Sunday, August 5, 2018

বিশ্বজিৎ লায়েক এর বিষয়হীন গদ্য 


বিয়োগফলের বত্রিশ আনা জীবন


ভাবছি নিজের কথা লিখব। হয় না। লেখার সঙ্গে ঢুকে পড়ে চাল, গম, চিনি। বি.পি.এল. এর মানুষ। পোড়ামাটির জীবন ও মানুষজন। মিডডে মিলের ভাত। ভাঙা স্কুলঘর। সর্বস্ব খোয়ানো আমানতকারীর ক্যাবলা, দোমড়ানো মুখ। আর্দ্রতা ও কৌতুহল।
আকাশে চাঁদ উঠলে নাচতে ইচ্ছে করে। কানে গুঁজে নিতে ইচ্ছে হয় পাখির পালক। সম্ভব হয় না। ঘর বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। পারি না।
মেসবাড়ির জানলা বন্ধ করলে পাশের খাট থেকে চিৎকার করে বিশু, ' দেখছিস না, বিড়ি ধরিয়েছি! স্যাভোকেশন হবে।'
আমি বিড়ির ধোঁয়ার দিকে ঈষৎ প্রেম প্রেম চোখে তাকাই। ঈষৎ জুলজুল চোখে তাকাই। বিপরীত  ইচ্ছের প্রবল দড়ি ধরে টানে কেউ। তাকের উপর রাখা ডিওলিন চোখ গোল গোল করে তাকায়। আমি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাই।
অতনু ফোন করে। বলে, 'খবরটা শুনে সেই থেকে আমার খুব খারাপ লাগছে। কেন এমন হল বলো তো!'
কী হল ভাবতে থাকি, ভাবতেই থাকি। ভাবনার আর গাছ, পাথর থাকে না। ১৯ মিনিট ১৩ সেকেন্ড পর মনে হয়, 'সেকি! অমন তো কিছুই হয়নি। হ্যাঁ, হতে পারত। কিন্তু হয়নি।'
বাংলা বাজারের জলবায়ু অঙ্কুরোদগম সহায়ক। দ্রুত মাটি ফুঁড়ে চারাগাছ। ডালপালা গজায়। গোঁফদাড়ি গজায়। শিশু কিশোর হয়। কিশোর যুবক হয়। যুবক প্রৌঢ় গাছ। প্রৌঢ় কি হেঁটে যায় ফেলে আসা শৈশবে। হাঁটি হাঁটি পা পা।
মিহির এসেছিল। আজ। এ যে আস্তাকুড়! কী করে থাকিস! বিছানা জুড়ে বইপত্র। খাতা। চ্যবনপ্রাস। আয়না।  বিস্কিট। মুড়ির কৌটো। ব্যাগ। শোয়েটার, ল্যাপটপ, বিনয় মজুমদার, নীরা, আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে, টর্চ!  বসবো কোথায়!
আমি সন্তর্পণে বাগিয়ে গুছিয়ে জায়গা করে দিই। নে বোস। চা খাবি? মিহির শুয়ে পড়ে। টান টান। চোখ বন্ধ। গরম জলে ব্ল্যাক কফি মিশিয়ে আমি নাড়তে থাকি। মিহির বোঝাচ্ছে বি-কমপ্লেক্স এর গুণাগুণ। প্রোটিন পাউডারের দাম...
আমি অনেকটা পিছনে হেঁটে ক্লাস ফাইভে ঢুকে পড়ি। গোরুর গাড়ি চেপে মামার বাড়ি। একমাসের অফুরন্ত এঁড়ে বাছুর। সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসার হ্যাপা।
আমাকে অঙ্ক কষতে দিয়েছে মিহির। আমি মিহিরকে দিয়েছি একটা খোলা নল আর ভর্তি নলের সঙ্গে বানর আর লম্বা বাঁশের পাটিগণিত। ঠাণ্ডা লড়াই আস্তে আস্তে গরম হচ্ছে - কে উত্তর মেলাতে পারে আগে।
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে লাফ মারি। উফ্ পিছলে পড়ি। টিউশন জুড়ে হো হো! ফাস্টবয়ের তিন টাকা দামের খাতায় প্রথম পাতায় লাল কালিতে গোল্লা। দশে শূন্য আমি। দশে মিহির দশ। সারা ক্লাস মুখ নিচু। লজ্জার চেয়েও দশ গুণ ভয় দাদাকে
মিহির আজ বীরপুরুষ। মুখে, চোখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। মিহির আজ অঙ্ক পুরুষ। মেজাজের রঙে দশে দশ।
ইলেকট্রিক বাতি তখনও আসেনি গ্রামে। বিকেল বিকেল হ্যারিকেনের কাঁচ মুছে দিত মা। কেরোসিন ভরে দিত ঠাকুমা। টিউশন শেষে হৈ হৈ বেরিয়ে পড়া। নিজের সামনেটুকু আলো। পিছনে ধূ ধূ অন্ধকার। হ্যারিকেন নিয়ে দৌড়লেই ঝুপঝাপ অন্ধকারে ভূতের ভয়। ভয় সামনে পিছনে। মাথার উপর অগণন নক্ষত্র। কে যেন চিৎকার করল, ' ভূত আসছে... '  আর দে দৌড়...
আজ নিখিল বিশ্বজুড়ে এতো জ্বালিয়েছ প্রভু। টিউব আর নিয়নের ধাঁধাঁ। আমাদের সন্তানেরা কি টের পাবে ভূতের ভয়। পাবে না। আরে ভূতের রাজা তো বর দিয়ে গেছে জব্বর জব্বর তিন বর - আলো, আলো, আলো...
এতো কষ্ট করে থাকিস। ভালো ঘর দেখে উঠে যা।
আমি চায়ে চুমুক দিই।
আর্দ্রতা বেশি হলে বাটা কাটি। চালের দেবতা রুষ্ট হন।
ঘরের কোণে এনে রাখি পাখির পরিত্যক্ত বাসা।
ছেলের ভাঙা খেলনা।
ডায়েরির পাতায় লিখি হিসেব। তের বছর তিন মাস সতের দিন সময় বিক্রি করে, শ্রম বিক্রি করে, নিম্নমেধার সঙ্গে ঘাম বেচে সাকুল্যে একলাখ উনিশ হাজার সাতশো সতের টাকা পঞ্চাশ পয়সা। ব্যাঙ্কে জমা রাখি। বছরে হাজার দশেক থেকে নেমে নেমে সাত, ছয়.. বই কিনি, মৃত আর তরুণ কবির কবিতাযাপন....
আয়নায় ঢিল ছুঁড়েছিল যে প্রবীণ,  ইন্ধন দিয়েছিল ঈষৎ নবীন ও মধ্যবর্তী তরুণ। আজ ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। কথা বলে না। আড়ালে গোপনে। লোক মারফত খবর নেয়।
ভাবে কোন যাদুবলে একটা মধ্য তিরিশের খেটে খাওয়া মানুষ এত আনন্দে গমগম হেঁটে যায়। স্বর্গের বাগানে। দুঃখ কি লুকোয় তাকে! নাকি সেই দুঃখ লুকিয়ে রাখে! বাড়ি আসে।  ছাদে উঠে পায়চারি দেয়। ফুলগাছে জল, মাটি, প্রাণ আর আরাম।
গান গায় - " বাসনা যখন বিপুল ধুলায়/ অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়/ ওহে পবিত্র ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।"
বাড়ি এলে, দু-পাঁচ জন লোক দেখা করতে আসে। চা আর পাঁপড় ভাজা খায়। আড্ডা দেয়। কবিতা আর অঙ্ক কষে রোজ। দুঃখ কষে না কেন!
কিছুতেই ভাঙে না, নুয়ে না। চা খাও তারপর অন্য কথা হবে।
কী আছে তার শিরদাঁড়ায়।
এইসব ভেবে ভেবে মনখারাপ করে কেউ কেউ।
ভাবতে ভাবতে কারো পেটও খারাপ হয়।
কেউ কেউ চাঁদা চাইতে আসে। দুর্গামন্দিরের চাতালে পাথর বসবে। কালিমন্দিরে মোজাইক। জানি ঈশ্বর মন্দিরে থাকেন না। ভাতের থালায় থাকেন আর থাকেন স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে...
দুপুরে উবু হয়ে শুই। কোনো কোনো রোববার। মাসে দু-একবার তো হয়ই। হাসতে হাসতে তিন বছরের সন্তান অপ্রতিম এসে খাটের বাজু ধরে দাঁড়ায়। হামি খায় গালে।
কোলের পাশে এসে চুপচাপ শোয়। ভাবি ঘুমোবে এবার। না। মিনিট পাঁচেক চুপচাপ থেকে তড়াক করে উঠে বসে।  ডায়েরিতে আঙুল ছুঁইয়ে বলে, 'বাবা দেখো 'ক'।'
আমি ওর মুখের দিকে তাকাই। ওর শৈশবের সঙ্গে মিশতে থাকে আমার ফেলে আসা শৈশবের রঙ। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ রামধনু। আমার বিয়োগ ফলের বত্রিশ আনা জীবন।
ছোটো ছোটো দুটো হাত আমার কর্কশ গালে বুলিয়ে দেয়। আদর করে। হামি দেয়। বলে, 'বাবা সোনা ছেলে 'ক' করে।'
ওকে বোঝাতে চেষ্টা করি  - 'ক' তারপর এই 'বি' (বিশ্বচরাচর)।  তারপর এই যে 'তা'(তাক ধিনতাধিন)  এই আমার কবিতা লেখা।
যাপিত জীবনে কবিতার আলো-অন্ধকার। তুই লিখবি!
হাততালি দিয়ে ওঠে, 'বাবা, আমিও কবিতা... '
আমার হাতে আলগা করে ধরে থাকা কলম কেড়ে নিয়ে গোটা পাতা জুড়ে মস্ত 'ক' লিখছে আমার শিশু ভোলানাথ।
সাতবছর পর আবার আমার চোখে জল আসছে।
আমি কাঁদছি না।
আমার অপ্রতিম সত্ত্বার ভিতর দেখছি আমার বীজ, আমার আগামী স্বপ্ন..
হাসছি। হো হো করে হেসে উঠছে অপ্রতিম। আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করছি বত্রিশ বছর পিছনে গিয়ে সেই হাসি টুকু ছুঁয়ে থাকার...

No comments:

Post a Comment