Tuesday, March 31, 2020


রিপন হালদারের বুক রিভিউ 

এখানে অমল নামে কেউ থাকে না’ গল্পগ্রন্থের পাঠ প্রতিক্রিয়া।
লিখেছেন শাক্য দে চৌধুরী

এর আগে দুটো কবিতার বই লিখেছেন। লেখকের এটাই প্রথম গল্পের বই। যদি কেউ ধরে নেয় যে, গল্পের বইয়ে তাঁর কবিসত্তার প্রভাব পড়বে, বলা বাহুল্য যে সে ঠিকই ভাববে। কিন্তু আরো যা যা সে ভাবতে পারবে না, বা ভাবা যাবে না তেমনই কিছু অভাবনীয় উপাদান ও প্রয়োগ এই বইটাকে অকল্পনীয় করে তোলে। 
বইটাতে মোট সাতটি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পেই লেখক তাঁর বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং উপস্থাপনায় অপরিচিত মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। প্রতিটি গল্পের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে সেই প্রথাভাঙা যাদু পাঠককে অন্যরকম ব্যাখ্যা করতে শেখায়, অনিবার্যভাবেই।
যেমন, ‘দ্য বয় উইথ দ্য বাই-সাইকেল’ গল্পটিতে এক কিশোর তার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর দিন সকালবেলা দুশ্চিন্তায় আনমনে তার সাধের সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। রেললাইন, বসতি, দীর্ঘ সরু রাস্তা পেড়িয়ে সে কোথাও একটা যায়। অথবা কোথাওই যায় না। এই যাওয়া না যাওয়ার মূল্যায়ন অর্থাৎ যার নিরিখে দাঁড়িয়ে আমরা কানের পাশে – জামার কলারে দুরন্ত হাওয়া আর পায়ের নিচে অমোঘ প্যাডেল অনুভব করি, সেটাও কি আসলে স্থির অস্থিরতা নয়! যা জনৈক পেন্ডুলামের মতো দুলতে দুলতে ক্রমশ নিচে নেমে এসে সম্ভাবনাময় বাস্তব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখছে।
আবার ‘এসো, বিষণ্ণতা এসো’ গল্পে এক নিটোল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কেউ আবিষ্কার করে জুটমিলের বড়ো নাৎসি একটা পাঁচিল কতো উচুতে উঠে গেছে! কদিন আগেই ওখানেই একটা নদী ছিল, যার তীরে মহালয়ার ভোরে একটা দোদুল্যমান শূন্য নৌকার পাশেই সূর্যোদয় হয় আর সেখানেই নিহিত ছিল দুঃখবোধের বীজ। ওঝা বলেছিল পরীতে পেয়েছে। হাজার ধূপকাঠির গন্ধেও সেই পরী চলে যায়নি। বরং বহু বছর পরে কোনো এক মহালয়ার ভোরেই গুলকয়লার ধোঁয়া আর ড্রেনের ধারে পয়াখানায় মগ্ন বাচ্চাদের সারি পেড়িয়ে পরী সন্ধান দেয় সেই পুরনো নদীর। 
নীত্‌সের দর্শনের এক দুর্দান্ত প্রভাব প্রায় অধিকাংশ গল্পে পাওয়া যায়। জাগতিক ও মহাজাগতিক পুনরাবৃত্তির যে অবাস্তব বাস্তবতা নির্ধারিত হয় লেখক তার অন্য রূপ দিয়েছেন। একদেশ থেকে আরেক দেশে অনুপ্রবেশের যে ক্লান্তিকর ইতিহাস চলে আসছে, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্বিসহ ঐতিহ্যের স্রোতে সপরিবারে ভাসতে ভাসতে মাঝনদীতে জনৈক বৃদ্ধের আবদার তার বৌমার উদ্দেশ্যে, “অরে একটু জাগাও বৌমা, শ্যাশবারের মতো দ্যাশটারে দেইখ্যা লউক!”
সাইকেল বা হেলিকপ্টার, নৈহাটির ভাড়াবাড়ি, পাটকল, যন্ত্রে (যন্ত্রণায়) উত্‌সর্গীকৃত আঙুলের দাম, ইঁটের বোঝা নিয়ে কন্ট্রাকশন বিল্ডিঙের উঁচু আড়ালে চলে যাওয়া রিফিউজি মা ইত্যাদি পেড়িয়ে বহু বছর পরও ক্যানিং বর্ডারে (তৎসহ পৃথিবীর সমস্ত বর্ডারে) পুরনো গন্ধটাই ফিরে ফিরে আসে। নদীর পারে ঘোর কুয়াশায় ভোরবেলা পাঁচ-সাতজনের একটা দল, পালাচ্ছে। কে যেন তার বাচ্চাকে জাগাচ্ছে, “শ্যাশবারের মতো জন্মভূমিরে একবার দেইখ্যা লও! একবার চোখ খোলো বাবা আমার!”
আবার ‘যে চরিত্রটি লেখক হতে চেয়েছিল’ গল্পে, সেখানেও একটা ফিরে আসা আছে বা আদৌ  ফিরে আসা নাকি নিছকই একটা জন্মগত ভ্রম, সেবিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এই জাদুবাস্তবতা ক্রমে প্রানান্তকর হয়ে ওঠে সেই লেখকের কাছে যে প্রচন্ড চেষ্টা করেও বিগত একবছর যাবত্‌ একটা ছোট গল্প শেষ করতে পারছে না। কেননা গল্প লিখতে বসলেই বড়ো বড়ো লাল ডাঁসা পিঁপড়ের মিছিল এসে শব্দগুলো খেয়ে চলে যায়। আবার লেখকও চরিত্রকে বিশ্বাস করাতে পারে না, “আমি লেখক আর তুমি আমার সৃষ্ট চরিত্র”। চরিত্রও তার সৃষ্টিকর্তাকে বাড়িওয়ালা বলে ভুল করে। চরিত্রের মাথার উপর দিয়ে ‘যোগচিহ্নের মতো বিষণ্ণ পাখি” উড়ে চলে যায়। আর লেখকের পথ আগলে বসে থাকে অগণিত পিঁপড়ের সমাবেশ।
সম্পূর্ণ অন্য এক সুর প্রতিধ্বনিত হয় ‘এডিটর’ গল্পেও। ল্যাপটপের স্ক্রিনে হঠাত্‌ দেখা দেওয়া একটা কালো স্পট ল্যাপটপের চতুঃসীমা পেড়িয়ে ঢুকে পড়ে এডিটরের জীবনে। শহর, রাস্তা, ব্রীজ, রেললাইন দুমড়েমুচড়ে এক সর্বগ্রাসী অতলতার স্মৃতিভ্রম, এডিটর নাকি তার শর্টফিল্মের চরিত্র, শেষমেশ কাকে পেয়ে বসে আমরা বুঝতেই পারি না।
‘আমি আর আমার হারিয়ে যাওয়া প্রতিবিম্ব’ গল্পটিতে ইতিহাস নিয়ে পড়তে পড়তে জনৈক ছাত্র মুন্ডুহীন কনিষ্কের মূর্তির সাথে নিজেকে মিশিয়ে স্মৃতি, দৃশ্য, স্পর্শ নির্বিশেষে এক মায়াময় অস্তিত্বহীনতায় ভোগে। হারিয়ে যায় তার প্রতিবিম্ব।
আরেকটি গল্পে হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য, ইচ্ছা বা কাঙ্ক্ষিত সম্ভাব্যের অবাস্তব বিমূর্ত শব্দগুলো আঁকড়ে ধরে মা-বাবা পরিত্যক্ত একটা ছেলে ভালবাসতে শেখে তার আবর্জনাময় তার জীবনটাকে। শব্দেরা পরী হয়ে ভুলিয়ে দেয় অসহ্য গরম আর লোডশেডিং। ভুলিয়ে দেয় দুশ্চিন্তা।
বিষয় নির্বাচনে, স্টাইলের অভিনবত্বে, অপ্রতিম আঙ্গিকে, শব্দ দৃশ্য আর ভাবগত ব্যঞ্জনাময় প্রতিটি গল্পই পরস্পরের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। JUSTAPOSITION -এর মতো একটা জিনিসকে যদি কেউ গল্পে ঢুকিয়ে দেয় তবে কী যে হয়! চরিত্র, প্রেক্ষাপট, স্থান, কাল, পাত্র ইত্যাদি কোলাজ যদি ব্যাকরণ না মানে তবেই বা কী হয়! অবচেতনের যুক্তিহীন প্রলাপ যদি সমান্তরাল অন্য এক দুনিয়ার খোঁজ দেয়, তবেই বা কী হয়! আর এগুলো পেড়িয়ে কিছু অস্পষ্টতা ও ধাঁধা নিয়ে পাঠক যদি পরের গল্পে না গিয়ে এই গল্পটাই পড়তে চায়, তখনই বা কী হবে! লেখক তার স্পর্ধা পেরিয়েছেন। পরিচিত বোধগম্য যা কিছু, সেখান থেকে বেরিয়ে এক অজানা ফসলের চাষ করেছেন তিনি। পণ্য সাহিত্যে বিকিয়ে যাওয়া এই বাজারে এই ফসল আজ গভীর ভাবে প্রাসঙ্গিক। 

এখানে অমল নামে কেউ থাকে না
রিপন হালদার
প্রকাশক- তবুও প্রয়াস 
বিনিময়- ১২৫/

No comments:

Post a Comment