Tuesday, February 27, 2018


অমিতাভ প্রহরাজ

কবিতা গদ্য তফাৎমজার গল্প-
 কবিতা গদ্য তফাৎমজার গল্প-
সরি সামান্য ডিস্ট্র্যাক্ট হতে হলো এই প্রশ্নটার জন্য। এটা এক অসাম প্রশ্ন। এতদিন কেউ জিজ্ঞেস করেনি বলে অবাক হতাম। থ্যাংক্স সরিতবাবু (Sarit Chatterjee)। এমন প্রশ্নের জন্য জান নিছাওর করে দেওয়া যায়। ভারি ভালো লাগছে প্রশ্নের ভঙ্গিটি। কোনো আবছা, অস্বচ্ছ নেই। সটান সপাট। বহুদিন অপেক্ষা করেছি এই লেখাটি লেখার জন্য। সেই প্রশ্ন পেলাম গতকাল। বহু বহু বছর অপেক্ষা করেছি এই লেখাটি লেখার জন্য, সেই প্রশ্নটি গতকালের আগে পাইনি। সরিৎবাবুকে উৎসর্গ এই লেখা।
সরিত চ্যাটার্জী-
পড়লাম। কমেন্ট করার মতো বিদ্যে নেই আমার, কিন্তু ভালো লাগল সেটা জানালাম।একটা প্রশ্ন ছিল, কিছুটা অপাংক্তেও। প্রচলিত ছন্দ না থাকলে সেটা যে কবিতা, গদ্য নয়, সেটা কী করে চেনা যায়? মজার কথা হলো যে আমি চিনতে পারি। কিন্তু কী করে পারি সেটা জানি না। একটু স্পেসিফিক উত্তর খুঁজছি।
প্রশ্নস্পার্ক পর্ব-
- সরিৎবাবু  একটু শুরু থেকে মানে শিবের গীত থেকে বলবো, কারন তাহলে লেখাটা কমপ্লিটনেস পাবে, আর এটি লেখার জন্য আমি বহু বহুদিন অপেক্ষা করেছি । এই দৈর্ঘ্যবৃদ্ধিটি মার্জনা করবেন। আপনার উত্তর অংশটি আলাদা করে হাইলাইট করা আছে, চাইলে সোজাসুজি ওখানে চলে যেতে পারেন, কোনো অসুবিধে নেই।
জন্মপর্ব-
একদম শুরুতে চলে যাই। কবিতা ও গদ্য তো আলাদা ছিলো না যখন লেখার ভাষা জন্মায়নি। ছিলো শ্রুতি। শ্লোক ছিলো না বাল্মীকীর আগে, বেদে উপনিষদে মন্ত্র। সেগুলি গদ্য নয়, কবিতাও নয়, অথচ রিদম ভিত্তিক। অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ, মৃত্যুর্মাঅমৃতমগময়ঃ। এই লাস্টে গময়ঃ গময়ঃ কিন্তু ছন্দ বা অন্তমিল নয়। মনে রাখার সুবিধার্থে রিপিটেশান। তাই একই বর্ণ শব্দ রিপিট হয়েছে। ঘটনাকাল হিসেবে মহাভারত রামায়ণের পরে হলেও, রচনাকাল ভাষাবৈশিষ্ট্য ইত্যাদি থেকে প্রমাণিত যে মহাভারত রামায়ণের প্রায় হাজার দুই বছর আগে লেখা। মহাভারতে তাই শ্লোক পাইনা। পরপর ঘটনাচক্র, বর্ণনা, চরিত্রদের কার্যকলাপের বর্ণনা। যুদ্ধের চলমান বর্ণনা, লাইভ আর কি। এগুলিতে ছন্দ টন্দ থাকার স্কোপ নেই, তাই নেইও। তবে বেদ উপনিষদ থেকে ভাষাটি আলাদা হয়ে গেল। কারন বেদ উপনিষদে যা ছিলো কনসেপচুয়াল, একটি দুটি ঘটনা থাকলেও, সেই একটি দুটি বেস করে নানা দিকের দরজা জানালা খোলা। নচিকেতাকে তার বাপ বললো তুই যমের বাড়ি যা, সে যমের বাড়ি গেল। এই এক সরল ঘটনা থেকে আস্ত কঠোপনিষদ। ফলে সেখানে কথোপকথন সংলাপজাতীয় হলেও মন্ত্রধর্মী। মনে রাখতে হবে তো। নচিকেতার তো নোট নেওয়ার খাতা নেই।
মহাভারতে এসে লেখার ভাষা জন্মে গেছে তা দেখতে পাই, কিন্তু যেহেতু অতি প্রাচীন তাই সবাই লিখতে শেখেনি। শিখলেও ভাবতে ভাবতে লেখা কাজটি করার দক্ষতা কারোর জন্মায়নি (রামায়নের আগে তা কারোর জন্মাবেও না)। ফলে লিপিকার গণেশের প্রয়োজন। এবার আপনি নিজেকে টেলিপোর্ট করে ওই সময়ে নিয়ে যান, লেখার ভাষা শব্দ জন্মেছে, তাতে কি আছে লক্ষ লক্ষ কিলবিল করা শব্দ, বাক্য, বাক্যাংশ। কানে শুনলে যেটা জাস্ট একটাই মন্ত্র, বিড়বিড় করে মনে রাখা যায়, লিখলে তার জন্য হাজার অক্ষর শব্দ বিভক্তি ইত্যাদি টুকরো টুকরো ভাগে মনে রাখতে হয়। ভাবুন দেখি কি আপদ!! অবিকল এ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন প্রথম দিকের মতো। আরে বাপ, ফোন ধরবো, ফোন করবো, ফোন কাটবো, তার মাঝে এত হাজার লক্ষ কাজ, এ্যাপ, উস্তুম ঝুস্তুম ঢুকে গেলে কেমন আকূল দশা হয়। ঠিক সেই অবস্থাই হলো মহাভারতে। এবং এই দশা থেকে নিজেকে মোটামুটি গুছিয়ে চলন্ত করার জায়গা হলো গদ্য। লেখা তো থাকছে, তাই আর মন্ত্রের মতো মনের রাখার কিউ দরকার নেই। তার চেয়ে এত সব জিনিসপত্র গুছিয়ে টুছিয়ে লোকের সামনে আনি। সর্টিং এ্যান্ড অর্গানাইজিং অফ ল্যাংগুয়েজ। বিউটিফিকেশান তখনো বহু দূর। উইন্ডোজ নাইন্টি এইট। ভিস্টা এক্সপি হয়ে সেভেন টেভেন স্বপ্ন। তো এই ভাষার যে অপারেটিং সিস্টেম তৈরী হলো সেটি হলো গদ্য বা গদ্যাকৃতি। অপারেটিং সিস্টেম শব্দটি কি অপূর্ব ফিট করেছে দেখুন মিনিং এর দিক থেকেও। তো আমরা গদ্য পেলাম। জানলাম গদ্যের কি ক্ষমতা? না ঘটনা ঘটার সময় বর্ণনা করা যায় হুবহু। আগে স্মৃতিতে রেখে তার থেকে শাস্ত্রে ঢুকিয়ে রাখতে হতো ঘটনাকে। এখন ঘটনা ঘটাটাকেই বর্ণনা করা যাচ্ছে। সঞ্জয়বাবু আস্ত একপিস চৌদ্দদিনের যুদ্ধের কমেন্ট্রি দিয়ে গেলেন!! এই জন্মজায়গাগুলো মাথায় রাখবেন পরে আসবো ফিরে।
তার বহু বছর পর এলো রত্নাকর ডাকাত। পড়লো পাপের ফাঁদে। নারদ তাকে বললো রামের আরাধনা করতে এবং উইঢিপি। পৃথিবীর প্রাচীনতম পোকাটি এখনো বাল্মীকি নামের মধ্যে বেঁচে আছে। রত্নাকর মহর্ষি বাল্মীকি হলেন। তাঁর চেলা হলেন ভরদ্বাজ। ভরদ্বাজকে নিয়ে বাল্মীকি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তীর্থে। ইতিমধ্যে নারদ এসে রামের জীবনকথা শুনিয়ে গেছেন। তখনো কিন্তু জীবনকথা। নারদ বীনা বাজান, বীনা থামিয়ে জীবনকথা শোনান। শুনিয়ে আবার থেমে খানিকক্ষণ বীনা বাজান। বাল্মীকি রামজ্বর হলো (এই জ্বর মানে আক্রান্তের এক তীব্রতম দশা, জ্বরাসুর নামক এক রাক্ষসের থেকে উৎপত্তি)। ভরদ্বাজকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রামের কথা ভাবেন সারাক্ষণ। জাহ্নবীর কাছেই তমসা নদীর ধারে ভরদ্বাজকে নিয়ে গেছেন। সেই স্বচ্ছ জল দেখে বাল্মীকি মুগ্ধ বললেন "অকর্দমমিদং তীর্থং ভরদ্বাজ নিশাময়..." - ভরদ্বাজ এই নদীতীর্থে দেখো কী চমৎকার জল। ঠিক যেন চরিত্রবান মানুষের মতোই স্বচ্ছ। বৎস তুমি কলসিটা রেখে আমায় বল্কলটা দাও তো, আমি চান করবো।
এটা কিন্তু পূর্ণ ছন্দে লেখা, তবুও এটি শ্লোকের মর্যাদা পাইনি। তখনো শ্লোক আবিষ্কার হয়নি।আপনাকে এই ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করেছি। এর মধ্যেই সেই অপার রহস্য আছে লুকিয়ে। শ্লোকের সংজ্ঞা বাল্মীকি অল্প পরে দেবেন আর তার সাথে জন্ম হবে পৃথিবীর এক অপূর্বতম জিনিসের।
সেই বল্কল হাতে নিয়ে জলে নামলেন না বাল্মীকি, ইতঃস্ততঃ চারপাশের বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। পাখি ডাকছে, নদী বইছে কুলকুল। রামের কথাগুলি মাথায় ঢেউ তুলছে তাঁর। কিন্তু কি একটা যেন নেই। কি একটা যেন নেই। কি পাচ্ছেন না তিনি? কোথায় অসম্পূর্ণ। ভাবতে ভাবতে দেখলেন এক্টি গাছের ডালে এক কোঁচ-বক কোঁচ-বকীর সাথে মিথুন খেলায় মত্ত। কলকন্ঠ ক্রৌঞ্চ, বলেছেন বাল্মীকি। কলকন্ঠ শব্দটি বাল্মীকির সৃষ্টি। অপূর্ব এক শব্দ। যেখানে একটা পাখির গলা থেকে অনেক পাখির সুরেলা কলকাকলি অব্যক্ত হয়ে বেরোয়, তাই কলকন্ঠ। কোঁচ-বক সাঁত্রাগাছিতে গেলেই দেখতে পাবেন। সাদা, গলায় কালো স্ট্রাইপ থাকে, মাথায় তামাটে ঝুঁটি। ডাকটা শুনে দেখবেন, কেন আদিকবি বলা হয় বাল্মীকিকে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকবে না।
আর ঠিক সেই সময়ে একটা ব্যাধ, তার যা কাজ তাই করেছে, অর্থাৎ তির ছুঁড়েছে। তিরের ফলায় বিদ্ধ ক্রৌঞ্চ অর্থাৎ পুরুষ বকটি মাটিতে পড়ে ছটফট করছে রক্তাক্ত অবস্থায়। আর তার ভার্যা ক্রৌঞ্চী নীচে না নেমেই তার সহচর ওই তাম্রঝুঁটি ক্রৌঞ্চের জন্য ওই কলকন্ঠে আকূল কান্না কাঁদতে লাগলো। একটু আগেই তারা দু ডানা মেলে কি অপূর্ব মিলনের খেলা খেলছিলো।
বাল্মীকি এটা দেখতে দেখতে যা বললেন তাও কিন্তু ছন্দে। অথচ সেটা হচ্ছে ওই মহাভারতের মতো ঘটনার বর্ণনা।
তং শোণিতপরীতাঙ্গং চেষ্টামানং মহীতলে।
ভার্যা তু নিহতং দৃষ্ট্বা রুরাব করুণাং গিরম
বিযুক্তা পতিনা তেন দ্বিজেন সহচারিণা।
তাম্রশীর্ষেণ মত্তেন পত্রিণা সহিতেন।
- মানেটা আগেই লিখেছি, খেয়াল করে দেখবেন এখনো অবধি কিন্তু লেখা হচ্ছে একটা বাক্যের পর পূর্ণচ্ছেদ। তার পরের বাক্যে পূর্ণচ্ছেদ নেই। আবার তার পরের বাক্যে আছে। তখনো অবধি যা কিছু লেখা তাতে পূর্ণচ্ছেদের চেহারা একটাই। দাঁড়ি। এবং সেটি কোনোকিছু অন্তিম বা শেষ বোঝায়। আর কিছু না এক্সট্রা।
আর তার পর সেই অমোঘ উচ্চারণ। যা ঘটনা ফুরিয়ে গেছে, তার অনুভূতি পড়ে আছে, সেখান থেকে জন্ম নিলো আশ্চর্য এক্সপ্রেশান।
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম শাশ্বতী সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম।।
মানে বলা নিষ্প্রয়োজন। ওরে নিষাদ তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবি না (অভিশাপেও কি শব্দের চয়েস দেখুন বাল্মীকির, প্রতিষ্ঠা, অকল্পনীয়!!) কারন তুই কামমোহিত থাকা অবস্থায় ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস।
এবং এই হলো কবিতার জন্ম। এরকম পদ আগেও লিখেছেন বাল্মীকি কিন্তু এটা স্পেশাল কোথায়? নিজেই বলছেন ভরদ্বাজকে যে,শোকে অভিভূত হয়ে ভরদ্বাজ, এই যে আমি চরণ-বাঁধা (পঙক্তি বা লাইন) সমান অক্ষরে তৈরী নারদের বীণা না থামিয়ে গাওয়ার উপযোগী বাক্য নির্মাণ করলাম এটি শোকাবেগ থেকে নিঃসৃত বলে "শ্লোক" নামে খ্যাত হবে।
তারপর হু হু করে কিছু আশ্চর্য ঘটনা, সেগুলি বলেই আমি আপনার প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাবো। ব্রহ্মা এলেন বাল্মীকির কাছে। বাল্মীকি তখনো সেই নিজ রচনায় ডুবে আছেন। ব্রহ্মা বললেন "দাঁড়িয়ে কেন? বোসো", বাল্মীকি আবার উচ্চারণ করলেন "মা নিষাদ..."। কি সুক্ষ্ম এই খেলা, ব্রহ্মাকে অসম্মান করলেন না, অন্যমনস্কও থাকলেন, অথচ সত্য উত্তরই দিলেন। ব্রহ্মা বললেন তুমি রামের জীবনকথা রচনা করো। তুমি এখন তার যোগ্য। এরপরেই আরেকটি অসাধারণ পর্ব যা কেউ খেয়াল করেননি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। রবীন্দ্রনাথের পরেও কাউকে দেখিনি স্পট করতে।
বাল্মীকি বললেন, রামের জীবন আমি তো নারদের মুখ থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া শুনেছি। আমি তো সব জানিনা। টুকরো টুকরো ঘটনা ইত্যাদি, রাক্ষস, সীতা, রাবণ এইসব জানি। আমি তো পূর্ণাঙ্গ ঘটনা জানিনা। (মহাভারতে ঘটনার সময় লেখা হচ্ছে তাই এই সমস্যা নেই। কিন্তু রামায়ণে এখান থেকেই স্পষ্ট যে প্রকৃত ঘটনাবলীর বহু পরে বাল্মীকির আগমণ।)
ব্রহ্মা এর উত্তরে বাল্মীকিকে দিলেন সেই এক অমর আশীর্ব্বাদ যা আজো প্রতিটি লেখার মানুষ, কবিতার মানুষ বহন করে। বললেন, বাল্মীকি, আমার প্রসাদে তোমার অজানা কিছু থাকবে না। সবই তোমার জানা হবে। আর এই শ্লোকবদ্ধ মহাকাব্যের একটা বাক্যও মিথ্যে হবে না। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন এই মহাকাব্য থাকবে।
আপাতভাবে মনে হয় এটা বোধহয় বর। আসলে এটা এক ভয়ংকর দায়িত্বের বাঁশ দিয়ে গেছিলেন বাল্মীকিকে প্রজাপতি। অজানা জিনিস লিখবেন, অথচ তা মিথ্যে বা অনৃতভাষণ হবে না, এটা কি করে লেখা যায়?!!!! বাল্মীকি ধ্যানে বসলেন এবং দ্বিতীয় আবিষ্কার করলেন। গোটা রামায়ণ করতলে রাখা আমলকীর মতো দেখতে পেলেন। কি অপূর্ব উপমা। হাতের তালুতে আমলকীর মতো একটা মহাকাব্য দেখতে পাচ্ছেন। এটা কি জানেন? এটা হচ্ছে "কল্পনা" র জন্ম। যা মিথ্যা বা অনৃতভাষণ নয়। যা বর্ণনার গৌরব বৃদ্ধি করে অথচ মানুষের অজানা, তাই হলো কল্পনা। এবং এই কল্পনার জোরেই বাল্মীকি নিজেকে ঢুকিয়ে দিলেন রামায়ণে চরিত্র হিসেবে। ছয় কান্ড, ২৪,০০০ শ্লোক, ৫০০ সর্গে লেখা রামায়ণ।
রবীন্দ্রনাথ এই অনবদ্য অংশটির আসল রহস্য স্পট করেছিলেন। "ভাষা ও ছন্দে" রয়েছে
"জানি আমি, জানি তাঁরে, শুনেছি তাঁহার কীর্তিকথা
কহিলা বাল্মিকি, তবু নাহি জানি সমগ্র বারতা
সকল ঘটনা তাঁর - ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে!
পাছে সত্যভ্রষ্ট হই, সেই ভয় জাগে মোর মনে।
নারদ কহিলা হাসি "সেই সত্য, যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা, তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি,
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়েও সত্য জেনো"
রবীন্দ্রনাথ এখানে ব্রহ্মাকে নারদ করে দিয়েছেন। কারন উনি আরো কঠোর ভাষায় বলে দিচ্ছেন যে কল্পনা একরকমের অসত্য, কিন্তু তার প্রয়োজন কোথায়। আহা, সাধে এই দেড়েল বুড়োর দিকে চোখ তুলে তাকানো যায়না?
(আমি নিজে একবার লিখছিলাম "উই আর দ্য ট্রুথমেকার্স। আমরা যা সত্যি তাই লিখছি এমন কিন্তু নয়। আমরা যা লিখছি তাই সত্যি। এটা বিরাট দায়িত্ব। দক্ষিণারঞ্জন যদি না লিখতেন কুলোর মতো কান, তার ভাঁটার মতো চোখ। আমরা কি জানতাম যে সত্যি সত্যি এমন হয়না?" ভেবেছিলাম দুরন্ত উপলব্ধি এক। পরে দেখি সেই একশো বছর আগে বুড়োটা এটা জলবৎ আল্পনার মতো লিখে গেছেন। হ্যাটস অফ। দাড়ি টেনে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে শালার। হিহিহি)
প্রশ্নোত্তর পর্ব-
যাক সরিৎবাবু, এতটা ধৈর্য্যের জন্য ধন্যবাদ। এবার আপনার প্রশ্নের স্পেসিফিক উত্তরে আসি। কবিতা ও গদ্যের তফাৎ আমরা কি করে সেন্স করি? এর উত্তর এই দুই জন্মরহস্যে রয়েছে। গদ্য জন্মেছে ঘটনা ধারণ করার জন্য, বর্ণনার জন্য। এর ডিএনএ র  মধ্যে একটা এলিমেন্ট অফ ট্রুথ বা এলিমেন্ট অফ ইভেন্ট লুকিয়ে থাকে। আর কবিতা শ্লোকের জন্ম হয়েছে কল্পনাকে ধারণ করে সেটাকে সত্যের সাথে মেশানোর জন্য। বা মিথ্যা বা অনৃতভাষণ থেকে কল্পনাকে আলাদা করার জন্য। আর তাকে সেই কাঠামো দেওয়ার জন্য। তাই এর ডি এন এ র মধ্যে একটা এলিমেন্ট অফ ননট্রুথ বা এলিমেন্ট অফ ইমাজিনেশান থাকে। আদি ওই জন্মকালে না হয় এত কঠোর ভাগাভাগি ছিলো সংজ্ঞাবদ্ধ। সময়ের সাথে সাথে একে অপরের সাথে মিশে গেছে। কিন্তু ডি এন এ টা বদলায়নি। আর ওটাই আমাদের ভেতরে সেই মজার উপায়ে চিনিয়ে থাকে।
এবার আরো মজার ব্যাপারটা দেখুন। যেখানে এলিমেন্ট অফ ট্রুথ আছে, সেখানে আনট্রুথ বা লাই বা মিথ্যেও রয়েছে। সত্যির হাত ধরে এসে পড়ে। ফলে এলিমেন্ট অফ লাই বা ফিকশান এটাও গদ্যের ডি এন এ তে থাকে। আর কবিতায় যেহেতু এলিমেন্ট অফ ননট্রুথ বা ইম্যাজিনেশান এর ডি এন এ তাই এখানে মিথ্যে চাইলেও ঢুকতে পারে না। ঢুকলে সে কল্পনার খাদ্য হয়ে যাবে। তাই কবিতা পড়ার সময় সত্য মিথ্যে দ্বন্দ্ব আমাদের জন্মায় না অজান্তেই। এটা একটা বিরাট জায়গা তফাৎ করার। গদ্যে অজান্তেই জন্মে যায় পক্ষ, বিপক্ষ। মানা, না মানা। জিত, হার। সত্যি, মিথ্যে। বিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য। অজান্তে সাবকনশাসে ঢুকে যায়।
তাই কবিতা আর গদ্য আসল রহস্য লুকিয়ে থাকে ছন্দ, মাত্রা, শব্দ এসবে নয়। ওই আশ্চর্য বাক্যগঠনের ডি এন এ তে। এ এক অলৌকিক। আপাত ভাবে দেখে দুটিকেই বাক্য লাগবে। কিন্তু কোনটি কবিতার আর কোনটি গদ্যের আপনি সেন্স করতে পারেন। তার কারন ওই জন্মরহস্য। আর এই তফাৎটি এত সরল, এত আদিম, আর এত গভীরে থাকে যে ভুল হয়ই না। হতেই পারে না। কোন বাক্যটির অঙ্গে অলিখিত সত্যি-মিথ্যে লেগে আছে। আর কার অঙ্গে লেগে আছে কল্পনা বা সত্যি-মিথ্যের অভাব। এটা ধরা আমাদের আদিম ইন্সটিঙ্কট।
স্রষ্টারা দূরদর্শী ছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন কবিতার এই সত্য মিথ্যার ভুবন পেরিয়ে অপার ভুবনে বসে থাকার অলৌকিক ক্ষমতা। তাই প্রবলভাবে চেষ্টা করে গেছেন মাঝে পাঁচিল তোলার। ছন্দবদ্ধ করার, পদবদ্ধ করার, চরণবদ্ধ করার নানান স্ট্রিক্ট নিয়মাবলীর জন্ম এক মজবুত পাঁচিলের জন্য। ভাবুন দেখি মহাভারতে কতো কান্ড করেই না যুধিষ্ঠির একটি অর্ধসত্য বলেছেন। যদি ওনার জানা থাকতো পানিং, এ্যালিটারেশান, ডাবল মিনিং, ছন্দঘোর, তবে কতো কতোই না মিথ্যে কথার স্রোতে উপচে পড়তো মহাভারত। তো তাই এই পাঁচিল তোলা।
কিন্তু মানুষ এক আশ্চর্য প্রাণ। সে পাঁচিল দেখলেই ভাবে এ এক দরজাসম্ভব, জানালাসম্ভব জিনিস। বাধা পেলে ভাবে এ এক টপকানোসম্ভব গন্তব্য। আশা বা হোপ আমাদের সৃষ্টির আদি থেকে রয়েছে। আদিতে রয়েছে ধ্বনি, যার থেকে ধ্বনাত্মক বা পজিটিভিটি। তাই পাঁচিল বার বার ভেঙে গেছে। মিশে গেছে। কিছু জিনে জিনে মেশেনা, ডি এন এ, ডি এন এ তে মেশেনা। তাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই আমরা তফাৎ করতে পারি কোনটা কবিতা আর কোনটা গদ্য। তার জন্য কন্ঠস্বরে ব্রেণডোবানো অতি ক্রিয়েটিভ চিল্লানোসোরাসের প্রয়োজন হয় না। আরে আমার ভাষা তৈরী করবো কি আমি? আমি তো নিজে ভাষার থেকে তৈরী হয়েছে। অগাধগাণ্ডু না হলে কেউ বলে যে আমি আমারকবিতার ভাষা সৃষ্টি করেছি। তুমি কে হে দাড়িওয়ালা ব্রহ্মা? ভাষা সৃষ্টি করবে। তুমি খুঁজতে পারো। খুঁজবে তোমার ভাষা। সেতোমাকে সৃষ্টি করেছে, আছে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও। ও তোমার বাপের সম্পত্তিও নয়। তোমাকে এক্সপেক্টেশানরহিত হয়ে খুঁজে যেতে হবে। আর তোমার সেই সন্ধান যদি সৎ ও সৃষ্টিশীল ও স্বতন্ত্র হয়, তবে ভাষা তোমাকে নিজে খুঁজে নেবে। তুমি এমন কোনো লায়েক নও যে নিজের কবিতার ভাষা চেরাপুঞ্জীর জঙ্গলে পেলে আর পাকড়াও করে পোষ মানালে। ভাষা যদি তোমার কাছে না এসে টোকা না দেয় তোমার দরজায়, তুমি জানতেই পারবে না, কোথায় তোমার দরজা, আর কোথায় তোমার জানলা। বনলতা সেন খুঁজতে যাবে বটানির ক্রীপার ক্লাইম্বার চ্যাপ্টারে। বন বাদাড়ে বেচারা পাখিদের বাসা ভেঙে ঘরে এনে খুব লক্ষ্য করবে। আর তারপর জীবনানন্দের ছবি দেখে, গায়ের রঙ দেখে, যখন মাথার মধ্যে ভ্যাবলাচাক ভোম্বল হবে। কিছুতেই খুঁজে পাবে না কুরূপ কবির অরূপ কলম কোথায়, আর ভুল বকবে হাজিবাজি।
সরি সরিৎবাবু, সরে গেছিলাম, আরেক লেখাটির জায়গায়। তবে খুব একটা সরিনি। আপনি বলেছেন না আপনার বিদ্যা কম। আপনি সৌভাগ্যবান। এবং তাই আপনি এমন এক উজ্জ্বল প্রশ্ন করতে পেরেছেন। যা আমাকে এমন এক লেখা লিখিয়ে নিলো। আমি বিদ্যাশূন্য। পড়াশোনায় বিশ্বাস করিনা, লেখাশেখায় বিশ্বাস করি। লেখাশেখা হলো পড়াশোনার মতোই এক যৌথ কাজ। বিদ্যা হলো ইঁট। আমরা মাথায় ইঁট ভরি। কিন্তু ওই ইঁট যে ভিত তৈরীর জন্য সেটি ভুলে যাই। বিদ্যা মাথায় ঢোকে, এবং ধাক্কা মেরে বের করেও দিতে হয় মাথা থেকে। আনলার্ন। বিদ্যা বেরিয়ে গেলে মাথায় তার যে পায়ের ছাপ পড়ে থাকে সেটিই হলো জ্ঞান। বিশুদ্ধ জ্ঞান। আর তার যে প্রভাবে আপনি দারুণ মজার ব্যাপার দেখেন, কবিতা ও গদ্য আলাদা করতে পারেন, কনফিডেন্টলি। ওটিই হলো বাক্যের ডিএনএ তে থাকা এক বোধ। ওই কুরূপ কবিও দেড়েল বুড়োর চেয়ে কম যায় না বিজ্ঞানমনস্কতায়। বহু আগে বলে গেছে, গভীরে এক বোধ খেলা করে।
ক্লিন্টন বি সিলি নামক গবেষক আছেন জীবনানন্দের, যাকে একবার সামনে পেলে ক্লিন্টন-কি-সিলি বলে চেঁচিয়ে ওঠার ইচ্ছে আছে। ওনার একটি গবেষণা হলো আদর্শ এ ধরণের পাঁঠামোর উদাহরণ। গদ্য আর কবিতার বেসিক জিনের জায়গাটা না ধরতে পারলে যা হয়। দশ বছর ধরে ভদ্রলোক জীবনানন্দের "মালয় সাগর তীরে" এটি কোথথেকে এসেছে তা নিয়ে বেজায় ভেবেছেন। বালী গেছেন। মালয়েশিয়া গেছেন। এবং লাস্টে বিশাখাপত্তনমের বীচে সার বেঁধে আলো জ্বলছে দেখে ভয়ানক আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন। আরে জীবনবাবু তো মালয় আলোর কথাও বলেছেন, আসলে ওটা হচ্ছে মালয়ালম ভাষার দেশ। বুঝুন কান্ড। আপনি এই জীবনানন্দ নিয়ে লেখাটি পড়ে এই অপূর্ব্ব প্রশ্ন করলেন, যার থেকে এই লেখা হলো। আপনাকে কেউ বিশেষজ্ঞ বলে পাত্তাই দেবে না। আর ক্লিন্টন বি সিলি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উড়ে আসবেন আপনাকে শেখাতে এই অপূর্ব্ব পাঁঠামো জানাতে আর তারপর উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে লাখ টাকা নিয়ে যাবেন। যাক উনি তো তাও কিছু নিয়ে যান। বেচারা জীবনানন্দের রূপবিশেষজ্ঞ, বনলতার ফেমিনিজম খোঁজা অকাট্য গণ্ডারগুলি রাগে গরগর ছাড়া আর কি করবে? তারা বেসিক জায়গাটা কখনো দেখবে না যে জীবনানন্দদের মাল্যবান বা সুতীর্থ এর ভাষা বনলতা সেনের এর চেয়ে কোথায় আলাদা। যে প্রশ্নটি আপনি করলেন। "অভিজ্ঞ কবি" এক্সপ্রেশানটা শুনলেই আমার মনে হয় পুশ আপ ব্রা পরা বিধবা রাঙাপিসীমা।
রাগ ছাড়ূন। সরিৎবাবু, আপনাকে আরেকটি অলৌকিক বলি এই তফাৎ বোঝার আরো স্পেসিফিক। সবার জীবনে রয়েছে। কখনো দেখেছেন একটা বাচ্চা কি করে ভাষা শেখে? দেখবেন সে নকল করে। প্রথমে দোলে। ঠাকুমা বলছে "আয় আয় চাঁদমামা কপালে টি দিয়ে যা"। আর তিনি ভারি নকল করতে গিয়ে ক পিস গাপ করে দিয়েছেন, দিয়ে বলছেন "আয়ায়া চাম্মামা টিদিযা, আয়ায়া চাম্মামা টিদিযা"। এই হচ্ছে শ্রুতি। খেয়াল করুন যে ইতিহাস বলেছি। মন্ত্রের রিদম। ধ্বনি। সে প্রথমে অর্থ, শব্দ, এইসবের বাইরে গিয়ে শেখে একটা বাক্যের বাক্যাংশ। শব্দ অর্থ বহু পরে। আর তফাৎ, খেয়াল করবেন। একটা বাচ্চাকে ঠাকুমা ভাত খাওয়াচ্ছে "আয় আয় চাঁদমামা, টি দিয়ে যা/ আয় আয় সোনাপাখি হলুদপাখি আয় দেখি/দেখি দেখি দেখি এটা এক গালে কে খাবে? কে খাবে? কে খাবে?" বাচ্চাটা জানে পুরোটার কোন অংশ ছড়া, আর কোনটা তাকে একটা ঘটনা ঘটানোর নির্দেশ। কতো আগে সে তফাৎ ধরে গদ্য আর কবিতার। ও তার জিনে আছে। বাংলাভাষার জিনে রয়েছে এই অপূর্ব্ব ক্ষমতা। আর আমাদের পাঁঠা পণ্ডিতগুলো গাবদা প্রবন্ধ লিখে আপনাকে বোঝাবে গদ্য আর কবিতার তফাৎ। করবে এক্সপেরিমেন্ট। খুঁজবে ইজম। একটা বাচ্চা ভাষা উচ্চারণের আগেই বুঝে যায় কোনটা কান্না ভোলানোর ছড়া, আর কোনটা দুষ্টুমির বকুনি। মজার না??

No comments:

Post a Comment