Wednesday, January 2, 2019

উত্তর পূর্বাঞ্চলের কবিতা


চিত্র ঋণ : পাবলো পিকাসো 

পটুয়া-কন্যা

চন্দ্রিমা দত্ত

নিজের মুদ্রাদোষে গিয়েছি ভেসে
অনন্য আলো যা ছিলো হারিয়েছে 
আমি তো পাখি ছিলাম,সাঁতারু বাতাসে
ময়ূরী ছিলাম বর্ষা-জলে
আগুনের বন্ধুও তো ছিলাম তখন
অসীম সাহসী, দূরন্তের ঢেউ..., 
চিনলো না কেউ....

এসব দু:খের কথকথা নয় বন্ধু,
সহজ উচ্চারণে জীবন...

আজও পটুয়া আমি,  এঁকে চলেছি মরণ...



উপেক্ষিত

দেবলীনা সেনগুপ্ত 

যারা সত্য বলেছিল
তারা কোন পুরস্কার পায়নি
তালিকাভুক্ত হওয়ার মত
যথেষ্ট স্নেহপদার্থ
ছিল না তাদের জীবন ও যাপনে
চোখে ছিল না রঙিন চশমা
চাঁদকে তারা সূর্য বলেনি 
অথবা অমানুষকে ঈশ্বর
তারা এক ঘরে একা হয়েছে
একা--একাতর----এবংএকাতম
তারা বিদ্রোহ করেনি
অধরোষ্ঠের সংগমে , প্রসারণে
ফুটিয়েছে উদাসীন উপেক্ষা
তারা বিপ্লব করেনি স্লোগানময়
দৃঢ়বদ্ধ চোয়ালে শুধু চলে গেছে
আলোকিত নক্ষত্রের পথে
একাই--- সত্য সাথে৷
একদিন বহুযুগ পরে
পৃথিবী আসর সাজায় তাহাদের তরে
বিজ্ঞাপনময়
পৃথিবীর বয়স বাড়ে

সত্য বিজ্ঞাপিত হয়৷



কথা-১

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় 

মুখভার করে আছে না-বলা কথারা
ভিতরে পাতা ঝরছে, কীটদষ্ট হলুদ...
কিছু কি বলার ছিল, ঘোমটার ভিতরে, 
ওগো মেঘলা আকাশ!
সব পাতা জড়ো করি না-বলা কথার
অন্তত দুটো চাল সেদ্ধ হোক অলীক সংসারে



অভিমন্যু

অভিজিৎ চক্রবর্তী

দরোজাকে গাছ বলে ডাকব। গাছকে দরোজা। তো দরোজাকে গাছ বলে ডেকে দেখি অজস্র পাখির বাসা। কিচির মিচির। পা ঝুলিয়ে বসতেই শুনতে পেলাম পাতার মর্মর। মেঘের গর্জন। এক্ষুণি বৃষ্টি আসবে। তখনো নিচে এক দু'জন লোক ছায়া পাবে বলে বসে আছে। ভ্রম। উপরে তো মেঘ, বিদ্যুৎ। ঝড়ো হাওয়া। তাণ্ডব। গাছকে দরোজা বলে ডাকতেই খুলে গেল সব। একটার পর একটা কপাট খুলে দেখলাম শুধু বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছি। রোদ জল হাওয়া খেলে যায় এমন প্রান্তর-- খুলে খুলে খুলে খুলে খালি বাইরে বেরিয়ে পড়ছি। দিন ঢলে বিকাল হয়ে আসছে। পাখিরাও ঘরে ফিরে যাচ্ছে একে একে। আকাশের মেঘ আরও লাল হয়ে উঠেছে। বোধহয় কোথাও আগুন লেগেছে। বোধহয় কোথাও সূর্যোদয় হবে আবার। আমার আর ফিরে যাওয়া হচ্ছে না। কেবলি বাইরে-- বাইরে থেকে আরও বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ছি



কথা এবং না-কথার বর্ণমালারা

বিজয় ঘোষ

জলছাপ ভালোবাসা রং পালটে কামনা হয়ে যায়
কামনার ঈষৎ হলুদ-বর্ণ প্রজাপতির পাখায়।
পাখিদের পালক ভিজে যায় কুয়াশার প্রেমে---

প্রেম শব্দটি অতি প্রাচীন।
কেউ কেউ একে যৌনতা বলে...



সুখের অসুখ

আবু আশফাক্ব চৌধুরী

একটা গাছ আর আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
তার গায়ে লেপ্টে থাকা রকমারি পরজীবী
যেন আমার সংসার সন্ততি অথবা চারপাশে
ভিড় করা প্রতিবেশী হাত ক্লিন্নমুখ ভিখারি
পাতায় লটকে আছে কারো ঘরবাড়ি
বাবুই তার সুখের কথা শুনায় অন্য পাখিকে

আমার কোন গান নেই অযশ এই মুখে
শান্ত সৌম্য সুঠাম শরীর একমাত্র কামনা
প্রেম বলতে পাখিদের কিচিরমিচির অথবা
কোনকোন বিষাক্ত সাপের ফুঁসফাঁস ফণা
এরচে বেশি কিছু না হলেও তেমন দু:খ নেই
যেন জন্ম তার এজন্যে পরহিতে বিধ্বস্ত কাঁকড়ার বুক।
তার মতো আমারও শাখাপ্রশাখায়
অনেক নতুন মুখ পর্যায়ক্রমে
দীর্ঘায়ত ছায়াবন্ধে সুখের অসুখ।



পাঁজর

বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য

যতক্ষণ না এফোঁড়-ওফোঁড় হবে
বুক, এর আগ অবধি-
এই বেশ ভাল আছি!

যাদের পাঁজর ভেঙে গেছে
রক্তে মিশে গেছে নদীর জলে
তারা জানে- 
বুলেট কখনও  নিরপেক্ষ নয়।

"ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই" 
রাজা, আর এ কথা আর বলো না

বুদ্ধিজীবী, এবার মাটির দিকে তাকাও!



সাদা কালো

কমলিকা মজুমদার

এক মেয়ের গল্প বলি
মাতাল আত্মঘাতী স্বামীর
মরদেহ চেয়ে যে বলেছিল
এতদিন (সব) জ্বালা জুড়ালো।
চিতাকাঠের ধোওয়া মেখে
বারোহাতি বৈধব্য সাজে
সরকারি অফিসে লিখিয়েছিলো নাম।

অনেক পরে জেনেছিলাম
সাদা শাড়ি পরিহিতা
একদিন শুধু ভালোবেসে ছেড়েছিল ঘর
সেই থেকে কত প্রেম রঙ
মিশলো এসে শাড়ির খাঁজে
বোকা শাড়িখানার তবু
রঙিন হয়ে ওঠা হলো না।



ছায়া

নীলাদ্রি ভট্টাচার্য 

লেখনীর জলে অভিমানী হয়ে ওঠে আঘাতের শ্রাবণ।
স্পন্দিত খেলার মাঠ একা ঘাসে ঘাসে গন্ধ শুঁকে, 
দাঁড়িয়ে থাকে নীল আকাশের প্রান্তিক মেঘসাজ।
একটি অনাথ রোদ্দুর পাখি হয়ে বসে 
বোধাতীত কুঁড়েঘরের পুরোনো জানালায়,
আলপথে ভিজে যাওয়া সময়ের ডানহাত।
পীঠের ঘাম. ....না..না...
সে হাঁসের অপূর্ব ঠান্ডা বাতাস,
সয়ে যাওয়া অবেলার অপরিচিত ভালবাসা।

যে নরম অস্তিত্বে গড়িয়ে যায় বৃষ্টি 
উঠোন ঢেকে রাখে কলজে নিধন,
আমি তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে যাবজ্জীবন হাসি,
নীলচে মানুষ জন্মের সমর্পিত ভাঁজে  
হাঁটু মুড়ে আশ্রয় খোঁজি নদীর প্রচ্ছদ।



মড়ক 

অমলকান্তি চন্দ 

তরমুজ পাতায় লাল পিঁপড়ের সারি 
আল বেয়ে দীর্ঘ রাতের মিছিল 
আধ বুজা চাঁদ পিঠে করে নিয়ে যায় 
উদোম সুরঙ্গ পথে, 
প্যাচানো লতায় উপুড় হয়ে চুমো খায় 
ফোঁটা ফোঁটা কোমল শিশির… ….

মাটিকে আঁকড়ে ধরে ছায়া শরীর 
কেবল অন্তরালে  হাঁটতে থাকে 
দীর্ঘ পথের শেষে 
দীর্ঘ রাতের শেষে 
বাতাসে ধেয়ে আসে অজানা মড়ক  …...



পবিত্রদুঃখ

তমা বর্মণ

দুঃখের কাছে কাদাজল হতে ভালো লাগে
সুখের মাপকাঠি নষ্ট করে নীরবতা
সৌন্দর্যপিপাসু মন ঝুঁকে যায়
না পাওয়ার কাছে,
খুঁড়ে আনা যাবতীয় তথ্য
যেখানে যত তোমার সুখের আর্তনাদ
অসুখের মায়া হাড়ের ফাঁক দিয়ে শুয়ে থাকে
দিনকে দিন মুঠোর মধ্যে শ্বাস--
রংমহল ছেড়ে রোদেলা দুপুর
নিসর্গতার কাছে বসে লেখে একটানা,
যে কথা বলা হয় না ভিড় ও শব্দে
কেউ বলে না ভুলতে না পারা নাম।
পরিশ্রান্ত দুঃখের জমাটি আসরে বসে পরমায়ু
হৃদয়ঘটিত রক্তাক্ষর
আমার কবিতাবাড়িতে তোমার ভালো থাকা,
ততদিন তুমি শান্ত থাকো দূর
তার কাছে



শব্দসন্ধান

সঙ্গীতা নাথ
                                
দাঁড়িয়ে আছি কবিতার পলেস্তার সামনে,
করছি অক্ষত শব্দের সন্ধান,
জানিনা শব্দরা আদৌ আছে কি টান টান  ;
শব্দঝড়ের তান্ডবে 
শব্দের ঠিকানা বদলে গেছে কিনা ;
তবু করে যাচ্ছি জীবন্ত শব্দের সন্ধান;
যদি পেয়ে যাই এমন একটা শব্দ ,
যার অভ্যন্তরে আজো জেগে আছে...
নয় এটা আমার আকাশ কুসুম চয়ন 
এ আমার বধির পথচলা আর নীরব শব্দ মন্ত্রণ ।



স্বগত-চার

দেবাশ্রিতা চৌধুরী

শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছে
পতনের ভয় থাকে না
কীইবা যায় আসে!
তবুও শহরের পিচগলা পথে
হেঁটে চলে নবীন যুবক
বুকে ধরে পিপাসা অক্ষরের,
কুটিল ভ্রূকুটি,অনাদর তাচ্ছিল‍্য
আজ আর ছোঁয়নি তাকে।

শ্রাবস্তী থেকে আঠারোর দূরত্ব
কঠিন, তবুও এপথে এগিয়ে সুজন।



প্রজন্মের ক্রুশ

ভাস্কর জ্যোতি দাস

অক্ষাংশের ব্যবধানে  পিলাতদের জয়যাত্রা,
প্রজন্মের তফাৎএ আলোর বার্তা,

এখনও যীশুরা ক্রুশবিদ্ধ হয়,
এখনও অমলকান্তি,
একটা অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করে।

অন্ধ পিলাত আর উলঙ্গ রাজা,
গলাগলি  করে বেঁচে থাকে।
যীশু ক্রুশবিদ্ধ, নীরেনবাবু অগ্নিদগ্ধ।

সে মিছিলের নাগরিক আমরা,
প্রতিদিন মাঠে খেটে খাই যারা,
আমরা চাই না অন্ধ পিলাত,
চাই না উলঙ্গ রাজা।

চাই সে শিশু,
যে নাকি "পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়"।
চাই সে মানুষ, যে জেরুজালেমের অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে পৃথিবীর মাটিতে।

চাই তাদের যারা, ক্রুশকে ক্রুশবিদ্ধ করবে।
ক্ষমতার দলনে নয়,
প্রেম ভালোবাসার মিলনে।
কিংবা কবিতার কলমে।


পাগলি তোকে...

অধিষ্ঠিতা শর্মা

সহস্র আলোকবর্ষ দূরত্ব যত আছে
সবকিছু ফাঁকি দিয়ে সটান চলে আয়, 
আমার একলা রাতের নির্জনতায় 
বুকে জাপটে ধরে একটিবার বল,
'শোন পাগলী তুই শুধু আমার...'
সহস্র জন্ম মৃত্যুর দিব্যি! 
এক আকাশভরা জীবনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা
সহস্র জীবনের প্রত্যেকটি হৃদস্পন্দন 
গোলাপের পাপড়ির মত তোর আকাশে
একটিবার শুধু বল, "শোন পাগলী
তোর সমস্ত পাগলামি জুড়ে 
শুধুই আমার অস্তিত্ব...আমাদের অস্তিত্ব।



মানুষ তোমার জন্য

দেবাশিস সায়ন চক্রবর্তী

এই যে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি চিরকাল,
প্রেমে-অপ্রেমে, সুখে-অসুখে, সুস্থ্-মাতাল,
স্বতঃসিদ্ধ জনতার সংলাপে। অস্থির প্রহরের রেলপথে
ভালো লাগে ঘর-ভাঙা ঢেউ, নৌকার গান ঢেউ ভাঙা,
ভালো লাগে কিশোরী চাঁদের সোহাগ, গোলাপের
ঘ্রান, স্বপ্নের বাগানে নির্ঝঞ্জাট পায়রার ঝাঁক,
প্রতিদিন-প্রতিরাত উর্দ্ধচারী আকাশ-চেরা
মানুষ, তোমার জন্য আমার ঘরে ফেরা।

মধ্যরাতে জানালায় চোখ মেলে অবিরাম
স্বচ্ছল অন্ধকারে নৈশব্দে শুনি বৃষ্টির গান,
বৃষ্টিতে ভিজে স্বপ্ন-গোলাপ, পাতা ঝরে, মৌন!
সার্সিতে সুরেলা কম্পন শেষে ঝরে সবুজ। 
                   সুন্দর তৃপ্তি অফুরান,
স্মৃতির ঈথারে বেজে উঠে স্বতঃস্ফুর্ত অবিরাম। 
বৃষ্টি-অফুরন্ত বৃষ্টি, বৃষ্টি শুধু বৃষ্টির বোবা গান।

কাক ডাকা ভোরে চায়ের পেয়ালা ঠোঁটে ছুঁয়ে
মানুষ, তোমাকে দেখি পৃথিবীতে আনন্দ-বিষাদে,
মৌনতায়, সংলাপে, তুখোড় আড্ডায়, জীবনের কর্মশালায়
জটিল বাস্তবে বেঁচে থাকায়-ভেতরে এবং বাইরে,
মানুষ, তোমার জন্য জাগরন এই ভেবে প্রতিদিন-প্রতিরাত।

যদি আসে ফের মৌসুমী মেঘ, স্বচ্ছল সুখ অনন্তের
ফসল-অমৃত সম্পূর্ণতায় ফিরে আসে জন্মান্তরে,
পাবো কি পৃথিবী, মানুষ, তোমাকে প্রেমে-অপ্রেমে ?



পাখিজাল

হারাধন বৈরাগী 

আকাশ ঢেকে গেলে বনের 
আড়ালে,তকসি উড়ে ঘরওবাইরে

সন্ধ্যা সেদ্ধ হলে থাপার আঁচে
রাত আচই'র বুকে---

চারপাশ থেকে ধেয়ে আসে
নিশিঘোর-ধুধু টিংটিং--

শেষপ্রহর ভেঙে গেলে তকের 
বাঙে-জারিত হয় দেহ বৃক্ষদাহে

মোঙ্গলীয় চাঁদ ঢুলে পড়ে 
গাইরিঙে-চুয়াকের ঘোরে

চোখ বোজে শুয়ে পড়ে জুমনীড়
আদর বিলায় অলকমেঘ

বনতট জুড়ে নেমে এলে দাবানল
ধূপ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে 

মাথার ভেতর জ্বলে ওঠে আকাশ
উড়ে যেতে চায় তকসি --

একটি কাকতাল পাখিজাল 
ছড়িয়ে পড়ে এপার ওপারে



ই.সি.জি

আশফাক্ব হাবিব চৌধুরী

ক্যানভাসে যত ধারা পর্বতমালা হবে
জীবন ততটাই স্বতঃস্ফূর্ত... 

সেদিনের ইসিজির ব্যাখ্যায় ঔষধি কলম
আঁকলো হুবহু এমন লেখচিত্র...



তোমার শহর

শতদল আচার্য     

তোমার মনখারাপে লাল রঙ কোথায় যেন লুকায়
তোমার চোখের বৃষ্টি চেয়ে যায়

গানের কথার আড্ডা  মিস করি  ।
তোমার তানপুরার সুরে,
এ শহর আর আগের মত জেগে উঠে না.....



বক

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

তুমুল ব্যস্ততায় খুঁতখুঁতে
লোডশেডিং রাতে ডিপোজিট মন
উষ্ণ দ্বীপে পরিনাম ভুলে
পথ হারিয়ে যুগের ভ্রমণ ।

যা ছিল নিরিবিলি জন্মগত
শূন্য আর রৌদ্র মাখা তিলক
রঙিন যন্ত্রণায় মেঘেদের বেঞ্চে
স্বপ্ন বুনছে উলঙ্গ বক ।

সংস্করণ শেষে দশকের উল্লাস
প্রতারিত গ্রীবায় খুনসুটি প্রবাদ
রাধিকার প্রেমে পুড়ছে রুটি
প্রতি বিশেষণে অজানা খাদ ।

No comments:

Post a Comment