Saturday, February 24, 2024

 সোমনাথ সাহার দুটি কবিতা

                শ্রীচরণেষু মা

"Except for Mankind, all Creatures are Immortal, as they are Ignorant of Death!”

                                 হোর্হে লুই বোর্হেস 


জীবিত কে তুষ্ট করার মতো সময় আমার নেই,

মৃত কে ভালোবাসার সময় আমার অনন্তকাল।

তাই হয়ত মায়ের গন্ধ,মায়ের উত্তাপ সবই নিকষ  অন্ধকারে কেবল একটা শব্দ হয়ে জাপটে ধরেছে আমায়।

মা বলত আমায়--

"--আমি আসব তোর কাছে। ঠিক আসব, দেখিস।

আর যদি না আসি, বুঝবি আত্মা আসতে পারে না।

তারা স্মৃতির খামে লেগে থাকে জলছবি হয়ে।

আমি বিশ্বাস করতাম মা'র কথা।

মা তো কখনও মিথ্যা কথা বলত না।

মায়ের মুখে রাগ মেশান খুশি দেখেই বুঝতাম মায়ের শরীর মন কখন কখন ঘরের আঙ্গন ছাড়িয়ে চলে যেত জগতের আনন্দ যজ্ঞে।

সবাই খুব অবাক হয়েছিল দেখে, যে যতটা ভেঙে পড়ার কথা আমার তার তুলনায় আমি যেন অনেক বেশি শক্ত।

আসলে, মা'র ওই সান্ত্বনাটাই ছিল আমার শক্তি।

মাতৃগর্ভ থেকে যখন উলঙ্গ ভূমিষ্ট হয়েছিলাম নিজেকে অগ্নিশুদ্ধ করে ফিরিয়ে এনেছিলাম তোমার চরণে।

 জানতাম, মা যখন বলেছে ঠিক আসবে।

আমাদের আবার দেখা হবে, কথা হবেই।

অন্ধকারে অস্পষ্ট অনুভব করতাম মায়ের গোপন হাসি মুখ।

মা তো আমাকে 'আসি' বলেও গেল না। তা কেমন করে হয়? 

আমাদের অভিমানও চুপ করে শুয়ে থাকতো মাটির গোপনে।

রাতের পর রাত জেগে থেকেছি আমি।

যদি মা আসে!

মা তো ! এসে যদি দেখে আমি ঘুমিয়ে আছি, হয়তো ডাকবে না। চলে যাবে।

খুব ইচ্ছে করতো দু-হাত ভোরে ভাসিয়ে দিতে চরাচরের সমস্ত পাপ, অতৃপ্ত মায়া তোমার চরণে।

জীবনের গানে কান্না জমলে মা আসতো আঁচল নিয়ে পাখিদের গান হয়ে।

আজ একা একা ভিজে যাওয়া অন্ধকারে আমি  ভাবছি তোমায় কি কোনোদিনও দিয়েছি আমি আমার সকল শূন্য করে ?

আপনজনের পদাবলি

"যদি না থাকত এই জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর প্রতাপ জীবনে, আমিও খুঁজতাম সুখ, যা কিছু সে রমনীয় রুচিকর মনে।"
                             ( বুদ্ধচরিতম্ , বন্দনা )

বাবা
বাবা আমার স্নিগ্ধ বাতাসের মতন, সমস্ত অনুভব দিয়ে তাকে অনুভব করলে বুঝতে পারি, 
আমার ছেলেবেলার পাতায় লেখা আছে সেই সময়ের কথা,
যখন বাবা শীতল চাঁদের মতো শিশির ভেজা পথে দাঁড়িয়ে ছিল সৃষ্টির সিন্ধু বুকে নিয়ে; আমরা তখন স্তব্ধতার খোঁজে রাত্রির বুক চিরে চলে যেতাম কালপুরুষের কাছে।
বাবা আমাদের বিশ্বাস দিয়ে মাটির ঈশ্বর গড়তে শিখিয়ে ছিল।
আজ আমাদের নিবিড় সংযমে স্মৃতিটুকু বেঁচে আছে, আর বাবা মিশে আছে অনন্তের গভীরে।

মা
'মা'-কে নিয়ে বলতে যোগ্যতা লাগে!
যোগ্যতাহীন ব্যর্থতার শীতলতা দিয়ে যা বুঝেছি তা হলো-
মা কে দেখতাম বিকেল হলে থালা ভর্তি সন্ধ্যা সাজিয়ে রাখত; আর আমরা চার ভাইবোন একমুঠো আলো ভাগ করতে শিখতাম মায়ের কাছে।
মায়ের অস্থির মন দিনরাত ছোটাছুটি করতো একলব্যের তীরের মতন।
একই জনমে অনেক বার জন্মেছি আমি, তবুও আমার বুকের ভিতর রয়েগেছে অজস্র চোরা ঋণ।
এপারে যা কিছু সঞ্চয়, তা এপারেই রেখে যাবো, তোমার সাথে নিজেকে মিলিয়ে দেবো বলে।

দাদা
স্বাধীনতা আনবে বলে সেই যে কখন ঘর ছাড়া হলো স্বাধীনতা এসেগেলো দাদা এলোনা।
আমি দেখতাম দাদা প্রতিটা অপমানের পর  ফিরে আসত সাদা কাগজের বুকে।
গোলাপের রাজনীতি দাদা বোঝেনি কোনোদিন তাই তো তুচ্ছ গোলাপ মাড়িয়ে হেঁটে গেছে লজ্জা হরণ নিদ্রালোকে।
দাদা শেষে একটা চিঠিতে লিখেছিল-" ক্ষমতার দরজায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা বারণ"।

দিদি
যতটুকু আমি জানি দিদি কে ওরা বিয়ে করে পশুর মতন কেটে খেয়েছিল।
আর বাকিটুকু মায়ের মুখে নির্জনতার ভিতর রুমাল দিয়ে ছটফটিয়ে কান্না দেখে বুঝতে পারি,
অযত্নে বেড়ে ওঠা শিউলি গাছের শরীর ভর্তি ঘায়ে  কারা জানো শান্তি পাচ্ছে। 
দিদির কান্নার জলে আমি আধার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বুঝতে শিখেছিলাম-
ফুলের গন্ধ ফুরিয়ে গেলে বাতাসও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়।

বোন
বোন একজনকে ভালোবেসে বলেছিল-
"তুমি দেখো মৃত জোনাকিদের পাশে আমি গোলাপ ফুটিয়ে তুলবোই।"
বোনের প্রেম ছিল নির্জন নদীর বিষণ্ণতার মতন, হরিনের চোখে মাধুর্যের মতন।
চোখের সামনে অপেক্ষা করতে করতে বোনটি আমার শ্রুতি হয়ে গেলো,
শ্রুতি হতে হতে স্তব্ধ হয়ে গেলো,
আজ হঠাৎ দেখি স্তব্ধ হতে হতে অশরীরী চুম্বন রেখা ছুঁয়ে ফেলেছে।

কুসুম
আমাদের বুকে দোয়েল নেমে আসলেই আমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে কুসুম আসতো।
কুসুমের ঠোঁটে অহংকার ছুঁয়ে আমি জ্যোৎস্না ধরার চেষ্টা করতাম; পারতাম না তলিয়ে যেত ভালোবাসার মতন।
রাত বেশি হলে সংক্ষেপে চাঁদ কে ডাকতাম, অন্ধকারে ঠোঁট ভেজানো কথা বলতাম।
২১ শে ফাল্গুন চাঁদ দেখতে গিয়ে হঠাৎ আমি তোমায় দেখে ফেলেছিলাম।
তার পর আমাদের কিছু কথা তোমার কাছে বন্ধক রেখে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম অপেক্ষার আলিঙ্গনে।

No comments:

Post a Comment