Saturday, February 24, 2024

 

শৈশবের ভোজপুরি গানে নোংরামির আনন্দ  

মলয় রায়চৌধুরী


যাঁরা আমার স্মৃতিকথা ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ ( চর্চাপদ ) আর ‘ছোটোলোকের জীবন’ (প্রতিভাস) পড়েছেন, তাঁরা আমার শৈশবের ইমলিতলা পাড়ার সঙ্গে পরিচিত । ইমলিতলা ছিল পাটনা শহরের গরিব অন্ত্যজদের, যাদের এখন মহাদলিত বলা হয়, তাদের বস্তি ।   আমার চরিত্রগঠনে বা বিগঠনে খাঁটি অবদান  ইমলিতলার মানুষগুলো  ; সেখানকার অভিজ্ঞতা আমাকে শিক্ষিত করে তুলেছে, শিখিয়েছে মানসিক-ঔদার্য, সারগ্রাহীতা, তার প্রতিটি বাসিন্দা ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বেপরোয়া, গোলমালকারী, স্হিতাবস্হাবিরোধী, যারা নিজেদের বলতো “দুনিয়াকা নাসুর”, মানে পৃথিবীর এমন নালি-ঘা, যা সারে না । প্রথমে বিদেশি ও পরে স্বদেশি সরকার তাদের জীবনযাত্রার লড়াইকে মনে করেছে প্রতিরোধ-প্রতিবাদ, মনে করেছে মৌরসি-পাট্টার শত্রু, তাদের মনে করেছে বিপজ্জনক, অথচ তা ছিল ওদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা । জীবনকেচ্ছা প্রায় প্রতিদিনই ঘটতো ইমলিতলা পাড়ায় কিন্তু সেসব নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের মতন কেউই খিক-খিকে হাসি হাসতো না, মাথা ঘামাতো না । 


যে কোনো উৎসবে ভোজপুরি বা পাটনাই গান গাইতো পাড়ার বউ-ঝি-মরদরা মিলে, ঢাক-ঢোলোক পিটে, যেমন এই গানটা :

যৌবন হোই ফিউজ জে করবে তু ইউজ

হই চঢ়ল তোর জওয়ানি ছোড়তা কোই পানি

এ রানি

যৌবন হোই ফিউজ জে করবে তু ইউজ

হই চঢ়ল তোর জওয়ানি ছোড়তা কোই পানি


ইমলিতলা পাড়ায় কবিতা নামে কোনো ব্যাপার ছিল না । ছিল ভোজপুরি বা পাটনাই গান, যাকে কেবল পাড়ার লোকেরা নয়, আমাদের বাড়িতেও অশোভন বা অশ্লীল মনে করা হতো না । আমার মা ওই পাড়ার বুলি রপ্ত করে ফেলেছিলেন, যা, উনি পরে জানতে পারেন, সংস্কৃতিবান হিন্দিভাষীদের কাছে অশোভন, এমনকী অশ্লীল । ইমলিতলার বস্তিবাসীদের জমায়েতে ইঁদুর পুড়িয়ে খাওয়া হতো, শুয়োরের মাংস খাওয়া হতো ; শৈশবে আমি পুরো ইঁদুর-পোড়া  খাইনি, বমি করে ফেলব আঁচ করে, তবু একটুকরো মুখে দিয়ে চেখেছিলুম, বিটকেল সোঁদা গন্ধ ; তবে শুয়োরের মাংস যখনই পাড়ায় রাঁধা হতো, খেয়েছি । দাদা সমীর রায়চৌধুরী ইঁদুর-পোড়া খেয়েছিল, তাড়ি দিয়ে । আমার তাড়ি আর ঠররা খাবার ট্রেনিঙ তো ইমলিতলায় । তাড়ি খেয়ে এরকম গান গাওয়া হয় :


তোহরা ইসক মেঁ পাগল

ভইল কাচি কাওয়ারি

ভইনি হম জয়সে

গরমি কে শাম সজনা

হাঁ বে তু লওঙ ম্যাঁয় ইলাইচি

হাঁ বে তু লওঙ ম্যাঁয় লাআআচি

তেরে পিছে আ গওয়াচি

তু লওঙ ম্যাঁয় ইলাইচি

অনেকের মতে, গত এক দশক ধরে ভোজপুরি ভাষায় লেখা গানের মিউজিক ভিডিওতে এমন ধরনের দৃশ্য দেখানো শুরু হয়েছে যাকে অনেকেই সফট পর্ন বলেন । অন্য পাড়ায় যে বাঙালিরা থাকতেন তাঁরা ভোজপুরি বা পাটনাই গানগুলোকে মনে করতেন নোংরা ।   আমি আমার সহ্যশক্তি আর যুঝে যাবার ক্ষমতা ইমলিতলার বস্তি থেকেই পেয়েছি : হাতকড়া, কোমরে দড়ি, জেলহাজত, শত্রুদল, কুখ্যাতি, অপমান, অপপ্রচার, বিরোধিতা, কটূ মন্তব্য, বিশ্বাসঘাতকতা । সেই পাড়ার গান শুনলে টের পাওয়া যায় যে অমন বস্তিতে জীবনের শুরুটা কাটিয়ে বাংলা সাহিত্যে ঢোকাকে বলা যায় জীবনের টেকটনিক প্লেটে শিফট ।

কেমন গান ? যা শুনলে মগজের সহ্যশক্তি বাড়ে ? এরকম :

দায়ে অওর বায়ে কে হিলে ত লাগে বেটর

দায়ে অওর বায়ে কে হিলে ত লাগে বেটর

হই তোত দুনু ইনডিকেটর

হই তোত দুনু ইনডিকেটর  


ইমলিতলাতেই জেনেছি, প্রতিটি নারীর দেহে নিজস্ব সুগন্ধ থাকে যা শহুরে মহিলারা পারফিউম মেখে নষ্ট করে ফ্যালে , পারফিউম জিনিসটা তাই আমার পছন্দও নয় , পাড়ার সকলের বাসার মতনই আমাদের বাড়িতেও কলিং বেল ছিল না, বাড়ির কারোর সঙ্গে দেখা করতে হলে বাইরে থেকে তার নাম ধরে ডাকতে হতো । নাম ধরে ডাকার এই বাচনিক সম্পর্ক হারিয়ে গেল ইমলিতলা ছাড়ার পর। আমাদের বাড়িতে ইমলিতলার দিনগুলো নিজস্ব রঙে আর গন্ধে দেখা দিতো, রাতগুলো দেখা দিতো কেরোসিন লন্ঠন আর রেড়ির তেলের লম্ফর শিখায় । সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে লন্ঠন জ্বালানো হলে বাইরে থেকে ভেসে আসতো তাড়ি-টানা পাড়ার বাসিন্দাদের সমবেত গান :


সবকে এহি রংগ ডর বাডু রে সবকে জোরি মেঁ হথিয়ার বাডু রে

নহি নাচ বুত পলট জায়েগা সামান তোহরা ফট জায়গা

হোঠওয়া কী লালী চুসা হো নাক কে নথিয়া খুলাই হো

হনা তনি করবু তো রানি হো গোলি চলগে ছেদড়ি হো

সামান তোহরা ফট জায়েগা

হামি তা অব জওয়ান হোই নহি কে দে অব তেরতার হো

অরে নহি তো পিলান তোহরা কট জায়েগা

সামান তোহরা ফট জায়েগা


সংবাদে পড়লুম, ভোজপুরি সিনেমা জগত থেকেই পরিচিতি অথচ সেই দুনিয়ার গান নিয়েই অভিযোগ তুলেছেন অভিনেতা তথা বিজেপি সাংসদ রবি কিষাণ। তাঁর অভিযোগ, “চূড়ান্ত অশ্লীলতা চলছে ভোজপুরি গানে। তাই এই নোংরামো বন্ধ করতে কড়া আইন দরকার। এই বিষয়ে রবি কিষাণ  সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “ভোজপুরি ভাষা শতাব্দী প্রাচীন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভোজপুরি গানে যে সব শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে তা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না।  শুধু গানের লিরিকস নয়, তার উপস্থাপনও হচ্ছে অশ্লীল ভাবে।” রবি কিষাণ অমন কথা বলেছেন কেননা ভোজপুরি সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক হলেন নিরাহুয়া, যিনি বিজেপি টিকিটে উত্তরপ্রদেশের আজমগড় থেকে লোকসভা নির্বাচন জিতেছেন আর নায়িকাদের জড়িয়ে যে ধরণের অভিনয় করেন তা অন্য ভোজপুরি অভিনেতারা পারেন না । 


যেকোনো লোকগানের মতন ভোজপুরি গানও ছিল নিম্নবর্ণ-নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক আস্ফালনের পরিসর। রবি কিষাণ ব্রাহ্মণ কিন্তু নিরাহুয়া নিম্নবর্ণের । নিরাহুয়ার জনপ্রিয়তার কারণও সমাজের এই বর্গে ভোজপুরি গানের আকর্ষণ, যাঁদের কাছে, গানগুলো, ইমলিতলা পাড়ার মতনই, নোংরা বা অশ্লীল বলে মনে করা হয় না । বাংলায় যে নামকরা কবিয়ালরা ছিলেন, তাঁরাও ছিলেন নিম্নবর্ণের, যেমন গোঁজলা গুঁই, নিত্যানন্দ বৈরাগী, ভবানী বেনে, রঘুনাথ দাস,  ভোলা ময়রা, কেষ্টা মুচি, যজ্ঞেশ্বর দাস, নীলমণি পাটনি, শ্যামসুন্দর স্যাকরা, জগন্নাথ বেনে, মতি পসারি, ভীমদাস মালাকার, জগা কৈবর্ত্য প্রমুখ । ভোজপুরি গান টিকে গেল কারণ ম্যাকলের শিক্ষাপদ্ধতির ছক ব্রিটিশ আমলে ভোজপুরি বলিয়ে-কইয়েদের ভৌগলিক এলাকায় তখন পৌঁছোয়নি ।


রবি কিষাণ যে ধরণের ভোজপুরি গানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন , তা আমি শৈশব থেকেই শুনে আসছি । এখন সেগুলো অভিনয় করে দেখানো হচ্ছে বলে, যাঁরা সমাজের ওপরতলায় চলে গেছেন, তাঁদের নোংরা মনে হচ্ছে। বাংলা ভাষার ডহরওয়া, পতরতুলা ,বেঁগাড়ি ,ঝুমরা, ঝুমটা, নাগপুরিয়া ,তামাড়িয়া, পাঁচপরগনিয়া ,মুদিআরি ইত্যাদি ঝুমুর গান আর কবিয়াল তথা দাঁড়াকবিদের যদি ভদ্রলোক ব্রাহ্মরা আর খ্রিস্টান পাদ্রি-শিক্ষকরা ‘নোংরা’ ছাপ্পা মেরে বিদেয় না করতেন, তাহলে এখনকার ভোজপুরি গানের মতন আমরা ভিন্ন ধরণের বাংলা গানের সঙ্গে পরিচিত হতুম ; তার লিরিক্স হতো আলাদা  । বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’, সুশীল রায়ের ‘ধ্রুপদী’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’, অরুণকুমার সরকারের ‘উত্তরাধিকার’ ইত্যাদি কবিতার পত্রিকায় আমরা কবিয়াল, দাঁড়াকবি, ঝুমুর গায়কদের মতন নিম্নবর্ণের নাম দেখতে পাই না । হাংরি আন্দোলনের কবি হারাধন ধাড়ার কবিতা স্বীকৃতি পাচ্ছিল না বলে তিনি এফিডেভিট করে নিজের নাম দেবী রায়তে পালটে ফেলেছিলেন ।


ভোজপুরি সিনেমা জগতের সুপারস্টার  নিরাহুয়ার সিনেমা বা ভিডিও ইউটিউবে আসামাত্রই একেবারে জনপ্রিয়তার টঙে পৌঁছে যায় সেই দিনই। শুধুমাত্র তাঁর নতুন গান নয়, তাঁর একাধিক পুরনো গানও সোশ্যাল মিডিয়াতে অত্যন্ত জনপ্রিয় । তিনি ভোজপুরি সিনেমা জগতের এমন একজন তারকা যার নামেই সিনেমা সুপারহিট হয়ে যায়। তার মত তারকা ভোজপুরি সিনেমার জন্য বেশ লাভের ব্যাপার কারণ তার জনপ্রিয়তার উপরে ভর করেই ভোজপুরি সিনেমা অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। তিনি ইতিমধ্যেই এমন কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন, যে সমস্ত ছবি ভোজপুরি এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মত রাজ্যে নিরাহুয়ার ছবি  মানেই সুপারহিট। তার সঙ্গে আম্রপালি দুবের যৌন রসায়ন যে-কোনো ভোজপুরি সিনেমায় দর্শকদের জন্য ফাঁদ পেতে রাখে। এই রোম্যান্টিক জুটির ফিল্ম তালিকায় এমন কোনো সিনেমা নেই যা ফ্লপ হয়েছে । 


সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা-পদ্ধতির হস্তক্ষেপে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়  বাংলা ভাষার ডহরওয়া, পতরতুলা ,বেঁগাড়ি ,ঝুমরা, ঝুমটা, নাগপুরিয়া ,তামাড়িয়া, পাঁচপরগনিয়া ,মুদিআরি ইত্যাদি ঝুমুর গান আর কবিয়াল আর দাঁড়াকবিদের বিশেষ আলাপচারিতা । শুধু তাই নয় । তারপর থেকে কর্ম ও জ্ঞানের স্হায়ী বিভাজন ঘটে যায় । আজকে আমরা চিন্তাই করতে পারি না যে একজন মুচি জুতো সেলাই করছেন, তাঁতি তাঁত বুনছেন, স্যাকরা গয়না গড়ছেন, মাঝি নৌকা বাইছেন, জেলে মাছ ধরছেন আর সেই সঙ্গে কবিতা লিখছেন আর খ্যাতি পাচ্ছেন । এনারা শ্রম বিক্রি করতেন কিন্তু আধুনিক কবিরা কবিতা বিক্রি করেন ।

প্রখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাসের মাতামহ দামোদর সেনের 'সঙ্গীত দামোদর' গ্রন্থে প্রথম 'ঝুমুর' শব্দ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত সঙ্গীত দামোদরে উল্লেখ আছে- “প্রায়ঃ শৃঙ্গারবহুলা মধ্বীক মধুরামৃদু।/একৈব ঝুমুরীলৌকে বর্ণদিনিয়মোজ্‌ঝিতা” [প্রায়সই শৃঙ্গারবহুল মধুর মৃদু সুরার (মাধ্বীক) মতো। ঝুমুরে বর্ণাদি (বর্ণালঙ্কার ও ছন্দ) নিবদ্ধ নয়।] ঝুমুর সম্পর্কে সঙ্গীত দামোদর-এর এই উক্তি অনুসারে জানা যায়, ঝুমুর গান শৃঙ্গার রসের এবং তাতে মধুর ব্যঞ্জনা আছে। অশ্লীল বলে এই গান দোষণীয় নয়। এই গানের কোনো বাঁধা-ধরা ছন্দ ছিল না।

বিশিষ্ট ঝুমুর কবি ও গবেষক সুনীল মাহাত এক সাক্ষাৎকারে  ঝুমুর গান নিয়ে  আলাপচারিতায় সোহম দাসকে বলেছেন, “ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন রাজন্যভাতার বিলোপ হল, তখন ঝুমুরকে মদত দেওয়ার আর কেউ থাকল না। ঝুমুরের শ্রোতা হল সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী অনেক গান রচিত হল এবং সেগুলো কিছু নিচুস্তরের যৌন-উত্তেজক  গান  হল। ঝুমুরকে সেই সময়টায় বলা হতে লাগল, ‘মাতালদের গান’। বলা হল, যারা মুনিশ, কামিন, বাগাল, মানে যারা শিক্ষিত লোক নয়, এটা তাদের গান। সেই সময়টাতে ঝুমুর ভীষণ নিন্দিত হতে থাকল। যারা শিক্ষিত সম্প্রদায়, তারা ঝুমুর সম্পর্কে বলত যে, না, না, ওইসব গান চলবে না। কলকাতারও কিছু পণ্ডিত-শিল্পী ঝুমুরকে ‘যৌনগন্ধী’ গান বলে আখ্যায়িত করল। এটা ঠিক ভদ্র সমাজে চলে না, এরকম একটা গান। আমরা যখন ঝুমুর নিয়ে চর্চা শুরু করলাম, তখন কিন্তু বাড়ির লোকরা আমাদের বাধা দিত। বাবা এসে বলতেন যে, না, না, বাড়িতে এসব ঝুমুর গান নয়, ওসব বাইরে।”


 অর্থাৎ, আদি ঝুমুর গান বিলুপ্ত হয়ে গেল এবং তার জায়গায় দেখা দিল ভদ্রলোকদের ড্রইঙরুমে চলতে পারে এমন সব লিরিক্স, যাকে প্রকৃত ঝুমুর গান বলা যায় না । আদি ঝুমুর পর্বে শিল্পী ও শ্রোতারা ছিলেন প্রান্তিক অর্থাৎ নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষ। ধর্ম ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা ছিলেন অন্ত্যজ। এই সময়ে স্থানীয় কূর্মি, মাহাতো, কুমোর, রাজওয়ার, ঘাটাল, হাড়ি, মুচি প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঝুমুর। একই সময় ঝুমুর গান করতেন সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। আদি ঝুমুর ছিল এইরকম :

 দেখ্যে বাড়ালি তকে

 তুঁই না দিলি হামাকে

 বুকের মাঝে শিমল কঁড়ি দলকে

 সেই দেখে মন ললকে।

[তোকে দেখে বড় হয়েছি। তুই সঙ্গম করতে দিলি না। বুকে তোর শিমুলফুলের মত স্তন দেখে, মন উত্তেজিত হয়েছে ]


সুনীল মাহাত আরও বলেছেন, “আগে আমরা যে ঝুমুরগুলো শুনতাম, গ্রামের মাঠে-ঘাটে, সেগুলো ঠিক পরিশীলিত বলা যায় না। এমনিতে মাঠে-ঘাটে যারা গানটা ন্যাচারালি গায়, তারা তো প্রফেশনাল গায়ক-গায়িকা নয়। তাদের গাওয়া গানগুলো ঠিক কানে লাগার মতো ছিল না।   গ্রামে  কিছু ঝুমুর নাচের দল ছিল। কম ছিল, কিন্তু ছিল।  তখন কিছু কিছু নাচনি নাচের শো হতো। নাচনিরা নাচত বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে। দেখলাম যে, তার মধ্যে ঝুমুরের অনেক ভ্যারাইটি আছে। ধীরে ধীরে যখন আমি ঝুমুরের মধ্যে প্রবেশ করছি, তখন আমি দেখছি, যে, প্রাচীনকালে এক ধরনের ঝুমুর ছিল।” 

যেমন : “আমার বঁধু রাতকানা /বাড়ি দিগে আনাগোনা/দেখ বঁধু গবর গাড়ায় ঢুকনা/আমাকে সাঁতায় না।/ঝাঁড়গাঁর হাট যাতে যাতে/বিহায়ে ধরিল হাতে/বিহাই ছাড়ো হাত/  ঝুড়ি ঝাঁটি বিকেই সাঁঝের ভাত।”

অথবা : “ভাত খাবি না মদ খাবি/হাটে যাবি না ঘরে যাবি।/বলি তোর দামটা ফুটা কড়ি তুই/আরে তোর দামটা ফুটা কড়ি তুই,/কোথা যাবি বিগাইতে।/লে লে ঝুমুর গাইলে তুই,/বোল তুলে দে মাদলে। আছিসে লগন এবার,লে লে পরব লাগায় দে।/কমলির যৌবন পুরালো,/অরে গ্যাদার মালা শুকালো রে…।/ লাল ফিতা কাঁচের চুড়ি,/মাথার কাটা, কলের ঝাড়ি।/রথের মেলায় কত লগন/দেখলি ঘুমের ঘরেতে।/ছাড় না ক্যানে খ্যামটা নাচোন,/ও তোর হ্যেড়িয়া মনের গ্যাছে লগন।আইলো যে ঝড়, কাজন মেলা,/ঝড় কদমে, বাধন জ্বালা। /সবাই মিলে মাররে ঠ্যেলা,/পাহাড় টকে সওরাইতে।/লে লে পরব লাগায় দে।”


ইউরোপের ঔপনিবেশিক ভাবুকরা ঠেকে শিখেছিলেন, যে, বলপ্রয়োগ করে নয়, উপনিবেশকে কব্জায় রাখতে গেলে, নিজেদের সিংহাসনটি বসাতে হবে নেটিভের মগজে, যাতা সাম্রাজ্য গুটিয়ে ফেলার পরও ভাবজগতটির দখলিসত্ব বজায় রাখা যায় । ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রকে তাই ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হলো লোককবিদের সাথে-সাথে । গ্রামের যাত্রাভিনয়কে জেমস লঙ বলেছিলেন অশোভন ও ইতর, ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরকে বলেছিলেন নোংরা, পাঁচালিগুলোকে বলেছিলেন লালসা-উদ্রেককারী ও অশ্লীল, বেতাল পঞ্চবিংশতিকে বলেছিলেন মোটাদাগের ও অশালীন । জেমস লঙের আক্রমণে বটতলা সাহিত্য তো লোপাট হয়ে গেল ।


ইংরেজদের ভাবকাঠামোয় ছিল বিশেষ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ : অনুসন্ধান, পরীক্ষা, উঁকি, সাক্ষাৎকার, নিরীক্ষণ, পরিদর্শন, তদন্ত, চরগিরি ইত্যাদি এবং বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন টেরি করা, যাতে উপনিবেশের লোকসংস্কৃতিটি ছারখার হয়ে যায়, স্মৃতি বিপর্যয় ঘটানো যায় । আমরা তাই দেখি যে জেলা গেজেটিয়ারগুলোতে ডাকাত আর ঠগিদের অনুপূঙ্খ খবর থাকলেও, প্রাগাধুনিক বাঙালি কবি, গায়ক, বাউল, এঁদের বিষয়ে তথ্য সেনসর করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা । ইংরেজরা বিদায় হবার পর মসনদে বসেন ভদ্রলোকদের দল যাঁরা জগা কৈবর্ত্য, কেষ্টা মুচি, ভবানী বেণে, গোঁজলা গুঁইয়ের মাঝে নিজের বাপ-ঠাকুর্দাকে চিনতে পারেননি । ব্রিটিশ কর্তাদের সংস্কৃতিটি সবর্ণরা উৎকৃষ্ট মনে করে বজায় রাখলেন আর যাবতীয় দেশজকে দিলেন নিকৃষ্টের তকমা । এর কোনও স্বকীয় নান্দনিক যুক্তি নেই । ফলে মর্সিয়ার চেয়ে এলেজি হয়ে উঠল শ্রেয়, নৌরচকা ও ভাটিয়ালির চেয়ে লিরিক, লাউনি ও সারির চেয়ে ওড, সখিসংবাদের চেয়ে বেলেলেটার্স, মুর্শিদা ও নিকউবানার চেয়ে লিমেরিক, লেটোর গানের চেয়ে রক অ্যান্ড রোল ।


ইমলিতলার মসজিদে লাউডস্পিকার ছিল না ; রমজানের সময়ে একজন ফকির ভোর রাতে গান গাইতে-গাইতে যেতো যাতে পাড়ার মুসলমান পরিবারের সদস্যদের ঘুম ভেঙে যায় । সেই ফকিরের এক হাতে সাপের মতন ব্যাঁকা ছড়ি আর অন্য হাতে লাউয়ের মোটা খোসা শুকিয়ে তাতে লোবানের ধোঁয়া। মুসলমান পরিবারগুলো ছিল অত্যন্ত গরিব কিন্তু রোজা পালন করতো । তবু, পাড়ায় যখন ঢোল-ঢোলোক বাজিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পুরুষ আর মহিলারা এইরকম  ভোজপুরি গান আরম্ভ করত, কেউ বাধা দিতো না :


খিড়কি বন্দ কর দে দরওয়াজা বন্দ কর দে

বহিয়া মেঁ আগ বুঝবা নস নস মেঁ উঠে লহরিয়া

দিল বহর হো যায়ে না তনি প্যার হো যায়ে

বহিয়া মেঁ লেলে সাজন দহিয়া মেঁ উঠে লহরিয়া

হোটবা কে আস পাস হোটবা রহে দাস

অঁখিয়া সে প্যার ওয়ালি বতিয়া কহ দে

তনি মারজাই য়ে নজরিয়া নহি বাটে মেঁ উমরিয়া

সজিয়া সাজীই ছতরিয়া মেঁ আবা 

উর্দু সাহিত্যে কবিয়ালরা আজও সমাদৃত কেননা মুসলমান সমাজ ব্রিটিশ মূল্যবোধকে প্রতিরোধ করে নিজেদের মুশায়রা লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে । দেশভাগের আগে পাঞ্জাবিরা উর্দুতে লিখতেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও বক্তব্যটা প্রযোজ্য । গুলজারের মতো বহু কবি আজও হিন্দি কবিতা উর্দুতে লেখেন । মুশায়রায় থাকে  এক জাদু, এক ধরনের নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতা। একটি শায়রি, তার কবি এবং শ্রোতাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার আনন্দ, প্রতিফলন এবং আত্মীয়তার অনেক সম্ভাবনার জন্ম দেয়। আমাদের কবিয়াল, দাঁড়াকবি, তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই,  বসা কবিগান, ঢপ, টপ্পা,  তুক্কাগীতি,  লেটো, আলকাপ, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া,  আর্যা,  আর ঝুমুর গায়করা সেই আত্মীয়তাই গড়ে তুলতেন দর্শক আর শ্রোতাদের সঙ্গে । এখন এই গানগুলোর নবায়ন করছেন মূলত উচ্চবর্ণের গীতিকার-গায়ক ও গবেষকরা, যে কারণে প্রাচীনকালের জীবনপ্রবাহ, আঞ্চলিকতা, যৌনতা, স্হানিকতা, উদ্বেলিত-স্বর, বিরহের গ্রাম্য ভাবাবেগ,   গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, , আকুলতা, লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ইত্যাদি হয়ে যাচ্ছে এলিট সমাজের উপভোগ্য । 

রবীন্দ্রনাথ কবিগান সম্পর্কে বলেছেন “কথার কৌশল, অনুপ্রাসের ছটা এবং উপস্থিতমত জবাবেই সভা জমিয়া উঠে এবং বাহবা উচ্ছ্বসিত হইতে থাকে—তাহার উপরে আবার চার জোড়া ঢোল, চারখানা কাঁসি এবং সম্মিলিত কণ্ঠের প্রাণপণ চীৎকার—বিজনবিলসিনী সরস্বতী এমন সভায় অধিকক্ষণ টিঁকিতে পারেন না।এই নষ্টপরমায়ু ‘কবি’র দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ, এবং ইংরাজ-রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন যে তিনি উচ্চবর্ণে আর উচ্চবর্গে জন্মেছেন বলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী প্রভাবিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, “ "আমি যদি পল্লী কৃষকের ঘরে জন্মাতাম, কিম্বা মাঝি, মালো, কর্মকার বা তন্তুবায়ের ঘরে, আর আমার যদি থাকত সহজাত কবিত্বশক্তি তাহলে আমি বড়জোর একটা কীর্তনের বা পাঁচালীর দল খুলতাম অথবা কবিয়ালরূপে গ্রামে গ্রামে গাওনা গেয়ে বেড়াতাম৷ সমাজের প্রতিকূল পরিবেশেই প্রতিহত হত আমার এর চেয়ে বেশী কিছু হওয়ার সম্ভাবনা৷ আমি জানি অনেক সম্ভাবনীয়তার কুঁড়িই এভাবে অকালে ঝরে যায় যেগুলি ফুল হতে পারে না এবং দেখেছিও তেমন দু'দশজন৷" 

রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য অনেকটা রবি কিষাণের মতন । ইমলিতলার বস্তিতে শৈশব কাটালে তাঁর মতামত নিঃসন্দেহে আলাদা হতো ।


No comments:

Post a Comment