Monday, February 26, 2018

ভাষাদিবস স্মরণে ব্যক্তিগত গদ্য : সব্যসাচী ঘোষ 


আতঙ্ক করবেন না 

সব্যসাচী ঘোষ



কবর খুঁড়ে কাউকে বেঁচে উঠতে দেখি নি । আমি এক কবরের পাশেই বসে থাকি । আমার বাংলা ভাষা কবরের কাছাকাছিতেই থাকে । সেও কাউকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে নি । আমরা কাউকেই বাঁচিয়ে তুলতে পারি না । তবে মেরে ফেলতে পারি অবশ্যই । নিজেকেও এবং ওপরকেও মেরে ফেলে কবরে পুতে দিতে পারি ।  ভাষা তাই ভাসাভাসা ধারণা হয়ে ঝুলে থাকে । ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমার ভাষার বর্ষপূর্তি হয় । উদযাপন হয় । সেই বর্ষপূর্তিও মৃত্যুরই , কবরেরই । ১৯৫২র মৃত্যু । এই দিনটিতে ভাষা স্থবির , ভাষা কাদা কাদা পুতিগন্ধময় , মৃত্যু তার আসন্ন এই সব আশংকা প্রকাশ করেন অজস্র উঠতি পড়তি নোয়াম চামোস্কিরা । সেকারণেই আমার স্বপ্নে ভাষাকে কবরে কল্পনা করে ফেলি ।  তবুও এই ভাষার টানে পর্তুগিজ সাহেব কবিয়াল হয়ে যান কেন ? অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ! ভোলা ময়রাই তো আমাদের সেরা কবিয়াল , তাঁর চর্চা তে কি কোনই খামতি ছিল । তাহলে বিদেশী তাকে বাংলার ধুলোতে আছড়ে দিল কোন মন্ত্রে! মধু কবি ছাত্রাবস্থায় বাংলার ব্যাকরণে সড়গড় ছিলেন বলে জানা যায় না অথচ “ শর্মিষ্ঠা ” লিখে ফেলতে তিনি রেকর্ড করার মতই কম সময় নিয়েছিলেন । ধর্মযাজক ফাদার দ্যাতিয়েন সাহেব তো আমাদের সামনেই এই সেদিন কলম তুলে রাখলেন । তাঁর বাংলা চর্চার মূলত দুটি ভাগ । একদিকে লেখার সৌকর্য , প্রকরণ । অন্যদিকে বাংলার জনজীবন সংস্কৃতিকে দেখার চোখ যা আমাদের মত চোখ দিয়ে নয় বরং তৃতীয় চতুর্থ চোখ হতে পারে । একজীবনে এরকম বাংলা শিখতে পারাটাই শ্লাঘার বিষয় সেখানে ফলিত ক্ষেত্রে তাঁর বঙ্গচর্চা তীব্র বিস্ময় ছাড়া আর কিই বা হতে পারে । ভাষা তো এখানে মরণোন্মুখ নয় । তাহলে আমার ভাষার ক্যান্সার হয় নি বলছেন ? রবীন্দ্রনাথের ১৪০০ সাল কবিতাটি আমি ১৪০০ সালেই প্রাথমিক শ্রেনিতে পড়াকালীন ২৫ বৈশাখের দুপুরে আবৃত্তি করেছিলাম । আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়েছ বসে এই লাইন মনে আছে । অর্থাৎ প্রায় শতবর্ষ আগে শতবর্ষ পরের শ্রোতাকে সরাসরি যোগাযোগ করছেন তিনি , সেতু বানিয়ে দিয়েছেন এপার ওপারে । আর সহস্র যাত্রীর মতই আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যে ১৪০০সালেই ১৪০০ সাল কবিতাটি আবৃত্তি করতে পেরেছিলাম । দাপটের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা সদ্য শেষ হয়েছে যার সেই সচিনের পর্বতসম রেকর্ডগুলো এখন মাত্রকবছরেই বিরাটের সুবাদে ভঙ্গুর মনে হতে শুরু হয়েছে , সেখানে ১০০ বছর পরও তিনি অপ্রতিরোধ্যই থাকবেন এবং বাংলা ভাষাতেই তাকে পাঠ করা হবে এরকম আত্মবিশ্বাস আর কোন ভাষার কবির রয়েছে বলেও তো মনে হয় না । এই আত্মবিশ্বাস আমাদের মধ্যে জাগ্রত হোক । আপনার মেয়েটি বা ছেলেটি ইংলিশ মিডিয়ামে গেলে বাংলা ভাষার আতঙ্ক হবে কেন ? কবিতা লেখার কোন বিশ্ববিদ্যালয় হয় না । তাই আজও ইঞ্জিনিয়ার পিছু কবির যা আনুপাতিক হার চিকিৎসক এবং গদ্যকারের যে আনুপাতিক হার তাতে সেসময়েও বদল হবে না । ওদের অনুভূতি নিয়েই ওরা বাংলা কবিতা গদ্য লিখতে আসবে । যেমন ভাবে অ্যান্টনি , মাইকেল , দ্যাতিয়েনরা এসেছিলেন । আতঙ্কের কবর থেকেই তাই ভাষা জাগ্রত হয়েছে , হবেও ।                  

No comments:

Post a Comment