জ্যোতির্ময় মুখার্জির ব্যক্তিগত গদ্য শ্রীচরণেষু,
.............
.............
পত্রের প্রথমেই আপনি আমার প্রণাম লইবেন। বড়দের প্রণাম ও ছোটদের স্নেহাশীস জানাইবেন। অনেক দিন হইল আপনাদের কুশল সংবাদ পাইনি। আশাকরি আপনারা সকলে ভালোই আছেন। আমার শরীরটা ইদানীং ভালো যাইতেছে না। বাতের ব্যাথাটাও বাড়িয়াছে। হরির হোমিপাতি ঔষধ খাইয়া অবশ্য কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ করিতেছি। গত পরশু কমলা সিঁড়ি থেকে পড়িয়া পা ভাঙিয়াছে। নেতো মাস্টার জড়িবুটি সহকারে পা বাঁধিয়া দিইয়াছে। চিন্তা করিবেন না, আশাকরি খুব দ্রুত ওর পায়ে বল ফিরিয়া আসিবে।
এই বৎসর বৃষ্টির দেখা নেই। মাঠের ধান মাঠেই শুকাইতেছে। কাঁদোরেও জল নেই। চিন্তায় আছি, এতগুলো পেট চলিবে কীভাবে। অবশ্য সম্বৎসরের ধান কিছু মড়াইয়ে বাঁধা আছে। চাল করাইয়াও রাখিয়াছি কিছু। কিন্তু মঙ্গলার হাতে গোর পরাতে কাজে বিঘ্ন ঘটিয়াছিল। ঢেঁকির পাদানি থেকে পুঁটির পা পিছলাইয়া এই দুর্ঘটনা। হাত ভাঙেনি তবে হাতের হাড় সরিইয়া গেছিল। আমাদের পাটকুড়ুনি নন্দা সরিষার তেল দিইয়া হাড় বসাইয়া দিইয়াছে। প্রতিদিন সকাল সন্ধে নিয়ম করিয়া ঝেড়েও যায় ও। এখন আর ফোলা ভাবটাও নেই। খুব শীঘ্রই ঢেঁকি চালু হইবে। অবশ্য ঢেঁকিটার’ও বয়স হইয়াছে। ঠাকুরদার আমলের সেগুন কাঠের ঢেঁকি। নতুন একটি ঢেঁকি তৈয়ার করাইব ভাবিতেছি। বাগানের পুব পাড়ের শাল গাছটা কাটাইয়া ফেলিব।
সে যাইহোক, আপনাদের আশীর্বাদে আর ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় আশাকরি দিন চলিয়া যাইবে। দুমোঠো অন্নের সংস্থান ঠিক হইয়া যাইবে। কিন্তু খড় না হইলে গোরুগুলোকে খাওয়াইব কী, জানি না। বৃষ্টি না হওয়ার দরুণ ঘাসের’ও আকাল দেখা দিইয়াছে। ভুবিডাঙ্গার মাঠের ঈশান কোনে যে পুকুরটি ছিল, সেটি সেঁচিয়া দিইয়াছি। তাতে কিছু জমির সুরাহা হইয়াছে। পুকুরটি থেকে প্রচুর মাগুর, ল্যাটা, ভেলে, কই, শিঙ্গি মাছ মিলিয়াছে। কিছু আত্মীয় স্বজনদের পাঠাইয়াছি, কিছু প্রতিবেশীদের। তবু অনেক মাছ তিনটি চৌবাচ্চায় জিয়ানো আছে। আপনাদের’ও কিছু মাছ পাঠানোর মনোবাসনা রহিয়াছে। আমি নিজেই যাইতাম, কিন্তু শরীরের এই অবস্থা তারপর মাঠে ঘাটে কাজে চিরিবিরি। যেদিকটাই না দেখিব, সেদিকটাই আটকে থাকিবে। সব ফাঁকি মারিতে ওস্তাদ। বিড়ি খাইতে উঠেও বাবুরা সিকি পোর বেলা পার করিয়া দেয়। দেখি, হেমুকে বলিব। ও যদি যায় তাহলে কিছু মাছ পাঠাইয়া দিব। সাথে কিছু লাউ’ও দিব। রান্না ঘরের চালে হইয়াছে।
বুধোর এবার বকনা হইয়াছে। দুটো এঁড়ের কোলে বকনা। খুব ভালো গাই। দুধেল গাই। দুধটাও খুব পুরু আর মিষ্টি। ওর গাদরা ভাজা খাইয়া দুইদিন পেটে গরবর দেখা দিইয়াছিল। লোভে লোভে অনেকটা খাইয়া ফেলিয়াছিলায়। বয়স হইতেছে, খাওয়া দাওয়াই সংযম দেখাইতে হইবে। আপনি তো জানেন, বয়সকালে এক সের দুধ দোয়াইতে দোয়াইতেই চুমুকে খাইয়া ফেলিতাম। কিন্তু এখন কী আর তা পারি, সহ্য’ও হয় না। ফুলি, ও পাড়ার সঙ্গীতানুষ্ঠানে গান গেয়ে ফাসট্ হইয়াছে। একটা বড়ো গামলা পাইয়াছে। বেশ শক্তপোক্ত, কানাউঁচু। ওর মা ওতেই এখন গরুর ঘাঁটা রাঁধে।
ও পাড়ার শঙ্কর গয়লার ছেলেটা এবারেও বাঁচিল না। ফুটফুটে ছেলে। গৌড়ের মতো কাঁচা সোনা রঙ। মায়ের রঙ পাইয়াছিল। কিন্তু মায়ের জন্যেই ছেলেটা আঁতুরেই মরিল। সেদিন মাঝ রাতে বৃষ্টি হইয়াছিল। উঠোনের ঠেঙে আঁতুরঘরে জল ঢুকিয়া মা ছেলে দুজেনেই ভিজে চবচবে, বুকে জল বসিয়া গেছিল। এর আগের ছেলেটাও আঁতুরেই লতায় কেটে মরিয়াছিল। আমি বলিয়াছিলাম তখনই, উঠোনে কেন, গোয়ালের এক কোণে আঁতুড় তুলতে পারিস তো। তা কে শোনে করা কথা। সে যাইহোক, আমরা আর কী করিতে পারি। সবই হরির খেলা। বিধির লিখনকে তো আর কেউ খন্ডাইতে পারে না। ভগবান যে কখন কাকে কাছে ডেকে নেন, তা তিনিই জানেন। জিতু বাগদির দ্বিতীয় পক্ষের বউটিও মারা গেল ও মাসে। ওঝা এসেছিল, বলল ওকে যে সে ভূতে নয়, বম্মদত্যিতে পেয়েছে। অনেক ঝাড়াঝুড়ি করল। লঙ্কা পোড়া ধোঁয়ায় ভরে গেছিল ঘর। বেলের ডাল দিয়ে এতো মারল, তবু বম্মদত্যিতা ছেড়ে গেল না। বউটাকে সঙ্গে নিয়েই গেল। আহারে, ছোট ছোট তিনটে ছেলে মেয়ে, আবার আগের পক্ষের দুটো, জিতু যে এখন কী করে। ওকে বলিয়া আসিলাম, তাড়াতাড়ি আর একটা বিয়ে করিইয়া লে। গতকাল খবর পাইলাম, জিতু বিবাহ করিয়াছে।
আপনাকে আর একটা গোপন সংবাদ দিই, দেশে নাকি খবর রটিয়াছে কারা নাকি বিপ্লব আনিতেছে। চিন না রাশিয়া কোথা থেকে। কিন্তু বিপ্লবটা কী, বুঝিতে পারিতেছি না। বিদেশি জিনিস। নিশ্চয় ভালোই হইবে। কতো দাম পড়িবে কে জানে, তাহলে কিছু কিনিয়া লইব। আপনি যদি এই ব্যাপারে কিছু জানিতে পারেন, সত্ত্বর জানাইবেন।
পত্র পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে পূজা আসিয়া যাইবে। তাই বিজয়ার প্রণামটিও সারিয়া লই। চিঠি পাইবা মাত্র কুশল জানাইবেন। আপনার চিঠির প্রতীক্ষায় থাকিব।
পুনশ্চঃ : প্রতিবারের ন্যায় এইবার’ও আপনার শালের দুই টিন উত্তম গুড় রাখিয়া দিবেন। আমি যাইয়া লইয়া আসিব।
No comments:
Post a Comment