Saturday, November 30, 2019


সুবীর সরকারের ব্যক্তিগত গদ্য 

ও মোর সারিন হাতির মাহুত রে ...
সুবীর সরকার

ঘরের মধ্যে ঘর।ঘরবাড়ির বিন্যাসে অগোছালো এক ভাবভঙ্গী বিন্যাসের সামান্য অদলবদলেই অগোছানোটা অনায়াসেই সুসজ্জিত সাজানো পথঘাটের রূপধারণ করতেই পারে।চরাঞ্চল থেকে রাত্রির খুব মাঝামাঝি থেকে জল ছুঁয়ে পাক খাওয়া বাতাসের অসামান্য মৃদু এক মন্থরতা সমস্ত সংজ্ঞার তীব্র বদল ঘটিয়ে দিয়ে যাবতীয়তাটাকেই সংজ্ঞায়িত করে তোলে।চর কিন্তু চিরস্থায়ী নয়,কোন না কোন চরকে সামগ্রিকতা সহই তলিয়ে যেতে হয়,ডুবেও যেতে হয়।আবার নুতন নামের ধারাবাহিকতাকেই অব্যাহত রাখে।এখানেই তো রহস্য।রহস্যের স্থবিরতাকে সচল করে তুলতে পারলেই পুর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ডুবে যাওয়া চরের ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুথথান।সাদৃশ্য অসাদৃশ্য তখন আর কোন বিতর্কের বিষয় হতে পারে না।বিষয়হীনতাই ঘরের মধ্যে ঘরের ভিতর কেবল অন্তহীন সব ঘরবাড়ি ঢুকিয়ে দেয়।নমোপাড়া যূগীপাড়া ঢুলিপাড়া দিনাজপুর কলোনী বামনপাড়া কাঁসারীপাড়া যাবতীয় সব টুকরোটাকরায় যেন ফেলে আসা এক দেশ হয়ে পুননির্মিত হতে চায়।হতে পারাটা সম্পূর্ণ না হলেও হতে চাওয়াটাই অনায়াসসাধ্য এক যৌথতা এনে ফেলে।যৌথতার শর্তসাপেক্ষ সামর্থের বিচিত্রতরতার ব্যাপ্ত সময়পর্বের ভিতর আবহমানের সব চরাঞ্চল ঘরবাড়ি আমোদপ্রমোদ পাশাখেলা স্মৃতিময়তা নিয়ে অনিশ্চিত ললাটলিখনের মতো জীবনের খন্ডে খন্ডে ভঙ্গ বিভঙ্গের মরমিয়া গানের আবহের নৈকট্যের সারাৎসার হয়ে গন্ডীর ভিতর গন্ডী ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া পেশীময় স্মৃতিময় প্রাবল্যের দোলায় দোলায় ভাসে।ভাসতেই থাকে।ভেসে যায়।এত এত জটজটিলতায় সূর্যোদয় সূর্যাস্ত চাঁদ ও অন্ধকার সবই নিজস্ব অধিকারে মর্যাদায় ঘরবাড়ির বিন্যাসটুকু এলোমেলো করে দিতে থাকে জীবনের জরুরীতম কার্যকারণসূত্রে।
অতিক্রমণের এক পর্বে হেরম্ব পরিচিত অপরিচিত নিসর্গের গমখেত ধান পাট তামাক তালগাছ নারকেলসুপারীর সারি_ এসবের মহামহিম গাম্ভীর্যময় অস্তিত্বের সামনে এসে দাঁড়ায়।তার দাঁড়ানোটা দাঁড়াবার ভঙ্গীটা অতিরাজকীয়।নিসর্গের অতিনিবিড় প্রাণবন্তে স্নিগ্ধতায় শুশ্রূষায় হেরম্ব তার অস্তিত্বের সকল সংকটকাল যেন অতিক্রম করতে থাকে।খুঁজে পেতে থাকে আত্মপরিচয়ের শিকড়বাকড়।প্রকৃতির চিরচেনা দৃশ্যপট অচেনা সব অনুপম মানুষেরা দৃশ্যকেন্দ্রের আধোআঁধারের ঘনঘোরজাত নুতন হতে থাকা মানবশাবকের মহামান্যতাই অর্জন করে ফেলে।অতিক্রমণের পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাওয়া আসার শূণ্যশাসিত অংশগুলি থেকে সুর করে যেন পাঠ করে যাওয়া পুরাণপুস্তক আরো আরো পুরাতন হতে থাকা মরজীবন নিসর্গের কিনার ঘেঁষে সদ্য রচিত নিসর্গেরই হাত ধরে নিসর্গকে স্থাপিত করে অনিবার্য নিসর্গগাথার ভিতর।হাট থেকে হাট চরাঞ্চলে ধানবাড়ি গাননাচের হাটের মধ্যে রেখে আসা জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ খড়ম জোতদারের আধিভৌতিক পৃথিবীর জনপদের সহজিয়া আখ্যানের মরমিয়া আহ্বানের তীব্র অংশগ্রহণ করতে চাওয়া হেরম্বকে কি তবে বনভূমি চা-বাগানের হাট আদিবাসী গ্রাম ময়ূরময়ূরী বাইসন বাঘের ডাক হাতিধরা গান নুড়িপাথরশ্যাওলানদীর সব বন্ধন সম্পর্ক ছিন্ন করে আপাতত অন্য কোন পরিক্রমণের অংশীদার হতে হবে।হেরম্বর তাতে কোন ক্ষয়বৃদ্ধি নেই কারণ তার স্মৃতিকাতরতা নেই;থাকলেও স্মৃতিকাতরতাকে অজস্র স্মৃতির ছায়া উপচ্ছায়ায় সে বিনির্মাণ করে তুলবে ভিন্নরকম কোন স্মৃতিময়তায় মিশ্রিত করে দেবার সহজাত সংক্রমণে।
এই যে জটপাকানো ভূগোল ইতিহাসের ভিতর হেরম্বকে ঢুকে পড়তে হয় একধরণের বাধ্যবাধকতায়,সে ভূগোলবাহিত সময়ের কথক হয়ে উঠতে থাকে একসময়।জীবনের নিজস্ব নিয়মেই এটা ঘটে।এইসব জটপাকানো জটিলতায় হেরম্ব কি দমবন্ধ পরিবেশ পরিস্থিতির অস্বস্তিটুকু এড়িয়ে চলতে চায়;সে কি ইতিহাস ভূগোলের বাইরে খোলা বাতাসের মধ্যে আসবার তাগিদ অনুভব করে।বাধ্যবাধকতার নিঃসঙ্গতায় হেরম্ব ক্লান্ত হয় কিন্তু ক্লান্তি তাকে গ্রাস করতে পারে না,সে আবার বাধ্যবাধকতায় চলে যায়।ইতিহাসের অংশ হয়ে ভূগোলের খণ্ডাংশ হয়ে হেরম্ব নিজের মতোন এক জীবনযাপন বয়ন করতে থাকে।জীবনযাপন্টা জীবনযাপন হয়ে উঠবে কিনা সেই সংশয় গ্রাস করলেও সংশয় থেকে সে আর সংকটের দিকে কিছুতেই চলে যেতে চায় না।এটা কি তবে তার  আত্মগোপন!সে হাট হয়ে ওঠবার গোটাটাই প্রত্যক্ষ করে।হাট থেকে হাটে রাতের বনভূমি অতিক্রম করতে করতে সে প্রতিদিনের প্রতিদিন হয়ে ওঠার পর্ব-পর্বান্তর অগ্রাহ্য করে করে নির্জনতার পথে নির্জন সব সাঁকো ও শালবনের দিকে পা বাড়ায়।সে কি পলায়নের কথা ভাবে;না কি পলায়নটাই তার জন্য পূর্বনির্দিষ্ট।হেরম্ব তার জটপাকানো ইতিহাস ভূগোলের এক জীবনকে জীবনযাপনের ধরাবাঁধার সঙ্গে সংযুক্ত বিযুক্ত করতে থাকে।হয়তো এও এক বাধ্যবাধকতা;তবু সাঁকো হাট নদী নদী দিয়ে সে পুরাণ ইতিহাসের সমস্ত মিথগুলোকে উপেক্ষা করতে করতে অন্য এক মিথ ইতিহাসেরই চমকপ্রদ দৃশ্যায়ন ঘটাতে থাকে।এই পর্বে তার সঙ্গে অফুরন্ত ও জটজটিল সব স্মৃতিকাতরতা কিংবা কাতরতা থেকে চুঁইয়ে পড়া স্মতিরা নিরপেক্ষভাবেই থাকে;নিরুপায় হয়েই অথবা!
চিলাপাতার হাটে ঢোল বাজাতে বাজাতে আমার নিকটবর্তী হয়েছিল জার্মান রাভা।আন্দুবস্তীতে হাড়িয়া খেতে খেতে কত কত বছর আগে জার্মান তার জীবনের নানাকিসিমের গল্প শুনিয়েছিল।কত কত বাদ্যগান মোরগলড়াই কবরখানা ধামসা মাদল!এক ফাঁকে জেনেছিলাম শিবজির বৃত্তান্ত,যাকে গিলে ফেলেছিল মেন্দাবাড়ির হাতি।মাঠে মাঠে ঘুরি।ছড়ানো রোদের মায়ায় ভরভরন্ত শীতকাল।নকসাদার।অপরূপ।প্রান্তিক সব গঞ্জবাজারে উত্তরজনপদের,নিম্ন অসমের নদীজলবাতাসে পুষ্ট হতে হতে কেমন এক চিরকালিনতাই এসে যায় বুঝি।কত সম্পর্ক।বর্ণময় এক জীবনই তো যাপন করি।
অসমের গৌরীপুর।সাদা ফিতের এক নদি গদাধর।লাওখাওয়ার বিল।৩০০ বলির দূর্গাপূজা।রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া।রাজকুমার প্রমথেশ।লালজি রাজার গল্পগাথা।আর হস্তির কন্যা প্রতিমা বড়ুয়া।জনশ্রুতিতে ‘আজার বেটি’।গৌরীপুরের পথে পথে হাঁটি।পাগলের মত হাতি খুঁজি।সেই সব মাহুতফান্দীদের খুঁজি।আমার শরীর জুড়ে গোয়ালপারিয়া লোকগান।কাঠি ঢোল।মায়াময় এক জীবন নিয়ে আমার গতজন্মের ‘মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি’।বিমল মালির বাজনা বাজে,বাজে সীতানন্দের সারিন্দা।প্রতিমা বড়ুয়ার গানের সুরে সুরে আমার আবহমানের অনুভুতিময় স্মৃতিকাতর কুয়াশাঘেরা জীবনের দিনগুলি জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকে।তুমুল এক শীতরাতে রাজবাড়ি থেকে বিমল মালির সঙ্গী হয়ে ফিরছিলাম।বিমল শোনাচ্ছিল প্রতিমার নেশাময় জীবনের হরেক গাথাগল্পগুলি।প্রতিমার জীবন,তার গান,গানময় বেঁচেবর্তে থাকবার আর্তি প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল।নাসিরুদ্দিন বিড়ি আর দেশী মদ খতে খেতে হাতিমাহুতের সে এক অন্তহীন পৃথিবী-
   ‘ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি/গদাধরের পারে পারে রে’
সে এক অদ্ভূত মানুষ!যার সঙ্গে হয়তো আর দেখাই হবে না কোনদিন।যার জন্য মন কাঁদে,বুকের ভিতর আশ্চর্য মোচড়।রাজশাহী শহরে পদ্মার পারে তার সাথে দেখা।সম্রাট স্বপন।পেশায় রিক্সাচালক।পদ্মাচরে বাড়ি।বন্ধু কবি মাসুদার রহমান ও আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দেখা পেয়ে যাই সম্রাটের।ওর রিক্সায় পরবর্তী ৩ দিন আমরা অন্তহীন ঘুরে বেড়াই।সম্রাট স্বপন ভবঘুরে,উদাসীন স্বভাবের।কিভাবে যেন আত্মীয়তায় বেঁধে ফেলে সে আমাদের।আমরা স্বপনের নদীচরের বাড়িতে যাই।বড্ড মায়াময় এই জীবন।হা হা হাসতে হাসতে প্রবল গান গেয়ে ওঠা সম্রাট স্বপনের।
আবার হেরম্ব বর্মণ কে কি করে ভুলি!সাহেবপোঁতার হাটে,পাটকাপাড়ার হাটে টর্চলাইট বিক্রি করত হেরম্ব।সে ছিল আমুদে,রসিক মানুষ।কোচবিহার রাজার শিকারযাত্রায় হাঁকোয়ালি করত।‘কুষাণ পালায়’ ছুকরি সেজে খোসা নাচতো।আবার হেমন্তের সদ্য কাটা ধানখেতে ঘুরে ঘুরে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে নিয়ে আসতো।হেরম্ব গল্প বলতো,যেন বহুপ্রজ এক কথোয়াল!পুরোন দিনের সব ধনীজোতদার,কোচবিহারের রাজারাণীরাজকুমারেরা কী জীবন্ত হয়ে বর্তমানে ফিরে আসতো যেন।
দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টির হচ্ছিল।বৃষ্টির ভিতর মৃত দিদির মৃতদেহবহনকারী আমরা।দিদির মৃতমুখ বেদনাবাহী বৃষ্টিকণায় মিশে যেতে যেতে কেমনতর এক শোকগাথা হয়ে দিদিকে নিয়ে লেখা যাবতীয় এলিজিতে গিয়ে ঝাঁপ দেয়।
গল্পের পাকে পাকে,স্মৃতির পাকে পাকে জড়িয়ে যাওয়া জীবন।অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে না!নদীতীরের বাতাসে তিরতির কেঁপে ওঠা জীবন।কাঠামবাড়ির জঙ্গল ভেঙ্গে হাতিরা বেরিয়ে আসে,হাঁটতে থাকে গজলডোবার দিকে।আমি বুঝে ফেলি,দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙিলা দালানের মাটি।








1 comment:

  1. খুব মায়াময় লেখা।‌ ভালো লাগলো।

    ReplyDelete