Saturday, February 24, 2024

 নিজার কাব্বানির ১০টি কবিতা।। 

( ফারহানা রহমান অনূদিত) 


১. যখন ভালোবাসি।। 


যখন ভালোবাসি

নিজকেই মনে হয় সময়ের রাজা 

পৃথিবী এবং এর সবকিছুর মালিক বনে যাই  

এবং নিজের ঘোড়াটির পিঠে চড়ে সূর্যের গভীরে ঢুকে যাই

প্রেমে পড়ে গেলে

আলোর তরল রশ্মি হই

অদৃশ্য চোখের কাছে 

এবং আমার নোটবুকের কবিতাগুলো

হয়ে যায় মেমোসা ও পপি ফুলের প্রান্তর, 


যখনই ভালোবেসে ফেলি 

আমার আঙুলগুলো থেকে ঝর্না প্রবাহিত হয়  

জন্মায় তখন জিভে গুল্মলতা 

 

প্রেমে পড়ে গেলে  

পেড়িয়ে কালের পরিক্রমা 

অনন্তকালের পথে চলে যাই 

যখন নারীর প্রেমে পড়ি  

দুনিয়ার সব গাছপালাগুলো 

আদুল পায়েই ছুটে আসে আমার দিকে... 


(When I Love by Nizar Qabbani)


২. একটি ছোট্ট প্রেমের চিঠি।। 


প্রিয়তমা, আমার অনেক কিছুই বলার আছে

হে আমার মহামূল্যবান, কোথা থেকে শুরু করব বোলো?

তোমার ভেতর যা কিছু আছে তা সবই রাজকীয়

ওগো তুমিই সে যে কী না তাদের তৈরি করা রেশমের মথ 

থেকে আমার কথাগুলোকে অর্থবহ করে তোলো

এই হোলো আমার গান আর এটি আমি

এই ছোট বইটি আমাদেরকে ধারণ করে

আগামীকাল যখন এর পৃষ্ঠাগুলোতে ফিরবো  

একটি প্রদীপ আর্তনাদ করবে

বিছানাটি গান গাইবে

তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে এর অক্ষরগুলো সবুজ হয়ে উঠবে 

এর কমাগুলো প্রান্তসীমায় উড়ে যাবে

তবু এটা বোলো না; কেন ছিল এই যৌবন ? 

(A Brief Love Letter by Nizar Qabbani) 


৩. আলো লণ্ঠনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।। 



লণ্ঠনের চেয়ে আলো গুরুত্বপূর্ণ, 

নোটবুকের চেয়েও বেশি জরুরী হচ্ছে কবিতা, 

আর ঠোঁটের চেয়ে চুমুর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।


তোমাকে লেখা আমার চিঠিগুলো 

আমাদের উভয়ের চেয়ে মহত্ত্বর এবং গুরুত্বপূর্ণ। 

তারাই একমাত্র প্রমাণপত্র 

যেখানে মানুষ আবিষ্কার করবে

তোমার সৌন্দর্য

আর আমার উন্মাদনা।


( Light is More Important Than The Lantern by Nizar Qabbani) 


৪. প্রেম তুলনীয়।। 


হে আমার নারী, আমি তোমার অন্যান্য প্রেমিকদের মতো নই 

অন্য কারও কি উচিত হবে তোমাকে মেঘ এনে দেওয়া?  

যখন আমি তোমাকে বৃষ্টি দেই

তার কি উচিত হবে তোমাকে লণ্ঠন এনে দেওয়া, 

যখন আমি তোমাকে চাঁদটিকেই এনে দেই  

তার কি উচিত হবে তোমাকে গাছের ডালপালাগুলো দেওয়া  

আমি যখন তোমাকে সব গাছগুলোই দেই  

আর অন্য কেউ যদি তোমাকে একটি জাহাজ দেয়

আমি দেবো তোমাকে ভ্রমণ। 


( Love Compared by Nizar Qabbani ) 


৫. ভাষা।।



একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে

সে কিভাবে পুরানো শব্দগুলোই ব্যবহার করবে? 

একজন নারী কি এমন প্রেমিককে কামনা করবে

যে ব্যাকরণবিদ এবং ভাষাবিদ হিসেবে মিথ্যে বলে 

আমি যে নারীকে ভালবেসেছিলাম

তাঁকে কিছুই বলিনি

কিন্তু তাঁর জন্য প্রেমের বিশ্লেষণগুলোকে জড় করে 

একটি সুটকেসের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম

এবং সমস্ত ভাষা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম।    


( Language by Nizar Qabbani) 


৬. প্রতিবার তোমাকে যখন চুমু দেই।।


যতবার আমি তোমাকে চুমু খাই 

দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর

অনুভব করি

আমি তাড়াহুড়ো করে 

একটি লাল ডাকবাক্সে প্রেমপত্র দিচ্ছি।


( Every Time I Kiss You) 


৭. আমার প্রেমিকা আমাকে জিজ্ঞাসা করে।। 


আমার প্রেমিকা আমার কাছে জানতে চায়

আমার আর আকাশের মধ্যে পার্থক্য কী?

হে আমার প্রেম! পার্থক্য আছে

আর সেটি হচ্ছে 

যখন তুমি হাসো

আমি আকাশের কথা ভুলে যাই। 


( My Lover Asks Me by Nizar Qabbani) 



৮. ওহ আমার প্রেম।। 



ওহ! আমার প্রেম 

তুমি যদি আমার মতো পাগলপ্রায় অবস্থায় থাকতে 

তুমি তোমার সব গহনা ফেলে দিতে  

হাতের সব কাঁকন বেঁচে দিতে

আর আমার চোখের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতে।  


( Oh, My Love by Nizar Qabbani) 



৯. সমুদ্রে প্রবেশের সময়



শেষ পর্যন্ত প্রেম হোলো 

আর আমরা ঈশ্বরের স্বর্গে ঢুকে পড়লাম

পিছলে পড়লাম 

মাছের মতো

জলের ত্বকের নিচে।

আমরা সমুদ্রের মহামূল্যবান মুক্তারাশি দেখেছি 

আর বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি

অবশেষে ভয়ভীতি ছাড়াই ভালোবাসা হোলো 

চাওয়া-পাওয়াগুলোও কী ভীষণ মিলে গেলো 

ফলে আমিও উজাড় করে দিলাম আর তুমিও তাই দিলে

আর আমরা দুজনেই ছিলাম দুজনের কাছে উন্মুক্ত। 

সবকিছু কী দারুণ সহজে ঘটে গেলো 

ঠিক যেন সুগন্ধি জল দিয়ে লেখার মতো

ঠিক যেন মাটি ফুঁড়ে কোনো এক ঝর্না বয়ে যাওয়ার মতো। 


( On Entering The Sea by Nizar Qabbani) 


 


১০. সংলাপ।।


কখনো বোলো না যে আমার প্রেম 

একটি আংটি অথবা হাতের বালা ছিল 

আমার ভালোবাসা হচ্ছে অবরোধ 

এটি হচ্ছে তাঁদের মতো বেপরোয়া এবং উদ্ধত 

যারা তাদের মৃত্যুর দিকে পাল তোলার অন্বেষণ করে। 

এটি বোলো না যে আমার প্রেম 

একটি চাঁদ ছিল। 

আমার প্রেম ছিল আসলে একটি স্ফুলিঙ্গের বিস্ফোরণ। 


( Dialogue by Nizar Qabbani)


কবি পরিচিতি 

নিজার তৌফিক কাব্বানি একজন সিরিয়ান, কবি, লেখক, প্রকাশক এবং কূটনীতিক ।  তিনি আরব বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত সমসাময়িক কবি এবং সিরিয়ার জাতীয় কবি হিসেবে বিবেচিত। ১৯২৩ সালের ২১ মার্চ  নিজার কাব্বানি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে একটি মধ্যবিত্ত বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আপাত সরল অথচ গভীর ব্যঞ্জনাময় কবিতা লিখে তিনি কবিতাপ্রেমিদের মন্ত্রমুগ্ধ করে  রেখেছিলেন। তাঁর কাব্যশৈলীতে প্রেম, কামোত্তেজকতা, নারীবাদ, ধর্ম এবং আরব জাতীয়তাবাদের চেতনা অন্বেষণ, সরলতা এবং কমনীয়তার সমন্বয় ঘটেছে।

তবে নিজার কাব্বানি নারীমুক্তি ও নারী অধিকারের পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার কবিকণ্ঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এবং একারণেই তাঁকে নারীবাদী কবি হিসেবে অভিহিত করা হয়। 


 কাব্বানী 'মিঠনাহ আল-শাহম' নামে দামেস্কের একটি পাড়াতে বেড়ে ওঠেন এবং ১৯৩০ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত দামেস্কের ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক কলেজ স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  ১৯৪৫ সালে আইন বিষয়ে স্নাতক হন। পরবর্তীতে  কাব্বানি সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য কাজ  করেন।  বৈরুত, কায়রো, ইস্তাম্বুল, মাদ্রিদ এবং লন্ডন সহ বেশ কয়েকটি রাজধানী শহরে সাংস্কৃতিক দূত হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৯ সালে, যখন সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়, কাব্বানী চীনের দূতাবাসে ভাইস-সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। তিনি এই বছরগুলিতে প্রচুর লিখেছিলেন এবং এই সময়ের কবিতাগুলি তার সেরা কবিতা ছিল। তিনি ১৯৬৬ সালে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কূটনৈতিক কাজ চালিয়ে যান। তখন তিনি বৈরুতে তার নিজের নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কাব্বারি ৩০ এপ্রিল ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি লন্ডন শহরে মৃত্যুবরণ করেন। 



No comments:

Post a Comment