দাগ আচ্ছে হ্যাঁয়
সব্যসাচী ঘোষ
ক্ষুধা পৃথিবীর মহার্ঘ্য সত্যগুলোর একটি। যে সত্য জন্ম থেকে পিছু নেয়, আর মৃত্যু অবধি তার আতঙ্ক রয়ে যায়। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতের ভেতরে যে সারসত্য আছে তা সেই ক্ষুধার তীব্রতা এবং ভীতি থেকেই বেড়িয়ে আসা উপলদ্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়। সাহিত্য ও সিনেমাতে ক্ষুধার বিশ্লেষণ নানা ভাবে নানা সময়ে হয়েই চলেছে। ক্ষুধার যাচনা, না পাওয়ার থেকে তৈরি হতাশা, আবার জোর করে ক্ষুধা মেটাবার জন্যে সংঘটিত অপরাধ সবই আমরা বারবার দেখি। পথের পাঁচালির সেই ব্রাক্ষণ। যিনি বাড়ি ছেড়ে যজমানি করছেন আর ছেলে মেয়ে কে নিয়ে অন্নবাড়ন্ত সংসার আগলে বসে আছেন সর্বজয়া। ছিমছাপ এক পাথুরে গ্রাম ছিল বটে রামপুর। সেখানে অজস্র সর্বজয়ার বাস। চাষ করে সারা বছরের পর আনাজ গোলায় তোলার আগেই নিয়ে চলে যেত ডাকাতেরা। শোলে ১৯৭৫, মনে করুন সেখানে ডাকাত দলের প্রাথমিকতম লক্ষ্যটাই ছিল ক্ষুধার নিবৃত্তি।
যে জীবনে একবারও মন্বন্তর দেখে নি। সেও মন্বন্তরের ভয়াবহতা জানতো। এই দুর্ভিক্ষের ভীতি সে তার পরিবারের থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। অভাব বোধ হলেই তাই প্যানিক বাইং করা নিম্নমধ্যবিত্ত তখন থেকেই রপ্ত করে নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার ফলশ্রুতিতে যে অনিবার্য ফ্যান দ্যাও রাস্তায় নেমে আসে সেখান থেকে সামান্য কিছু বছরেই অসামান্য সাহিত্য বেড়িয়ে আসতে থাকে। ঠিক যেভাবে মানুষ শেষ কবে হেসেছিল তার থেকে মানুষ শেষ কবে কেঁদেছিল তা অনেক বেশি ছাপ রেখে যায় একই ভাবে শিল্প কলাতেও মন্বন্তরের চিরস্থায়ী ছাপ এখনও দাগ হয়ে বসে আছে। কিন্তু এই “দাগ আচ্ছে হ্যাঁয়”। আর সেজন্যেই মন্বন্তরের পর আড়াই দশক কেটে গেলেও সত্যজিৎ রায় অশনি সংকেত নির্বাচন করেন। এই সিনেমার ভেতর না ঢুকে শুধু একটা কথা আলাদা ভাবে বলা যায় বিদেশী এক চ্যানেলের ইন্টারভিউতে বসে সত্যজিৎ বলেন, “দুর্ভিক্ষে যখন মানুষ মরছে তখন প্রকৃতি উদার ভাবে নিজেকে সাজিয়ে চলেছে, কি সুন্দর তার সেই সাজ, কি তীব্র বৈপরীত্য। তা ফুটিয়ে তুলতেই আমি অশনি সংকেতকে সাদা কালোর বদলে রঙিন করার সিদ্ধান্ত নিই।” সিনেমার একটি দৃশ্যে কাদার মধ্যে বসে প্রজাপতির আনন্দ মানুষের মৃত্যুতেও প্রকৃতির ডোন্ট কেয়ার মনোভাবকে ফুটিয়ে তোলে। কি ভাবছেন, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, এখনো যখন মানব সভ্যতা করোনা থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় খুঁজতে লম্বা লম্বা লক ডাউন ডেকে দরজায় খিল এঁটে কাঁপছে তখন প্রকৃতি একই ভাবে বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে মজে যাওয়া পুকুর অবধি আবার জাল বিস্তার করছে। সত্যজিৎ এর ভাবনা কি অব্যর্থ ভাবে মিলে গিয়েছে তার এর থেকে ভাল ফলিত উদাহরণ আর কিই বা হতে পারে। তবে ক্ষুধা শুধু প্রকৃতিকে উদার করে না কোথাও কোথাও মানুষকেও বোধহয় করে। গ্রামের স্কুলগুলোতে সপ্তাহে যেদিন ডিম খাওয়ানো হয় সেদিন পকেটে বা ফ্রকের কোটরে সেদ্ধ ডিমটা বাড়ি নিয়ে যায়। কতই বা বয়স থ্রি কিংবা ফোর। সে এখনো রিডিং পড়তে গিয়ে হোঁচট ও বকুনি পালা করে খায় কিন্তু তারপরেও সে ক্ষুধা জানে। ছোট ভাই আর বোনটিকে নিজের না খাওয়া ডিম খাওয়াবার আনন্দ জানে। আর গব্বর সেতো এখনো আসে। সেবারে চালের বস্তা উঠিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল আর এখন কৃষি বিল দিয়ে যেতে এসেছে। কিছু কি বদলেছে, কিছু কি বদলায়!
No comments:
Post a Comment