Wednesday, January 2, 2019


অপাংশু দেবনাথের মৃত্তিকাঋণ- কিছু কথা

বিদিশা সরকার


কিছু উন্মনা লাইন, কিছু দিন গুজরানের আক্ষেপ, কিছু অতীতসম্ভবা পৃথুল 
মেঘভার ও বৃষ্টি সম্ভাবনার জানলাগুলো খুলে দিয়ে সম্বিতের বিদ্যুৎ -- এসব নিয়েই কবি অপাংশু দেবনাথের কাব্যগ্রন্থ ' মৃত্তিকাঋণ মেঘমিতাকে'- 
প্রসঙ্গত বলে রাখার প্রয়োজন বোধ করছি যে, অপাংশু'র বই হাতে পাওয়ার আগেই তার কবিতার পুরুষকার, চৈতন্য আকাশ- জানবার সুযোগ হয়েছিল ফেসবুকের মাধ্যমেই।ফেসবুকে কবিতা লেখার প্রবণতা নিয়ে তাবড় কবিদের উষ্মা দেখে কষ্ট পাই।আজকে অপাংশু'র মতো আরও 
অনেক কবিকে জানবার ও পড়বার সৌভাগ্য তো এই মাধ্যমকে কেন্দ্র করেই। আমার অনেক কবিবন্ধু আর প্রিয় কবির তালিকাভুক্ত হওয়া ফেসবুকের সুবাদেই। নিজে রক্তাক্ত হলেও অন্যদের রক্তাক্ত দেখতে বড় কষ্ট হয়।

কাব্যগ্রন্থের সুচনায় বা কথামুখও বলা যেতে পারে, কবি বলছেন -- 
" কবিতার জন্য অহোরাত্র জেগে থাকে একা 
  মৃত্যুর দুয়ারে প্রতিবার লাথি মেরে ফিরে 
  আসিয়া,যে দেখে অনন্ত সেই প্রত্ন- প্রভাত।" 
যেন বিজনবাটির সিংহদুয়ার, যেন সাবেকিয়ানার ঘোষিত অহংকার অনন্ত 
প্রত্ন প্রভাতের কাছে নতজানু ! 

মৃত্তিকাঋণ যে স্বগতোক্তি। জীবনপ্রবাহের সমান্তরাল বহমান ইতিনদীকথা। 
কবি অশোকানন্দ রায়বর্ধন ভূমিকায় তার কাব্যময়তার পূর্বাভাস দিয়ে লিখেছেন-- " কবিতার প্রব্রজ্যা যে সময়কে সঙ্গী করে কিংবা সময়ের চিত্রল ছায়া যে জীবনকে জড়িয়ে আশরীর তার দোহার বার্তা এখানে প্রবল 
উচ্চারিত। " 
প্রথম কবিতার নামকরণ - মেঘমিতার সঙ্গ-সুখ এক দীর্ঘকাব্য। সঙ্গ ও সুখের মাঝখানে এই হাইফেন আবার আশরীর কথাটা মনে করিয়ে দেয়। 
" প্রিয়, 
  মেঘমিতা, 
  প্রাগৈতিহাসিক গুহাজীবন থেকে,তোমার 
 মঙ্গোলীয় মুখ দেখে কেটে গেছে সিঁড়ি ভাঙা 
 অংকের মতন বাইশ জনমের পুন 
 পাঠজীবন।......" 
প্রেম চিরজীবী, প্রেম পরজীবী, প্রেম অসহায়, প্রেম অস্বীকৃতি- আর সেই কারণেই ' অসময়ের অফুরাণ মেঘলা যন্ত্রণাও।' 
কবি মেঘমিতাকে এঁকে চলেছেন অপার্থিব নীলে অথবা ' সে তমালীয় নীল,
চোখে মুখে লাগতেই / ক্রমাগত নীল হয়ে উঠে হৃদয়। মুহূর্তে। ...... ।' 
অথবা '... শূন্য ঘর।/ আসবাবপত্রহীন।অস্পষ্ট ছায়া উনুন/ কিংবা রকমারী ব্যাগ নেই একটাও তো / যাতে করে এনে দিতে পারি হাটবন্দী সুখ ...' 
অকৃপণ 'হাটবন্দী সুখ' এনে দেওয়ার মধ্যে কোথায় যেন এক প্রায়শ্চিত্তের 
আত্মতৃপ্তি। প্রতি শ্রাবনেই যেন হারানো সংবাদ নিয়ে বিষণ্ণ স্মৃতির আনাগোনা! 
" ওখানেই স্বপ্নবিনিময়, ওখানেই দ্বন্দ্ব 
  চলে ক্রমাগত উষ্ণ ও শীতল স্রোত হয়ে 
  অহোরাত্র। এই দ্বন্দ্ব বলয়ে দাঁড়িয়ে বুঝি -- 
  জীবনের প্রতিরূপ হয়ে উঠছ কখন ...... " 
অথবা 
" তরল খাদ্য কনিকার মতোন ; অসুন্দর 
  অবয়বে আজও অবোধ্য তা আমার কাছে। 
  ভোর বিজন কিংবা কোলাহলে হয়ে হয়ে উঠো - 
  অভ্যাস।" 
এ যেন দিনাতিপাতের অবসরে সেই অদৃশ্য জানলা, এ যেন ফ্রেমবন্দী জীবন থেকে অগম্য পথের দিশা ' জাতীয় সড়কে মেশে' । হাইওয়ে আর আকাশ কী 
সমার্থক ? অথবা সম্ভাবনাময় ইতিহাস ? কবির যন্ত্রণা যখন একজন সাধারণ
পাঠকের হৃদয়েও সেই চিনচিনে ব্যথা সংবাহিত করে তখন মনে হয় এর শেষ কোথায় ! এই মগ্ন উচ্চারণ তো উপবাসের অন্তে দৈবী আঘ্রাণেই চিরহরিৎ ফসলের গান। হ্যা গান। সমগ্র কবিতাটিই যেন স্থায়ী থেকে অস্থায়ী,  
অস্থায়ী থেকে অন্তরা আবার অন্তরা থেকে সঞ্চারী। যেন অন্তহীনের সুরবাহার।
প্রতিতটি মোচড়ে কোমল পরদাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে সমে ফিরে আসা। হয়ত পয়ার ছাড়া কবিভাষ্য মেঘমিতাকে বেষ্টনীর আবর্তে বেঁধে রাখতে পারতেন 
না। কারণ মৃত্তিকাঋণের দো-ফসলি জীবনের জীবনগানই একটা মসৃণ পথ 
ধরে মোহানা অভিমুখে। 
কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এ কবিতা যে তার নির্ধারিত সময়সীমাকে 
নির্ধারিত করেই এগিয়ে চলেছে। যেখানে কবি থামতেই পারেন না। অতি 
কৌতূহলে চলভাষে জানতে পারি সম্পূর্ণ কবিতাটি কবি পঁয়তাল্লিশ মিনিটে 
সমাপ্ত করেছেন। কলমের বাধ্যতাকেও সাধুবাদ না জানিয়ে পারছি না। আর 
কবি তো পথে পথে দেশে দেশেই নিরলস খুঁজে চলেছেন স্মৃতির আনাচ কানাচ। 
" এ কোন মায়ার তীব্র টানে ছুটছি আমরা, 
  ভাঙছি বিচূর্ণ সময়। হৃদয়ের ভেতর 
  ফেরিওয়ালা চাতক মন চারণের মতো 
  শরীর বেয়ে ওঠা লেলিহান চৈত্র দুপুর 
  মাপে। শুধু অপরিমেয় প্রান্তিক অনুভবে। " 
শেষ করবো কয়েকটি লাইন রেখে -- 
" অতি নাস্তিক মন, বাইশ জনমের ধ্রুব 
  সত্যের বাহক সে, প্রান্তিক প্রত্ন জীবনও 
  গৃহহীন ছুটে বেড়ানোর কথা ভাবে বসে " -- 
এই অপ্রাপ্তিই কি বেদনার গুরুভারে অতি বিশ্বাসকে নাস্তিক শব্দটি দিয়ে 
শাসন করলেন , না অভিশাপ ? এই বৈপরীত্যই তো সার্থক কবির হৃদয় 
উৎসারিত তাগিদ - যা তার বয়ানকে প্রান্তিক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে সম্পর্কের 
সততায়।  
  
অনেকদিন পর একটি ধ্রুপদী কবিতার বই আচ্ছন্ন করে রেখেছে । স্রোত প্রকাশনীকে ধন্যবাদ। অনবদ্য একটি ও অনেক বিদগ্ধ কবিদের বই প্রকাশে যে নিরলস কর্মযজ্ঞের শরিক হয়েছেন, তা কবিতা পিপাসুদের মননকে সমৃদ্ধ করবে। কবিকেও আমার শুভেচ্ছা । তার আরও কবিতার 
বই নানারূপে কবিতার বাগানে ফুটে উঠুক নানান পুষ্পসম্ভারে ।

No comments:

Post a Comment