ছোটগল্প
হাড় হাভাতের দেশ
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
"আরঅ টুকু ভাত দিবেন মেমসাব,পেটে কইসে খিদা। কিছুতেই থিরবির দিছে নাই।" কথাগুলো বলার পর বড় আশা নিয়ে অরিত্রার দিকে তাকিয়েছিল সে। মেমসাবের দয়ার শরীর । কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যেই বদলে গিয়েছিল মুখের মানচিত্র “ এমন হাড় হাভাতে মেয়ে বাপের জন্মে দেখিনি আমি। এতগুলো ভাত কেউ খায় ? ছিঃ ছিঃ ছিঃ লোকে শুনলে বলবে কি ? এইটুকুন একরত্তি মেয়ে। পেট তো নয় যেন সমুদ্র। রাক্ষসের মতো খাই খাই করিস না দিনরাত ।” কথাগুলো শোনার পর হাত আর নড়ছিল না বাসন্তীর । পেটে পোষ না মানা একটা বাঘ ছুটছে। তাকে কান্না দিয়েও আটকাতে পারে না সে । হাড় হাভাতের দেশটা কোথায় ? সে তন্ন তন্ন খুঁজে চলে নিজের ভেতর। পেটের খিদের জন্যই তো সে কাজ করতে এসেছে। রোজ রোজ অপমান গিলতে গিলতেও আজকের কথাটা আঁতে লেগে যায় তার ।ফ্রকের আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে থালা ছেড়ে দ্রুত উঠে যায় সে।কলতলায় এসে জলের সাথে মিশিয়ে দেয় কান্না। খিদে কি খুব বেশি তার? সারাদিন খাটাখাটুনি আর অভাবের গর্তে বড় হতে হতে পেটের গাভাটা একটু বড় । লোভ নয়, লালসা নয়। চাহিদা। যে উনুন যত বেশি জ্বলে , যত বেশি তাগদ দেয়, জান লড়িয়ে কাজ কাম করে, সে তো বেশি কাঠ খাবেই। গাঁ ঘরের বিটিছেলে এভাবেই বেড়ে উঠে। মা বলত- "খা বাসন্তী খা, বিটিছিলা পরের ঘরে যাইয়ে কত কাজ কইরতে হবেক, ভিতট মজবুত রাখ।" সেই মা এখন চিররুগী। ঘরের এককোণে পড়ে থাকে। কপালের ফের তার বাবা ভৈরবের ।ডাক্তার কোবরেজ, হাসপাতাল করতে গিয়ে ধানী জমি গেল পাঁচ বিঘা। গোরু বাছর ছাগল ভেড়া হাঁস মুরগি কিছুই বাকি থাকল না।সব বিক্রি হয়ে গেল। তাবিজ কবচ ঝাড়ফুক জলপড়া থেকে আরম্ভ করে শিব থানে মানত কিছুই বাদ রাখেনি ওর বাবা ভৈরব। কিন্তু যা হবার নয়, যা শিবেরও অসাধ্যি তাই হল। চিররুগি হয়ে গেল তার মা। সাত সাতটা পেটের খোরাক জোগাতে তখন হিমসিম খাচ্ছে তার বাপ। ফলে গাঁ ঘর ইসকুল সবই ছাড়তে হল বাসন্তীকে। ফাইফরমাস খাটার একটা কাজ পেয়ে শহরে চলে আসে বাসন্তী। খরা মরার দেশ তার গাঁ। । মাটি চুয়ালেও জল নেই। সেই শক্ত মাটি চিরে চাষ করত বাপ। ফসল তুলত। এক কণা ধান একবিন্দু রকত। তবু বাপ বলত - প্যাট ভইরে খা। প্যাটই ধম্ম। প্যাটই ভগবান।
এসব কথা কতদিন আগের। তবু উকুনের মতো চিটে আছে তার স্মৃতিতে।সে তুলতে পারে না মাথা থেকে, দুটো নখের মাঝে চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে পারে না আঁতে লাগা কথার জ্বলন। মাঝেমাঝে নিলয়পুর গায়ের জন্য তার মনখারাপ করে। ঝুমরি নদী তাকে ইশারায় ডাকে। সে আনমনে কাশবনের সরু আলপথে বাইদ বহাল পেরিয়ে চলে যায় বহুদুর পথ। সেই নদী আর কাশবনের গল্পে গল্পে তার বড় হয়ে ওঠা।তখন তার খিদে শুধু পেটে নয় চোখেও। কত কিছু দেখার আছে দুনিয়ায়। গায়ের মাটি, কলমকাঠি চালের ভাত এত হিসেব শেখায়নি তাকে । শহর তাকে অনেককিছু শেখাল। পেট খুলে কথা না বলতে। দাঁত দিয়ে উঠালপাথাল মনটাকে চাপা দিতে। আর বানিয়ে বানিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিজেকে বেলুন বানিয়ে নিতে। শুধু পেটের খিদে নয় সে তার অবাক হওয়ার খিদেটাকে একটু করে মেরে ফেলল ।একটু একটু করে মেরে ফেলল মাটি জল আর হাওয়ার শুশ্রুষায় বেড়ে ওঠা ভালোবাসার গন্ধটাকে।
তবু কথায় কথায় নিলয়পুরের কথা বেরিয়ে আসত তার পেট থেকে। এমন গাঁ তো আর দ্বিতীয় কোথাও নেই। বুকের মধ্যে তোলপাড় খায় সেই সব দিন। রুখা মাঠের পাথুরে মাটি চুম্বকের মতো টানে।
মেমসাব বলেছিল- "খুব ত গাঁ গাঁ করিস। কী আছে তোদের গাঁয়ে একবারটি দেখাতে পারিস। দেখতাম।"
কী যে আছে সে কি বলে বোঝানো যায়। মনের ভেতর উথালপাথাল সে কি শব্দের জমিতে ফুটে ওঠে ? হাড়হাভাতের এক দেশ। নেই নেই কিছুই নেই। শুধু খিদে আছে পেট জুড়ে বুক জুড়ে পেট জুড়ে চোখ জুড়ে।
" আপনি যাবেন মেমসাব?" ঠিক জিজ্ঞাসা নয় বিস্ময় মাখা এক ঘোরের ভেতর কথাগুলো বলে বাসন্তী। " দেইখবেন ঝুমরি লদী কেমন খিদায় লিশট হইয়ে আছে। তার বুকে জল নাই শুধু বালি। সেই বালিতে যে কী আছে আপনি দেইখতে পাবেন নাই। কিন্তুক আমি জানি। "
"যাব না তো কি এমনি এমনি বলছি।"
"তাহলে সামনে মাসেই চলেন আমার সঙ্গেই।"
"সামনের মাসে নয়। তুই যখন তোদের ভাদু পরবে ঘর যাবি লম্বা ছুটি নিয়ে। তখন তোকে জানিয়েই একদিন হুট করে চলে যাব তোদের গাঁয়ে। ছেলেমেয়ে দুটোর বড় ইচ্ছে গ্রাম দেখার।"
কথাগুলোকে সত্যি বলে ভাবেনি বাসন্তী । এরকম কত খেয়ালই তো মানুষের হয়। চৈত্রের শিমূল তুলোর মতো তা আবার উড়েও যায়।হারিয়ে যা।
কিন্তু অরিত্রা মেমসাবের কথাগুলো যে মিথ্যে নয়। তা আজ বুঝল বাসন্তী।
মেমসাব জানিয়েছে আল্লাদপুর স্টেশনে নেমে ঠিক চলে যাব তোদের গাঁয়ে। বাসন্তীর ঘুম হয়নি কাল সারারাত। ভাদুর জাগরণ গেছে পরশু । কালও সে জেগে থেকেছে নিদ্রাহীন। সাহেব মেমসাব পিউ পল ঠিক পারবে তো স্টেশনে নেমে এখানে আসতে। মাঝে যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলে। এ এক ভুলভুলাইয়ার দেশ। বুল্যানার দেশ। ওর বাবা ভৈরব কতবার ওকে আশ্বস্ত করেছে," উয়ারা নিজেরাই আইসতে পাইরবেক বইলেছে, তাছাড়া ইস্টিশানে টোটো রিক্সার অভাব নাই। তুই আনখাই এত ভাবিস না ত।"
"তা বটে, কিন্তুক উয়ারা ত আনাড়ি লক, যদি ভুলভাল রাস্তা ধইরে ফেলে।"
"ইখেনের রাস্তা সজা সরল রে বাসন্তী, কনহ গোলকধাঁধা নাই।"
শুকনো ডালপালা ভেঙে জ্বালানির বন্দোবস্ত করে রেখেছে ওর দিদি জয়ন্তী । বাসন্তীর মা শুয়ে বসেই কাজের তদারকি করে।
মেঘ ঘুরছে আশমানে। সবাই জানে এখানে মেঘ আসে ফিরে যায়। বুল্যানার দেশ। আজ রোদ ওঠেনি তেমন। বেলার আন্দাজ করা কঠিন। বাসন্তী জিজ্ঞেস করল, বাবা কটা বাইজবেক এখন?
জয়ন্তীর একটা মোবাইল আছে। তা থেকে সময় দেখে নেওয়া যেত । কিন্তু তা এখন থেকেও না থাকা। ট্রান্সফর্মার খারাপ হওয়ার কদিন ধরেই গাঁয়ে বিজলি নেই। মোবাইলে চাজ নেই।
ভৈরব বলল- কটা আর হবেক, বড়জোর সাতটা, দুয়ারে দাঁড়াই এই ত চুনু খুড়াকে ডি এম ইউ ধইরতে যাইত্যে দেইখলম।
তারমানে, বেলা এখন তেমন কুছু হয় নাই। সাড়ে দশটায় টেরেন, এখনঅ ঢের দেরি।
পদ্মবাঁধের ধারে বাসন্তীদের অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া ঘর।বছর খানেক আগেও মাটির দেওয়াল ছিল, টিনের টেপা তালা ঝুলত কপাটে । একটু একটু করে রক্ত দিয়ে ঘরটা বানিয়েছে ভৈরব। মাথায় করে ইট বয়ে এনেছে । রঙচঙ লেগে সেই ঘরটা এখন একদম নতুন। চারদিকে মাটির পগার । ফলে এখন আর ইচ্ছে করলেও বাঁধটাকে দেখা যায় না। দেখেই কী হত । নামেই পদ্মবাঁধ। ঘটি ডোবে না। আঁজির তলে একটা খাটিয়ায় বসে ভৈরব একদৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে পাখি দেখছিল। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে বাসন্তীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল- উয়ারা কজন আইসবেক রে।
চাইরজন। সোয়ামী ইস্তিরি আর দুটা বেটা বিটি।
উনুনে জ্বাল দিতে দিতে জয়ন্তী বলল- চাইরজন।
হঁ দিদি ছুটু ছিলাটরই ত বেশি হুচুক। দিদি তুমাদের গাঁ দেইখব, নাইলে দিদিমনি ত কবেই ভুইলে গেইছিল কথাগুলান।
মার্ডগার্ড খোলা সাইকেলটা আঁজির গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। ছেঁড়া কাপড় দিয়ে সেটা মুছতে মুছতে ভৈরব বলল - "চায়ের জল বসা টুকু জয়ন্তী । টুকু চা খাইয়ে হাঁট ঘুইরে আসি।"
"কী আইনবে বাজার লে ?"
টুকু মাংসই আইনব। কপাটে টাঙানো জামাটা হাতে নিয়ে ভৈরব চকিতে জবাব দেয়।
সে ত টের দাম তার লে ঘরে একট হাঁস আছে...
চোখ ছল ছল করে ভৈরবের " উট থাক মানুষের সংসার সবাইকে লিয়েই
এগারোটা লোক, বুইঝে শুইন্যে আইনবে।
অঙ্ক না জানা ভৈরব মনে মনে হিসেব করে সংসারের গণিত। এগারো দুগুণে এক কুড়ি দুই। পুরোপুরি দু কেজি কিনলে আড়াইশো টাকা চলে যাবে এক ঝটকায়। গত বছর ধান হয়নি তেমন, ঘরটার পিছনেও গেছে অনেক টাকা, একটা নতুন হেত্যার কিনতে হয়েছে তাকে। একজন ভৈরব এইসব ভাবে, আরেক ভৈরব ভাবে এই পেত্থম আসছে মানুষগুলা, তারা কুটুম তারা আত্মীয়, এই গাঁ গঞ্জ দেখার জন্য তারা আসছে, তাদের যেন অসম্মান না হয়। এ তার ইজ্জতের সওয়াল।
চায়ের কাপটা নামিয়ে মন্দিরতলা হাটের দিকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভৈরব। পাঁচ বিঘা জমি চলে যাওয়ার পর হাতে আর মাত্তর বিঘা পাঁচেক জমি আছে তার। কিন্তু এখন যা অবস্থা চাষে তেমন আয় উপায় নেই। ধার দেনা করে আর সারা বছর মেহনত করে ঘসটাতে ঘসটাতে কোন রকমে সংসারটা চলে যায়। ফি বছরই শোনা যায় চাষীদের আত্মহত্যার খবর। গলায় দড়ি নিয়ে ঝুলতে ঝুলতে কোথায় চলে যায় তারা। ব্যস এটুকুই, কিন্তু এর বেশি কেউ আর ভাবে না। কষ্ট হয় বাসন্তীটার জন্য।জলকাদায় বড় হওয়া মেয়েটা বাপের পাশে দাড়ানোর জন্যই বাবুদের বাড়ির কাজ করে। ইচ্ছে ছিল না ভৈরবের, বলেছিল দরকার হলে একবেলা আধপেটা খাব, কিন্তুক… মেয়ে শোনেনি। বলেছে "যে করেই হোক ঐ পাঁচ বিঘা জমি আবার ফিরত আইনতে হবেক বাবা।" অনেক ভেবেচিন্তে ভৈরব শেষ তক্ক সায় দিয়েছে। তবে বলেছে মাথা উঁচু রাখবি মা, নিজের মজুরিটুকু ছাড়া আর কনহকিছু লিয়ে লোভ করবিস নাই।আমরা রুখা দেশের লক বটি কিন্তুক শিরদাঁড়া সজা। নিজের ঘাম ঝরানো টাকা, বাসন্তী সেটুকু চাইতেও ভুলে যায় মাঝে মাঝে।
সাতপাঁচ ভেবে আড়াই কেজি মাংসই কিনে ফেলল ভৈরব। এতগুলো লোক খাক না সবাই একটু পেট ভরে। এই আনন্দের দিন জীবনে ত খুব বেশি আসে না।এসব বলতে বলতে মেয়েদের দিকে তাকায় ভৈরব- লে, হাত লাগ। টুকু মশলাপাতি বাঁইটে দে, রান্নাট আইজ আমিই করি। বাসন্তী জয়ন্তীর সাথে হাত মেলায় ছোট ছোট দুটো বোন আর লখাই ।
আনন্দের হাসিতে খুশির আলোয় ভরে যায় সারা ঘর। মাংসের গন্ধে মইমাড়ান হয়ে গেছে বাতাস।
"বাসন্তী, টুকু ছামুবাগে ভাইলে দেখ, বেলা ত ঢের হইল। "বাপের তাগাদায় রাস্তার দিকে নজর ঘোরায় বাসন্তী।
তখনই একটা টোটো এসে দাঁড়ায় ঘরের সামনে। চারজন নেমে আসে। বাসন্তী শুধোয় ঘর চিনতে কনহ অসুবিস্তা হয় নাই ত?
"না, না এই তো সোজা রাস্তা" অরিত্রার সহজ উত্তর শুনে উৎকন্ঠা কেটে যায় বাসন্তীর।
ভেরি সুইট ইয়োর ভিলেজ বাসন্তীদি, চারদিক দেখতে দেখতে এলাম। সামনের নদীটার কী যেন নাম ?
ঝুমরি নদী।
চা টিফিন খেয়ে ওরা আনন্দে বেরিয়ে পড়ে গ্রাম দেখতে। ওদের সাথে বাসন্তী আর জয়ন্তী দুই বোন। পাহাড় টিলা থেকে সার সার মেঘ নামছে। যেন এখনই ভিজিয়ে দেবে সবাইকে। কিন্তু বাসন্তী জানে জল হবে না তেমন । ঝিটেফোঁটা ছাগল ভিড়কানো শান্তিবারি। এই ভরা বর্ষাতেও ঝুমরি নদী কেমন উপোসী মোষের মতো একপাশে পড়ে আছে। শুনশান পথ। তবু কোন ভয়ডর নেই ওদের। নদী পেরিয়ে একটা ভাঙা মন্দিরের সামনে এসে থামল ওরা। অনেক পুরানো মন্দির । কী দেখার আছে এই গাঁয়ে। মরা শরীরে ভাঙা হাড়ের কঙ্কাল। যারা শিকড়ের গভীরে ডুবে আছে তারা ছাড়া বাইরের কেউ দেখতে পাবে না এই ক্ষুধার্ত দেহের লাবণ্য।
"এখানে ভূত আছে ? " পিউ প্রশ্ন করল বাসন্তীকে।
থাইকতেই পারে।
পরীর মতো দেখতে মেয়েটিও কেমন চুপসে গেছে ভয়ে।
রাতের বেলি ইখানে কেউ আসে না। কতজনকে দেইখেছে তাকে। সেই লোকটাকে ?
গা ছমছম করে ওঠে সবার। চুপচাপ থেমে যায় ঘরটির কাছে। রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে থাকে ভাঙা দরজার দিকে- কোন লোক? কে যেন ভয়ে ভয়ে প্রশ্নটা করল।
বাসন্তী বলে যায় সেই গল্পটা। ছাগল চরাতে যখন সে এদিকে আসত তখন লোক মুখে শোনা সেই গল্পটা আজ এতদিন পর আবার বেঁচে উঠল তার গলায়। সেবার আকাল। ধান হয়নি তেমন । রাজা তবু খাজনা মকুব করবে না কিছুতেই। কম খাজনাও নেবে না। লোকটা কিছুতেই রাজাকে খাজনা দেবে না। একদিন রাজার লোকেরা এসে জোর করে তার খামার থেকে তুলে নিয়ে যায় ধান। চার চারটি ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাবে লোকটা। খিদেতে ছটফট করছে, খাবার নেই। রাজার লোকেরা জোর করে নিয়ে গেছে সব ধান। কী করবে লোকটা? খিদেতে ধুকতে ধুকতে সবার মরণ দেখবে ? লোকটা জল খেয়ে কাটাল দুদিন। তারপর অন্ধকার রাতে এসে দাঁড়াল এই মন্দিরের চাতালে। তারপর গলায় দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়ল মন্দিরের এক কোণে। তখন থেকে এই মন্দিরে আর কেউ আসে না। লোকটা নাকি এখনও ঘুরে বেড়ায় এখানে। কেউ এলেই লোকটা ভাঙা সানকি নিয়ে সামনে দাঁড়ায় – টুকু ভাত দিবে গ বাবু , টুকু মাড়জল।
এর কোন ভিত্তি নেই বাসন্তী জানে। তবু হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো গল্পটাকে আজ এভাবেই বলল সে। রাজা রাজড়া নেই। রাজপাট নেই। তবু এই খরামরার দেশে গল্পটা বেঁচে আছে।যেমনভাবে বেচে আছে মানুষের খিদে। যেমনভাবে গলায় দড়ি ঝুলে পড়ছে আজও কত চাষী।
আর দেরি করা ঠিক হবে না। আড়াইটে বাজে। ক্লান্ত শরীরে খিদের ঘন্টা বাজছে। ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে নিলয়পুরের মানচিত্রে আবার ঢুকে পড়ল ওরা। থমথমে গল্পটা পড়ে রইল পিছনে।
বাতাসে গন্ধ ভাসছে।
কীসের গন্ধ গো ? অরিত্রা মেমসাবের প্রশ্নে ঘুরে তাকায় বাসন্তী- গোবরের। বেশ যত্ন কইরে মা আইজ মাড়ুলি দিয়েছে সারা উঠান। গবুর লেপা আঙিনায় আইজ নবান পরব।
উঠোনে সুন্দর করে পাতা হয়েছে মাদুর। এখন মেঘ নেই, রোদ্দুর নেই তেমন। গাছের ছায়ায় শান্ত হয়ে আছে চারপাশ। একটা বেনেবউ পাখি তাকিয়ে আছে নতুন মানুষজনের দিকে। নিজের সাংকেতিক ভাষায় কিছু বলছে, কেউ তা বুঝতে পারছে না। জয়ন্তীর ছোট ভাই লখাই, পাঁচ বছর বয়স ওর। দশ মিনিট আগেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মাংসের ঝোলের দিকে। কতদিন কতদিন এ বাড়িতে মাংস রান্না হয়নি। সকাল থেকে অধীর আগ্রহে বাটি নিয়ে বারবার বাবার কাছে গেছে আর শুনেছে, টুকু সবুর কর, বাবুদের খাওয়া হোক। সবুর করতে করতে করতে সে এখন ঘুমিয়ে গেছে।খিদে নয় এক সপুনের দেশ তার হাতের মুঠোয় ।
" সবাই মিলে একসাথে খাওয়া যাক, তোমরাও বসো আমাদের সাথে।" পরীর মতো বাচ্চা মেয়েটি আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। যেন সে আজ পিকিনিকে এসেছে এখানে।
"আমরা টুকু পরেই খাব, তুমাদের খাওয়া হইলে…" ভৈরব জানে বাবুদের সাথে বসে খাওয়া যায় না।বড় লাজ লাগে, শরম লাগে। কোনমতেই এই আড়ষ্টতা অতিক্রম করতে পারে না সে । হয়তো চায় না বলেই।
খাওয়া শেষ হতেই ট্রেন ধরার তোড়জোড় শুরু হয় ওদের। অরিত্রা মেমসাব তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ব্যাগ থেকে ঢাউস সাইজের টিফিন বাটি বের করে – মাংসটা বড় সুন্দর রান্না হয়েছে। এখনও জিভে লেগে আছে তার স্বাদ। রাতের খাবার এই বাটিতেই সাজিয়ে দাও ভৈরবদা। একটু বেশি করে দিও। আজ সারাদিন যা ধকল গেছে রাতে আর খাটাখাটুনি করতে পারব না।
ভৈরব যত্নে সাজিয়ে দেয় বাটি। ভরে দেয় গ্রামগন্ধ।
টোটো এগিয়ে যেতে থাকে স্টেশনের দিকে। ভৈরব হাসিমুখে বলে, আবার আইসবেন আপনারা , বাসন্তীর যাইতে দিন দুই দেরি হবেক কিছু মনে কইরবেন নাই।
পেট ভর্তি খিদে নিয়ে বাসন্তী দেখে ডাল নেই, তরকারী নেই, তা না থাক, মাংস দিয়ে শুধু ভাতই খাওয়া যাবে এক পেট । এতে আর এমন ক্ষতি কী ।মাংসের হাঁড়ি কাত করতে গিয়ে চমকে উঠে বাসন্তী, খরায় পুড়া মাঠের মতন ফাকা হাঁড়ি, জল নাই ঝুমরি লদীর পারা শুখা। কুথাও কিছু নেই।হাড়গোড় বা টুকু ঝোলও নাই।
সে চেচিয়ে উঠে – বাবা
ভৈরব হাড়িটা উপুড় করে দেয় উঠোনে, আড়াই কেজি মাংস একটা হাড় শুদ্ধা নাই।চারজনে যা খাইল, যেন কতদিন খায় নাই উয়ারা। খাক । মানুষ খাইল্যে বড় পুন্যি হয় ।
"আমি আর উঠেনে কাজ কইরতে নাই যাব বাবা "
চমকে উঠে ভৈরব- কেনে ?
বাসন্তীর চোখ থেকে নেমে আসে আশ্বিনের মেঘ। ঝম ঝম বৃষ্টিতে ভরে যায় মাঠ প্রান্তর। ঝুমরি নদী ভরে উঠে কানায় কানায়।
ই মাটি রুখা লয়। ইয়ার লেও রুখা দ্যাশ দুনিয়ায় আছে...
No comments:
Post a Comment