" চা-ফুল এবং ভাতের মিছিল "
' কবিতা করিডোর ' উত্তরবঙ্গের প্রথম মাসিক ওয়েবজিন । এই ব্লগ নতুন সৃষ্টি নিয়ে ভাবে । কবিতা নয় সাহিত্যের নানা দিক ও চিত্রকলা থেকে চলচ্চিত্র সবেতেই এই ব্লগ নতুন ভাবনার পথিক ।
Friday, November 20, 2020
ভুল
সোমনাথ বেনিয়া
বউটি প্রতিদিন তুলসীমঞ্চে সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ জ্বালাতো তার স্বামীর আরোগ্য কামনায় আর সকালে নিভে যাওয়া প্রদীপ আনার সময় একটি তুলসীপাতা তুলে আনতো তার স্বামীকে মধু দিয়ে খাওয়ানোর জন্য।
একদিন সকালে সেই বউ ঘুম থেকে উঠে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুমাচ্ছে আর তার মুখের উপর প্রদীপ শিখার মতন একটি উজ্জ্বল আভা তৈরি হয়ে আছে। সেটা দেখে সে ভীষণ খুশি হলো। বিছানা থেকে নেমে সে তুলসীমঞ্চে গেল এবং দেখলো এক অদ্ভুত ব্যাপার যে প্রদীপটি তখনও একই ভাবে জ্বলছে যেমনটি সে সন্ধ্যাবেলায় জ্বালিয়ে গিয়েছিল। সাধারণত প্রদীপটি নিভে যায় এবং সকালে সেটাকে তুলে আনার সময় একটি তুলসীপাতা তুলে এনে ঘরে ঢোকে। তাই সে অবাকই হোলো। কিন্তু অতশত না ভেবে সে প্রদীপের শিখাটি এক ফুঁয়ে নিভিয়ে একটি পাতা তুলে এনে ঘরে ঢুকলো। তারপর স্বামীকে ডাকতে গিয়ে দেখে তার মুখের উজ্জ্বল আভা চলে গিয়ে সেখানে পোড়া দাগের কালশিটে ছোপ পড়ে আছে ...
নির্জন পার্ক
শোভন মণ্ডল
এই পার্কটা বেশ নির্জন। ঊর্মি দু'দিন ছাড়া এখানে আসে। ঝিলের ধারে এই বেঞ্চটা তার খুব পছন্দ। লোকজন খুব একটা এদিকে আসেনা। একটা গভীর ঝোপ জায়গাটাকে আড়াল করে রেখেছে।
অন্যদিনের মতো ঊর্মি এখানে এসে বসলো।ব্যাগটা পাশে রেখে রুমালটা বের করে ভালো করে মুখ মুছলো। ঢকঢক করে বোতল থেকে জল খেল খানিকটা। তারপর যথারীতি কালো ব্যাগটা থেকে ল্যাপটপটা বের করে কোলের ওপর রাখলো। খটখট করে টাইপ করতে লাগলো। আসলে সে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। বিভিন্ন আর্টিকেল লিখে সংবাদপত্রে মেল করে পাঠায়। এই পার্কের বেঞ্চটাই তার কাজের ডেস্ক হয়ে উঠেছে বেশ কিছুদিন। অনেকক্ষণ কাজ করার পর ল্যাপটপটা মুড়ে রেখে একটু আড়মোড়া ভাঙলো সে।
বেলা পড়ে এসেছে। তবে বিকেলের আলো এখনও ঝিলের ওপরে খেলা করছে। এইসময়ই একটা বৃদ্ধ লোক লাঠি হাতে বেঞ্চির কাছে এসে ইতস্তত করছিল বসার জন্য। ঊর্মি ব্যাগদুটো আর জলের বোতলটা নিজের দিকে সরিয়ে নিয়ে কিছুটা জায়গা করে দিল। বৃদ্ধমানুষটিকে তবুও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঊর্মি মৃদু হেসে বললো, বসতে পারেন।
বৃদ্ধ বসলেন। দুচোখে প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট।
খুব স্টাইলে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ মাই সান
ঊর্মি কোনো কথা বললো না। আবার ল্যাপটপ খুলে কাজ শুরু করলো। আলো কমে যাবার আগেই লেখাটা শেষ করতে হবে তার।
অনেকক্ষণ কাজে মগ্ন থাকার পর বৃদ্ধের একটি কথায় তাল কাটলো ঊর্মির।
--তোমার নাম কী মা?
--ঊর্মি
--তোমার অসুবিধা হচ্ছেনা তো?
--এ মা, অসুবিধা হবে কেন? অবাক হয়ে বললো ঊর্মি।
-- আসলে জানো তো মা, আগে এখানে প্রায়ই আসতাম। আমার স্ত্রী আর আমি এই বেঞ্চিটাতে এসেই বসতাম। উনি চলে যাবার পর আর আসিনা। তবে বছরে এই একটি দিন...
বলে বৃদ্ধ যেন চোখ মুছলেন। ঊর্মি কাজের কথা ভুলেই গেছে।
--কোন দিন...? মুখ ফুটে প্রশ্নটা করেই ফেললো।
ঝুরোগল্প
কাজল সেন
গোঁয়ারগোবিন্দ
গোঁয়ারগোবিন্দ একেই বলে। একবার রোখ চাপলেই হলো, সেটা শেষ না করা পর্যন্ত কোনো ছাড়ান নেই। হ্যাঁ, তোতনের এটাই একমাত্র দোষ। সেই যে প্লাশ-টুয়ের সিবিএসসি বোর্ড পরীক্ষায় যে কান্ডটা করল! কয়েকটা ম্যাথ সল্ভ করার পর একটা ইন্ট্রিগাল ক্যালকুলাসের সাম কিছুতেই সল্ভ করতে পারছিল না। ব্যাস রোখ চেপে বসল। সল্ভ তাকে করতেই হবে। এদিকে আরও কয়েকটা অঙ্ক তখনও সমাধান করা বাকি। খুবই সহজ প্রশ্ন। অনায়াসে করে ফেলতে পারে। কিন্তু করবে না। যেটার সমাধান করা যাচ্ছে না সেটা নিয়েই তার কুস্তি। কেন হবে না? হতেই হবে! আরে বাবা, এদিকে যে পরীক্ষার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে! অন্য যেগুলো করা যাবে, সেগুলো আগে করে নে! না, তা হবে না। ওগুলো তো চুটকি মেরে হয়ে যাবে। কিন্তু এটা কেন হচ্ছে না? বাকি সময়টা তোতন লড়ে গেল সেই ইন্ট্রিগাল ক্যালকুলাসের সঙ্গে। তোতনের মা বাবা অসহায় কন্ঠস্বরে বললেন, বলুন তো, এই ছেলেকে নিয়ে আমরা কী করি? অঙ্কের পরীক্ষাটাই চটকে দিল!
ঠিক একই কান্ড কলেজেও। সহপাঠী একদঙ্গল মেয়ের মধ্যে আচমকাই তার ভালো লেগে গেল ঝিমাকে। ঝিমা খুবই অ্যাভারেজ মেয়ে। শরীরে ও পড়াশোনায়। তবে খুব সাংস্কৃতিক মানসিকতার। নাচ ও গান দুটোই শিখছে। ভালো আবৃত্তি করতে পারে। পারিবারিক আবহাওয়া নিতান্তই রক্ষণশীল। কলেজেই শুধুমাত্র ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করে। ঘরের কেউ তা জানে না, পছন্দও করে না। এমনই এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল তোতন। সরাসরি ঝিমাকে জানালো তার মনের কথা। বেচারি ঝিমা! সে আর কী করে! প্রস্তাবে সাড়া দিতে মনের কলকব্জাগুলো ছটপট করে, অথচ ঘরের কথা চিন্তা করলে মনটা দমে যায়। তোতন ঝিমাকে বোঝায়, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, তুই ভালো করে ভেবে দেখ। তারপর যদি রাজী থাকিস, আমাকে জানাস। ব্যাস সেই থেকে শুরু হলো তোতনের প্রতীক্ষার প্রহর গোণা। চারিদিকে অসংখ্য মেয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, অথচ তোতন সেদিকে তাকিয়েও উদাসীন থাকে। কিছু মেয়ে তাকে নাড়া দিতে চাইলেও সে নড়ে না। ঝিমি কবে ভেবে তাকে হ্যাঁ বা না জানাবে, তার আগে অন্য কোনো মেয়েকে তার ভাবনায় এন্ট্রি দিতে সে নিতান্তই গররাজী। এদিকে ঝিমাও কোনো সিদ্ধান্ত নেবার মতো অবস্থায় নেই। এর আগে কোনো ছেলে তাকে প্রপোজ করেনি। তোতনই তার হৃৎপিণ্ডে প্রথম এমন টেনশন ইনজেক্ট করেছে। মা বাবা দাদারা এসব জানতে পারলে হয়তো ঝিমাকেই কেটেকুটে গরমমশলা দিয়ে ঝোল বা ঝাল বানিয়ে দেবে।
কিন্তু তোতনকে এসব বোঝায় কে? তিন তিনবার সে তার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র বসের সঙ্গে লড়ে গেল প্রোডাকশন শপের কোনো একটা মেকানিক্যাল গন্ডগোল নিয়ে। তোতন নাছোড়, বসকে সে কনভিন্সড করেই ছাড়বে যে, বস সমস্যাটা আসলে কিছুই বোঝেনি।
তবে তোতন তার বেস্ট পারফর্মেন্স দেখালো বিয়ের আগে। ভাবী শ্বশুরকে বলল, মিতাকে আমি বিয়ে করব, কিন্তু মিতা অঙ্কে নেহাৎ কাঁচা। আগে আমার কাছে রেগুলার ক্লাস করে পাশ করুক। তারপর উলু-উলু…
ছোটগল্প
ফজিলন বালা
মিলটন রহমান
এক.
পাড়ে নোঙর ফেলে জলসন্তরনের বিপরীতে স্থির হয়ে আছে নৌকাটি। কোন তাড়া নেই অন্য কোথাও যাওয়ার। জলের বুকে ব্যস্ত বৈঠা গেঁথে গেঁথে নৌকারা চলে যাচ্ছে গঞ্জে কিংবা অন্য পাড়ে। কেবল এই নৌকাটির অন্য কোন গন্তব্য নেই। এখানেই রোদের সামিয়ানার নীচে থির হয়ে আছে। মাঝে চিৎ হয়ে শুন্য আকাশের সাথে কথা কইছে তরুণ মাঝি আকানূর। চোখের পলক পড়ে না। দ্রুত চলে যাওয়া নৌকার ঠেলে দেয়া ঢেউ আকানূরকে দোলা দিয়ে যায়। তার নৌকা জল কামড়ে থির হয়ে থাকে। অকস্মাত ঘূর্ণির মতো মোচড় দিয়ে ওঠে নৌকা। কোনমতে টাল সামলে উঠে বসে আকানূর। দেখে চোখের সামনে দাঁড়ানো একপেড়ে তাঁতের শাড়ি পরা এক তরুণী। ঝাঁঝালো কণ্ঠ আকানূরের-
-ওই নৌকা যাইবো না, নামেন।
শুনেছে কি শোনেনি বোঝা গেলো না। এক পাশে বসে পড়লো তরুণী।
-কইলাম না যামু না, বসলা ক্যান?
তরুণী চোখ তুলে তাকায়। খিল খিল হাসে।
-রাগো ক্যান মাঝি। আমারে একটু গাঙের ওই পাড় থিকা ঘুরাইয়া আনো। তোমার লগে বেড়াইতে চাই।
মুহুর্তেই আকিনূরের চোখ গেঁথে যায় তরুণীর চোখে। এতো সুন্দরী এই গাঙে এলো কোথা থেকে! যাবেইবা কোথায়?
-বাড়ি কই, আর যাইবেন কই?
-এই গাঙই আমার বাড়ি। এইহানেই আমারে একটু ঘুরাও মাঝি। তোমারে গল্প কমু।
-আমার গল্প হুননের কাম নাই। কই যাইবেন কন, নামাইয়া দিয়া আহি।
-কইলাম তো এই গাঙই আমার বাড়ি।
-আমার লগে ফাইজলামি করেন, নামেন নৌকা থিকা।
-গল্প শুনবা না মাঝি?
কি এক মুস্কিল। আকিনূরের চোখ-মুখ থেকে লাফিয়ে পরে বিরক্তি। কত সুন্দর তাতানো রোদে শরীরটা মেলে ধরেছিলো। তার চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা, কি গল্প বলতে চায় তরুণী। কে সে? এতো রূপসী মেয়ে তাদের গাঁয়ে দেখে নি আগে। কোথা থেকে এলো? কোথায় যাবে? আবার বলছে এই গাঙই তার বাড়ি। পাকানো কথাসমুহের কোন জট খুলতে পারে না সে। চেঁচিয়ে বলে-
-কন কি গল্প হুনাইতে চান।
দুই.
জলের ঢেউ আঁচড়ে পড়ে নৌকায় মিশে গিয়ে যেনো শেষ হয় তরুণীর বাঁকানো শরীরে। গল্প শুরু করার আগে কাটা তরমুজের মত ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে। চোখে-মুখে শূন্যতা। নদীর পাঁজর চিরে দ্রুত চলে যাওয়া একটি নৌকার দিকে ইঙ্গিত করেই গল্প শুরু করে তরুণী।
-এই পথেই আসা যাওয়া আছিলো ফজিলন বালা‘র। কি রইদ, কি বিষ্টি, কি ঝড়, কি তুফান, কোন কিচ্ছুই থামাইতে পারতো না তারে। এই পথেই গাঙের ওইপারে যাইতো কবিরের লগে দেহা করতে। কোন কোন দিন কবিরও আইতো এই পাড়ে। সেই সত্তুর-একাত্তুর সালের কথা। তখন এই পাড়ার মাইয়ারা কোন পোলার লগে সম্পর্ক করার কথা স্বপ্নেও ভাবতো না। ফজিলন আছিলো উল্টা। কাউরে ডরাইতো না। রূপের তার কমতি আছিলো না। কত পুরুষ যে তারে পছন করতো তার কোন হিসাব নাই। কিন্তু কাউরেই সে গোনায় ধরতো না। কেবল কবিরই আছিলো তার সব। ওই সময় আবার দেখা দিলো গল্ডোগল। সারা দেশে কেবল গন্ডগোলের খবর। পাড়ায় পাড়ায় পাকিস্তানি পুলিশ। এই গাঙে সারাক্ষণ পুলিশ আর আর্মিরা যাইতো আর আইতো। পাকিস্তানীদের পক্ষে একটা দল হইলো শান্তিবাহিনী নামে। তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়া সাবধান করে, কেউ যেন মুক্তিবাহিনীতে না যায়। তারপরও অনেক পোলা ভারতে চইলা গেছিলো ট্রেনিং নিতে। হেই খবর যখন পাকিস্তানী মিলিটারি জানলো তো শুরু হইলো নির্যাতন। ফজিলনদের গ্রামের মোল্লা বাড়িতে একদিন আস্তানা গাড়লো পাকিস্তানী মিলিটারি। যাগোর পোলারা মুক্তিবাহিনীতে গেছে তাগোরে ডাইকা কইলো, যেনো তাগো পোলাদের ফিরাইয়া আনে। যারা গেছে তারা কি আর ফিরা আহে। আহে নাই। তারপরতো শুরু হইলো বাড়ি জ্বালাও। প্রায় সব বাড়ি থেকেই ধইরা নিয়া গেলো কম বয়সী মাইয়াদের। সেই তখন, ফজিলন বালা ছাড়লো বাড়ি। তার রূপের সুন্দরও হইয়া গেছিলো কাল। করলো কি সারা শরীরে কালি মাইখা, ছিঁড়া শাড়ি পইরা, গেলো কবিরের কাছে। কইলো, চলো কবির যুদ্ধে যাই। শত্রুগরে খেদাইতে না পারলে কাউরে বাঁচতে দিবো না। চলো কবির ভারতে গিয়া ট্রেনিং লইয়া যুদ্ধে নামি। কার কথা কে হুনে। কবির যাইতে রাজি হয় না। তার বাবা-মা উল্টা ফজিলনরে কইলো হেই যদি কবিররে যুদ্ধে নিতে চায় তাইলে মিলিটারিরে কইয়া দিব। ফজিলনরে ধরাইয়া দিব। কবির সাফ জানাইয়া দেয় যুদ্ধে যাইবো না।
আকিনূর মগ্ন হয়ে শোনে তরুণীর কথা। যত শুনে ততই চোখে জেগে ওঠে বিস্ময়।
-কি কও, কোন জাতের পোলা কবির! দেশের এমুন গন্ডোগলে যুদ্ধে যাইতে চাইলো না। অথচ ফজিলন মাইয়া হইয়া কইলো যুদ্ধে যাইবো।
-হ, কবির গেলো না। ফজিলন পলাইয়া যুদ্ধে যোগ দিতে চইলা গেলো। ট্রেনিং নিতে যোগ দিলো আগরতলার লেম্বুচোরা ক্যাম্পে। পুরুষ যোদ্ধাগর লগে বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্প থেকে আনা হইলো আরো নয়জন মাইয়া। যাগো বয়স প্রায় ফজিলনের সমান। দশ জনের একটি দল বানাইলো কমান্ডার। ওই দশ জনের মইধ্যে ফজিলন স্যুইসাইড স্কোয়াডের ট্রেনিংও নিছিলো। ট্রেনিং শেষে যোগ দিলো মতিনগর সাবসেক্টরে। তার সাহস দেইখা কমান্ডার ল্যাফটেন্যান্ট দিদারুল আলম নতুন নতুন অপারেশনের পরিকল্পনা করে। প্রথম অপারেশন হইবো পয়েলগাছায়। হেইখানে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালাইতে হইবো। একটা বোডের মইধ্যে মানচিত্র আইকা কমান্ডার সবাইরে বুঝাইয়া দিলো কোন দিক থিকা আক্রমণ শুরু করতে অইবো। কোন দিকে কতজন থাকবো। কার লগে কোন অস্ত্র থাকবো। মাইয়াগো কি করতে অইবো। সব বুঝাইয়া দেওনোর পরে শুরু হইয়া গেলো চলা। মতিনগর থিকা মাঝরাইতে বিশ জনের একটি দল রওনা দিলো পয়েলগাছার দিহে। আগেই দুইজনরে পাঠানো হইছিলো আশপাশে অবস্থান লইয়া খবর দেওনের লাগি। ঠিক ফজরের আজানের আগে আগে সবাই হাজির হয় পয়েলগাছায় সেই আর্মি ক্যাম্পের কাছে। বিশজন ভাগ হইয়া গেলো চাইরভাগে। আগে আসা দুইজনের একজন আইসা কইলো সূর্য উঠার আগেই আক্রমণ করতে অইবো। কমান্ডারের আদেশ মতই ফজিলন আরো দুইডা মাইয়ারে লইয়া ঢুকলো ক্যাম্পের ভিতর। সবার কোমরে শাড়ীর নিচে বান্ধা স্ট্যানগান। সোজা ঢুইকাই এক সিপাহীরে কইলো, তোমার বসের কাছে লইয়া চলো, আমরা তারে একটা খবর দিতে আইছি। সুন্দরী ফজিলনরে দেইখা সিপাহী বেটা দৌড় দিয়া তার কামান্ডাররে ডাইকা নিয়া আইলো। কমান্ডার উর্দুতে তাদের অন্ধরে যাইতে কইলো। অন্ধরে যাইয়াই কমান্ডাররে কইলো দরজা লাগাও, তোমার লগে জরুরী কথা আছে। কমান্ডার সিপাহীরে বাইর কইরা দিলো দরজা লাগায়া। খাস কামরায় গিয়া ফজিলন কোমর থিকার স্ট্যানগান বাইর কইরা ঝাঝরা কইরা দিলো কামন্ডারের বুক। সাথে সাথে চাইরদিকে থাকা মুক্তিরাও খইয়ের মত আক্রমণ করলো। হেইবার কোন মুক্তিযোদ্ধা মরে নাই। মরছিলো পাকিস্তানী আর্মির ছয় সিপাহী ও তাগো কমান্ডার। অপারেশন শেষ কইরাই সূর্য উঠার আগেই সবাই অবস্থান লইলো বিশাল এক পানের বরজের মাঝখানে।
আকিনূর বিস্মায়াভিভ’ত চোখে গল্পবলিয়ে তরুণীকে দেখছে আর তার বলা গল্প ভক্ত শ্রোতার মত শুনছে। আকিনূরের কানে আর কোন জলচিরে চলে যাওয়া নৌকার শব্দ আসে না। এমনকি ঠিক কোথায় সে বসে আছে তাও স্মরণে নেই। তরুণী বলতে থাকে-
-হেই পানের বরজ থাকি আবার বাইর হইলো পরের দিন মাঝ রাইতে। পান বরজের মালিক মুন্সি ব্যপারীর বাড়িতে হইছে খাওনের আয়োজন। কোন আলো নাই। গুটগুইট্টা আন্ধারে সবাই উঠলো ব্যাপারীর বাড়িত। খাওনের মাঝামাঝি সুময় শুরু হইলো গোলাগুলি। চারদিক থিকা পাকিস্তানী আর্মি ঘিরা ফালাইছে ব্যাপারী বাড়ি। শুরু হইলো পাল্টা গুলি। প্রায় এক ঘন্টা গোলাগুলির মইধ্যে ফজিলনের লগে থাকা দুই মাইয়ার একজন মারা যায়, সাথে মারা যায় দলের আরো দুই পোলা, হারাধন আর শফিক। শফিক দেইখতে ছিলো কবিরের মত। হের লাইগা ফজিলন তারে খুব পছন্দ করতো। শফিক মইরা যাওয়ার পর কবিররে আরো বেশি করে মনে পড়ে তার। ফজিলনের মন পোড়ে। নিজে নিজে কথা কয়, কবির কোথায় আছে, গিরামে কি আছে,নাকি পালায়ছে অন্য কোনহানে? তাইলেতো গিরামে গেলে কবিররে পাওন যাইবো না। কবিররে পাইবো না, একথা মনে হইতেই চোখ ভাইসা কাঁদন আহে তার। আর বুকে স্ট্যানগান চাইপা পালাইতে থাকে। কাউরেই লগে নিতে পারেনাই ফজিলনরা। অন্ধকারে কোরলিন কইরা ব্যাপারী বাড়ির পিছন দিয়া পালায় ফজিলনসহ বাকিরা। হের পর কে কোন দিহে গেছে কোন পাত্তা নাই। ফজিলন একা পালাইয়া আশ্রয় নিলো এক গোয়াল ঘরে। ওই ঘরে যে কখন ঘুমাইয়া পড়ছিলো তার মনে নাই। ঘুম থাকি জাইগা, চোখ কছলাইতে কছলাইতে দেহে চারদিকে। কোনহানে কোন মানুষের আলাপ পাওন যায় না। বাইর হইয়া বাড়ির উঠানে আইসা খাড়ায় ফজিলন। আস্তে আস্তে ডাকে, কেউ আছেন নাহি বাড়ি? নিরব নিস্তব্দ বাড়িতে তার ডাকের শব্দ চক্কর দিয়া মনে লয় আবার তার কাছেই ফিরা আহে। কয়েকবার ডাকার পর এক বৃদ্ধ জানালা দিয়া দেহে, আর জিগায় কারে চাও গো মা? মা ডাক হুইনা হাটু গাইরা উঠানে বইসা পড়ে ফজিলন। চিৎকার করে কাঁদে। মনে পড়ে বাপ-মা‘রে। কই আছে তারা কেমুন আছে? বৃদ্ধ আইসা তারে লইয়া যায় ঘরে। ঘরেই ঢুইকাই অবাক হয়ে যায় ফজিলন। দেহে তিনডা মাইয়া কোন রহমে ছিঁড়া কাপড় দিয়া গা ঢাইকা রাখছে। অমনি আর দেরি করে না। বৃদ্ধ পুরুষ মানুষটির দিকে উঠাইয়া ধরে স্ট্যানগান। চিৎকার কইরা উঠে ওই তিন মাইয়া।
-উনিই আমাগোরে বাঁচাইছে। কাইল রাইতে ওই মাদ্রাসার ক্যাম্পে হানাদার বাহিনীর লোকেরা আমাগোরে ইচ্ছেমতন ব্যবহার করছে। মুক্তির লোকেরা যখন হামলা চালাইলো তখন এই চাচা নামাজ পড়তে গেছিলো। গোলাগুলির ওই ফাঁকে চাচা আমাগোরে লইয়া পালাইয়া নিয়ে আইলো এই বাড়িতে। এই বাড়িও চাচার না। এইহানে থাকতো এক হিন্দু পরিবার। তাগো এক মাইয়া ও পোলারে পাকবাহিনী ধইরা লইয়া যাওনের পর বাকিরা চইলা গেছে গিরাম ছাইড়া। হানাদাররা জানে এই বাড়িতে কেউ থাহে না, তাই চাচা আমাগোরে এইহানে নিয়া আইছে।
তিন.
আকিনূর তরুণীর মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজের ভেতরে নিজে আছে কিনা টের পায় না। হানাদারদের বিভৎসতা আর ফজিলনের সাহস তার মধ্যে মেঘ আর আলোর মত বেজে যায়। পাকিদের কঠিন চেহারা তার মনে এক ধরনের মেঘাচ্ছন্ন দেয়াল তুলে রেখেছে। অন্যদিকে ফজিলন, তার কাছে হয়ে উঠেছে সূর্যের আলোর মতো তীক্ষ্ম এবং ক্ষীপ্র।
-তারপর কি হইলো কও না ক্যান?
-ফজিলন ঠিক করে এই বাড়িতেই থাকবো কয়দিন। এইহানেই তিন মাইয়ারে ট্রেনিং দিবো। তারপর আক্রমণ হইবো ওই মাদ্রাসা ক্যাম্পে। কিন্তু আরো তো অস্ত্র দরকার। পাইবো কই? ওই চাচায় কইলো বর্ডারের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটা দল আছে। ওইহান থেইকা হয়তো কিছু অস্ত্র যোগাড় করা যাইতে পারে। আর তা না হইলে চুরি কইরতে অইবো পাকিস্তানী ক্যাম্প থাইকা। চাচার দ্বিতীয় কথাটা ফজিলনের মনে ধইরলো। কিন্তু অস্ত্র কেমুন কইরা চুরি কইরতে অইবো? রাইতের মধ্যেই চাচারে কইলো তার লুঙ্গি, পাঞ্জাবী আর একটা টুপি আনতে। যেই চিন্তা হেই কাজ। পরদিন হাইঞ্জাবেলায় চাচার পাইঞ্জাবি, লুঙ্গি, আর চুল ছোট কইরা কাইটা টুপি পইরা মাদ্রাসার মসজিদের দিকে রওনা করে ফজিলন। পুকুরের ঘাটে গিয়া অজুর ভান কইরা দেইখা লয় সিপাহীগোর অবস্থান। এরই মইধ্যে হুনা যায় আরো কিছু মাইয়াদের কাঁদনের শব্দ। ফজিলন আর দেরি করে না, পুকুরের পাড় ধইরা পিছন থেইকা ঢুইকা পড়ে ক্যাম্পে। কয়েকজন সিপাহী দরজার বাইরে রাইফেল রাইখা ভিতরে আটক মাইগর লগে খারাপ কাম করে। ফজিলন চিন্তা করলো এখন কিছু করা যাইবো না। এখন কেবল তিনটা রাইফেল আর ম্যাগজিন লইয়া যাইতে অইবো। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনটা একে ৪৭ রাইফেল আর দশ বারোটা ম্যাগজিন লইয়া ফজিলন সোজা নাইমা পড়ে পুকুরে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ফজিলন পুকুরের উত্তর পাড় ঘেইসা যাইয়া উঠে পুব পাড়ে। রাস্তায় না উইঠা জমির আইল ধইরা কোনাকোনি গিয়া উঠে ওই বাড়িতে। আইসা দেখে চাচা মাইয়াগোর লাগি কাপড়সহ বাজার সদাই নিয়া আইছে। এই বাড়িতেই রাইতে চলে তিন মাইয়ার ট্রেনিং। রানু, বালি আর সুজাতা, এই তিনজন ট্রেনিং নেয় আর ক্ষোভ নিয়া অপেক্ষা করে কখন হামলা চালাইবো ক্যাম্পে। কিন্তু খারাপ খবর লইয়া আহে চাচা। রাইফেল চুরি যাওয়াই ক্যাম্পে রইটা গেছে এই এলাকায় মুক্তিবাহিনী আইছে। পুরা গ্রামে তল্লাশি করতাছে হানাদার বাহিনী। এই বাড়িও বাদ যাইবো না। যা করার আইজ রাইতেই করতে অইবো। গোয়াল ঘরের পাশ থেইকা দুইখান কোদাল লইয়া আইলো ফজিলন। বাড়ির পিছনে জংলা মতো জায়গায় খুঁড়তে শুরু কইরলো অদল-বদল কইরা। বিশাল এক গর্ত কইরা ভিতরেই অবস্থান লইলো সবাই। গর্তের মুখ বন্ধ করা হইলো গাছের ডাল-পাতা দিয়া। চাচারে কইলো তার বাড়িতে ফেরত যাইতে। দেখা গেলো সূর্য উঠার আগেই হাজির হইলো পাকিস্তানী সিপাহীরা। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কাউরে না পাইয়া, উল্লাস শুরু কইরা দিলো। কইলো এই বাড়িতেই তারা অবস্থান করবো। নিরিবিল বাড়ি। গণিমতের মাল এই বাড়িতেই আইনা উঠাইবো। মহা বিপদে পড়ে যায় ফজিলনরা। তবুও সাহস হারা হয় না। অপেক্ষা করে আরেকটা রাইতের। কিন্তু একটি দূর্ঘটনা ঘটে যায় দুপুরেই। চাচা যখন এই বাড়িতে খাবার লইয়া আইলো, ঝাপটাইয়া ধরলো সিপাহীরা। জিগাইলো কার জন্য খাবার আনছে। চাচা কইলো কইবো না। চিৎকার কইরা কইলো মাইয়াগুলোরে কি করছস তোরা। ওরা তোগরে শেষ কইরা দিবো। এ ক‘টি কথা বলার পর পর এক সিপাহীর গুলিতে ঝাঁঝরা হইয়া যায় চাচার বুক। কলমা পইড়তে পইড়তে চাচা লুইটা পড়ে মাটিত। ফজিলনরা সব দেখতে পায় বাড়ির পিছন থেইকা। কেবল অপেক্ষা রাইতের। রাইতে যে করেই হোক অপারেশন করতেই অইবো। সারাদিন কোন খাওয়া নাই। সাথে কেবল এক কলসি পানি ছিলো। পানি খাইয়া চারজনে দিন কাবার করলো। হাইঞ্জার একটু পরে গর্ত থাকি বাইর অইয়া বাড়ির চাইর দিকে অবস্থান লয় ফজিলনরা। কথা আছে, শীষ দেয়ার সাথে সাথেই শুরু অইবো আক্রমণ। যেই কথা হেই কাজ। ফজিলনের শীষ হুইনাই শুরু হয় চাইরদিক থেইকা গুলি। ঘরের মইধ্যে থাকা ছয়জন সিপাহীর দুইজন পলাইয়া যায়, বাকি চারজন গুলি খাইয়া ওইখানেই মইরা যায়। কিন্তু এইহানেই শেষ না। হুনা যায় মাদ্রাসার ক্যাম্প থাকি গুলি কইরতে কইরতে আইতাছে আর্মিরা। ফজিলনরা ছয় সিপাহীর অস্ত্রগুলা লাইয়া আবারো অবস্থান নেয় গর্তে। আর্মিরা আইসা সিপাহীদের মরা দেইখাই আগুন লাগাইয়া দেয় বাড়িতে। দাউ দাউ করে জ্বলে বাড়ি।
চার.
আকিনূর থির বসে থাকে। তার দৃষ্ঠি সম্মুখে শূন্যতার পর্দায় যেনো ভেসে উঠছে তরুণীর বয়ানকৃত দৃশ্য। এখন তরুণীর কণ্ঠ শুনে কেবল, আর দেখে দৃশ্য। যে দৃশ্য একের পর এক নির্মাণ করে যাচ্ছে তরুণী।
-কোন মাইনষের আনাগোনা নাই। পোড়া বাড়ি, কোন আড়ালও নাই। ফজিলনরা রাত পোহানোর পর হারাদিন আর বাইর হইতে পারেনাই গর্ত থাইকা। ওই গর্ত থাইকায় হুনছে চারদিকে মানুষের কাঁন্দন। গিরামের পিরাই সব বাড়িতে হামলা দিছে হানাদাররা। ধাইরা নিয়া গেছে কম বয়সি মাইয়াগরে। রানু, বালি, সুজাতা আর সুময় লইবার চায় না। ফজিলনরে বলে, চলো মাদ্রাসা ক্যাম্পে হামলা করি। ফজিলন আরো সুময় লইতে চায়। তয় বেশি সুময় না। রাইতে বাইর হইয়া চার জনেই মাদ্রাসার চাইরধার ঘুইরা রেকিকইরা আহে। পরে হারাদিন গর্তে বইসা পরিকল্পনা লয় কিভাবে হামলা করন যায়। ওই ক্যাম্পে কমপক্ষে কুঁড়িজন আর্মি আছে। আর ফজিলনরা মাত্র চাইরজন। কিন্তু জান হাতে লইয়া হামলা করনই লাগবো। অনেকগুলা মাইয়ারে আটকায়া রাখছে। কোনমতে তাগোরে মুক্ত করা গেলেইতো দলের সদস্য বাইড়া যাইবো। হেই হিসাবে মাদ্রাসার পিছনে যেই ঘরে মাইয়াগরে আটাকাইয়া রাখা হইছে হেই ঘরেই প্রথম হামলা করার পরিকল্পনা ঠিক করে ফজিলন। পরিকল্পনা শেষে অপেক্ষা রাইতের। হাইঞ্জা নামনের কিছু পরেই ফজিলন বাইর হইয়া আরেকবার দেইখা আহে আশেপাশের পরিস্থিতি। গর্তে ফিরাই তৈরী করতে থাকে অস্ত্র। ভাগ কইরা লয় চাইরজনে। মাইঝ রাইতে বাইর হইয়া বিল ধইরা হাটতে থাকে মাদ্রাসার দিহে। ফজিলন আর সুজাতা গেল মাদ্রাসার পিছনে যেইহানে মাইয়াগোরে আটক করা হইছে। বালি আর রানু গেলো মাদ্রার সামনের দিকে, যাতে আক্রমণ করার সুময় কেউ বাইর অইতে না পারে। ফজিলন আর সুজাতা কোরলিন কইরা ওই ঘরের দরজার সামনে গিয়া খাড়ায়। কান পাইতা হুনে। কয়েকটা মাইয়া বিলাপ কইরা কানতাছে। আর একজন কইতাছে, আমার উপরে আর কতজন সওয়ার হইবেন। আমিতো মইরা যামু। আমারে ছাইড়া দেন। অমনিতেই ভাইসা আসে অট্টহাসি। হানাদার বেটারা মাইয়াগো ফরিয়াদ হুইনা হাসে। ফজিলন আর স্থির থাকতে পারে না। দুইজনে গুলি কইরতে কইরতে ঢুইকাপড়ে ভিতরে। হাউমাউ কইরা আটক মাইয়ারা যে যেভাবে পারছে বাইর হইয়া পালাইতে শুরু করে। ওইদিকে সামনে থাইকা আক্রমণ শুরু করে বালি আর রানু। মাইয়াগোর ঘরে থাকা চাইর জোয়ানরে কিছু বুইঝা উঠার আগেই কতল করে দেয় ফজিলন আর সুজাতা। কিন্তু এর মইধ্যেই ওগোরে ঘিইরা ফেলে আর্মিরা। ওইদিকে সুজাতা আর বানুর কোন আলাপ পাওয়া যায় না। ফজিলন আর সুজাতা আবার গুলি চালাইতে শুরু করে। তাগোর দিকে ছুইটা আসে পাল্টা গুলি। সুজাতার ঠিক বাম বুকে আইসা লাগে গুলি। ঝাঁঝরা বুক লইয়াও অনেক্ষণ গুলি চালাইলো। কিছুক্ষণ পর হুইয়া পরলো মাটিতে। একহাতে স্ট্যানগান তুইলা কইলো, জয়বাংলা‘। আর কোন শব্দ পাওয়া যায়নাই সুজাতার মুখে। ফজিলন গুলি কইরতে কইরতে মাটিতে কয়েক গরান দিয়া পড়লো পুকুরে। দেখলো হেই সুময় বালি আর রানুরে ঘিরা রাখছে চাইর জওয়ান। পালাও ফজিলন কইয়াই ওরা চালাইতে শুরু করলো গুলি। দুই জওয়ান কতল হইলেও বাকি দুই জওয়ানের গুলিতে মাটিতে লুইটা পড়ে বালি আর রানু। দুইজনেই একলগে চিৎকার কইরা কয় ‘জয়বাংলা‘। এরপর দুই রাইন্ড গুলির শব্দ ছাড়া আর তাগোর কোন কথা হুনা যায়নাই। ততক্ষণে ফজিলন ওই এলাকা ছাইড়া অন্য এলাকার পথে।
পাঁচ.
এরপর ফজিলনের গন্তব্য কোথায়? দলহারা এই যোদ্ধা বারবার একা হয়ে যাচ্ছে। প্রথম তাকে একা করেছে কবির। তারপর দলছুট হয়ে দল গড়া, আবার একা হয়ে যাওয়া। অকিনূরের ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলে, ফজিলন যেনো তাকে সাথে নিয়ে চলে। কিন্তু গলা থেকে কথা সরে না। কেবল দেখে বিধ্বস্ত গ্রামের পর গ্রামের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে এক ফজিলন। যতদূর ছুটে যাচ্ছে ততদূর লেখা হয়ে যাচ্ছে একটি নাম ‘বাংলাদেশ‘। এই নামটির জন্যই একদিন কবিরকে ছেড়ে যুদ্ধে নেমেছিলো ফজিলন। আকিনূরের মনে অনেক ঘৃণা দলা পাকিয়ে ওঠে কবিরের জন্য। আকিনূর কবিরকে সরিয়ে দিতে চায় আর ফজিলনের সামনে গিয়ে নিজেই দাঁড়াতে চায়। বৈঠার আঘাতে ছিঁড়ে যাওয়া জলের মতো তার পাঁজরও যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ফজিলনের এই দৃশ্য সে আর দেখতে চায় না। এসব ভাবতে ভাবতে আকিনূর রক্তচোখে আবারো দেখতে থাকে তরুণী বিরচিত দৃশ্য।
-ফজিলন দৌঁড়ায় আর কবিরের কথা ভাবে। আইজ কবির যদি লগে থাকতো আরো সাহস লইয়া যুদ্ধ করা যাইতো। হারা রাইত কাবার হইয়া যায়, ফজিলনের হাটা থামে না। একসময় ফজরের আজানের পর পর আইসা দাঁড়ায় এই গাঙের পারে। কোন মানুষের আনাগোনা নাই। গিরামের বাড়িঘর বলে কিচ্ছু নাই। গাঙপাড় থিকাই ফজিলন দেখে খাড়াইয়া আছে তাগো পোড়াবাড়ি। কোথায় তার বাবা-মা হেই খবর লওনের মতও কোন মানুষের দেখা মিললো না। পুরো গিরামে কোন মানুষ নাই। গাঙ পার অওনের নৌকা নাই। গাঙ পাড় ধইরা হাটতে হাটতে এক সুময় দেখলো একটা নৌকা বান্ধা ঘাটে। ওই নৌকা লইয়া নিজে বৈঠা বাইয়া পার হইলো ওইপাড়ে। রাস্তা ধইরা না যাইয়া, জমির আইল ধইরা গিয়া উঠলো কবিরদে বাড়ি। কবিরের বাবা-মা ফজিলনরে দেইখা শুরু করে চিৎকার। কবির ঘর থিকা বাইর অয়না। ফজিলন দৌড়াইয়া ঘরের ভিতর যায়। কয়, কবির দেখো আমি যুদ্ধ থেকে আইছি তোমারে নিতে। তুমি থাকলে আমি আরো যুদ্ধ করুম। তোমারে আমি স্বাধীন একখান দেশে বিয়া করুম। হেইদিন আমাগোর লগে আর কেউ মথা তুইলা কথা কইতে পারবো না। আমাগোরে গণিমতের মাল ভাববো না কেউ। আমি তখন বউ অইয়া তুমার সংসার করুম। চলো কবির যুদ্ধে যাই। এই সুময় কবিরের মা চিৎকার কইরা ওঠে, ‘হুন তুমি যদি না যাও, আমরা তোমারে হানাদারগো হাতে উঠাইয়া দিমু। আমার ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যাইবো না। হেই মুক্তিবাহিনীর খবর দেয় পাকিস্তানীগো কাছে। তোমার খবরও দিয়া দিবো। ফজিলন বিশ্বাস কইরতে পারে না কবিরের মায়ের কথা। সে আরো সুময় লয়। কবিরের ধারে বইসা থাহে। কবির কোন কথা কয় না। কিছুক্ষণ পরেই দেখে কবিরের বাবার লগে ঘরে আইসা ঢুকলো দুই আর্মি জওয়ান। ফজিলনের চুল ধইরা টান মাইরা খাড়া কইরা কয়, খুব সুরত লেরকি হায়‘। ফজিলন চুপ হইয়া যায়। কোমরে বাঁধা স্টেনগান তুইলা দেয় আর্মিগো হাতে। কোন কথা ছাড়াই হাটতে থাকে আর্মি ক্যাম্পের দিহে। ক্যাম্পে একটা ঘরে আরো মাইয়াগ লগে রাখে ফজিলনরে। রাইত ঘনাইয়া আইলেই তারে এক জওয়ান আইসা লইয়া যায় কমান্ডারের ঘরে। কিছুই কয় না। কমান্ডার ফজিলনের কাপড় ধইরা টান মারার লগে লগে চোখ তুইলা তাকায়। কোমরে বাইন্ধা রাখা হাত বোমটা ছুইড়া মারে কমান্ডারের দিহে। চারদিকে অন্ধকার হইয়া যায়। ক্যাম্পে আটকা বাকি মাইয়ারাও চিল্লাচিল্লি কইরা পালাইতে থাকে। হেই দলে ফজিলনও আছিলো বইলা হুনা যায়। কিন্তু ফজিলনরে আর কেউ কোনদিন দেখছে বইলা হুনা যায় নাই।
আকিনূর তরুণীর কথা শেষ না হতেই তীরের মত তীব্রফলা তুলে দাঁড়ায়। কেঁপে ওঠে নৌকা। লাফ দিয়ে উঠতে থাকে নদীতীরের দিকে। পিছন থেকে তরুণী ডাকে, কই যাও আকিনূর?‘ আকিনূর পিছন ফিরে না তাকিয়েই উত্তর দেয়, ‘ফজিলনরে খুঁইজতে যাই। আমারে থামাইওনা, আমি বাংলাদেশরে খুঁইজতে যাই। পিছন থেকে তরুণীর কন্ঠ বাতাসের মত ভেসে আসে,‘কোথায় যাও, এইতো আমি এইহানে, আমিই ফজিলন‘,। তীব্রবেগে পিছন ফিরে তাকায় আকিনূর। দেখে শূন্য নৌকাটি ভাসছে নদীর জলে। কেউ নেই। কোন তরুণী কিংবা ফজিলন। আকিনূর পা চালায়। ফজিলনের খোঁজে।
আমার দূর্গা
দেবপ্রিয়া পন্ডিত
"আমরা নারী,আমরা পারি"। সত্যি আমার মা সেটা করে দেখিয়েছেন। বড় অভাগী আমার মা। ভাগ্যদোষে অজান্তে বরমাল্য পড়িয়েছিল এক পাগলকে।২ বছর সংসার করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আদর্শ স্ত্রীর মতো ডাক্তার বৈদ্যর কাছে দৌড়েছে স্বামীর আরোগ্যের জন্য। কিন্তু বর্বর স্বামী গভীর নেশায় আসক্ত তাই স্ত্রীর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরই মাঝে আমি পৃথিবীতে আসতে চলেছি, তখন মার অবস্থা মরোমরো। হাসপাতালেই কাটিয়েছেন বেশিরভাগ সময়।
অবশেষে আমি আসি পৃথিবীতে। জানিনা আমি আসায় আমার বাবার মনে কতটুকু খুশির ঝলক এসেছিলো। হয়তো আসেনি, তাই জন্মলগ্নে বাবা ছিলোনা আমার পাশে, আজও নেই। কোনোদিনই থাকার চেষ্টাও করেনি। আমার মা'র শ্বশুরালয়ে থাকার দুই বছর অনিদ্রা, প্রচন্ড মারধর, অশান্তিতে কেটেছে। এমনকি বৌভাতের দিনই বেল্টের আঘাতে কালশিটে পরেছিল পিঠে। যেদিন বাবা ছোট্ট আমিকে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে মাকে আবার মারধর শুরু করেছে, সেদিনই মা নিজেকে আর আমাকে বাঁচাতে সব কিছু ছেড়ে চলে এলো বাপের বাড়ি। শুরু হয় সংগ্রাম। সেই ছোট্ট আমিকে দিদার কাছে রেখে সকাল, বিকাল ও সন্ধ্যায় টিউশনি পড়াত। আস্তে আস্তে আমি বড়ো হচ্ছি, অন্যদিকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত আমার দুর্গা। মা দুর্গার মতো দশ হাত না থাকলেও, মনোবল ভীষণ শক্ত। দাদুর জমি সহ ছোট্ট বাড়িটাকে ধীরে ধীরে সামান্য নিজের হাতে সাজিয়ে চলছে এখনও। এখন মা খুউব ছোট্ট একটা মুদির দোকানের মালিক। আমি বড়ো হচ্ছি, মা করছে অক্লান্ত পরিশ্রম। লক্ষ্য একটাই আমাকে মানুষের মতো মানুষ করা। বাবার স্নেহ ও ভালোবাসা আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে মায়ের পবিত্র পরিশ্রমে।
দিদা ও দাদুর দেখাশোনার পাট চুকিয়ে গেছে। এখন শুধু আমাকে নিয়েই তাঁর জগৎ ও তাঁর কর্ম। পিশাচরূপী মানুষের কটূ মন্তব্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে একাগ্রতার সাথে। সংগ্রামই হয়তো মায়ের ভবিতব্য। জানিনা মায়ের হাতের এই বৈঠা ধরে মাকে কতটুকু সুখের ছোঁয়া দিতে পারব। আমার মা 'আমার দুর্গা'। তাঁর দৃঢ় মনোবলকে অনুসরণ করে এগোতেই হবে আমায়...
আমার দুর্গা চিন্ময়ী
চুমকি বিশ্বাস
সংসার ধর্ম পালন করা মূল কর্ম তাঁর। লেখাপড়াও জানেনা সে, অতি সাধারণ জীবন যাপন করে। গোয়াল ভর্তি গরু বাছুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব। শাখা, পলা, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর দিয়ে অতি সাধারণ করুণাময়ী সাজ তার। দেখলে মনে হয় দেবী। শত্রুদের ডরায় না সে। বিপদের সময় সবার আগে এক পা এগিয়েই থাকে। নাম তার অন্নদা। সেবায় সে দেবী অন্নপূর্ণা। বিড়ি বেঁধে সংসারের ভান্ডার পূর্ণ করার চেষ্টা করে। হাতের কাজের গুণ আছে। তিন ছেলে-মেয়ে মানুষ করেছে পেটে গামছা বেধে। এক বিঘে মাটি রেখেছে সাত দিন গমের ছাতু খেয়ে। মহাদেবের মতো পতি তার সমাজসেবায় ব্যস্ত। হতে পারে গ্রাম্য নারী, তবে সমাজে সহজে পরাস্ত হতে নারাজ। জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছি শুধু তাকেই দেখে। সে আর কেউ নয় আমার দশভূজা আমার দিদা আমার দুর্গা।
প্যাঁচ গোজ বোঝেনা সে সহজ সরল মন। খালি পায়েও চলতে পারে বিলক্ষণ। জুতো পরলে মাথা গরম হয়ে যায়। কখনো বা দুরকম জুতো পরে বিশ্ব পরিক্রম করে আসে। মন ভোলা দুর্গা আমার। এই নিয়ে মহাদেবের খুনশুটি চলে অনর্গল। এমনিতে মনটা ভালো। কারো কথাতে বিরক্তি বোধ করেন না মোটেও। দেশ-বিদেশে থাকে ছেলে মেয়েরা, অথচ দূর থেকেই বুঝতে পারে তারা অসুস্থ কি না। সে যেন আমার চিন্ময়ীরূপে আমাদের দুর্গা মা।
পল্লীর দুর্গা
পাঞ্চালি দেবনাথ
আমার দুর্গা থাকে গ্রাম্য পল্লীতে। সে হাজার ব্যস্ততাতেও নিজের ভালো মন্দ নিয়ে না ভেবে তার রত্নের কথা না ভেবে থাকেনা। আমার দুর্গা বড়ো দুঃখী। অভাবের সংসারে আমার দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। অনেক কষ্টে তিনি তার রত্নকে শিক্ষিত করে তুলেছেন। সে স্বামীর অনুগত। তার চোখের তলায় অযাচিত কালী মুখে সৌখিন বলিরেখা। কাঁচাপাকা চুল আর ঘামে ভেজা মুখটা তাঁরই।
সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসার সামলে আঁচলে মুখ মোছে। ক্লান্তিতে দুচোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। ঘুমন্ত মুখটা দেখে বড্ডো মায়া হয়। খাবার সময়টুকুও পায়না। মুখে খাবার তুলে দিয়ে তৃপ্তি পাই আমি। সে বড়ো ক্লান্ত, বড়ো অভাগী।
কখনো বলা হয়নি মা তোমাকে যে বড্ডো ভালোবাসি মা। সে শত শত আঘাত বুকে নিয়েও মুখ বুজে থাকতে পারে। প্রতিদিন নতুন করে বেঁচে উঠতে পারে। শত দুঃখেও তাঁর মুখে হাসি। চোখের জলে মুক্তো খুঁজি। সেই জলও বড্ডো দামী। দশ হাত না থাকলেও আমার দুর্গা দশ দিকের ঝঞ্ঝা দুহাতে সামলাতে পটু। সে আমার আমার মিত্র, সখি। দুঃসময়ে সাহস যোগান তিনি। আমি নিশ্চিন্তে তাঁর কোলে মাথা রেখে পরম তৃপ্তি পাই। কালো আকাশ মাথায় নিয়ে ছাতা হয়ে দাঁড়ায় আমার দুর্গা। কখনোবা প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। সমস্ত প্রতিকূলতা, সবকিছুকে পেছনে ফেলে দুর্গা চলে সামনের দিকে এগিয়ে। তাঁর কোনো তুলনা নেই। তার জুড়ি মেলা ভার। আমার দুর্গা আমার কাছে সেরা... সমাজ তাকে ঘরের বৌ বললেও সে আমার কাছে দুর্গতিনাশিনী দুর্গাই। আমার মাই আমরা দুর্গা।
সাধারণ নারী
অমৃতা মন্ডল
সেই দুর্গা, সেই কালী। সেই অন্নপূর্ণা দেবী। যে রূপ তাঁর প্রয়োজন সেই রূপ ধারণ করেন। এ হচ্ছে ঘরের গৃহিনী। কারোও মা, কারোও জীবনসঙ্গিনী, কারোবা দিদি। লক্ষী হয়ে ঘর আলো করে। অন্নপূর্ণা হয়ে সকলের মুখে খাবার তুলে ধরে। সরস্বতী হয়ে বিদ্যাবুদ্ধিতে মন জয় করে। সতী হয়ে মহাদেবের পাশে থাকে। পার্বতী হয়ে সন্তানের খেয়াল রাখে। কালী হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওযাজ তোলে। দশভূজা হয়ে সকলের সেবা করে। প্রয়োজনে অসুরের বিনাশ করে। সে আমাদের মা হয়ে ঘরে থাকে। প্রয়োজনে দুর্গারূপী চিন্ময়ী মা হয়ে ওঠে।
"নারীর সম্মান, অবহেলা করে যে নারীরে তাহারেই করো পূজা। সম্মান যদি করেই থাকো, দিও তাঁরে নির্দিষ্ট জায়গা। লান্ছিত করো, অবহেলা করো, করো তার সম্মানহানী। শ্রদ্ধা যদি করে থাকো, ঘর বন্দী কেন সে নারী?"
ঘরের লক্ষী। সেও এক নারী, করো তারে অত্যাচার? সে যদি রূপ নেয় মা কালীর রক্ষে পাবেনা আর। লজ্জা, সম্মান, দয়া, মায়া নারীর প্রকৃত পরিচয়। অত্যাচারের ফলে তার সহ্যের বাঁধ যদি ভাঙো চোখের জলে চন্ডীর অবতার নিতে দেরি হবেনা আর। যে রূপেই থাকুক সে সম্মান করো তাঁকে। আর করো যদি অবহেলা রাবণরূপী হও় যদি সমাজে তুমি বার বার, পাবেনা নিস্তার। দুর্গা রূপে এক সাধারণ নারীর হাতে নিশ্চিত তোমার বিনাশ।
Tuesday, October 27, 2020
কবিতা করিডোর, সেপ্টেম্বর সংখ্যা ,২০২০ ,ক্ষুধা বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা
প্রচ্ছদ: শ্রীহরি দত্ত
সম্পাদক: শুভঙ্কর পাল
সহ সম্পাদক: সব্যসাচী ঘোষ
উত্তর পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক: রাজেশচন্দ্র দেবনাথ
সম্পাদকীয়
লাটিমের মতো ঘুরছে এই পৃথিবীর যাবতীয়। কার্যকারণ সম্পর্ক একটা সংখ্যা মাত্র নয়। সব মিলিয়ে সবেতেই থাকে সে। এই মুহূর্তে শুধু পুজো নিয়ে হুল্লা নয়, অতিমারীর ভয়ঙ্কর থাবায় কত চেনা মুখ হারিয়ে গেছে ও যাচ্ছে। তবুও ওই ফাইট অনলি ফাইট। লড়াই চলছে হাসপাতালে, পাড়ায় পাড়ায়। খেতে না পাওয়া মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়েছে । মানবিকতার অপমৃত্যু এখনো পুরোপুরি হয়নি। এই পরিস্থিতিতে কবিতা করিডোর এর ' ক্ষুধা ' বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হচ্ছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য, লেখা সংক্রান্ত সমস্ত দায় সম্পাদকের নয় । যারা লেখা দিয়ে এই সংখ্যা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা রইলো।
ধন্যবাদান্তে
শুভঙ্কর পাল
সম্পাদক, কবিতা করিডোর
যোগাযোগ: 9933770541
subhabrb@gmail.com
বিষয় ভিত্তিক নয়
নীলাদ্রি দেব
ক্ষুধা নিয়ে কবিতা লিখতে বসে
বারবার হারিয়ে যাচ্ছে বিষয়, যাবতীয় অক্ষর
আগুনের পাশে শুকোতে দিয়েছ ঘি-এর শিশি
খই উড়ছে বাতাসে
হাই তুলতে না তুলতেই
পাল্টে যাচ্ছে ব্রেকিং নিউজ
আর অট্টহাসির ভেতর দিয়ে
বাইপাস খুঁজছেন শাসক
খিদে ওদের কাছে অস্ত্র
এবং বর্মও
প্রাইমটাইমের হ্যালুসিনেশন নিয়ে মাথাব্যথা নেই
তবু ব্যালট আর বুলেটের মাঝে
চকচক করছে অপ্রত্যাশিত চিৎকার
মুখোশ জড়িয়ে রাষ্ট্র ভালই ছিলেন
আরও কিছু চাপিয়ে এখন অনেকটাই নিরাপদ
প্লিজ এবার মেনে নিন,
আপনি মুখ দেখাতে পারছেন না
শুকোতে শুকোতে ফল প্রকাশের আগেই
উঠে গেছে ভোটের কালি
অথচ প্রতিটি সেকেণ্ডে বীভৎস শুকিয়ে আসছে
বিশ্বাস, স্বপ্ন আর আস্ত একটা দেশ
"ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি"
কবি সুকান্তের হাত ধরে ক্ষুধা কেমন হয় শুনেছি ,অনুভব করেছি আমরা আমাদের পেটের ক্ষুধার অনুপাতের হিসেবেই ।
কিন্তু ক্ষুধাকে বিশ্ববাসী চাক্ষুস করলো আবেদিন সাহেবের মোটা তুলির আঁচরে,যা ছিলো হৃদয় বিদারক মানবতার অবক্ষযের এক করুন দৃশ্য,যা দেখলে তথাকথিত যারা শিল্পপ্রমী নন তাদের ভরা পেটও ক্ষিদের জ্বালায় কুঁকড়ে উঠে পরে।
হ্যাঁ , শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন১৯৪৩ শে যখন দেশেরই কিছু স্বার্থাণ্বেষী মানুষ ও বৃটিশ সরকারের চক্রান্তে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ শুরু হয় তখন তিনি কলকাতার ১৪ নম্বর সার্কাস রোডের বাড়ীটিতে আর বসে থাকতে পারেন নি।কলকাতার রাস্তায় ডাস্টবিনে পরে থাকা সামান্য উচ্ছিষ্ট খাবারের জন্য যখন কুকুর মানুষের তীব্র লড়াই চলছে তখন তিনি অতি সাধারন কাগজ ও কালো কালি নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলেন।
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন,প্রত্যেক্ষ করেছেন অনাহারক্লিষ্ট মানুষের আর্তনাদ,ক্ষুধার তাড়নায় মানুষের বিবেকহীনতা,খাদ্যহীন,বস্ত্রহীন মানুষের চরম দূর্দশা।
শত শত স্কেচে ভরে উঠেছিলো তার ঝোলা।"স্ত্রীর শবদেহের পাশে আর্তনাদরত স্বামী","মৃত মানুষের চোখ ঠুকরে খাচ্ছে কাক"। এরকম বহু দৃশ্য তিনি আঁকেন।এরকম ১২ টি চিত্র নিয়ে তিনি তৈরি করেন "Darking Days Of Bengal"নামে একটি এলবাম ।
শিল্পীদের একটি প্রিয় বিষয় "ম্যাডোনা"তাতে আমরা দেখতে পাই মা ও শিশুর অকৃত্তিম ভালোবাসার কথা।ইতালীয় রেনেসাঁর শিল্পী লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চি থেকে শুরু করে ,মাইকেল এঞ্জেলো ,রাফায়েল এরা প্রত্যকেই ম্যাডোনার ছবি এঁকেছেন ।লিওনার্দো-দা -ভিঞ্চির "Virgin of the rocks" ছবিটিতে ম্যাডোনার সুশ্রী রূপ তুলে ধরা হয়েছে সুন্দর বর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থাৎ ম্যাডোনা বলতে আমরা সুন্দর মায়ের রূপই কল্পনা করি।
কিন্তু "ম্যাডোনা ১৯৪৩" নামে জয়নুল আবেদিনের ম্যাডোনা এর ব্যাতিক্রম। তিনি যে ম্যাডোনা কে আঁকলেন তিনি রাস্তায় পরে থাকা না খেতে পেয়ে অস্তি কঙ্কালসার মৃত মায়ের এক করুন দৃশ্য যার বুকের উপর চড়ে জীবিত শিশুসন্তানটি মাতৃদুগ্ধ পান করছে ।যদিও মা মৃত তবুও মানবপ্রেমী আবেদিন সাহেবের তুলিতে প্রাণের স্পন্দন স্পষ্ট দেখা যায় ।
এরকমই আরো একজন সংগ্রামী শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য সংগ্রাম করেছেন মানুষের দুঃখ ,দুর্দশা ,ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়ে ।হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন কালো রং।এমন কি শিল্পী প্রত্যক্ষ ভাবে যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দলনে।শিল্পীসত্তা ও প্রতিবাদী সত্তার মিশ্রনে এই সাদা-কালোর সম্রাট ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে ভীষণভাবে আলোড়িত হন।চট্টগ্রামে বিমান আক্রমন ,পূর্ববংগের বিরাট অঞ্চলে খাদ্যশস্যের হাহাকার চিত্তপ্রসাদের ছবিরর বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।১৯৪৩ সালে মেদিনীপুর জেলায় ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকেন যা হা যা hungary Bengal নামে পরিচিত ।
চিত্তপ্রসাদের ভাবাদর্শ ও শিল্পাদর্শে অনু্প্রাণিত হয়ে সোমনাথ হোর কাজ করেন।
খিদে যখন বেড়ে উঠে পরিপূর্ণ রূপ পেতে চায়
শ্রীহরি দত্ত
খিদেই পায় আমাদের, মাতৃগর্ভ থেকে খিদে পায় আমাদের। জন্মের পর প্রথম চিৎকারে মাকে খুঁজে পেতে যে হাত দুটি ছুঁড়ে দিই, খিদের খোঁজ থাকে তাতে। যত বড় হই ততই খিদে পায়, যত ছুটে বেড়াই ততই খিদে বাড়ে, মায়ের কাছ থেকে যতই দূরত্বে থাকি না কেনো, যতই থাকি কোনো না কোনো আড্ডায়, পেটে যখন টান তৈরি হয়, ফিরে আসি মায়ের কাছে... খিদের জন্যে। এই ভাবেই ঘরের ভেতর তৈরি হয় খাবার সংগ্রহের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। ধীরে ধীরে চিৎকার বড় হতে থাকে, একদিন ঘরে বসেই শুনতে পাই খাদ্যের জন্যে আন্দোলনের স্লোগান ... মনটা কেমন করে ওঠে, তার মানে মাথা বুঝে নিতে চায় আমাদের প্রত্যেকের খাবার কি কেউ নিয়ন্ত্রণ করে? ...আর সেটা বুঝতে গিয়ে কখন যে ওদের দলে মিশে গেছি, তা বুঝে উঠতেই... খিদে কখন পেটের থেকে মাথায় উঠে বোধের জন্ম নিয়েছে, বুঝতেই পারিনি। এখন মনের খিদে পায়, মাথার খিদে পায়। তার থেকে মনে জন্ম নেয় ছবি। আঁকিবুকি টানতে টানতেই ছবি আমাকে তলিয়ে দিয়েছে তার খেয়ালে, তা বুঝে গেছে মন... এখন মন কেমন করার পালা... তার থেকে পরিত্রাণ পেতে রোজই এই মন ছবি আঁকে, আঁকলে খিদে মেটে। কিন্তু সেই পেট ভরার মতো খিদেরা একইরকম, আবার পায়। এখানে ছবির চিৎকার আরও গভীর... বুঝতে শিখেছে মন। কিন্তু মাথা বুঝতে শিখেছে যে সাহিত্যে খিদে অনেক আগেই এসেছে তাই তখন মাথা... রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, অরুণেশ, শক্তি, সুনীল পড়ে, সমস্ত শিল্পীর কাজ দেখে, খিদের পরিসর বাড়তে থাকে। একই সাথে জন্ম নিতে থাকে শরীরের খিদে ... সে তো আরেক মোচড়। যেন সব কিছুর উর্দ্ধে উঠে ভাবনার দেশে উন্মুক্ত বাতাস। চোখ বলে ধরে দেখ, জিভ বলে চেখে, হাত বলে উল্টে দেখ নিজ পরিসরে; কিন্তু সব কিছুতেই মানা। চুরি করে খাওয়ার স্বভাব, বাইরে চোখ রাঙায় যে মন, ভেতরে সিদ কাটে। কিন্তু খিদে বাড়তে বাড়তে চোখ তৈরি করে সে খিদে মেটানোর চেষ্টা আজও জারি রেখেছে।
এই খিদেকে বুঝতে গিয়ে কত মানুষ নিজেকে হারিয়েছে। ছুটে গেছে ভাতের কাছে... নদীর কাছে... প্রেমিকের কাছে... প্রকৃতির কাছে। শুধু নিজেকে পরিপূর্ণ করতে। খিদে কী, কেন, কোথায় পায়, মানুষ ভেদে খিদে কেমন, তার কি কোনো পার্থক্য আছে... প্রয়োজন বুঝতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যে ক্ষুধার আন্দোলনের জন্ম হয়ে সাহিত্যে নতুন ভাষা খোঁজার চেস্টা হয়েছে। ছবি আন্দলনের ক্ষেত্রেও বার বার সারা পৃথিবীব্যপী বিভিন্ন রূপ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। ক্ষুধাকে নিয়ে শিল্পীদের বিভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই... বিভিন্ন শিল্পী, তাদেরই নিজস্ব ভাবধারায় যে শিল্প কর্ম করে থাকেন সেখানেও শিল্পী তার দর্শন তৃপ্তির সন্ধান করেন। আজও আমরা প্রতিদিন ছুটি সেই লক্ষ্যে, যেখানে চোখ... পেট... শরীর... মন... সমস্ত খিদের পরিপূর্ণতার জন্যে এই লক্ষ্যই একটি বিলীয়মান বিন্দুর মতো।
খিদে
Monday, October 26, 2020
ফুটো থালায় স্তব্ধ ভাষা
স্বপ্নপরাগ
এক
সোমা সাহা পোদ্দার
পাতার মার্জিন ছুঁয়ে রোদের খেলা ।
স্বপ্নপরাগ মিশিয়ে যোগ হবে নব জন্মের
রঙ বেরঙের মেহেক ঢেলে রেখেছ আশ্রয়ে
শব্দ গুছিয়ে না বলারা এভাবেই থাক।
অচেনা শব্দে লেখা হয় জেগে থাকার অভ্যেস
সরু রেখায় চাঁদ আরি পাতে ক্ষুধার জানলায়
ঘুমের ভেতর আসা যাওয়া করে আলোখানি
গভীর রাত খুলে এখনও বাকি হাঁটা
উড়ে যায় রাত পাখি দূরের সহজতায়
নরম আলোয় নিঃশব্দ বয়ে নেয়
শুধু দৃশেরা মৃদু কাঁপে আগের মতো করে।
দুই
তুমি তো ক্ষুধার সূচক সরিয়ে মুক্ত হতে চেয়েছিলে ?
সীমাহীন ক্ষুধায় মুচড়ে ওঠে কোণ
কোষে কোষে ছড়িয়ে পরে তার বীজ
হাত ধরাধরির ক্লান্ত পথ তবু এগোয় ঝাপসা চলন মেখে
পোশাক বদল হয় ফেরিওয়ালার
ফেরিওয়ালা ক্ষুধা ফেরি করে আর কেউ তা কেনে
উড়াল খুলে রাখি প্রতিদিন বাড়ার জন্যে
না দেখারা আরও তীব্র হয় স্বপ্নক্ষুধায়।
গুঁড়ো পাকস্থলী
রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
অন্ধকার স্রোতে সারা শরীর ক্রমে দড়ির মত পাকিয়ে যাচ্ছে, ওদের ৷
প্রতি রাতে উপোসী চাঁদ আর কাঙাল নদীটা মাধুকরী করে৷
ছাল ওঠা মাটির বুক থেকে সব অমৃত শুকিয়ে গেছে ৷
নিভন্ত চুল্লীর ছাই থেকে হাহাকার উঠে আসছে ৷
ভাতের দানাগুলোয় দুঃস্বপ্নরা মাখামাখি হচ্ছে ৷
রক্তের স্রোত ক্রমে জলের মত পাতলা হচ্ছে ৷
শ্মশানের শূণ্যতা মেখে জনপথ, ক্ষেত, ঘরবাড়ি ৷
বুভুক্ষু মানুষেরা একে একে সীমানা পেরোচ্ছে ৷
ওদের দুদিকের ডানা পুড়ছে, পুড়ছে হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ৷
নিরন্ন পাকস্থলীগুলো ক্রমে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে,
একদল পরজীবী তা চেটেপুটে খাচ্ছে ৷
যুগ যুগ ধরে ওরা এইভাবেই বেঁচে আছে-
উপবাসী মানুষের পাকস্থলী, অস্থি, মজ্জা চিবিয়ে খেয়ে ৷
ভবিষ্যতেও বাঁচবে, সভ্যতার শেষদিন পর্যন্ত বাঁচবে, এই ভাবেই ৷
আর অনাহারী মানুষগুলো, পেটে গামছা বেঁধে যুগযুগ ধরে ওদের খাদ্য হয়ে উঠবে প্রতিনিয়ত ৷
অনন্ত এক খিদে
বাবা ও বাহারি উল
শ্রদ্ধা চক্রবর্তী
এইমাত্র
প্রবীর রায়ের দুটি কবিতা
সু দী প্ত মা জি
সাপলুডোর ভারতবর্ষ
নিতান্ত দৈবের বশে সাপের সহজ মুখ থেকে তুমি
একদানে সরে গেছো লেজের ডগায়...
আঃ, কী নিঃসীম শান্তি — ভেবে তাকিয়েছো ওই
শীর্ষদেশে, মইয়ের চূড়ায়
যেখানে দেশের মাত্র তিন শতাংশের মতো
প্রকৃত মানুষ বাস করে !
উচ্ছিষ্ট ফেলে দেয় তারা কৃপাভরে —
লেজের ডগায় বাঁচা খণ্ড খণ্ড মানুষের
প্রতিদিন ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় !
লেজের ডগায় বাঁচা লোকজন তারপর ভাবে, আহা,
এখনও সাপের মুখে পড়িনি তো ভাগ্যধর
আমরা কজন !
তিন বর্ণে আঁকা, আহা, আমার পতাকা
অন্তত দু'বার তাকে নমস্কার করে ফি বছর
পুষ্প ও প্রসাদ সহ, গৌরবের গান সহ
বাতাসে ওড়াই...
এইভাবে বাঁচি আর এইভাবে মরি প্রতিদিন
এইভাবে মরে গিয়ে বেঁচে যাই হঠাৎ একদিন !
বিজয়গৌরব নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র
তূর্যনাদ করে...
মানসপুর
রাজা-সাজা
শোভন মণ্ডল
নিতান্তই পাকেচক্রে এভাবে গলিয়েছি মাথা
মাথা নয়, মাথাব্যথা, মুকুটের ভার
সে তো সহজ নয়, জানা কথা
তবুও কাঁপাতে হবে স্টেজ, যে ভাবেই হোক
অজস্র রোশনাই, শত শত চোখ
আমাকেই দেখছে, না হয় অভিনয়ে মন দি
এ তো কঠিন কাজ, নজরবন্দি
কাহিনী শেষ হয়ে গেলে
গ্রীনরুমে মেকআপ তুলি
রাজা-সাজা সারা, ফিরিয়ে দাও তবে
ভিক্ষের ঝুলি
শীতের দিনের খিদে
হে ঈশ্বর
বাপ্পাদিত্য দে
যদি শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নাও
আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
বিষণ্ণতা দিয়ে গড়েছি এই ঘর
পাজরের হাঁড় দিয়ে বোনা দেওয়াল
আর সম্ভবনাময় ফসলের ক্ষেত
এ সবই আমার শেষ সম্বল।
যদি শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নাও
আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
আকাশের নীচে কালো মেঘ।
সেখান থেকেই ঝরেছিল
অভিশাপের পোড়া জল।
ধ্বংসের হাওয়া মেখে কী আশ্বাসে
লুঠে নিল প্রকৃতির দল
বিষণ্ণতা দিয়ে গড়া
আমার এই একচালা ঘর।
যদি শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নাও আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
আমি তো দেখেছি অট্টালিকার অন্ধকার ঘরে নীল জোনাকীর আলো
আকাশ ছোঁয়া প্রাসাদের চূড়া ।
কৈ তাদের চোখে-মুখে তো
তোমার ধুলো পড়েনি ?
দেহ-মন দিয়ে সাম্যের গান
আমিও তো গেয়েছি।
তবে আমার পথেই কেন এত অন্ধকার ?
তবু বাঁচার স্বপ্ন দেখি আমি।
তাই বেঁধেছি ঘর তোমাকে আলিঙ্গন করেই।
আজকাল তুমিও হয়েছ ফন্দিবাজ
কাউকে বিলোচ্ছ মহাভোগ রাজ
কাউকে দিয়েছ ফকিরের সাজ।
থালার ফুটোটা বড় হয়ে উঠলে
জেগে উঠছে ভয়
তোমার দেওয়া এই জন্ম, এই জীবন
থাকবে তো ?
ঐ একরতি মেয়েটি কী জানে,
জীবনের মানে ?
আমি বুঝি ওর উপস্থিতি
বংশের স্মৃতি... বোঝা হয়ে গেছে
ওর চোখের জল আরও বেশী ভারী
দুঃখ-কষ্টে, অনাহারে
যদি শেষ সম্বল টুকুও কেড়ে নাও আমি তোমাতে বিশ্বাস হারাবো।
আমি খোলা আকাশের নীচে
শতাব্দীর স্মৃতি হয়ে যাবো।
হে ঈশ্বর ...
উপেক্ষিত খিদে
বাবলি সূত্রধর
টিলার আকাশ থেকে গলে পড়ে
চাঁদ।শাল মহুয়ার বিস্তীর্ন প্রান্তরে
ফুলমণির বন্ধ্যা যাপন।
জ্যোৎস্না মাখা শিমূল ফুলে
উপচে পড়ে বন্য খিদে....।
রঙীন রাতের পাতায় লেখা হয়
ধামসা মাদলের ইতিহাস!
ফুলমণির পেটে তখন ভাতের
গন্ধ ব্রাত্যই থেকে যায়।
টিলার আকাশ বেয়ে গলে পড়ে
খরখরে ভাত আর উপেক্ষিত খিদে।
অণুগল্প
সরীসৃপ সঙ্গ (২)
অম্বরীশ ঘোষ
আগে কখনো সুস্নেহ এভাবে চমকে ওঠেনি । টিভিতে মুভি দেখছিল ও । হঠাৎ দেখল যে কিচেনের জানালা দিয়ে একটা বড়সড় কালো কুচকুচে সাপ মা বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল । সে কি গতি সাপটার ! মা-বাবাকে বাঁচানোর জন্য সুস্নেহ ঢুকলো ওই ঘরে । খাটের নিচ থেকে শুরু করে ঘরের সর্বত্র খুঁজলো ভয়ে ভয়ে । না , কিছুই নেই । কিন্তু নিজের চোখে দেখা ঘটনা ! পরের দিন আবার প্রায় একই সময় । এবং তাজ্জব ব্যাপার , আবার সেই একই ঘটনা । ওই বিশাল বড় কালো কুচকুচে সাপটা কিচেনের জানালা দিয়ে ঢুকলো । বীভৎসভাবে এঁকে বেঁকে গিয়ে ঢুকলো মেয়ের পড়ার রুমে। আঁতকে উঠে সুস্নেহ ঢুকলো মেয়ের ঘরে । পিতৃস্নেহে ভয়-ডর বাদ দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলো ঘরের সর্বত্র । না কোথাও কিচ্ছু নেই ! আজ বাড়ির সকলে বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে চাইছে না । সকলে বলছে যে সুস্নেহর কোথাও নিশ্চয়ই একটা ভুল হচ্ছে । কিন্তু সুস্নেহ কি করে নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবে ! তৃতীয় দিন বিষয়টার বীভৎসতা একেবারেই আলাদা । একই সময়ে স্ত্রী ইচ্ছে করেই নজর রাখছে জানালাটায় । সুস্নেহ একটু অস্থির মন নিয়ে টিভিতে খবর শুনছে । আবার জানালা দিয়ে ওই কালো মিশমিশে সাপটা ঢুকে পড়ছে । সুস্নেহ বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে সাপটার দিকে । সাপটা একটু থেমে দাঁত বের করে তাকালো ওর দিকে । তারপর অন্যদিনের চাইতেও বেশি গতিতে এসে ঢুকে পড়ল ওর বুকের ভেতর । বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে বসে পড়ল সুস্নেহ । কিন্তু বুকে কোন ক্ষতচিহ্ন না থাকায় কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারল না ।
যাকে পাবি তাকে খা
সোমনাথ বেনিয়া
কালো বিড়াল! হাঁচি! শরীরে আঘাত! অতএব দাঁড়িয়ে যাও। এই যে দাঁড়ালে তা কিন্তু পারতপক্ষে পেটের জন্য। পেটের ভিতরে দৌড়। পেটের বাইরে দৌড়। রান অ্যান্ড রান অ্যান্ড "ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান!" কোথাও মস্তিষ্ক, কোথাও-বা গতর। মস্তিষ্কের কোষে-কোষে শ্রম আর গতরের চামড়ার ভাঁজে ঘর্মাক্ত পরিশ্রম। দু-ক্ষেত্রেই "ওয়ান পাইস ফাদার মাদার!" মাথা ঝিমিয়ে যায় আর ক্লান্তির অকৃত্রিম আক্রমণে শরীর নেতিয়ে পড়ে। অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ডে দু-জনার প্রয়োজন বিছানা। এখন তুলতুলে নাকি শুধু তক্তা, তা বিবেচনা করতে গিয়ে পূর্ণিমার সাথে পেঁচার গোপন বৈঠক হয়। পূর্ণিমার আলো নরম, কোমল, স্বপ্নালু, অন্যদিকে পেঁচার ঠোঁট কঠিন, কঠোর, বাস্তবিক। তবু স্বপ্ন একটা থাকে যে আসে রক্তকণিকার সমস্ত বাধা পেরিয়ে। স্বপ্নের রঙ বদলে গেলে হৃৎপিণ্ডের ওঠা-নামা হাঁসের ঠোঁটের পর্যায়ক্রম হয়ে ওঠে। যেন একথালা ভুসি মেশানো পানতা ভাতের মধ্যে ঠোঁট দুটির কতকত শব্দে অবিরত নড়ে চলা। কী দেখবে? খিদের রাজ্যে শিল্পী সত্তার গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো হয়। প্রতি মুহূর্তে চরাচর ডুবে থাকতে চায় ভোগবাদীর চূড়ান্ত অসুখে। সেই অসুখপ্রিয়তা প্রাত্যহিকীর আনাচকানাচ থেকে তুলে আনা কদম চালে চলা সারিবদ্ধ মুখের কষ্টকল্পিত নিশ্বাস।
খিদের জ্বালায় এখানে সম্পর্ক জটিল হয়ে ওঠে। জটিল রসায়ন ফ্লয়েডিয় তত্ত্বের ঘাড়ে বসে থাকে। সম্পর্কের সরু তারে অভিধানের বাছা-বাছা শব্দগুলো ব্রাউনিয়ান মোশানে দৌড়ায়। এই আপেক্ষিক জীবনে কার ভালো, কার মন্দ কিংবা এর উলটো ঘটনাও দোলাচলে থেকে মাঝেমধ্যে "জরুরী অবস্থা" জারি করে। ঠোঁটের সাথে ফুঁয়ের মিলবন্ধন ঘটলে মাউথ অর্গান বিপ্লবী হয়ে ওঠে। আশেপাশের যত ছড়ানো-ছিটানো মন আছে, তাদের সবার মধ্যে যেন তাদের নিজস্ব প্রিয়সুর অ্যাকসেস খুঁজে পায়। তখন সবাই সবার আইডল। প্রত্যেকে প্রত্যেকের রূপকথার নায়ক হয়ে যায়। আলোকবর্ষ দূর থেকে ছিটকে আসা কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর অভিকর্ষের টানে গ্রন্থিত হয়ে ছুটে আসে। ফিল্মের দৃশ্য। নায়িকা ছুটে যাচ্ছে নায়কের কাছে। তারপর একে অপরের বাহুডোরে আবদ্ধ। জেগে ওঠে আদিম খিদে। নলেনগুড়ের মতো চুয়ে পড়ে শরীরী উপাদান। ঘোষণা হয়ে যায় "কোহি মিল গ্যায়া!" আনন্দ তখন শব্দের খেলাঘর। প্রেমের শব্দছক। শুধু ঘরের পর ঘর মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। থমকে দাঁড়ালে মনে হয় "অ্যায় মসোম বড়া বেইমান হ্যায় বড়া, বেইমান হ্যায় অ্যায় মসোম!"
-
টংঘরে রাজা প্রথম মনীন্দ্র গুপ্ত রমিত দে ...” জন্ম থেকে এই জগৎকে পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছি, আর তাঁর বিচিত্র অর্থ মনের মধ্যে উঁক...
-
চোখ নীলাব্জ চক্রবর্তী ক্যামেরা অর্থে কোনও কাগজের চোখ ঠাণ্ডা দেখি সম্পর্ক একটা গাছ ফেনার ভেতর কে একটা দশকের বারবার নাম বইছে কাঁচের...
-
গানদীঘির কবিতা সুবীর সরকার ১. রাজবাড়ীর আলো সাগরদীঘির জলে পৌষের ঘন হয়ে ওঠা শীত শহরে ছড়িয়ে পড়ে সুরেন বসুনিয়ার ভাওয়াইয়া ঘোড়া ছোটাচ্ছ...