Wednesday, October 2, 2019

উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা কবিতা 

গরীয়সী 

স্বাতী ইন্দু

সব হিসেব দেখলে মা
হৃদয়ের দাগ দেখলে না।
একটুকরো অপমান কালো
জ্বলে উঠলো অঙ্গারের ফণা!
তোমারের রাজত্বে মাগো
মাথানত,সম্মান বাঁচেনা।
কবিরা চেয়ার মোছে, মানী
নিয়মিত করে আনাগোনা ।
প্রান্তিকতার দ্বারে হাত পেতে
আর তার অহংকার সাজেনা।
সব হিসেব দেখে ফেললে
হৃদয়ের দাগ দেখাবো না।


শ্রাবণ

বিশ্বজিৎ দেব 

শ্রাবণের বিচ্ছেদের গানগুলি নিয়ে
সন্ধ্যের দাওয়ায় বসেছে একটি
সেলাই মেশিন, খট খট আওয়াজের দিকে
নেমে আসছে সুতো, টুকরো টুকরো মেঘে
জুড়ে দিচ্ছে অঝোর সাটিন, বাতাসে
আর্দ্রতার তারতম্য অনুযায়ী তার পাশে
এসে বসে একটি নিরুপায় হাতপাখা
খানিকটা উপরিতল নিজের জন্য রেখে
এর দুদিকেই উপচে পড়ছে জলের মরশুম

শ্রাবণের বিচ্ছেদের টানে কে তাকে বিলিয়ে দিচ্ছে ঢালু,
গোটা ভাটিদেশ, সাটিনের রঙে
এঁকে দিচ্ছে মেঘ , মাছভেরী আর জোয়ারের টান!


তাপমাত্রা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

তুমি সেদিন আহ্লাদে আমার ভাইয়ের বুকে চাঁদমারি খুঁজেছ
আমি সেদিন সোল্লাসে তোমার বোনের শরীরে মানচিত্র এঁকেছি ৷

তোমার সমারোহ তোমার মহল্লায় জয়ের হুল্লোড় করেছে ৷
আমাকে ভ্রূকুটি করেছে তোমার বাহিনী
আমার অশ্লীল শল্যচর্চায় জয়ন্তীজিগির চলেছে আমার বস্তিঘরে
তোমাকে নস্যাৎ করেছে আমার অক্ষৌহিণী

শুরুতেই থামতে শিখিনি আমরা দুজনেই ৷ কেউ আমাদের থামতেও শেখায়নি ৷ শুধু হাততালি দিয়েছে যার যার সীমানার ভেতর ৷ আর জড়ো করেছে বিরল আশরফি নিজেদের ঘরে ৷

এখন শান্তির প্রস্তাব উঠলে কেউ কাউকে মানিনা ৷ তুমিও না ৷ আমিও না ৷ কেবল একে অন্যের অতীত খুঁড়ে দুষ্ট কয়লা তুলে আনি ৷

এখন আমাদের উপত্যকা আর শান্ত হয়না ৷ তাপমাত্রা বাড়ে প্রতিদিন ৷ তাপমাত্রা বাড়ে প্রতিদিন ৷


স্বপ্ন 

শুভেশ চৌধুরী

হবে । সত্যি হবে
না হলে মনে স্বপ্ন বা সেই দূর ঘটনা যা একদিন সত্য হয় কেন এত নিকট হল ।
স্বপ্নের ভিতর পাপ ও আছে , আছে অন্ধকার , বুঝি আমার ভিতর আছে কষ্ট কল্পনা ।
স্বপ্ন দেখতে ওই দূর চাঁদের মত , প্রিয়
ভাবি যদি প্রতিবেশী হয়
স্বপ্ন চাঁদ ও আমরা  তিন সত্য , হবো


আশ্বীনের আলো

নীলাদ্রি ভট্টাচার্য 

দুর্গাদি তুই কুমারটুলির আধশুকনো রোদে এসে দাঁড়ালি
আমাকে চিনতে পারছিস ?
আমি ....অপু ,তোর অ....পু....রঙের   অপু।

শরৎ এসে গেলো
হৃদয়  ভিড় করে আছে এলাচ গন্ধের কাঠাম মাটি
তুই তবুও চিনতে পারলি না ...আমি অপু
সত্যি আমি অপু।
আসলে দিদি আমি এখন বড্ড বড় হয়ে গেছি
আমাকে ফেলে তুই চলে যাওয়ার পর
আমি অনেক বেশী বড় হয়ে গেছি
আর ছোট্ট হতে পারছিনারে।
তুই ঠিক আগের মতোই
যেমনটি ছিলি তেমনটি....একদম নিশ্চিন্দিপুরের সেই মাঠের বালিকা দুর্গাদি।
ছুঁয়ে যাওয়া রেলের হলুদ শব্দে
তোর ইছামতী শ্রোত আর ....আর....
তোর লাল চন্দন বাটার মতো শাড়ির আঁচলে হাজারটা কাশফুলের কুয়াশা পোহানো গন্ধ
আহা পুজো এসে গেছে দুর্গাদি তাই তোর সেই আকাশের মতো শাড়ির কাছে একটা পথের পাঁচালী উপহার দিতে চাই আর সারাদিন বাতাসের নাতিশীতোষ্ণতায় উড়তে চাই আমাদের উঠোন ভর্তি  হলুদ ডানার পাখি হয়ে।


অনন্ত

দেবাশ্রিতা চৌধুরী

মৃতশরীরে মুখাগ্নির সময়
নারীচোখে দু'ফোঁটা" নগ্নজল!"
সমস্ত ইতিহাস ও দু'ফোঁটায়
উন্মোচন করে কী লাভ!!

আগুন নেভাতে একঝাঁক
বৃষ্টিইতো ছিল অপরিহার্য।


চিত্রনাট্য 

তমা বর্মণ 

অতঃপর হাতগুলি জড়িয়েই ভেঙে পড়ে
উন্মুক্ত
রাজপথে
অপসৃয়মান ছায়ায় সেবাদাসরা কুড়িয়ে নিয়ে যায়
চালাচালি করে প্রেক্ষাপট ধরে সংলাপ-কাহিনি
ধুলোর শতরঞ্জিতে দু-এক মনোযোগী শ্রোতা নির্বাক
কোনো চরিত্রকে ছুঁতে পারে না স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর
হৃদয়ে
বিশ্বাসে
তাদের অজ্ঞতা দিয়ে ভাত মেখে খায় জ্ঞানী ও দ্রষ্টা
বাড়াবাড়ি রকমের ভিড় সব একপাক্ষিক গল্প...


মনোভূমি কিংবা লীলাবতী কথা

বিজয় ঘোষ

১.

রাত্রির রঙে ডুব দেয় ইশারা...
ক মানে কৃষ্ণ ক মানে কারুবাসনা

ঈশ্বরীর চোখে কাজল ঠোঁটে লিপস্টিক

২.

সেই পাগলি  ছুঁয়ে ছিল
তারপর  বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি

এবার  মনোভূমিতে কৃষিকাজ হবে

৩.

কত দূরে ঈশ্বরীর বাস
স্বর্গ সুখ কাকে বলে

লীলাবতী জানে আঁধারের প্রিয়রূপ
ছলাকলা...


অনামিকা-৬

শতদল আচার্য 

ভীষণ মনে পড়ছে তোমার কথা
কেমন আছ এই বরষায়
জানি ভীষণ একটা আলো আসছে
সাথে অপূর্ব এক বাতাস
কতকাল এমন হয়নি ।

নিজস্বতা বলতে আজ
চুপি চুপি গলির রাস্তায়
একা একা তোমার কথা
ভেবে পথ চলা ।
কবে বাবার সাথে হেঁটেছি
সেই থেকে এই চলা শুরু
একটুক ও  থামিনি


কথা-২

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়

রেল লাইন পাতা ছিল, বুকের ভিতর। সরল ও সর্পিল। ফিসপ্লেট খুলে নিয়ে রিকেটি সর্ষেখেতে লুকিয়ে থেকেছি। তুমি আর আমি। প্রেম হয়নি, দুর্ঘটনার বগিগুলি সর্ষেঢেউ পিষে দিয়েছিল। এইভাবে নিজের ভ্রমণ নিজেকেই সেরে নিতে হয়। মঘা নক্ষত্রের আলো এলোচুল বারান্দায় খুলে। রমণ ও রাতের ক্লান্তি ভুলে। কার ঢেউ ছুঁয়ে কে যে পাষাণ হয়ে যায়!


রনো ও আমি ১

কমলিকা মজুমদার

নির্ভীক প্রেমে বুকের পাটা দরকার;
আমার রিব-কেজ গড়া সকল মাটি
রনো নিজ হাতে শাবল চালিয়েছে
কোটর মাঝে রেখে গেছে
কিছু উডরোজ ও অক্ষরজাল,
এখন আমি শুধু লুকিয়ে দেখি
সুদীর্ঘ কালো শঙ্খচূড়ের মতো নিশ্বাস
দেখি আর বসে থাকি অপেক্ষায়
এক অশান্ত শ্রাবণ বৈশাখীর-
মানুষভর্তি রাস্তায় বেরিয়ে পড়বো একা
শহরের পাথুরে মাটি লেপবো বুকে
নতুন সফেদ হাড় গজাবার মন্ত্র
লিখে রেখে যাবো আরেক পাঁজর কোঠায়।


জন্ম

বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য

নৈঃশব্দের গভীরে
যে শব্দ-ভ্রূণ
খেলা করে
তার শরীরে
লেখা আছে
কোলাহলের কাহিনি!


যে পথ 

অমলকান্তি চন্দ

যে পথ শেষ হয় গুলঞ্চ ঠিকানায়
বহু দূরে তার খোলা দ্বার
রাতের গভীরে
পাখি মায়া জড়িয়ে ধরে বুকে…

যে পথ মোহন বাঁকে যেতে যেতে
পাহাড়ের ঢালে কোন বৃক্ষের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়…
মাথা নত করে উড়াল আকাশ
বিচিত্র ডানা তার, ভবঘুরে সকাল ...

দু'পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে বৃক্ষ
দেখে যায় দৃশ্যের ভেতর অচেনা মানুষের উল্লাস…


স্বাক্ষরহীন উত্তরসূরি

অপাংশু দেবনাথ

হলুদ পাতার থাকে এক অন্তর্মুখী ইতিহাস।

গাছ জানে কোথায় রেখেছে বোঁটার ক্ষত প্রশ্বাস।
না-উইলকৃত জমি তাই পড়ে থাকে খাস-বৃত্তে,
কখন জুমিয়া, ভাগচাষী, চালায় লাঙল।

স্বাক্ষরহীন এ পথ উজ্জ্বল---উন্মুক্ত তোমার গানে,
প্রেম আমার, অখন্ড সূর্যোদয়।

আমার কাজের কোনো থাকবেনা স্বাক্ষর।
স্বাক্ষরহীন কর্মের জীবনে,ধারাপাত রেখে গেছে যারা,
তাদের উত্তরসূরি আমিই


পাষানের এপিটাফ 

রাজীব ভট্টাচার্য

জিদের উল্টো পিঠে কী নির্বাক ঘৃণার লালন !
এতো পাপ জমে ছিলো, এতো তিমিরে, এতো অন্ধকার ?
এখন মেধার স্খলন দেখি, দেখে ফেলি
মুখোশের মুখ ,
সম্পর্ক দূরে দূরে হাঁটে,সমস্ত তিতিক্ষাকে
তীরবিদ্ধ করে
নিজের জন্য রচিত স্বাধীন আকাশ
মুক্তির আলুলায়িত স্বাদ জুড়ে সাজানো অভিমান !
তারপর একদিন আমাদের চেতনার পাখি ফুস্...

মুক্তির স্বাদ লেহন করা ক্ষুধিত রসনায়
সমস্ত বাসনার উদগ্রীব উদযাপনে
মস্ত জিও , অগভীর অলীক যাপনে
এরই নাম বুঝি ভালো থাকা !

যাদের কোন মাঝরাত নেই ,
মাঝ দরিয়ায় ডুবে যাওয়া নেই ,
নিজের সাথে নিজের সংঘাত অবান্তর মনে হয়!

আনন্দ আসলে এতোটাই গোলাম
যে তাদের চরণ চুমে যায় বারবার...।


আমি মৃতবৎসা নই

আবু আশফাক্ব চৌধুরী

সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে দেখছি
কাজল মাখা আকাশ হরিণা চোখ
সন্তর্পণে মেঘের মত ওড়ে যাচ্ছে
বনেদী পাহাড়ের গায়ে চুমু খেয়ে
ফিরে আসছে কান্না ভরা চোখ

আমাকে সে দেখেনা অথচ
আমি আড়ালে নই
এ কথাও সে জানেনা আমি তাকে চাই
তাকে ভীষণভাবে ভালবাসি। মঙ্গল কামনায়
দু হাত জুড়ে আমি স্থির হয়ে তার দিকে তাকাই

একঝাঁক ধোঁয়াশা মাঝপথে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে
অহেতুক বিদ্যুৎ চমক আঁধার বাড়িয়ে তুলে
আমি মৃতবৎসা নই
কারাগারে বারবার বন্দি করে রাখো তবু
একরাতে হাজার কৃষ্ণের জন্ম দিতে পারি
অকুতভয়ে...।



নির্জন দ্বীপ 

নবীনকিশোর রায়

বয়ে যাওয়া তরী মধ্য দরিয়া পার হয়ে  অন্তিম বিকেলে পৌঁছায়,
সমাসন্ন  অস্তমিত বসত বেলা---
ঘনিয়ে আসা গন্তব্যে মাঝি একা, আড়ালে সূর্য ডুবে যেতে দেখে;
দেখে,---নিঃসঙ্গ  তীরভূমি,--- বহুদূরে পড়ে  আছে ফেলে আসা দিন !

অচেনা  ঘাটে ঘাটে নোঙর করে,
রঙিন পালে  লেখা নাম হৃদয় অক্ষরে  আসন-পাতা
খোঁজে ফিরে "দূর দ্বীপ বাসিনী"!

যুগান্তর ব্যাপী সকাল
দিনে দিনে ফুরিয়ে যায়
মুছে যায় প্রতি পাতায় লেখা,পাঠ...

পেছনে ফেলে আসা দিনের মায়াময় খেলাঘর আপন পর  স্বপ্নের জগৎ তীর-জুড়ে লীলাভূমি,গোধূলির নিরঞ্জনে ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে দৃশ্যমান তীর, নির্জন দ্বীপ!


ফিরতি রথ

পার্থ ঘোষ

যে ভাবে গর্জন শুনি শূন্য আকাশের
ভাবি, এই বুঝি তুমুল প্রলয়
ভেসে যায় মালা
চন্দন-নকুলদানা সহ লোটের বাতাসা...

যেভাবে শুভদ্রা জগন্নাথ আর বলরাম হাসে
শুকিয়ে যাওয়া ফুল ফিরতি রথের দিকে
নরম বিশ্বাসে
আড়ালে কে যেনো আবার তাকিয়ে থাকে স্থির...

দ্রাবিত সময় বয়ে চলে যায়
দু'হাতে রথের দড়ি, দোলাচলে চাকা
এভাবেই ঘুরে যায়- আসছে বছর


ভাষানাদ 

ভাস্কর জ্যোতি দাস

পদাতিকদের রক্তে, এ উপত্যকার ইতিহাস,
ভূমিতে কৃষ্ণচূড়া আজও বিপ্লবের মাসেই ফোটে ।
বিঁধে গিয়েছিলো কিছু স্বপ্ন অবশ্য,
রাজনীতির লাঠালাঠিতে...
কিন্তু এ উপত্যকা জানে, স্বপ্নের স্বাধীনতায়,
পথে নামতে হয় মিছিল করতে হয়।

পথের আল্পনা এখানে মাতৃভাষায় কথা বলে,
'উনিশ' হয়ে উঠে উপত্যকার পবিত্র শব্দঈশ্বর।


নার্সকে ভালোবাসতে গিয়ে...

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

সব ফর্মুলা ভুলে
ছুটে যাই জ্যামিতিক কায়দায়

নার্সকে ভালোবাসতে গিয়ে
শব্দের ধর্ম গাঢ় হয়
রাতের যন্ত্রণায় নেমে আসে ছন্দের দস্যিপনা
মানচিত্রের শুশ্রূষায় তখন লৌকিকতা
হাসপাতালে কবিতায় কবিতায় সে সারিয়ে তুলে
উচ্চারণের সমস্ত দ্বন্দ্ব

No comments:

Post a Comment