শব্দ কবিতা, নিঃশব্দ কবিতা
অনিন্দ্য রায়
কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে, হ্যাঁ, শব্দ দিয়েই তো । কিন্তু ‘শব্দ’ কী ?
শব্দ। এর যে অর্থগুলো আমরা পাই বাংলা অভিধানে
১ শব্দকরণ, ধ্বনি, রব, নিঃস্বন, নাদ
২ শ্রোতোগ্রাহ্য আকাশগুন
৩ কণ্ঠস্বর
৪ কলকল
৫ সার্থকবর্ণসমূহ, বাক্
৬ (ব্যাকরণে) বিভক্তিহীন পদ; প্রতিপদিক
৭ শব্দশাস্ত্র, ব্যাকরণ
৮ ভাষা
৯ (ন্যায়ে) আপ্তোপদেশ, আপ্তবাক্য
১০ উপাধি, নাম, সংজ্ঞা
১১ নামমাত্র
১২ প্রচার, প্রসার, ঘোষণা
১৩ কথা, বিষয়
হ্যাঁ, শব্দের প্রথম অর্থটি – ধ্বনি, Sound; আবার ব্যাকরণে অর্থযুক্ত ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ (Word ) বলে । কিন্তু ধ্বনির কি অর্থ হয় ?
ভাষাতাত্ত্বিক Ferdinand de Saussure চিহ্নের অযৌক্তিক চরিত্রের ( arbitrary nature of signs ) কথা বলেছেন যেখানে signifier ও signified-এর মধ্যে যুক্তিসিদ্ধ সম্পর্ক নেই, মানুষের ভাষাতে ধ্বনি ও অর্থের মধ্যের সম্পর্ক, তাঁর মতে arbitrary । অথচ ভাষাকে ভাঙতে ভাঙতে বাক্য, শব্দ পেরিয়ে আমরা পোঁছই আদিতম একক ধ্বনিতে, সে ধ্বনিই তো শব্দই যা দিয়ে কবিতা লেখা হয়, যা কবিতার বুনিয়াদি একক। আমাদের চারপাশে যেসব শব্দ হয়, যেসব আওয়াজ হয় – সবই কি ভাষার যুক্তিকাঠামোয় খাপ খেয়ে যায় ? না কি?
ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম দ্রাম,শুনে লাগে খটকা–
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্কা!
শাঁই শাঁই পন্ পন্, ভয়ে কান বন্ধ–
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?
হুড়মুড় ধুপধাপ–ওকি শুনি ভাইরে!
দেখ্ছনা হিম পড়ে– যেও নাকো বাইরে।
চুপ চুপ ঐ শোন্! ঝুপ ঝাপ্ ঝপা-স!
চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? গব্ গব্ গবা-স!
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশ্ ঘ্যাঁচ্ ঘ্যাঁচ্, রাত কাটে ঐরে!
দুড়দাড় চুরমার–ঘুম ভাঙে কই রে!
ঘর্ঘর ভন্ ভন্ ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচ শোন্–ধেই ধেই ধিন্তা!
ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজেরে–
ফট্ ফট্ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে!
(শব্দকল্পদ্রুম / সুকুমার রায়)
শব্দকল্পদ্রুম একটি সংস্কৃত অভিধান। রাধাকান্ত দেব অভিধানটি সংকলন করেন এবং করুণাসিন্ধু বিদ্যানিধি সম্পাদনা করেন । ১৮০৩ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছরে আটটি খন্ডে এই অভিধানটি প্রকাশিত হয়। শোনা যায় যে, সংস্কৃত ভাষায় এমন কোন শব্দ নেই যার অর্থ এই বইতে নেই ।
এমন কোনো শব্দ কি আছে যার গায়ে অর্থের জামা নেই? অথচ ঐ জামা খুলে আমরা কি দেখতে চাইব না তার প্রকৃত
শরীর ?
আমরা তো বলি,’ অর্থই অনর্থের মূল’, শব্দ ও তার অর্থের মধ্যের সম্পর্কের স্বতঃসিদ্ধ কিনা তা নিয়ে আমরা অবিশ্বাসী হয়ে উঠছি । আমাদের কবিতাকেও ভাষার আদিতে, ধ্বনিতে উপনীত করতে চাইছি ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার বীভৎসতা, ধ্বংসময়তা ও হহাকার নিয়ে সেইসময়ের মানবসভ্যতাকে টুকরো টুকরো করল, টুকরো করল মানুষের চিন্তাচেতনাকে। ধ্রুপদীতত্ত্বের মৃত্যু হল। শিল্প ও সাহিত্যে একের পর এক নতুন ইজম, নতুন আন্দোলন উঠে এল ।
১৯১৬ সালে Hugo Ball তৈরি করলেন Dada Manifesto, ‘Dada’ ? কোত্থেকে এল শব্দটি ? ফরাসি অভিধানে এর মানে বাচ্চাদের খেলনা ঘোড়া। অনেকে বলেন আস্ট্রিয়ান শিল্পী Richard Huelsenbeck একটি ছুরি অভিধানে একটি শব্দে এলোপাথাড়ি গেঁথে দেন, সেই শব্দটি Dada আর এভাবেই এই অন্দোলনের নামকরণ । কারু কারু মতে এটি মানবশিশুর প্রথম উচারিত শব্দ, আবার কারু মতে এর প্রকৃত কোনো অর্থই নেই যা এই আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য অর্থহীনতারই সমার্থক।
১৯১৬-তেই Hugo Ball লিখলেন Karawane কবিতাটি
jolifanto bambla o falli bambla
großiga m’pfa habla horem
egiga goramen
higo bloiko russula huju
hollaka hollala
anlogo bung
blago bung blago bung
bosso fataka
ü üü ü
schampa wulla wussa olobo
hej tatta gorem
eschige zunbada
wulubu ssubudu uluwu ssubudu
–umf
kusa gauma
ba–umf
অর্থহীন, ননসেন্স শব্দ দিয়ে লেখা একটি কবিতা, যার কোনো মানে নেই অথবা মানেহীনতাই এর মানে । তৈরি হল sound poetry, শব্দকবিতা, ধ্বনিকবিতার ধারা ।
যদিও এর ইতিহাস আরেকটু পুরোনো। মৌখিক কবিতাচর্চায়, সঙ্গীতে এরকম আপাত অর্থহীন ধ্বনির ব্যবহার আমরা আগেই পেয়েছি। জার্মান কবি Christian Morgenstern-এর ১৯০৫-এ Das Große Lalulá কবিতাটি আমরা এর উদাহরণ পাই।
ইতালির ফিউচারিজম আন্দোলনের অন্যতম কবি Filippo Tommaso Marinetti যুদ্ধক্ষেত্রে নানান আওয়াজের ভেতর উপলব্ধি করেন যে, শুধুমাত্র ধ্বন্যাত্মক শব্দ ব্যবহার করেই যুদ্ধের আবহ কবিতায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব, শুধুমাত্র তা দিয়েই কবিতা লেখা সম্ভব । সেই যুদ্ধকালীন ধ্বনিপ্রবাহেই ১৯৩৪ সালে তিনি লেখেন Zang Tumb Tumb কবিতাটি।
১৯১৮-তে Tristan Tzaraআরেকটি ইস্তেহার লেখেন দাদাইজমের এবং তা হুগো বলের ইস্তেহারটির থেকে ভিন্ন। ত্রিস্তান জারার কবিতাতেও শব্দের অর্থহীনতার ঝোঁক দেখি আমরা। কংক্রিট কবিতার অন্যতম নাম ফরাসি কবি Henri Chopin( অঁরি শঁপা ), তাঁর কবিতাতেও সাউন্ড কবিতার দেখা পাই আমরা। বিভিন্ন দেশের লেখম-শিল্পীদের রচনায় এর প্রকাশ নজরে আসে । নিউইয়র্কবাসী জার্মান Elsa von Freytag-Loringhoven, অস্ট্রিয়ান Raoul Hausmann, জার্মান Kurt Hermann Eduard Karl Julius Schwitter-র নাম উল্লেখযোগ্য।
Bruce Lansky নিয়ে নিবন্ধে এর উদাহরণ দিতে গিয়ে এই কবিতাটি লেখেন রেলপথের পরিমণ্ডলে ।
Choo Choo
Chuga-chuga, chuga-chuga, chuga-chuga, chuga-chuga, chug.
Choo Choo!
When I hear a choo choo train I think of all the many things that I
should do
সাউন্ড পোয়েট্রিরও নানা উপবিভাগ Bruitist poem ঃ Richard Huelsenbeckএর পথ ধরে ধ্বন্যাত্মক কবিতা, Simultaneous poem ঃ Tristan Tzara-র পথ ধরে এমন কবিতা যা বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ছন্দকাঠামোয় পড়া যাবে। দাদাইস্টের একটা প্রবণতা ছিল শিশুর সারল্যে পৌঁছনোর ।
.
শিশুর উচ্চারণের শব্দগুলিতে অর্থের প্রলেপ লেগে থাকে না, সেগুলি এলিমেন্টাল ধ্বনি। আর শিশুর সাথে কথা বলতে আমরাও এরকম অনেক শব্দ বলি যেগুলির আওয়াজ নেই।
মহারাজ, আমি তোমার সেই পুরনো বালক ভৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? তোমার বুকে হোঁচট পথে
চাঁদের আলোয় মোট বয়েছি, বেতের মতো গান সয়েছি
দু’হাত নিচে, পা শূন্যে- আমার সেই উদোম নৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ,
চাঁদের আলোয়?
মহারাজ, আমি তোমার চোখের জলে মাছ ধরেছি
মাছ না মাছি কাঁকরগাছি একলা শুয়েও বেঁচে তা আছি
ইষ্টকুটুম টাকডুমাডুম, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!
অমন তোমার ভালোবাসা, আমার বুকে পাখির বাসা
মহারাজ, তোমার গালে আমি গোলাপ গাছ পুঁতেছি-
প্রাণঠনাঠন ঝাড়লন্ঠন, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!
মহারাজ, মা-বাপ তুমি, যত ইচ্ছে বকো মারো
মুঠো ভরা হাওয়ার হাওয়া, তো কেবল তুমিই পারো।
আমি তোমায় চিম্টি কাটি, মুখে দিই দুধের বাটি
চোখ থেকে চোখ পড়ে যায়, কোমরে সুড়সুড়ি পায়
তুমি খাও এঁটো থুতু, আমি তোমার রক্ত চাটি
বিলিবিলি খান্ডাগুলু, বুম্ চাক ডবাং ডুলু
হুড়মুড় তা ধিন্ না উসুখুস সাকিনা খিনা
মহারাজ, মনে পড়ে না?
( মহারাজ, আমি তোমার / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )
পুরনো বালক ভৃত্য ভোলাচ্ছে মহারাজকে, মহারাজ নামের শিশুটিকে। বলছে, ‘মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!’ আর ভোলাতে ভোলাতে,’ইষ্টকুটুম টাকডুমাডুম’ ‘বিলিবিলি খান্ডাগুলু, বুম্ চাক ডবাং ডুলু হুড়মুড় তা ধিন্ না উসুখুস সাকিনা খিনা’- এই সব শব্দ করছে যা অর্থহীনতার সারল্যে শিশুটির সাথে কমউনিকেশন সরল করছে ।
আমাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই ধ্বনি দিয়ে তৈরি, শব্দ থেকে প্রচলিত অর্থে না গিয়ে উৎসে, সেই জায়মান ধ্বনি-আয়নে পৌঁছতে পারেন কবি। তাঁর কবিতাও প্রচলের পথ ছেড়ে ‘নতুন’ হয়ে ওঠে।
গোধূলি কার গোধূলিকার
হাসলে কিছুদিন বরোজ সবুজ কিছুদিন
পান-ই-পান্না
মনে হবে শ্বাস ফেলছে অবন-পাখিরা ।
অস্থানে মনে নেই শোয়ার কুঁজে সারারাত উট ভরা লাই
দুর্গেই ছিল চূড়ান্ত নীপবন
সেও কার দুলকারি কে জানতো কার এত
লয় ঝাড়া সুর
সেও এম্নি নাশের বুকে এম্নি পাতি
পটে বসলেই রটে যাচ্ছিল আদিগন্ত লিখিত
লু-থর
ভাঙা ভাঙা কাহিনীকত্থকে প্লাশই ডাকছে রাজপুত পলাশকে
...
( ও পলাশ / স্বপন রায় )
ধ্বনির যে সঙ্গীতময়তা, মার্গসঙ্গীতে, তালবাদ্যে, নৃত্যবোলে ধ্বনির যে পরম অবস্থান তাও ছুঁয়ে থাকেন কখনো ।
ভোজালির ভিল্লিতে চাপছে ভাবিনীর ভিন...
দুটো ঢং বালিশে সাজানো
শিশিরের ভোট নিয়ে সাতাশে হারালো
লিনায় পরালে
পারমাণবিক কোকুনে বিভ্রাট তুলে কোকিলা হেঁটে গেল ল্যাম্পের খোঁজে
পুরুষের স্বাভাবিক সুইচ
লটারি পেরোনো
বোতামে ডাম্প দেখ আড়াইশো বছরের...
দোদুম ফেনে ওঠো
নিঝুম
আফিম
ক্যাম্পাসে দোলো ঘোমটার আলে...
অলিতে গলিতে
ধা-নি-সা-গা
নি-সা
নি-সা,
মা-ধা-নি
গ্লাসে গ্লাসে ঐরাবত ঠেলে
আমার নিদ লেগে গেল
‘দাদা আমাকে প্রিয়াতে ঠেলে দিন’...
ঢলে যাক
মেহেদির লজ
হিবিস ভোলানো,
রুণা কপ্চানো
পা-নি
পা-নি
নোনাদের ভ্রূণ
ফুলমুন সধবারা নিয়ে গেল রূপ থুড়ি কলোনির ঘুম
আমাকে লম্ফ দাও
চিরুনিরা তল্লাশে ভালো...
এইখানে বসে আছে মরুলাল বাংলার জল,
সা-মা
রে-সা
নি-রে-সা
লক্ষ লক্ষ মীর কোটায় ভূদেশে...
গামলার ঘর
আমাকে তুমি উষ্ণ পড়োনি ?
কী জানি রাম রাম ঝোঁক
সবিনয় রোগ
গা-মা
গা-মা
মনিটর চর্চার দেশ
আমাদের টর্চের খোঁজ নিশায় পোড়েনি,
নিশিও বলেনি
যমালয়ে হাত পাতো বেশ
‘মাগো ! মাগো ! দুটো দাওনা মাগো!’
[ হিং চার চিল (অংশ ) / সব্যসাচী হাজরা ]
কবিতা সাধারণত অর্থের শৃঙ্খলা ধরে এগোয়, এগোয় কবির ভাবনাপথে। কিন্তু যদি তা ধ্বনিকে নির্ভর করে, সেই পথে লিখিত হতে থাকে ।
চাঁদের নাকি পা আছে
চন্দ্রপা শুনে আটকে গেছি
বিশ্বায়ন শুনেছো
শিল্পায়ন
কবিতায় আঁটে না এমন শব্দজ্যাম
যারা মৃত্যু দেখতে পাওনা
যারা উনুনে চাঁদের পা
চন্দ্রভাগা
অভাগা এই গেলো তো সেই গেলো
ক্রাচ দেখলাম
জয়পুর কাঠের পা
প্রজাপতি
এবং ওই তারাটা
প্লেনের চলে যাওয়াও দেখো
ছায়া ফুরনো মানুষটার দুচোখ ভরা
( চাঁদের প্রতি-কবিতা / বারীন ঘোষাল )
এইভাবে ধ্বনির কবিতা লিখিত হতে থাকে, তা শব্দকবিতা ( sound poetry )এবং নিঃশব্দ কবিতা ( non-word poetry)।
কিন্তু শব্দের অর্থ হয় কিনা, সে যে সংস্কারগত, ইতিহাসগত সাংস্কৃতিক অর্থ বহন করে তা খুলে নিজে যে অনর্থ পড়ে থাকে, যোগাযোগ-অসম্ভব যে ভাষার কঙ্কাল পড়ে থাকে তা আমাদের বেঁচে থাকাকেও কি নিষ্প্রাণ করে দেয় না?
তর্ক পেরিয়ে, তত্ত্ব পেরিয়ে সুকুমার রায়ের লেখা দিয়েই বুঝতে চাইব।
তাঁর লেখা নাটক ‘শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম’-এর অন্তিম অংশ ।
গুরুজি । শব্দের ঘাড়ে চিন্তাকে চাপাচ্ছ - ? ছিঃ ! অমন ক’রে শব্দশক্তি ম্লান কোরো না – আমার পূর্ব উপদেশ স্মরণ কর –
শব্দের সঙ্গে তার অর্থের যে একটা সূক্ষ্ণ ভেদাভেদ আছে সাধারণ লোকে সেটা করতে পারে না ।
সকলে । তাদের শব্দজ্ঞান উজ্জ্বল হয়নি –
সকলে । তারা শব্দের রূপটিকে ধরতে জানে না –
গুরুজি । তারা ধরে তার অর্থকে । তারা শব্দের চক্রের আবর্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায় । যেমন কর্মবন্ধন, যেমন মোহবন্ধন, যেমন সংসারবন্ধন, - তেমনি শব্দবন্ধন !
সকলে । শব্দবন্ধনে প’ড়োনা- প’ড়োনা-
গুরুজি । শব্দকে যে অর্থ দিয়ে ভোলায় – সে অর্থপিশাচ । শব্দকে আটকাতে গিয়ে সে নিজেই আটকা পড়ে । নিজেকেও ঠকায়
শব্দকেও বঞ্চিত করে । সে কেমন জানো ? এই মনে কর, তুমি বললে ‘পৃথিবী’ – তার অর্থ কর দেখ দেখি? – সূর্য
নয় চন্দ্র নয় আকাশ নয় পাতাল নয় - সব বাদ – শুধু পৃথিবী ! এরা নয় অরা নয় তারা নয়, এসব কি উচিত ? আবার
যদি বল ‘পৃথিবী গোল’ – তার সঙ্গে অর্থ জুড়ে দেখ দেখি, কি ভয়ানক সংকীর্ণতা ! – পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে তো
বলা হোল ণা – পৃথিবীর উত্তরে কি দক্ষিণে কি, তা বলা হল না – তার তিনভাগ জল একভাগ স্থল, তা বলা হল না –
তবে বলা হল কি ? গোটা পৃথিবীটার সবই ত বাদ গেল ! এটা কি ভালো ?
সকলে । আজ্ঞে না – এটা ত ভালো ঠেকছে না – তাহলে কি করা ্যায় ?
গুরুজি । তাই বলেছিলাম – শব্দের বিষদাঁত যে অর্থ, তাকে আগে ভাঙ । শুধু পৃথিবী নয়, শুধু গোল নয়, শুধু এটা নয়, শুধু ওটা
নয় ; আবার এটাই ওটা, ওটাই সেটা – তাও নয় । তবে কী ? না
[ গৌ গবৌ গবঃ –
হলদে সবুজ ওরাং ওটাং – ইত্যাদি ]
[ বিশ্বকর্মার আবির্ভাব ]
বিশ্বকর্মা । নিঝুম তিমির তীরে শব্দহারা অর্থ আসে ফিরে
কালের বাঁধন টুটে দশদিক কেঁদে উঠে
দশদিকে উড়ে শব্দধূলি উড়ে যায় উড়ে যায় মোক্ষপথ ভুলি –
ভেবেছ কি উদ্ধতের হবে না শাসন ? জাগে নি কি সুপ্ত হুতাশন ?
বিদ্রোহের বাজেনি সানাই ? শব্দ আছে প্রতিশব্দ নাই ?
শব্দমুখে প্রতিলোম শক্তি এসো ফিরে কুণ্ডলীর মুখ যাও ফিরে
শব্দঘন অন্ধকার নিত্যঅর্থভারে নামে বৃষ্টি ধারে
শব্দ যজ্ঞ হবিকুণ্ড অফুরন্ত ধূম এই মারি শব্দকল্পদ্রুম
[ ‘দ্রুম’ শব্দে সশিষ্য গুরুজির স্বর্গ হইতে পতন ]
।। যবনিকা ।।
অনিন্দ্য রায়
কবিতা লেখা হয় শব্দ দিয়ে, হ্যাঁ, শব্দ দিয়েই তো । কিন্তু ‘শব্দ’ কী ?
শব্দ। এর যে অর্থগুলো আমরা পাই বাংলা অভিধানে
১ শব্দকরণ, ধ্বনি, রব, নিঃস্বন, নাদ
২ শ্রোতোগ্রাহ্য আকাশগুন
৩ কণ্ঠস্বর
৪ কলকল
৫ সার্থকবর্ণসমূহ, বাক্
৬ (ব্যাকরণে) বিভক্তিহীন পদ; প্রতিপদিক
৭ শব্দশাস্ত্র, ব্যাকরণ
৮ ভাষা
৯ (ন্যায়ে) আপ্তোপদেশ, আপ্তবাক্য
১০ উপাধি, নাম, সংজ্ঞা
১১ নামমাত্র
১২ প্রচার, প্রসার, ঘোষণা
১৩ কথা, বিষয়
হ্যাঁ, শব্দের প্রথম অর্থটি – ধ্বনি, Sound; আবার ব্যাকরণে অর্থযুক্ত ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ (Word ) বলে । কিন্তু ধ্বনির কি অর্থ হয় ?
ভাষাতাত্ত্বিক Ferdinand de Saussure চিহ্নের অযৌক্তিক চরিত্রের ( arbitrary nature of signs ) কথা বলেছেন যেখানে signifier ও signified-এর মধ্যে যুক্তিসিদ্ধ সম্পর্ক নেই, মানুষের ভাষাতে ধ্বনি ও অর্থের মধ্যের সম্পর্ক, তাঁর মতে arbitrary । অথচ ভাষাকে ভাঙতে ভাঙতে বাক্য, শব্দ পেরিয়ে আমরা পোঁছই আদিতম একক ধ্বনিতে, সে ধ্বনিই তো শব্দই যা দিয়ে কবিতা লেখা হয়, যা কবিতার বুনিয়াদি একক। আমাদের চারপাশে যেসব শব্দ হয়, যেসব আওয়াজ হয় – সবই কি ভাষার যুক্তিকাঠামোয় খাপ খেয়ে যায় ? না কি?
ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম দ্রাম,শুনে লাগে খটকা–
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্কা!
শাঁই শাঁই পন্ পন্, ভয়ে কান বন্ধ–
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?
হুড়মুড় ধুপধাপ–ওকি শুনি ভাইরে!
দেখ্ছনা হিম পড়ে– যেও নাকো বাইরে।
চুপ চুপ ঐ শোন্! ঝুপ ঝাপ্ ঝপা-স!
চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? গব্ গব্ গবা-স!
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশ্ ঘ্যাঁচ্ ঘ্যাঁচ্, রাত কাটে ঐরে!
দুড়দাড় চুরমার–ঘুম ভাঙে কই রে!
ঘর্ঘর ভন্ ভন্ ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচ শোন্–ধেই ধেই ধিন্তা!
ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজেরে–
ফট্ ফট্ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে!
(শব্দকল্পদ্রুম / সুকুমার রায়)
শব্দকল্পদ্রুম একটি সংস্কৃত অভিধান। রাধাকান্ত দেব অভিধানটি সংকলন করেন এবং করুণাসিন্ধু বিদ্যানিধি সম্পাদনা করেন । ১৮০৩ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছরে আটটি খন্ডে এই অভিধানটি প্রকাশিত হয়। শোনা যায় যে, সংস্কৃত ভাষায় এমন কোন শব্দ নেই যার অর্থ এই বইতে নেই ।
এমন কোনো শব্দ কি আছে যার গায়ে অর্থের জামা নেই? অথচ ঐ জামা খুলে আমরা কি দেখতে চাইব না তার প্রকৃত
শরীর ?
আমরা তো বলি,’ অর্থই অনর্থের মূল’, শব্দ ও তার অর্থের মধ্যের সম্পর্কের স্বতঃসিদ্ধ কিনা তা নিয়ে আমরা অবিশ্বাসী হয়ে উঠছি । আমাদের কবিতাকেও ভাষার আদিতে, ধ্বনিতে উপনীত করতে চাইছি ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার বীভৎসতা, ধ্বংসময়তা ও হহাকার নিয়ে সেইসময়ের মানবসভ্যতাকে টুকরো টুকরো করল, টুকরো করল মানুষের চিন্তাচেতনাকে। ধ্রুপদীতত্ত্বের মৃত্যু হল। শিল্প ও সাহিত্যে একের পর এক নতুন ইজম, নতুন আন্দোলন উঠে এল ।
১৯১৬ সালে Hugo Ball তৈরি করলেন Dada Manifesto, ‘Dada’ ? কোত্থেকে এল শব্দটি ? ফরাসি অভিধানে এর মানে বাচ্চাদের খেলনা ঘোড়া। অনেকে বলেন আস্ট্রিয়ান শিল্পী Richard Huelsenbeck একটি ছুরি অভিধানে একটি শব্দে এলোপাথাড়ি গেঁথে দেন, সেই শব্দটি Dada আর এভাবেই এই অন্দোলনের নামকরণ । কারু কারু মতে এটি মানবশিশুর প্রথম উচারিত শব্দ, আবার কারু মতে এর প্রকৃত কোনো অর্থই নেই যা এই আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য অর্থহীনতারই সমার্থক।
১৯১৬-তেই Hugo Ball লিখলেন Karawane কবিতাটি
jolifanto bambla o falli bambla
großiga m’pfa habla horem
egiga goramen
higo bloiko russula huju
hollaka hollala
anlogo bung
blago bung blago bung
bosso fataka
ü üü ü
schampa wulla wussa olobo
hej tatta gorem
eschige zunbada
wulubu ssubudu uluwu ssubudu
–umf
kusa gauma
ba–umf
অর্থহীন, ননসেন্স শব্দ দিয়ে লেখা একটি কবিতা, যার কোনো মানে নেই অথবা মানেহীনতাই এর মানে । তৈরি হল sound poetry, শব্দকবিতা, ধ্বনিকবিতার ধারা ।
যদিও এর ইতিহাস আরেকটু পুরোনো। মৌখিক কবিতাচর্চায়, সঙ্গীতে এরকম আপাত অর্থহীন ধ্বনির ব্যবহার আমরা আগেই পেয়েছি। জার্মান কবি Christian Morgenstern-এর ১৯০৫-এ Das Große Lalulá কবিতাটি আমরা এর উদাহরণ পাই।
ইতালির ফিউচারিজম আন্দোলনের অন্যতম কবি Filippo Tommaso Marinetti যুদ্ধক্ষেত্রে নানান আওয়াজের ভেতর উপলব্ধি করেন যে, শুধুমাত্র ধ্বন্যাত্মক শব্দ ব্যবহার করেই যুদ্ধের আবহ কবিতায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব, শুধুমাত্র তা দিয়েই কবিতা লেখা সম্ভব । সেই যুদ্ধকালীন ধ্বনিপ্রবাহেই ১৯৩৪ সালে তিনি লেখেন Zang Tumb Tumb কবিতাটি।
১৯১৮-তে Tristan Tzaraআরেকটি ইস্তেহার লেখেন দাদাইজমের এবং তা হুগো বলের ইস্তেহারটির থেকে ভিন্ন। ত্রিস্তান জারার কবিতাতেও শব্দের অর্থহীনতার ঝোঁক দেখি আমরা। কংক্রিট কবিতার অন্যতম নাম ফরাসি কবি Henri Chopin( অঁরি শঁপা ), তাঁর কবিতাতেও সাউন্ড কবিতার দেখা পাই আমরা। বিভিন্ন দেশের লেখম-শিল্পীদের রচনায় এর প্রকাশ নজরে আসে । নিউইয়র্কবাসী জার্মান Elsa von Freytag-Loringhoven, অস্ট্রিয়ান Raoul Hausmann, জার্মান Kurt Hermann Eduard Karl Julius Schwitter-র নাম উল্লেখযোগ্য।
Bruce Lansky নিয়ে নিবন্ধে এর উদাহরণ দিতে গিয়ে এই কবিতাটি লেখেন রেলপথের পরিমণ্ডলে ।
Choo Choo
Chuga-chuga, chuga-chuga, chuga-chuga, chuga-chuga, chug.
Choo Choo!
When I hear a choo choo train I think of all the many things that I
should do
সাউন্ড পোয়েট্রিরও নানা উপবিভাগ Bruitist poem ঃ Richard Huelsenbeckএর পথ ধরে ধ্বন্যাত্মক কবিতা, Simultaneous poem ঃ Tristan Tzara-র পথ ধরে এমন কবিতা যা বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ছন্দকাঠামোয় পড়া যাবে। দাদাইস্টের একটা প্রবণতা ছিল শিশুর সারল্যে পৌঁছনোর ।
.
শিশুর উচ্চারণের শব্দগুলিতে অর্থের প্রলেপ লেগে থাকে না, সেগুলি এলিমেন্টাল ধ্বনি। আর শিশুর সাথে কথা বলতে আমরাও এরকম অনেক শব্দ বলি যেগুলির আওয়াজ নেই।
মহারাজ, আমি তোমার সেই পুরনো বালক ভৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? তোমার বুকে হোঁচট পথে
চাঁদের আলোয় মোট বয়েছি, বেতের মতো গান সয়েছি
দু’হাত নিচে, পা শূন্যে- আমার সেই উদোম নৃত্য
মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ, মনে পড়ে না? মহারাজ,
চাঁদের আলোয়?
মহারাজ, আমি তোমার চোখের জলে মাছ ধরেছি
মাছ না মাছি কাঁকরগাছি একলা শুয়েও বেঁচে তা আছি
ইষ্টকুটুম টাকডুমাডুম, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!
অমন তোমার ভালোবাসা, আমার বুকে পাখির বাসা
মহারাজ, তোমার গালে আমি গোলাপ গাছ পুঁতেছি-
প্রাণঠনাঠন ঝাড়লন্ঠন, মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!
মহারাজ, মা-বাপ তুমি, যত ইচ্ছে বকো মারো
মুঠো ভরা হাওয়ার হাওয়া, তো কেবল তুমিই পারো।
আমি তোমায় চিম্টি কাটি, মুখে দিই দুধের বাটি
চোখ থেকে চোখ পড়ে যায়, কোমরে সুড়সুড়ি পায়
তুমি খাও এঁটো থুতু, আমি তোমার রক্ত চাটি
বিলিবিলি খান্ডাগুলু, বুম্ চাক ডবাং ডুলু
হুড়মুড় তা ধিন্ না উসুখুস সাকিনা খিনা
মহারাজ, মনে পড়ে না?
( মহারাজ, আমি তোমার / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )
পুরনো বালক ভৃত্য ভোলাচ্ছে মহারাজকে, মহারাজ নামের শিশুটিকে। বলছে, ‘মহারাজ, কাঁদে না, ছিঃ!’ আর ভোলাতে ভোলাতে,’ইষ্টকুটুম টাকডুমাডুম’ ‘বিলিবিলি খান্ডাগুলু, বুম্ চাক ডবাং ডুলু হুড়মুড় তা ধিন্ না উসুখুস সাকিনা খিনা’- এই সব শব্দ করছে যা অর্থহীনতার সারল্যে শিশুটির সাথে কমউনিকেশন সরল করছে ।
আমাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই ধ্বনি দিয়ে তৈরি, শব্দ থেকে প্রচলিত অর্থে না গিয়ে উৎসে, সেই জায়মান ধ্বনি-আয়নে পৌঁছতে পারেন কবি। তাঁর কবিতাও প্রচলের পথ ছেড়ে ‘নতুন’ হয়ে ওঠে।
গোধূলি কার গোধূলিকার
হাসলে কিছুদিন বরোজ সবুজ কিছুদিন
পান-ই-পান্না
মনে হবে শ্বাস ফেলছে অবন-পাখিরা ।
অস্থানে মনে নেই শোয়ার কুঁজে সারারাত উট ভরা লাই
দুর্গেই ছিল চূড়ান্ত নীপবন
সেও কার দুলকারি কে জানতো কার এত
লয় ঝাড়া সুর
সেও এম্নি নাশের বুকে এম্নি পাতি
পটে বসলেই রটে যাচ্ছিল আদিগন্ত লিখিত
লু-থর
ভাঙা ভাঙা কাহিনীকত্থকে প্লাশই ডাকছে রাজপুত পলাশকে
...
( ও পলাশ / স্বপন রায় )
ধ্বনির যে সঙ্গীতময়তা, মার্গসঙ্গীতে, তালবাদ্যে, নৃত্যবোলে ধ্বনির যে পরম অবস্থান তাও ছুঁয়ে থাকেন কখনো ।
ভোজালির ভিল্লিতে চাপছে ভাবিনীর ভিন...
দুটো ঢং বালিশে সাজানো
শিশিরের ভোট নিয়ে সাতাশে হারালো
লিনায় পরালে
পারমাণবিক কোকুনে বিভ্রাট তুলে কোকিলা হেঁটে গেল ল্যাম্পের খোঁজে
পুরুষের স্বাভাবিক সুইচ
লটারি পেরোনো
বোতামে ডাম্প দেখ আড়াইশো বছরের...
দোদুম ফেনে ওঠো
নিঝুম
আফিম
ক্যাম্পাসে দোলো ঘোমটার আলে...
অলিতে গলিতে
ধা-নি-সা-গা
নি-সা
নি-সা,
মা-ধা-নি
গ্লাসে গ্লাসে ঐরাবত ঠেলে
আমার নিদ লেগে গেল
‘দাদা আমাকে প্রিয়াতে ঠেলে দিন’...
ঢলে যাক
মেহেদির লজ
হিবিস ভোলানো,
রুণা কপ্চানো
পা-নি
পা-নি
নোনাদের ভ্রূণ
ফুলমুন সধবারা নিয়ে গেল রূপ থুড়ি কলোনির ঘুম
আমাকে লম্ফ দাও
চিরুনিরা তল্লাশে ভালো...
এইখানে বসে আছে মরুলাল বাংলার জল,
সা-মা
রে-সা
নি-রে-সা
লক্ষ লক্ষ মীর কোটায় ভূদেশে...
গামলার ঘর
আমাকে তুমি উষ্ণ পড়োনি ?
কী জানি রাম রাম ঝোঁক
সবিনয় রোগ
গা-মা
গা-মা
মনিটর চর্চার দেশ
আমাদের টর্চের খোঁজ নিশায় পোড়েনি,
নিশিও বলেনি
যমালয়ে হাত পাতো বেশ
‘মাগো ! মাগো ! দুটো দাওনা মাগো!’
[ হিং চার চিল (অংশ ) / সব্যসাচী হাজরা ]
কবিতা সাধারণত অর্থের শৃঙ্খলা ধরে এগোয়, এগোয় কবির ভাবনাপথে। কিন্তু যদি তা ধ্বনিকে নির্ভর করে, সেই পথে লিখিত হতে থাকে ।
চাঁদের নাকি পা আছে
চন্দ্রপা শুনে আটকে গেছি
বিশ্বায়ন শুনেছো
শিল্পায়ন
কবিতায় আঁটে না এমন শব্দজ্যাম
যারা মৃত্যু দেখতে পাওনা
যারা উনুনে চাঁদের পা
চন্দ্রভাগা
অভাগা এই গেলো তো সেই গেলো
ক্রাচ দেখলাম
জয়পুর কাঠের পা
প্রজাপতি
এবং ওই তারাটা
প্লেনের চলে যাওয়াও দেখো
ছায়া ফুরনো মানুষটার দুচোখ ভরা
( চাঁদের প্রতি-কবিতা / বারীন ঘোষাল )
এইভাবে ধ্বনির কবিতা লিখিত হতে থাকে, তা শব্দকবিতা ( sound poetry )এবং নিঃশব্দ কবিতা ( non-word poetry)।
কিন্তু শব্দের অর্থ হয় কিনা, সে যে সংস্কারগত, ইতিহাসগত সাংস্কৃতিক অর্থ বহন করে তা খুলে নিজে যে অনর্থ পড়ে থাকে, যোগাযোগ-অসম্ভব যে ভাষার কঙ্কাল পড়ে থাকে তা আমাদের বেঁচে থাকাকেও কি নিষ্প্রাণ করে দেয় না?
তর্ক পেরিয়ে, তত্ত্ব পেরিয়ে সুকুমার রায়ের লেখা দিয়েই বুঝতে চাইব।
তাঁর লেখা নাটক ‘শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম’-এর অন্তিম অংশ ।
গুরুজি । শব্দের ঘাড়ে চিন্তাকে চাপাচ্ছ - ? ছিঃ ! অমন ক’রে শব্দশক্তি ম্লান কোরো না – আমার পূর্ব উপদেশ স্মরণ কর –
শব্দের সঙ্গে তার অর্থের যে একটা সূক্ষ্ণ ভেদাভেদ আছে সাধারণ লোকে সেটা করতে পারে না ।
সকলে । তাদের শব্দজ্ঞান উজ্জ্বল হয়নি –
সকলে । তারা শব্দের রূপটিকে ধরতে জানে না –
গুরুজি । তারা ধরে তার অর্থকে । তারা শব্দের চক্রের আবর্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায় । যেমন কর্মবন্ধন, যেমন মোহবন্ধন, যেমন সংসারবন্ধন, - তেমনি শব্দবন্ধন !
সকলে । শব্দবন্ধনে প’ড়োনা- প’ড়োনা-
গুরুজি । শব্দকে যে অর্থ দিয়ে ভোলায় – সে অর্থপিশাচ । শব্দকে আটকাতে গিয়ে সে নিজেই আটকা পড়ে । নিজেকেও ঠকায়
শব্দকেও বঞ্চিত করে । সে কেমন জানো ? এই মনে কর, তুমি বললে ‘পৃথিবী’ – তার অর্থ কর দেখ দেখি? – সূর্য
নয় চন্দ্র নয় আকাশ নয় পাতাল নয় - সব বাদ – শুধু পৃথিবী ! এরা নয় অরা নয় তারা নয়, এসব কি উচিত ? আবার
যদি বল ‘পৃথিবী গোল’ – তার সঙ্গে অর্থ জুড়ে দেখ দেখি, কি ভয়ানক সংকীর্ণতা ! – পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে তো
বলা হোল ণা – পৃথিবীর উত্তরে কি দক্ষিণে কি, তা বলা হল না – তার তিনভাগ জল একভাগ স্থল, তা বলা হল না –
তবে বলা হল কি ? গোটা পৃথিবীটার সবই ত বাদ গেল ! এটা কি ভালো ?
সকলে । আজ্ঞে না – এটা ত ভালো ঠেকছে না – তাহলে কি করা ্যায় ?
গুরুজি । তাই বলেছিলাম – শব্দের বিষদাঁত যে অর্থ, তাকে আগে ভাঙ । শুধু পৃথিবী নয়, শুধু গোল নয়, শুধু এটা নয়, শুধু ওটা
নয় ; আবার এটাই ওটা, ওটাই সেটা – তাও নয় । তবে কী ? না
[ গৌ গবৌ গবঃ –
হলদে সবুজ ওরাং ওটাং – ইত্যাদি ]
[ বিশ্বকর্মার আবির্ভাব ]
বিশ্বকর্মা । নিঝুম তিমির তীরে শব্দহারা অর্থ আসে ফিরে
কালের বাঁধন টুটে দশদিক কেঁদে উঠে
দশদিকে উড়ে শব্দধূলি উড়ে যায় উড়ে যায় মোক্ষপথ ভুলি –
ভেবেছ কি উদ্ধতের হবে না শাসন ? জাগে নি কি সুপ্ত হুতাশন ?
বিদ্রোহের বাজেনি সানাই ? শব্দ আছে প্রতিশব্দ নাই ?
শব্দমুখে প্রতিলোম শক্তি এসো ফিরে কুণ্ডলীর মুখ যাও ফিরে
শব্দঘন অন্ধকার নিত্যঅর্থভারে নামে বৃষ্টি ধারে
শব্দ যজ্ঞ হবিকুণ্ড অফুরন্ত ধূম এই মারি শব্দকল্পদ্রুম
[ ‘দ্রুম’ শব্দে সশিষ্য গুরুজির স্বর্গ হইতে পতন ]
।। যবনিকা ।।
No comments:
Post a Comment