Saturday, November 30, 2019


















সত্যম ভট্টাচার্যের একটি আর্টিকেল 

কেন এমন হল?
                  
 

গাড়িটা এমন এক জায়গায় কিছুক্ষণ হল আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে যে এবার কি করবো,কোন দিকেই বা যাবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে।আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে আশপাশ ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে যাবে।এই জায়গাটা এমন যে কোন দোকানপাট বা মানুষজন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,তাই কাউকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবো সে উপায়ও নেই।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি আর দেখছি একের পর এক গাড়ি তীব্র গতিতে হাইওয়ে ধরে বেড়িয়ে যাচ্ছে।কোন কোন গাড়িতে আবার তারস্বরে বাজছে গান।সবাই যেন আফিমের নেশায় মশগুল।চারিদিকে কি হয়ে যাচ্ছে এই সম্পর্কে কারুর কোন জানবার ইচ্ছেই নেই।যেমন এই জায়গা থেকে ঠিক দু কিলোমিটারের মধ্যে একজন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে স্রেফ ছেলেধরা সন্দেহে।এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ঠিকও করতে পারছি না যে অন্য কোন গাড়ীকে হাত দেখিয়ে এখান থেকে বেড়িয়ে যাবো কি না।শুধু মাঝে মাঝে ভাবছি এই উন্মত্ততাই কি একমাত্র প্রাপ্য ছিলো আমাদের?
এই এমন সবুজের দেশে যেখানে হাতে হাত ধরাধরি করে ধামসা মাদলের আওয়াজে বেড়ে ওঠা ছিলো আমাদের সেখানে কিভাবে এই ভয়ঙ্কর বিষ ঢুকে পড়লো?না কি সবই মজুত ছিলো আমাদের মনে,শুধু বাকি ছিলো দেশলাইয়ে কাঠিটুকু পড়বার।একবার দেশে সে আগুন জ্বলতেই দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।সেখানে দিল্লী না গুয়াহাটি,কাশ্মীর না কন্যাকুমারির কোন দূরত্বই আর থাকলো না।যখন সহজেই পাওয়া যাচ্ছে নির্বোধ,হাবাগোবা বা খানিকটা জড়ভরত টাইপের লোক,ব্যস তখনই এই টার্গেট।একেই পিটিয়ে থেতলিয়ে খুঁচিয়ে প্রস্রাব বিষ্ঠা গিলিয়ে তবে না শান্তি আমাদের।আরো যদি মানুষটি হয় পঙ্গু বা অথর্ব তাহলে তো কথাই নেই।কারুর মনে প্রশ্ন আসে না যে মানুষটির নিজেকে দাড় করাতে গেলে কাউকে ধরতে হয় সে কিভাবে ছেলে ধরতে পারবে।আর যেখানে আমাদের সবুজ বলয়ে বহুদিন থেকেই সঠিক পুষ্টি বা খাদ্যের অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন লোকের কোন অভাবই নেই।সে হয়তো পাশেরই কোন জায়গার বা মূকবধির বা পথ হারিয়ে ফেলে বিভ্রান্ত।তাই মারো,এদেরকেই মারো,এমনভাবে মারো যে বলার যেন কোন জায়গাই আর না থাকে।আর বাকিরা নির্বিকার থাকো,ফোনের মোবাইল ক্যামেরায় ধরো রক্তের উতসব।এমন লোককেই বানাও আমাদের নিশানা।আমাদের তো করার কিছুই নেই,তাই চলো এ নিয়েই মেতে থাকা যাক।আমাদের দৈনন্দিনের হেরে যাওয়া,প্রাপ্য পাওনা না পাওয়া,একের পর এক সবুজ লাল হলুদের আমাদেরকে নিয়ে ছেলেখেলা,আমাদের ভালোবাসার মেয়েদের স্রেফ খাবারের অভাবে স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া দিল্লী-মুম্বাইতে-আমাদের মনে এইসব হতাশা নিয়ে এসেছে।তাদেরকে কিছু করতে না পেরে আমাদের টার্গেট ঠিক হয়েছে এইসব সফট পয়েন্টেই।
কিন্তু এই উন্মত্ততার আফিমে মাতাল হয়ে আমরা যেটা করছি যে নিজেরাই নিজেদের খুন করছি আমরা।ভারতবর্ষের এই ভূখন্ডে যেখানে বাস  সাদ্রী-নেপালী-রাভা-মেচ-রাজবংশী সহ বহু ভাষাভাষী মানুষের-তাদের মিলিত সংস্কৃতি-মিলিত জীবনই বহন করতো ভারতের প্রকৃত ধর্ম-বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।কিন্তু এইরকম গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষ বিশ্বাস হারাবে মানুষে।এর আগেও সুচতুর ভাবে বহুবার এই পারস্পরিক বিশ্বাসে আঘাত হানার চেষ্টা করেছে কুচক্রীরা।সাময়িক বিশ্বাসে হয়তো চিড় ধরেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর।কিন্তু আবার সব বাধাবিঘ্ন জয় করে জীবনের মন্ত্রে একে অপরের পাশে এসে দাড়িয়েছিলো এই এলাকার প্রত্যেকটি মানুষ।কারণ এই দেশ সবার।আর বাঁচতে হলে তো এখানে এই কঠিন জীবনে,এই জঙ্গলাকীর্ণ শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেষ্টিত ভূখন্ডে,বাঁচতে হবে একে অপরের হাতে হাত ধরেই।এখানে এই চাবাগানের ঢালু ভূখন্ডে যেখানে যে কোন সময় এমনকি দিনের বেলাতেও ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে চিতাবাঘ,মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চা পাতা তোলে মায়ারাণী তামাং আর লছমী ওঁরাও।নিশ্চিন্তে চাবাগানের মাঝে একটু ফাঁকা জায়গায় নিজেদেরই করা ক্রেশে অবলীলায় বাচ্চাকে রেখে পাতা তুলতে সদ্য মা হওয়া শ্রমিক মহিলাটি।বাচ্চা যখন কাঁদে দুধের জন্য,তার মায়ের জন্য,তাকে কোলে নিয়ে স্তন্যপান করান ঘুম পাড়ান আরেক মহিলা।রাতে সাক্ষাত মৃত্যুদূত হয়ে আসে হাতি,তাকে তাড়াতে সবাই মিলে সবাই মিলে হল্লা করতে হয় একসাথে।এভাবেই আমাদের বেঁচে থাকা-কঠিন ভূখন্ডের যৌথ জীবন।এখানে প্রাইমারী স্কুলে পাশাপাশি বসে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারে সোমরা মুন্ডা আর রোশন তামাং।একসাথে খেলতে খেলতে তারা চা বাগানের পথে স্কুলে যায় আসে।এই বিশ্বাসই জীবন এখানকার।কিন্তু কিভাবে এই বিশ্বাসের জীবনে এতবড় এতবড় অবিশ্বাসের গাছ জন্মালো যে এক চা বাগানের একজন মানসিকভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে স্রেফ ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেললো খানিক দুরের আরেক চা বাগানের লোকেরা।তা সম্পর্কে জানতেই এসেছিলাম এখানে।কিন্তু এই সন্ধ্যা রাতে মনে হচ্ছে দেরী হয়ে গেছে।আর ভয়ও লাগছে খানিকটা।দিনে দিনে যে পাশবিক হিংস্রতা বাসা বাঁধছে মানুষের মনে-যে নারকীয় মনোবৃত্তিতে কিছু মানুষ মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলছে নিরীহ একলা মানুষকে-এখন অপেক্ষা করতেই হবে এই সময় কেটে যাবার।আর স্বপ্ন দেখতে হবে,আবার নতুন সকাল আসবে-আবার হাতে হাতে ধরে চলা শুরু করবে এই ভূখন্ডের সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষার লোকেরা...(সাম্প্রতিক ডুয়ার্সের বেশ কিছু জায়গায় গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে এ লেখা)

No comments:

Post a Comment