সত্যম ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত গদ্য
এভাবেই বসন্ত আসে
অলিখিতভাবে সরস্বতীপুজো মানেই শীতকালের চলে যাওয়া।এবারেও যথারীতি তার ব্যতিক্রম হল না।দু বছর পর পর দুদিন ধরে সরস্বতীপুজো চলছে।সমস্ত ক্লেশ ক্লেদ ভুলিয়ে দিয়ে দেবী যেন যথার্থ প্রেমের দিন হিসেবেই দিনটি আমাদেরকে উপহার দিয়ে থাকেন।এ যেন ঠিক বাঙালীর ভ্যালেন্টাইন্স ডে।আর এই চলে যাওয়া শীতকাল-সরস্বতী পুজো-ভ্যালেন্টাইন্স ডে, এসবের সাথেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে মাধ্যমিক পরীক্ষা।এসময় থেকেই কেমন যেন ঠোঁট ফেটে যেতে থাকে,স্কুলের বিশাল বড় মাঠের কোথাও কোথাও পাক খেয়ে ওঠে হাওয়া,সাথে সাথে পাক খায় খড়কুটো-জঞ্জাল-প্লাস্টিক।একই সাথে মনের ভেতরেও ডানা মেলতে থাকে মনকেমনের হু হু।আর কখন যেন অজান্তেই শুরু হয়ে যায় বসন্তকাল।
চারিদিক স্তব্ধ করে চলা মাধ্যমিক পরীক্ষার এমন নিঝুম দুপুরেই কড়া গার্ড দিতে দিতে মোটা ভারী ফ্রেমের রাগী দিদিমণিটিরও হয়তো মনে পড়ে যায় মনের ভাঁজে বা বইয়ের ভাঁজে রাখা তার প্রথম লেখা বা প্রথম পাওয়া চিঠিটির কথা।দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি উদাস চোখে তাকিয়ে থাকেন বিশাল মাঠটার দিকে।সেখানে তখন হাওয়া পাক খেয়ে খেয়ে উঠছে,যেমন উঠছে দিদিমণির মনের ভেতরেও অসংখ্য বুদবুদ কোন অজানা মহাদেশের অতল থেকে।ওই কয়েক মূহুর্তের জন্যই হয়তো তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কুলমাখা,বিটনুন আর হজমির কথা।মনে পড়ে পঞ্চদশী কিশোরীর প্রথম অবাক চেয়ে থাকা বা তার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করা কাউকে আড়চোখে দেখে নেবার দিনগুলোকে।অথবা যেদিন হয়তো পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে সন্ধের নিঝুম রাস্তায় ছেলেটির একহাতে সাইকেল আর অন্যহাতের আঙ্গুল ছুঁয়েছিল তার আঙ্গুল,সেই শিরশিরাণি,সেই হু হু হাওয়ার সাথেই তো জানালা দিয়ে মনের ভেতর ঢুকে পড়ে একখন্ড কুয়াশা বা মেঘ।এটাই তো গোটা উত্তরবাংলা জুড়ে নেমে আসা বসন্তকাল।
এইসময় নাগাদই হয় উত্তরবঙ্গের দুটো নাম করা মেলা।হলদিবাড়িতে হুজুরের মেলা আর জল্পেশে শিবরাত্রির মেলা।যদিও এখন মেলা মানে দাদু-ঠাকুমার মুখে শোনা গরুর গাড়িতে চড়ে কদিনের জন্য মেলায় থাকা তা আর নেই।কিন্তু মেলা মানে প্রকৃত অর্থেই মানুষের মিলনক্ষেত্র।মেলা মানে এখোনো টমটম গাড়ি,বাঁশি,ভেঁপু আর ঢোলের আওয়াজ।সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোরের ভালোলাগা মেয়েটির খানিক পিছু পিছু চলা।এসবের পাশ দিয়ে ফিরতে ফিরতেই বিগত যৌবন ক্লান্ত মাস্টারমশাইয়েরও হয়তো মনে পড়ে যায় বহু বহু বছর আগের এই মেলাতেই কোন এক সন্ধের কথা।তার বহুদিনের মনের কথা না বলতে পারা কেউ চলে যাচ্ছে অন্য আরেকজনের সাথে হাত ধরে হাসতে হাসতে।ফ্যালফ্যাল দাঁডিয়ে থাকছেন তিনি,আর তারপর আধো অন্ধকার এক সরু গলি,এমনই বসন্তকাল,ফাঁটা ফাঁটা ঠোঁট জ্বলছে,দমকা বাতাসের শিরশিরানি জন্ম দিছে এক আশ্চর্য ঘোরের।
সারা জঙ্গল জুড়ে তখন পরে থাকে ঝরে পড়া পাতারা।লাল- কমলা মাদার-শিমুল গাছে ভিড় করে আসে মৌটুসী আর বেনে বৌ পাখির দল।তখন বাসের ভেতরে গরমে ঘেমে ওঠা আর নামলেই অল্প অল্প শীত,দমকা হাওয়া আর বাড়িতে ভুলে আসা হাফ সোয়েটার অথবা উইন্ডচীটার।এভাবেই এসো বসন্তকাল,চিরদিন এভাবেই,উত্তরের বাঙালীর হয়ে,আমাদের হয়ে...
খুব সুন্দর ।
ReplyDelete