Sunday, February 2, 2020

সত্যম ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত গদ্য 
এক চিলতে আলো
                           

    শীতকাল আসলেই আমাদের পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয়।ঝুপ করে নেমে পড়া সন্ধ্যেতে কখন যে ঢেকে যায় মানুষজন-মাঠঘাট-বাড়িঘর।কোনো কোনোদিন পাড়ার আলো জ্বলে না আর সেদিন  কি ভালোই যে না লাগে এই অন্ধকার।তখন ব্যালকনিতে বসে বসে লোকের কাজ শেষে ঘরে ফিরে যাওয়া দেখা যায়।এমনিতে অন্ধকার, কিন্তু আকাশের আলো তখোনো মুছে যায় নি।পশ্চিমদিক থেকে কে যেন গাঢ় কমলা রঙ ছড়াচ্ছে সেখানে।তখনই কোথা থেকে যেন মনের বারান্দায় এক চিলতে আলো এসে পড়ে।কোন বাড়ির জানালা থেকে এই আলো তা ঠিক বোঝা যায় না।হতেও পারে বা এ চাঁদের আলো।তখন দুধ সাদা জ্যোতস্নায় ধুয়ে যায় আমাদের চরাচর-ছাদ- ছোট্ট একটু মাঠ-পেছনের বাড়ির পুকুর।সেখানে তখন পাড়ে এসে চুপ করে পিঠে আলো নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে মহাশোল মাছ।কবে যে তাকে পাহাড়ী নদী থেকে কে তুলে নিয়ে এসে এই পুকুরে ছেড়েছিলো কে জানে।সে কি একা না কি কোন সঙ্গী আছে তার সেখানে বা হয়তো প্রেমিকা।
   সামনাসামনি হওয়াতে কত কথাই না বলা রয়ে গেলো আমাদের।অসংখ্য বুদবুদে সূর্যের আলো পড়ে রামধনুর যে রং ছড়ালো তা মিলিয়ে গেলো অচিরেই।তখন শুধু শীত আর কুয়াশা ছড়িয়ে থাকতো আমাদের মফস্বলে।হাত ছাড়িয়ে চলে যেতো কেউ আর ঘন গাঢ় কুয়াশায় মিলিয়ে যেতো সে।সে সময় এতো ক্রিসমাস আসেনি।আসেনি এত কেক-প্যাস্ট্রি-প্যাটিস।আর্চিস যেন কাকে বলে?না এসব নাম স্কুলে শুধু বলে এলিট ক্লাসেরা।তখন মনে রঙ লেগে ডানা মেলতে শুরু করেছে প্রজাপতির পাখারা।শুধু উড়ে উড়ে বেড়ায় সারাক্ষণ।সারাদিন চোখের সামনে বাস থেকে হাত নেড়ে চলে যায় ড্রিমগার্ল।নড়ে চড়ে ঘুরে বেড়ায় বইয়ের পাতায়।তার স্কুলের কমলা স্কার্ট থেকে রঙ লেগে লেগে রঙ্গীন হয়ে যায় আমাদের মফস্বলের পথঘাট।
   সন্ধ্যে নামে।দলা দলা কুয়াশারা জড়ো হয় দূরে হ্যালোজেন আলোর চারপাশে।আর তারপর উড়ে যায়।আসে বড়দিন।প্রেমের কথা বলতে বুকের বাজনা খুব জোড় বাজে।সে যখন বাড়ি ফিরে যায় সন্ধ্যেবেলায় মোড়ের মাথা থেকে হাঁটতে হাঁটতে,তার এই চলে যাওয়াটি হয়ে ওঠে সব থেকে মনোরম।এই তো মোক্ষম সময় বলার।এইরকমই একটি সন্ধ্যের প্রতিক্ষায়ই তো সে ছিলো জীবনভর।বহু কষ্টে পয়সা জমিয়ে শহর থেকে উড়ে চলে আসে আর্চিস আর তার নিল খাম ধীরে ধীরে রং ভরে নেয় নিজের হৃদয়ে।যেন তাকে নিয়ে সে পাড়ি দেবে কোনো স্বপ্নের দূরদেশে।হৃদয় নিঙড়ে আসা আসা সে রঙ গাঢ় হতে থাকে শীতের সন্ধ্যেয় লেপের নীচে।বাড়ির ভয়ে সমস্ত কিছু গোপন।ওদিকে আজ একটা কিছু যা হোক হয়ে যাবে।তো সেই সন্ধ্যেতেই হাঁটতে হাঁটতে যখন সে ফিরে যাবে, হাঁটু গেড়ে বসে চেয়ে নিতে হবে তার হাত।হোক না তা পাড়ার এঁদো গলি,তবু আজ সেখানেই নামবে জন্নত।
   কিন্তু কি যে হয়।সেই সন্ধ্যেতে ড্রিমগার্ল আর পথে নামে না।আর ওদিকে সান্ধ্য খবরে প্রকাশ পায় সংবাদ-কাল তারা বড়দিনের ছুটিতে।একি মোক্ষম পরিহাস।এতবড় আর্চিসকে কোথায় লুকোনো যাবে আজ।কোথায় আজ সেই মনোরম চলে যাওয়াটি।ধীরে ধীরে ক্রমঃশ নিথর হয়ে আসে পথঘাট-রাস্তা-মানুষজন।শীত যেন আরো চেপে বসতে থাকে মনের ভেতর।কি করবে-কোথায় যাবে-কে রাখবে বুকের ভেতরের পতপত ওড়া এই নিশানটি,কিচ্ছু বোঝা যায় না।আর তো কোনদিন উড়তে পারবে না সে।নিজেকে মেলে দিতে পারবে না আর বাতাসে।সব কিছু শেষ হয়ে গেলো আজ এই শীতের সন্ধ্যায়।এরপর রাত বাড়বে।গুড়ো গুড়ো রেণুর মতো ঝরে পড়তে থাকবে হিম।আরো গাঢ় হবে কুয়াশারা।তার চেয়ে থাক।সব থাক বুকের ভেতরকার এই পকেটের গোপন অন্তরালে।টুকরো করে ফেলা যাক এই তিল তিল করে গড়ে তোলা আর্চিস।ডানা ছেড়া প্রজাপতির মতো তারা ঝরে ঝরে পড়ুক জঙ্গলে আর জঞ্জালে।শীত বাড়ুক,এতো বাড়ুক যেন সব জমে যায়,এই বুকের ভেতরের মরে যাওয়া প্রেমের মতো।আর কিছু তো পারা যাবে,বরং কড়া তামাকই একমাত্র পারে আপাতত সব ভোলাতে।তাই একের পর এক সব জ্বলে পুড়ে যাক সেই নেশায়।টলতে টলতে আর শীতে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকার সেই সন্ধ্যায়,এমনই এক চিলতে আলো এসে পড়েছিলো মুখের ওপর।কোথা থেকে যে এসেছিলো সে আলো বা আজো যে কোথা থেকে আসে সে তা বোঝা যায় না।তবু বড় ভালো লাগে এই আলোকে-অন্ধকারকে-সেই সেদিন থেকেই আজন্ম সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে যে তারা।

1 comment:

  1. বড় ভালো। মন কেমন করা লেখা।

    ReplyDelete