Saturday, November 30, 2019

অনিন্দ্য রায়

তাস ও কবিতা 


তাস, হ্যাঁ, খেলাটি নামে ও বদনামে পরিচিত সকলেরই । ওই বাহান্নটি তাস মিলে একটি ডেক; ডেকে চারধরণের, রুইতন-ইস্কাপন-হরতন-চিড়িতন, প্রতি ধরণের ১৩টি করে, টেক্কা, দুরি... নওলা, দওলা, গোলাম, বিবি, সাহেব, মোট ৫২টি, তাদের সাফ্‌ল করা,  খেলোয়াড়দের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া, তারপর খেলা, নিয়ম মেনে। খেলাও তো বিভিন্ন, নামে ও নিয়মে, রং মেলান্তি, তিওপাত্তি থেকে পেসেন্স বা ব্রিজ।
এই খেলার ভেতর কবিতা মিশে থাকে।
যখন খেলি, নিজের ভাগের তাসগুলি হাতে নিই, সাজাই, কোনটা কখন খেলব, কোন দানে চিড়িতনের গোলাম না হরতনের সাত, ভাবি, ঠিক করি, খেলার পরিস্থিতি আর আমার গেম রিডিং অনুসারে একেকটি তাস ফেলি, এই তো খেলা ।
কবিতারই মতো ।
শব্দগুলিকে, আমার কাছে আসা শব্দগুলিকে, এলোমেলো শব্দগুলিকে সাজানো ও কার পরে কোনটি লিখব সেই ক্রম কবিতার দাবি মেনে স্থির করা, লেখা। হ্যাঁ, ‘কবিতা লেখার, প্রিয়, এটুকুই মজা’।
এভাবেই, তাস ও কবিতা, খেলা ও লেখার একটি সম্পর্ক জমে ওঠে, আমরা জানি।
 কারুটা, জাপানের একটি খেলা, তাস ও কবিতার।
 দুজন প্রতিযোগীর মধ্যে খেলা। তাস থাকে দু ধরণের, তোরিফুদা ( খেলার তাস ) আর ইওমিফুদা ( পড়ার তাস ), প্রতি ধরণের ১০০টি করে। প্রত্যেক ইওমিফুদায় থাকে একটি করে ওয়াকা। ওয়াকা হল জাপানি কবিতার ৫-৭-৫-৭-৭ অক্ষর ( syllable) বিন্যাসে পাঁচ লাইনের জাপানি কবিতা । তোরিফুদায় থাকে ওই ওয়াকাগুলির একেকটির শেষের দুলাইন  ( অন্তিম ৭-৭ অংশ )। তৃতীয় একজন একটি করে  ইওমিফুদা থেকে ওয়াকাটি পড়ে আর প্রতিযোগীরা খোঁজ করে তার শেষ অংশের তোরিফুদাটিকে। যে আগে পাবে তাসটি তার। শেষে যার সংগ্রহে বেশি তাস থাকবে সেই বিজয়ী। জাপানে এটি জনপ্রিয় খেলা। নববর্ষের সময়ে অনেকেই কারুটায় মেতে ওঠেন। এর জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতাও হয়।
নবম শতাব্দীতে চিনে প্রচলন হয় তাস খেলার। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। নানান বির্বতনের মধ্যে দিয়ে পায়  আজকের  এই বাহান্ন তাসের রূপ। রুইতন-ইস্কাপন-হরতন-চিড়িতনের এই দেশ ফরাসিদের অবদান।
তাসের দেশ – শুনলেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাখ ঠাকুরের নাটকটির কথা, তাসের রূপক বেশ জনপ্রিয় আমাদের সাহিত্য।
তো, পাঠক তাসের মতোই কবির লেখা শব্দগুলি থেকে কবিতাটি খুঁজে বের করেন, সাজান। তাঁর পাঠ এক নিজস্ব ভাবনাক্রম তৈরি করে।
পেসেন্স একটি খেলা, তাসের। একক খেলা। খেলোয়াড় ও তাঁর তন্‌হাই, বাহান্নটি তাস ও তাঁর ধৈর্য ।
তিনি সামনে নিয়ে বসেন। তাঁর কাজ নিয়ম মাফিক এলোমেলো তাসগুলিকে সঠিক সারিতে, সঠিক অবস্থানে বিন্যস্ত করা। তাহলেই খেলার শেষ।
এরমই ‘পেসেন্স কবিতা’। বাহান্নটি শব্দ, চারটি বাক্যের, প্রতি বাক্যে ১৩টি করে। কিন্তু তাদের সেভাবে লেখেন নি। লিখেছেন এলোমেলো । পাঠক ওই বাহান্নটি শব্দের সামনে বসেন, শব্দগুলির ক্রম পরিবর্তম করেন, খুঁজতে থাকেন মূল কবিতাটিকে । আর এই খোঁজের ভেতরেই তিনি তৈরি অসংখ্য শব্দ-প্যাটার্ন, অসংখ্য কবিতা।
পেশেন্স কবিতা

পাথর গিলেছে প্রেত সাবান অভ্যর্থনা মোছা তুলো ঘাম দূর্বা আরতি আর অন্ধ মঙ্গল ছুরির ফলার পণে কমিনা সনেট দৃশ্য ঘুটঘুট দীপালি হো নম্র আভা ভ্রম সাজ ছাউনি শেষ করে লিরিকে গড়িয়ে যাচ্ছে ডানাময় মুখঢাকা গাড়ি ঘুম মেঘ বিষাক্ত শূণ্যতা চুমুকে সিগ্রেট কমে ধোঁয়া উড়ে সুখ ধুত পাংশু হাত মাংস খুবলে রক্তপায়ী হয়
                 ( সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় / কাব্যগ্রন্থ ঃ আমি তো মাছির গায়ে বসি না, মাছি বসে কেন  )

তিনপাত্তি । বদনাম তাসের খেলাটি ।
খেলতে বসে দুজনে । মাঝে খেলার টেবিল ও তাস । বাটোয়ারা হয় ।প্রত্যেকের হাতে তাস তিনটি করে ।
খেলুড়েরা নিজ নিজ তাস দেখে , ফেলে ,
একের পিঠে অপরে । তিন দান ।
যার তাস বড়ো জয়ী সেই।
তো কবিতা?
ছয় লাইনের । দুটি করে পংক্তির একেকটি জোড় । তিনটি স্ট্যানজা ।
কবি এমন একটি বিষয়ে লিখবেন যা নিয়ে তাঁর মনে দ্বন্দ্ব চলছে ।একটা আইডিয়ার পিঠে আসছে তার বিপরীত আইডিয়া । থিসিস ও অ্যান্টিথিসিস ।
কবি একটি একটি করে ফেলবেন । তিনটি থিসিসের পিঠে তিনটি অ্যান্টি ।দু লাইন করে তিনটি জোড় । । তিনটি স্ট্যানজা ।
পাঠক ঠিক করবেন কে জিতল , বা আদৌ কোনো হারজিৎ হল কিনা।
সিনথেসিস । সেটাই কবিতা।
           













শিরোনামহীন পাখি
   

     অনিমেষ পাখিটিকে বাদাম দেয়
পাখিটা রোজ বাদাম খায়

পাখিটা বাদামি রং ভালোবাসে
পাখিটা বাদামি গান গায়

পাখিটা রোজ বাদাম খেতো
পাখিটা রোজ বাদামি রং হারাচ্ছে

       ( শমীক যাণ্নিগ্রাহী / কাব্যগ্রন্থ ঃ আনজান আদর )

পরপর দুটি লাইন হতে পারে দুজনের সংলাপ। হতে পারে একজনেরই মনের দুই বিপরীতমুখী ভাবনা । আবার তা যে ৬ লাইনেরই হবে, নাও হতে পারে, কিন্তু দুজনে রং মেলান্তি খেলার মতো একেকটি করে পঙ্‌ক্তি, পরের পঙ্‌ক্তিটিকে নিয়ে একটি  স্ট্যানজা, কিন্তু ভাবনাগতভাবে পঙ্‌ক্তিদুটি মিলছে না, বিপরীত অথবা তাদের মধ্যে একটা অমিল রয়েই যাচ্ছে। কবি লিখেছেন ততদূর যতক্ষণ না মিলে যায় দুটি লাইনের ভাবনা। যেভাবে রং মিলে যাওয়া অব্দি তাস ফেলে যান দুই খেলোয়াড় আর মিলে গেলে শেষ হয় একটা দান।



  ( জয় গোস্বামী / কাব্যগ্রন্থ ঃ আজ যদি আমায় জিগ্যেস করো )
দুজনের কথাবার্তা চলতে থাকে একের পিঠে অপরে । শেষ স্তবকে বদলে যায় , প্রেমিক বলে আগে, তারপর ঈশ্বর। এবং এতক্ষণ যে কথার অসাযুজ্য চলছিল তা মিলে যায়।
এবং সংলাপের মতো না হয়ে ভাবনাগত দিক থেকে


( কালীকৃষ্ণ গুহ / কাব্যগ্রন্থ ঃ স্মৃতিহীনতার মধ্যে নিস্তব্ধ পুরাণ )
 ভাবনা, পাল্টা ভাবনা- এইভাবে রচিত হয় কবিতাটি। এবং শেষ স্তবকে একীভূত হয় কবির উচ্চারণ।
এইভাবে তাসের ভাবনাগুলি, তাসখেলার ভাবনাগুলি কবিতায় এসেছে, কখনো কবির সজ্ঞানে, কখনো অজ্ঞাতে।
 তাসের খেলাগুলি আরও নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে আমাদের কাব্যভাবনাকে
এভাবেই কবিতা, এভাবেই তাস, এভাবেই আমাদের ভাবনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 

No comments:

Post a Comment