Wednesday, October 2, 2019


আফজল আলির গদ্য 


চিন্তা প্রসারণ এবং কবিতায় ছক ভাঙা 
     (একটি দার্শনিক পর্যবক্ষেণ)

আফজল আলি 

Dubito Ergo Cogito Ergo Sum - এটি দার্শনিক গণিতবিদ রেনে দেকার্ত র কথা । Latin ভাষা থেকে ইংরেজিতে এসেছে এইভাবে - I doubt , therefore I think , therefore I am . অর্থাৎ কোনো কিছুকে সন্দেহ করা থেকে নতুন করে চিন্তার সূত্রপাত হয় এবং চিন্তা করার মধ্যে দিয়ে মানুষের অস্তিত্ব । দেকার্ত অবশ্য বলেছেন ব্যক্তি সব কিছুকেই সন্দেহ করতে পারে , কিন্তু সে নিজের অস্তিত্বকে সন্দেহ করতে পারে না । সন্দেহবাদ এর প্রবক্তা রেনে দেকার্ত র মতে - মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি লাভ করা । 

অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি লাভ করার কথা শুধু দেকার্ত ই বলেননি , অনেকেই বলেছেন , এখনো বলে যাচ্ছেন। 
চিন্তা করার মধ্যে দিয়ে মানুষ তার অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলতে পারে । মানুষ চিন্তা করে তার বর্তমান অবস্থানকে পাল্টানোর জন্য । তা সে সমস্যা থেকে মুক্তি হোক বা উন্নত বিকল্পে পৌঁছাতে অথবা উন্নত বা কল্পিত চিন্তার বাস্তবায়নে । প্রতিটা ক্ষেত্রেই তা হল অবস্থান পরিবর্তনের লক্ষ্যে । এটি বিজ্ঞানেও স্বীকৃত । নিউটন তাঁর গতিসূত্রে বলেছেন বাইরে থেকে কোনো বস্তুর উপর বলপ্রয়োগ না করলে সচল বস্তু চিরকাল সচল বা অচল বস্তু চিরকাল অচল থাকবে। সচল বস্তুর চিরকাল সচল থাকার বিষয়টি কেবলমাত্র একটি কাল্পনিক স্থল বা মহাকাশীয় অবস্থান যেখানে কোনো বিরুদ্ধ শক্তি নেই গতিকে দমন করার। বাস্তবে বা এই পৃথিবীতে সর্ব ক্ষেত্রেই থাকে নানান প্রতিকূলতা যা গতিশীল বস্তুকে গতিশীল রাখতে দেয় না । আমার বক্তব্য হল বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য যেমন বলপ্রয়োগের ব্যাপার থাকে , মানুষের অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য চিন্তা একটা বড়ো factor. চিন্তার কথাটা বললাম , আসলে চিন্তার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে বুদ্ধি মেধা জ্ঞান বিদ্যা এবং বাস্তবায়নের পন্থা । বিজ্ঞান বা দর্শন বা নীতিশাস্ত্র সবের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে চিন্তা বা প্রজ্ঞার শ্রম। এটা খুব ই সরল বিষয় সভ্যতার ক্রম বিকাশে মানুষ নিজস্ব টিকে থাকা এবং বিস্তারের জন্য নিজস্ব চিন্তার নিগূঢ় ছাপ স্পষ্ট রেখেছে , নচেৎ এই বিপুল সম্ভার নিয়ে পৃথিবী মান উন্নয়ন করতে সক্ষম হতো না । 

এই চিন্তার সূত্র ধরেই বলতে পারি যে জ্ঞান সামগ্রিক ভাবে ক্রম বর্দ্ধমান এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা একে অপরের সাথে interlinked. অর্থাৎ জ্ঞান ক্রম বিকাশমান একটি বিশাল ইউনিট যা ভিতর থেকেই পরিবর্তন বা সংযোজন হতে চায় । যেকোনো মানুষের অধিকার থাকে অবস্থার পরিবর্তন না করা , জ্ঞানের ক্রম সংযোজন এবং প্রসারণে অংশগ্রহণ না করা। যদিও সামগ্রিক ভাবে একক কোনো মানুষ তা সক্ষম হয় না কারণ system তাকে অংশীদার করে তোলে। কিন্তু জ্ঞান প্রসারণ সংযোজন হয়েই চলে । এটা একটা continuous process. মানুষের দ্বারাই ঘটে এই প্রক্রিয়া । দার্শনিক বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী , চিন্তাবিদ, এমনকি কৃষক শ্রমিক পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার শরিক । একজন কবি যখন কবিতা লেখেন তখন তার প্রাথমিক সূত্রে থাকে চিন্তা শক্তির প্রতিফলন ; তার নানান মানসিক পর্যায়ের ভাষাগত এবং কাব্যিক প্রতিফলন হল কবিতা । কবিতার ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততার পটটি পাশাপাশি সংযুক্ত হয়েছে ।

তমসার স্নিগ্ধ জলে অবগাহন করতে এসে ঋষি বাল্মীকি যখন দেখলেন ব্যাধ কর্তৃক পুরুষ ক্রৌঞ্চের তিরবিদ্ধজনিত ছটফটানি এবং সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম শ্লোক তথা কবিতা " মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমঃ অগমঃ শাশ্বতী সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধিঃ কামমোহিতম " । এই শ্লোক স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারিত হয়েছিল । কিন্তু যদি একটু analysis করা যায় তাহলে বুঝতে পারব সেই মুহূর্তে বাল্মীকি শোকের মধ্যে মুহ্যমান হয়ে গভীর চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং সেই চিন্তারই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ এই কবিতা । যদিও এটি রামায়ণের প্রথম শ্লোক নয় , কিন্তু কাব্যশ্লোক হিসেবে প্রথম । অর্থাৎ এখানেও সেই অনুঘটক হল চিন্তা , গভীর চিন্তা এবং চিন্তা নিঃসৃত জ্ঞানের আহরণ ও প্রতিফলন । কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততার বিষয়টি এভাবেই এসেছে যেখানে চিন্তা এবং একাগ্রতা মস্তিষ্কে hammer করে শব্দ নামিয়ে আনে। বাল্মীকির কবিত্বশক্তি প্রথমে জানা ছিল না , কিন্তু পরবর্তীতে তা প্রকট হয়েছে। 

চিন্তা প্রক্রিয়ার সাথে নানাবিধ বিষয় জড়িয়ে থাকে। অগ্রগতির প্রক্রিয়া যেমন একজন মানুষ তার good being এর জন্য কীভাবে নির্ধারণ করবে সেই নিরিখে অগ্রসর চিন্তা এবং বাস্তবায়ন । তেমনি কবিতার ক্ষেত্রে একজন কবির কাছে এসে হাজির হয় নানান অনুষঙ্গ উপকরণ উপাদান । কবি কীভাবে লিখতে চাইছেন , কবির ভিতরে লুকিয়ে থাকে তাঁর নিজস্ব সহজাত বহিঃপ্রকাশের ধারা অথবা কবি নিজেকে বদলের মধ্যে নিয়ে যেতে চান কিনা । বেশির ভাগ কবি চান নিজস্ব একটি signature তৈরি করতে , সেই style এর বাইরে তাঁকে দেখা যায় না বেশি । আবার অনেকে চান signature না তৈরি করে নানারকম লেখনী ভঙ্গিমায় থাকতে । এটা কবির নিজস্ব চাওয়া ও বোধের উপর নির্ভর । কিন্তু প্রত্যেক কবির শব্দ প্রয়োগের কৌশল স্বতন্ত্র থাকে , এটা কবির ভিতর থেকে উঠে আসা এক প্রবণতা যা পর্যবক্ষেণ করলে কবিকে চেনা যায় । কেউ কেউ আবার সজ্ঞানে নিজের ভিতরের style ভাঙতে ভাঙতে যান , পছন্দ করেন। 
এজরা পাউন্ড ছিলেন নিরীক্ষাধর্মী কবি , সাহিত্য জীবনের পুরো সময়টাই কবিতার বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেছেন । আর এর ফলস্বরূপ তাঁর প্রতিটা কাব্যগ্রন্থ ই আমাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়। এ প্রসঙ্গে T S Eliot বলেছেন - পাউন্ডের কবিতা যেমন ভাবা হয় তারচেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ ই নয় , বরং তা ধারাবাহিক উন্নতির চিহ্ন রেখেছে। - 
এজরা পাউন্ড নিজে বলেছেন - " ত্রিশ বছর বয়সে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম, কবিতা বিষয়ে যে কোনো জীবিত ব্যক্তির থেকে আমাকে বেশি জানতে হবে, কবিতার পরিবর্তনশীল উপাদানগুলি বুঝে নিতে হবে এক্কেবারে খোলস থেকে । কবিতার কোন অংশ অবিনশ্বর , কোন অংশ অনুবাদে হারিয়ে যায় না , এবং যা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় , কোনো ফলাফল কেবল এক ভাষাতেই পাওয়া সম্ভব , অন্য ভাষাতে নয় । এর খোঁজে কম বেশি নয়টি বিদেশি ভাষা রপ্ত করেছি , অনুবাদের মাধ্যমে পড়েছি ওরিয়েন্টাল সাহিত্যকর্ম । প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধান ও অধ্যাপকদের সাথে লড়াই করেছি যারাই এই ব্যাপারটি ছাড়া অন্য কিছু শেখানোর চেষ্টা করেছে আমাকে , কিংবা জ্বালাতন করেছে ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে । অবশ্যই কোনো পরিমাণ পাণ্ডিত্য ই কাউকে কবিতা লেখায় সাহায্যে করে না , এটা এমনকি বিশাল একটা বোঝা মনে হতে পারে , কিন্তু বেশ কিছু ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যেতে সাহায্য করে তা । দ্বিতীয় শ্রেণীর কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা আমি ঘৃণা করি - "

অর্থাৎ এজরা নিজে স্বীকার করেছেন যে নির্দিষ্ট একরকম লেখা বা ধারাকে তিনি পরিহার করতে চান , ঠিক যে কথাটা আমি চিন্তার প্রসারণের ক্ষেত্রে বলতে চেয়েছি । চিন্তার প্রসারণ এলেই কবি তাঁর নিজের ছক বা গন্ডিকে নিজেই ভেঙে ফেলবেন । তখন signature কথাটি অবান্তর হয়ে ওঠে । চিন্তার প্রসারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই চলে আসবে জিরো বাউন্ডারি ধারণা যা আমি বলেছি বা লিখেছি । অর্থাৎ চিন্তাশীল ব্যক্তি এগিয়ে যাবেন তাঁর অভিপ্রায়ে । কবিরা চিন্তা প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকেন বলেই তাঁরা পারবেন তাদের লেখনীর ছাঁচ ভেঙে ফেলতে । এটি যদিও খুব কঠিন কারণ আমরা কেউ ই বেরিয়ে আসতে পছন্দ করি না যা আমাদের favorable zone বলে মনে করি। চিন্তা প্রসারণের বিষয়টি চিন্তাশীল ব্যক্তির ভিতর থেকে আসতে পারে আবার বাইরের উপাদান থেকেও আকস্মিক ক্রিয়া করতে পারে , যেন হঠাত্ কোনো ঝলক এসে খুলে দিল দ্বার। 

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ " কবিতাটিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত কাব্যের ভূমিকা হিসেবে গণ্য করেছেন । এই কবিতাটিকে রবির প্রথম আলো বলা যায় । 
" কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন
চারিদিকে তার বাঁধন কেন 
ভাঙ রে হৃদয় , ভাঙ রে বাঁধন
সাধ রে আজিকে প্রাণের সাধন
লহরীর পর লহরী তুলিয়া 
আঘাতের পর আঘাত কর " 

কবি লিখেছেন - " একটি অদ্ভুত হৃদয় স্ফূর্তির দিনে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ লিখেছিলাম কিন্তু সেদিন কে জানত এ কবিতায় আমার কাব্যের ভূমিকা লেখা হইতেছে " 
কুড়ি বছর বয়সে লেখা কবিতাটিকে কবি তাঁর সমস্ত কাব্যের ভূমিকা হিসেবে গণ্য করেছেন । অদ্ভুত এক আবেশ কাজ করেছিল এই কবিতাটি লেখার সময় । এক সকালে কলকাতায় বসে সূর্যের আলো এসে পড়ার সাথে সাথে কবি বোধ করলেন যেন তাঁর চোখের থেকে একটা পর্দা সরে গেল , একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্ব সংসার আচ্ছন্ন হয়ে গেল । কবি বললেন -" আনন্দ এবং সৌন্দর্য সর্বত্র তরঙ্গায়িত হইতে লাগিল- আমার মনে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক মুহূর্তে ভেদ করিয়া অন্তরের মধ্যে বিশেষ আলোক বিচ্ছুরিত হল " । কবি আলোকিত হলেন , চোখ গেল খুলে । যা আমি বলেছিলাম বাইরের উপাদান থেকেও আকস্মিক ক্রিয়া করতে পারে । 
কবি ভাঙার ডাক দিয়েছেন , চারিদিকে বাঁধন ভাঙার ডাক , লহরীর পর লহরী তুলে প্রাণের সাধন করতে বলেছেন , আঘাতের পর আঘাত করতে বলেছেন । এই আঘাত নিজের বোধ ও চেতনার কাছে , মানুষের কষ্ট যন্ত্রণা দুঃখ দুর্দশা নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং কবি হয়ে উঠলেন দার্শনিক । কবি স্থিতির বিরুদ্ধে মত জারি রাখলেন । রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার সাথে এজরা পাউন্ডের ভাবনা মিলে গেছে , স্থবিরতার বিরুদ্ধে , signature তৈরি করার বিরুদ্ধে । ডেকার্ত বলেছেন অজ্ঞানতা দূর করার মধ্যেই মুক্তি। কবিও তাই বললেন । 

এ সম্পর্কে কবি নজরুল ইসলামের কারার লৌহকপাট ভাঙার আহ্বান - 
" কারার ওই লৌহ কপাট 
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদি " 

বৃটিশ-কারার লৌহকপাট এর পরিবর্তে যদি মনের কপাট , সাম্প্রদায়িকতার কপাট , বিষাক্ত মন ও সমাজের কপাট , রাষ্ট্রের চাপানো অত্যাচারের কপাট ভেঙে সমতার নতুনত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া হয় , তাহলে এই কবিতাংশ যেন আজকের দিনের জন্য । Great man think alike - কবি এবং দার্শনিকের ভাবনার মধ্যে মিল থাকে , মিল থেকেই যায় কারণ সুক্ষতম ভাবনায় দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় এক হয়ে যায় । এটিই হল জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার সার্থকতা । 
কবিতার নিজস্বতায় রয়েছে diversity এবং বিবর্তন । কত রকমের কবিতা , কত রকমের ভাব , বিনিময় এবং অনিবার্যতা । কবির মধ্যে যদি উত্তাপ না কাজ করে কবির ভাষা স্তব্ধ হয়ে যাবে । কবির থাকে হতাশা , জীবন বোধের অনিশ্চয়তা , কিন্তু এ সব ছাপিয়ে তাঁর কলম ,তার চিন্তা, তাঁর দর্শন তাঁকে টেনে নিয়ে যায় , মান নির্ণয়ের ভূমিকায় কে গ্রহণ করল , কে করল না তার পরোয়া নেই। এক দূর দ্বীপবাসিনী তাঁকে হাতছানি দেয় , " মম জীবন যৌবন , মম অখিল ভুবন " - সে হেঁটে চলে বহে চলে । কবি কাজের মধ্যে থাকেন , কবি সংসারে থাকেন , তদুপরি কবির মাথার মধ্যে এক বোধ কাজ করে । 
" অর্থ নয় ,কীর্তি নয় ,স্বচ্ছলতা নয় , - আরো এক বিপন্ন বিস্ময় 
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে 
আমাদের ক্লান্ত করে , ক্লান্ত - ক্লান্ত করে " 
এই বিপন্ন বিস্ময় যা মৃত্যুমুখী এক বৈভব , অনিশ্চয়তার মুকুট আমাদের বোধের মধ্যে তীব্রতর হয়ে জন্ম দেয় কবিতার উৎসরণ । নিজের ভিতরে নিজের প্রজ্ঞা গড়ে তুলি , জীবনের দৌড়ে নিজেরাই হয়ে উঠি দার্শনিক । আমাদের ভিতরে জন্ম নেয় চিন্তার প্রসারণ , বিকশিত হই , নির্মোহ হই , আরো কদম এগিয়ে যাই - এক অমোঘ নিয়তি ছাপিয়ে যাওয়ার প্রয়াস । 

কবিতার বাঁক বদলে , বিবর্তনে নানা প্রকরণ আমরা দেখতে পাই যা সময়ের প্রেক্ষিতে পরিবর্তন হয়েছে । দেখতে পাই কবিতার নানান রূপ ও ডাইমেনশন । বিভিন্ন ইজম মতবাদ , বিভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কবিতার নানান রূপরেখা এবং সেই কেন্দ্রিক লেখার গতিপ্রকৃতি সামগ্রিক ভাবে সাহিত্য শিল্প তথা কবিতার ভান্ডারকে সম্পদশালী করেছে। কালের স্রোতে তারা টিকে ও আছে , গ্রহণ বা বর্জন ব্যতিরেকে । এই সব ইজম আন্দোলন রূপরেখার মধ্যে না ঢুকে একটা কথা অবশ্যই বলা যায় যে কবিতা static থাকেনি কখনো । Static থাকতে পারে না কারণ মানুষ তথা সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ভাবনা প্রসারিত করে গেছেন বা চলেছেন তাঁদের ই তাগিদে যা ভিতরের স্পন্দন , চিন্তা প্রসারণের প্রক্রিয়ায় । পূর্ববর্তী দলিল হাতে নিয়ে বা পরিচিত হয়ে শিল্পীরা আগমনীর সূর আঁকেন , কবিতার ছক ভাঙার সাহস দেখান । শিল্পের ক্ষেত্রে শুধু ছক ভাঙলে ই চলে না , নতুন সেই ভঙ্গিকে হয়ে উঠতে হয় , না হলে তা মান নির্ণয়ে গ্রহণযোগ্য হয় না । হয়ে ওঠার ব্যাপারে ও দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য রয়েছে সেটা বিতর্কের । তবুও আমাদের চেতন অবচেতনে আমরা সক্ষম হয়ে উঠি ব্যাপকতার নির্ধারণ কেমন হতে পারে । আমাদের মধ্যে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন এই সূর্য চন্দ্র পৃথিবী গ্রহ নক্ষত্র মানুষ প্রকৃতি জীবন মৃত্যু শোক দুঃখ স্থিতি বিনাশ - এ সবই তো চিরন্তন , এগুলো তো তেমন বদলায় না । তাহলে এই সব অনুষঙ্গ থেকে সৃষ্ট শিল্প কেন বদল হবে। এর উত্তরে বলা যেতে পারে শিল্প হল সৃষ্টির ভিতরে সৃষ্টি । প্রাকৃতিক ভাবে যা সৃষ্টি হয়ে আছে এই ব্রহ্মাণ্ড বা জীবনের আধার জনিত অন্যান্য সমাবেশ , তা আমরা পরিবর্তন করতে পারি না, তার বিরাটত্বর কাছে মানুষ নগণ্য । কিন্তু মানুষ সেই অসীম সৃষ্টির ভিতরে বসে সসীমের বিস্তার করতে পারে । এটিই হল শিল্প । এই সসীমের মধ্যেই চলে নানান প্রক্রিয়া , খেলা , ডাইমেনশন যা আমাদের সাধ্যে । আমরা খোদার উপর খোদগারি করতে পারি না , কিন্তু নিজের উপর নিজের জানার তরঙ্গে আঘাত হানতে পারি , কৌশল নির্মাণ করতে পারি ।

অগাস্ট কোঁত বলেছেন - নিজেকে উন্নত করতে নিজেকে জানুন । 
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন - আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে 
জ্যাক লাকা একটা অদ্ভুত কথা বলেছেন - পৃথিবীর সব কিছু ই আয়নার মতো ব্যবহার করে । 
এ সম্পর্কে বিতর্কের মধ্যে না ঢুকে একটা বিষয় ভাবতে পারি যে আমাদের নাগালে সব বস্তু বা প্রাণের সমাহার থেকে আমরা কিছু না কিছু দেখতে পাব যা আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে আমাদের স্বরূপ পরিবর্তনে বা সাধনে । অর্থাৎ জ্ঞানের উপাদান আমাদের চারপাশে এবং সামগ্রিকতায় । আমাদের নিজেদের মধ্যেই প্রথিত আছে অনেক কিছু । আমরা তা জানি না , জানার চেষ্টা করি না । তাই নিজের স্বরূপ জানার মধ্যে ই চিন্তার প্রসারণ লুকিয়ে থাকে । তাই মানুষ তার চিন্তা শক্তির জন্য আলাদা অন্যান্য প্রাণী থেকে , বলা হয় শ্রেষ্ঠ । মানুষের বৈশিষ্ট্য তার bi-pedalism . মগজ এবং হৃদয় এ দুটো মানুষের super সম্পদ । একজন কবি তো মগজ ও হৃদয় দিয়েই লেখে , কখনো কখনো অতীন্দ্রিয় কিছু , তাই কবিদের মধ্যে চিন্তার প্রসারণ অত্যন্ত সক্রিয় । বুদ্ধি এবং বোধ না থাকলে কবিতা লেখা যাবে না । 

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে চিন্তার বিষয়টি আসছে কেন । মানুষ মাত্রই চিন্তা করে , চিন্তার মধ্যে নুব্জ , তার আশপাশের পরিমণ্ডল নিয়েই তো ব্যস্ত থাকতে হয় যা তাকে চিন্তার মধ্যে নিবিষ্ট করে। নৈমিত্তিক যাপনের জন্য একটা মানুষকে চিন্তা তো করতেই হচ্ছে । তাহলে নতুন করে আবার কী করবে । উত্তরটা হচ্ছে চিন্তার প্রসারণ । গন্ডিবদ্ধ বা গতানুগতিকতার বাইরে expansion করা যা তাকে নিয়ে যাবে অন্য আধারের দিকে , সে আলোকিত হবে to be enlightened. যতটা জানা আছে তার বাইরে গিয়ে আহরণ করা। নিজস্ব কর্মের periphery র বাইরে অথবা নিজস্ব বৃত্তের মধ্যে ই নতুন অভিমুখ তৈরি । বুদ্ধি expand হতে চায় । এমনটা নয় সব মানুষ ই এই কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে । কিন্তু কবিদের ক্ষেত্রে এটা জরুরি কারণ কবিরা নতুনের পূজারী , নতুন সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা । তাই তাদের ক্ষেত্রে চিন্তার প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি । কবিতার উপাদান হল শব্দ । শব্দ তার অন্তর্গত স্থবিরতা ছেড়ে বেরোতে চায় । সেই স্থবিরতা হল জাড্যধর্ম অর্থাৎ নতুন ভাবে নতুন চিন্তনে নতুন রূপে ব্যবহৃত হতে চায় । কিন্তু এই নতুন রূপে ব্যবহারের জন্য চাই শক্তি প্রয়োগ । শক্তি প্রয়োগ muscle power নয় , মেধা শক্তি এবং কাব্য শক্তির দ্বারা শব্দের অবস্থানকে নাড়িয়ে দেওয়া । জ্যাকস দেরিদার deconstruction তত্ত্ব থেকে আমরা অনেক আগেই জেনেছি the relation between text and it's meaning. জেনেছি signifier এবং signified এর মধ্যে সম্পর্কটা endless. তাই শব্দে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা নতুন দ্যুতি নতুন উপস্থাপন পেয়ে যেতে পারি, অতিক্রম করে যেতে পারি তথাকথিত কাঠামোর বাইরে পরিবর্তন । পরিবর্তন করতেই হবে এমন দিব্যি কেউ দেয়নি , কিন্তু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী কারণ জ্ঞান থেমে থাকবে না , যুক্তি তার চোখ ঘোরাতে থাকবে । 
,পরিবর্তন যে অবশ্যম্ভাবী তা রবীন্দ্রনাথ টের পেয়েছিলেন । তাই কখনো বলেছেন -
" ওরে নবীন , ওরে আমার কাঁচা 
ওরে সবুজ ,ওরে অবুঝ 
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা " 
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে 
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে 
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ করে 
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা " 

কখনো গেয়েছেন - " আমি চঞ্চল হে , আমি সুদূরের পিয়াসি , দিন চলে যায় , আমি আনমনে তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে - " 
স্পষ্ট করে বলার অবকাশ রাখে না কবিও হাত বাড়িয়ে ছিলেন । কী সেই সুদূরের পিপাসা 

এই প্রসঙ্গে অবশ্যই চলে আসবে জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টের বিষয়টি যা বলেছে এই পৃথিবীতে কোথাও কোনো বাউন্ডারি নেই নিজস্ব বা ব্যক্তি ইউনিটের বাইরে । আগে ছিল বাউন্ডারি ভাঙার কথা , এখন তা হয়ে উঠল বাউন্ডারিহীনতা । আরো স্পষ্ট করে আরো জোর দিয়ে মানুষের প্রয়াসকে কুর্নিশ জানিয়ে পৃথিবীকে এক করে দিতে ভালোবাসা যুক্ত এক বিশ্ব-গ্রাম , Global Village 

1 comment:

  1. ভাল লাগলো। তথ্য সমৃদ্ধ ও মননশীল লেখা। পড়ে উপকৃত হলাম।

    ReplyDelete