবিতার কোনো কাল নেই। কবিতার কাল হয় না। তাই যদি হতো তাহলে মঙ্গলকাব্য, চর্যাপদ, আলাওল সমসাময়িক কবিতা এখন আর পঠিত হতো না। মানবসমাজ যত তার অনুভ‚তিকে তীব্র করেছে, পরিপার্শ্ব দ্বারা যত বেশি স্পন্দিত হয়েছে, ততবেশি কবিতার বিকাশ ঘটেছে। সমাজ কাব্যময় হয়েছে, অথবা বলা যায় কবিতার সঙ্গে মানব সমাজের পরিচিতি ঘটেছে। হয়তো রঙ-রূপ-গন্ধ পাল্টেছে, কিন্তু কবিতা যুগে যুগে তার আত্মপ্রকাশের বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রেখেছে।   সমসাময়িক কবিতা বলতেও কিছু আছে কি? আজ যা সমসাময়িক, আগামী কাল তা অতীত। কিন্তু তার প্রাসঙ্গিকতা কি ফুরিয়ে যায়? হোমার তার মহাকাব্য ইলিয়াড-এ ট্রোজান যুদ্ধকে আশ্রয় করেছিলেন।  ট্রোজান যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দিতে। সে যুদ্ধ চলেছিল কম-বেশি ১০ বছরকাল। কিন্তু হোমার ইলিয়াডে বর্ণনা করেছেন মাত্র কয়েকদিনের অথবা বড়জোর কয়েক মাসের কাহিনী। যদিও তিনি অতীত টেনেছেন বারবার, প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তৎকালীন গ্রিসের পাঠকদের কাছেও সে অতীত পরিচিত ছিল। কিন্তু ভীন্ন রুপে আজও কি ইলিয়াড আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে না? আবার প্রাচীন যুগের রামায়নকে আশ্রয় করে উনবিংশ শতাব্দিতে মাইকেল মধুসুদন দত্ত লিখেছেন মেঘনাদবধ। পুরাণ নির্ভর হলেও এই মহাকাব্যে আছে এমন বার্তা, এমন সব নীতিবাক্য যা শাশ্বত। তবে হ্যা, কবি কোনো কবিতার সমসাময়িক অথবা কবিতা কোনো কবির সমসাময়িক হতে পারে।
তারপরও আমরা কবিতার বৈশিষ্ট্য বুঝতে, কবিতার সময়কাল ও প্রেক্ষাপট বুঝতে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সময় ভাগ করে নিই। কারণ, সময় অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক, ভৌগলিক অবস্থার পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় মানুষের জীবনের উপলব্ধি, জীবনবোধ।  তাছাড়া আমাদের যাপিত জীবনে এমন সময় আসে যখন সবকিছু উল্টেপাল্টে যায়। সেই সময়টা কেন্দ্র করে একটা সাহিত্য বলয় তৈরী হয়।  যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অথবা বলশেভিক বিপ্লব;কিংবা ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই সময় সৃষ্টি হয় নতুন অবয়বের গল্প-কবিতা-উপন্যাস।   প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থমাস হার্ডি, ডবিøউ বি ইয়েটস, এরিখ মারিয়া রিমার্ক,  এডোয়ার্ড থমাস, সারা টিসডাল, অ্যালান সিগার,আইজাক রোজেনবার্গসহ অনেক কবি ও উপন্যাসিক তদের প্রত্যক্ষকরা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সহিত্য রচনা করেছেন। তাঁদের ওই সময়কে একে রেখে গেছেন।  এদের অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। কোনো কোনো কবি-সাহিত্যক এক হাতে অস্ত্র, আরেক হাতে কলম নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়েছেন। বলশেভিক বিপ্লবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে মায়াকভস্কির মত খ্যাতিমান কবির কবিতা। অরো অনেক কবি বিপ্লবের দ্বারা তাড়িত হয়ে কবিতা রচনা করেছেন, অথবা কবিতার দ্বারা বিপ্লব অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমাদের কথাই বলি, ১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাপিয়ে পরতে হয়েছে এই জাতিকে। প্রাক-স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা উত্তর অসংখ্য কবিতা, গল্প, গান রয়েছে আমাদের সাহিত্যাঙ্গণে। এখনো আমাদের ভেতরে অনুরণিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধকালে রচিত অনেক লেখা। কবিতার চেহারাও কি খুব বদলেছে ৭১-পূর্ব কবিতার থেকে?  তাহলে সমসময়িক আমরা কাকে বলব?
অতি সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি, ৮০ এর কবিতা, ৯০ এর কবিতা, শুণ্য দশকের কবিতা বলে একটা কথা চালু আছে। এর মানে আমার কাছে পরিস্কার নয়। দশকওয়ারি কবি ভাগ হতে পারেন তাদের বয়সের কারণে, কিন্তু কবিতা নয়। তাতেও সমস্যা আছে। দেখুন--
সহসাই তোমার কথা বর্ণিত হয়, সহসা পতনমুখী দুটি
চোখ যথার্থ চঞ্চল হয়ে সমান্তরাল ঢেউয়ের সাথে সাথে
                                           কিনারায় আসে
একেই কি সুখ বলে কেউ? তোমাকে না ছুঁইয়েই বলে দিতে
                            পারি....এ শরীর ফুলের শরীর।
তাতারদের অশ্বখুরে এ শরীর ক্ষত-বিক্ষত শরীর, সত্যের
অপূর্ব ভঙ্গিমায় এ শরীর জ্বলে ওঠে বারংবার, ক্ষণে অথবা
                              দূর নিরীক্ষণেও জ্বলে ওঠে।         
এক দূর্বোধ্য আগুনের মতো এ জীব খুলে দেয় বুক,
 কোনোকিছু না ভেবেই ঝাঁপ দিই এমতশরীরে তোমার...
তুমি যখম হও, রঙীন ও শোচণীয় জখম।
চন্দ্রগ্রস্থ হতেম হতে তোমার রূপ ও অনুতাপ আমাকে
প্রদর্শন করে থাকো তুমি
আগুন সাহস পায় তোমাকে গিলে ফেলার, স্তরে স্তরে
স্পর্শে স্পর্শে আমি ভক্ষিত হই, অবশেষে স্বীকার করি
এবং স্বীকার করতে বাধ্য হই যে, আগুন আমার মা, তুমি
আর তুমি আমার রূপ-ঐশ্বর্যের এক শ্রেষ্ঠ রমণী।
হতে পারে এই কবিতা শূণ্য, নব্বই, আশি, সত্তর অথবা পঞ্চাশ দশকে রচিত।  কবি তার কবিতায় উপমা টেনেছেন কেবল মধ্যযুগের তাতারদের। কিন্তু না, কবি আব্দুর রাজ্জাক এই কবিতা লিখেছেন বড়জোর ২০১৩ সালে এবং প্রকাশ পেয়েছে ছোটকাগজ শালুক ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারী সংখ্যায়। আবার ব্যক্তি-বয়সের দিক বিবেচনা করলে কবি আব্দুর রাজ্জাক ঠিক শুন্য বা নব্বই দশকের কবি নন। ওভাবে বিচার করলে তাকে ৮০’র কবি বলা উচিত। কিন্তু তিনি এ সময় লিখে যাচ্ছেন ছোট কাগজ এবং দৈনিকের সাহিত্য পাতায়। অর্থাৎ কবিতার সময়কে ছোট ছোট কাল এ ভাগ করা যেমন দুরূহ, তেমনি অপ্রয়োজনীয়।
তবে এ সময়ের যে অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জীবনের জটিলতা রয়েছে, সেটা কবিতায় উঠে এলে সময় আপনিতেই বাধা পরে যাবে। এ জন্য সময়কে ভাগ না করলেও চলবে। আমরা প্রাচীনযুগের, মধ্যযুগের এবং বিংশ শতাব্দির কবিতা আজও যেমন আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি, তেমনি যেন আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কবিতা থেকে সমান রসাস্বাধন করতে পারে ভবিষ্যতের প্রজন্মগুলো।। তাহলেই কবিতা স্বার্থক হয়ে উঠবে।

1 comment:

  1. বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের
    বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বসনা রাখতেন ।
    গাছ নেই নদী নেই অপুস্পক সময় বইছে
    পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই

    শুনুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার সমস্ত কবিতা
    আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি
    নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না
    আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিস্ফলা, ঠাকুর
    আধ্যাত্মিক কবিতা

    ReplyDelete