Sunday, August 5, 2018

কবিতা করিডোর ( জুলাই- ২০১৮) 
বাংলাদেশ বিভাগ 

ফারহানা রহমানের কবিতা 


তোমাকে দেখে না মন

এ হৃদয় এক কোমল পাখি কখনো বন্দি হয় খাঁচায়
কখনো উড়ে যায় আকাশে
বুনোহাঁসের মতো কুয়াসায় ডুব দেয় যখন তোমাকে দেখে না মন

পরন্ত বিকেলে বিপন্নতা ফিরে এলে
তুমি হয়তো ভাবছো
এই নিদারুণ আধুনিক দিনে 
প্রাচীন কোন মুখোশ পরে
কোনদিন হেঁটে যাবে নষ্ট সহবাসের দিকে
সুগন্ধি আঁতরে ঢেকে দেবে পাশবিক সুখ
তখন কেউ জানবে না
কেন ব্রোথেল ছেড়ে রথে চরে বেড়িয়ে এলো মিসরের দেবী...

অথচ প্রতিটি শ্রাবণেই সন্ন্যাস এসে উন্মোচিত হলে 
বৃষ্টিতে ভিজে যায় শত শত উলঙ্গ জোনাকির দল... 

অনলের দাবদাহ 


এ বিমূর্ত সকালের গায়ে ঢেউ তোলে রঙধনুর স্বপ্ন ক্যানভাসের গ্রীবায়। গমরঙা মায়াবী সংঘাত ভেসে থাকে নাভিপদ্মে ।  সূর্যকনার মতোই মানবজন্ম বিশুদ্ধ হয় মধ্যরাতে। 
এভাবে হৃদয় নিংড়ানোর মতো ফোঁটা ফোঁটা অহংকারে আকুলমায়া জমে আছে 
ডাহুকডাকা অনাদি ভোরের বিষণ্ণ আলোর কণার উৎসমুখে !

তুমি কী দেখেছো ?

কতো জলজ কন্যারা যেখানে নিরুদ্দেশ হয় মহাশূন্যের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে....!! নীল চৈতালি বাতাসে মুখ লুকায় বারবার কুয়াসা মানবীর মতো ;
আমিও তখন নদীর অলস নীরবতায় ভেসে থাকি......
তীব্র অনলের দাবদাহে।।


মীর রবির কবিতা 


পিঁপড়ে 


 কালো পিঁপড়ের দল ফেলে দেওয়া নারিকেলে খুঁজে পেয়েছিল যে নিরাপদ আশ্রয়- আমরা তাও একদিন ভেঙে দিয়েছিলাম পুতুল খেলার ছলে। বুঝে উঠিনি- কিভাবে ভেঙে গিয়েছে পিঁপড়েদের সংসার ; কতটা অসহায় হয়েছিল তারা, জানা নেই তারও কোনো পরিসংখ্যান। মানুষতো বুঝতে পারে জমির খতিয়ান, দাগ নম্বর তার কত, কিন্তু- পিঁপড়ে সব জানতো কি, মানুষের পৃথিবীতে কি তার অধীকার? জানা না জানা নিয়ে আমি এখন গবেষণাপত্র জমাই, কালো অক্ষরে দেখি পিঁপড়ের মিছিল- দৃশ্যপটে এঁকে যাই ছবি, পিঁপড়েরা টেনে নিয়ে যায় মানুষের শব, উৎসব করে প্রকৃতি।


ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধ 


হন্তাকারক প্রতিটি রাত ঝুলে থাকে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত কয়েদির উপর, ক্রসফায়ারে চলে যায় নৈমেত্তিক ব্যঞ্জন। আমরা মানবাধিকারের অঙ্ক কষতে কষতে ফেনা তুলি মুখে, রাষ্ট্র গুণতে থাকেন নাগরিক কফিন। সংবিধানের পোকায় খাওয়া হরফ মুছে যায় স্লেটের মতো করে, বিচারিক অধিকারে উড়ে যায় হাওয়াদের দেশে। বাড়তে থাকে আমাদের বেগতিক দিন, বন্দুকযুদ্ধ- খবরের কাগজের দৈনিক শব্দ মাত্র। গুলি ও বুলেটের আওয়াজে বাজতে থাক শুধু মাদকাসক্ত সংলাপ।

ফেরদৌস নাহারের কবিতা 


একটু ধোঁয়াটে

মুছে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। মুছে যাওয়া আসছে ফিরে ফিরে
চোখের উপরে হাত রেখে অন্ধকারের পরিবর্তে ছবি দেখি
কতকাল এভাবে চলবে জানি না

ডাক দিচ্ছ। শুনতে পাচ্ছি না। শুনতে চাই না। অভিযোগ নেই
অভিযোগ না থাকাও একরকমের অভিযোগ, এসব জেনেছি
নিঃশ্চুপ থাকা থেকে

তীর্থে আছি। ফিরে এসে বলব, কেমন কেটেছে দিন, কেমন ছিল
মাঝরাতের ঘুম ভাঙা বৃষ্টি। অসভ্য ইঙ্গিতে কী কী ঘটেছিল সব বলব
এখন দেখ তো চিনতে পারো কিনা

মৃত্যু রেসেপি 

এখনো আমার একুশ বছর বয়স
অভিমানের জামা এখনো নামাইনি গা থেকে। মুছে যাচ্ছে লেবুঘ্রাণ
পিয়াজু বুটের ইফতার সন্ধ্যা। ওই তো মা জায়নামাজে
পিছন থেকে দেখতে দেখতে পালিয়ে যাচ্ছি ছাদে
এখন আমি খুবই নিজের, মৃত্যু রেসেপি শেখা

তুমি আমাকে মৃত্যুর রেসেপি দাও আর আমি মৃত্যু রান্না করি
কাল আকাশে চাঁদের অসুখ তীব্র অভিঘাতে
টুকরো টুকরো জ্যোৎস্না হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘাটে
সেখানেও দড়ি-কলসি অপেক্ষাতে
সারাটা দিন কেটে গেল, মৃত্যু এসে নামে সন্ধ্যার ট্রেন থেকে


অনুপমা অপরাজিতার কবিতা 


১অগ্রন্থিত পত্র


পৃষ্ঠা ভর্তি কানামাছি মিথ্যে কানামাছি
সত্যি নিয়ে
কী যত্নে গুছিয়েছি সেদিন হলদে পোশাক
রিক্সার প্যাডেল ঘুরতেই
ঠা ঠা রৌদ্রকে ভিজিয়ে দেয়
হঠাৎ বৃষ্টি।

ঝাঁক  ঝাঁক নাগরিক চোখ
উপচে পড়া ঈগলছোঁ দৃষ্টিকে মাড়িয়ে
কাকচোখ এঁকে বেঁকে স্পর্শের আহ্লাদ।
রিলকের কবিতাকে ছাপিয়ে
অগ্রন্থিত কয়েক পৃষ্ঠা পত্রপাঠ
অতঃপর অন্য ডাকবাক্সে
রানার ছোটে রানার রঙিন ভার্সনে।

২স্কেচ

দূর্বার সবুজে চিত্রিত শব্দগুলো
 ঝলসে ওঠে--
ওখানে কখন যেন আমি রেখে এসেছিলাম
আমার বেদনা আর বাসনার সুগভীর
নগ্ন নির্জনতা
 আর সবগুলো আঙুলের জলছাপ!



স্নিগ্ধা বাউলের কবিতা 


কবিতাঃ ১ 

দৈবের অভিস্মপাতে ঘুরে আসি
জন্ম জন্মান্তরের খেয়া নৌকা
মহাকাল, যোজন-অভিযোজন
অতঃপর সংসার মিলে
সে এক বিশ্রী কারবার;
মরে যাবার মতো ভয়ে
দারুন সুখ মিলে গুরুবাদের তরীতে
বটবাদ আর অশ্বত্থের মায়া জাগে ওখান
জানতাম মায়ের স্মৃতি থেকে স্ত্রৈণকাল
সমস্ত জুড়ে জরায়ুর মায়া-
রাধিকার জলকেলি ব্যখ্যায় সাধ হয়
একগুচ্ছ চুলের বিনিময়ে পরমেশ্বরী হই
আর জনমে রাধা, মেনে রাখি
এক হোম বহু শ্যাম
সঙ্গমে আসুক বহুতর
পুত পবিত্র হয়ে স্নানের মতো তবে
কৌটিল্য আমার জতিলতায় রয়ে গেছে
নারী জন্মের সাধ!
ভাঙি চল নারীর ভান্ডার, ওখানে যত বীজ
 হয় বপন কৈবর্তকালে
নরম ওমে-
যৌবন ধায় ভোগে , অভিলাসী হয়ে
আমি দৈব অভিসম্পাত  চাই মেঘরাজ
তোমার কপটতা আমায় ধার দাও ওগো
অঙ্গের দানরুপ আমি মাথা পেতে নিব।

কবিতাঃ ২ 

গেলো শীতে বুণেছিলাম বীজ
ভেজা আকাশের চোখ টেনে
বরাহ দেবতার আসনে প্রার্থী হয়ে
চেয়েছিলাম হেমন্ত;
এই আকাশের চোখের জল নেমে আসে
দিঘীর ঢেউয়ে, মাঠেলী ঘাসে
বিস্তারিত নিলামী একাকীত্বে। 
হেমন্তের ঘ্রান পাই, সীতার আঁচলে মুখ রেখে,
মা যেন সীতা আর লক্ষি পেঁচার চোখ,
সিথানো সিঁদুরে তার
জন্মে এক পুষ্ট ধানের ছড়া-
বেঁচে থাকে কয়েক পুরুষ আর হাজার বছর।

আসছে শীতে বুণে রাখবো আরো হেমন্তের বীজ।

জুয়েল মাজহারের কবিতা 

কোকিলের বনে
-----------------------
জিরোবার ইচ্ছে হলো মন খুলে কোকিলের বনে।
কুডুরাফলের মতো জীবনের পাকা অবসাদ
মরমের এই দু:খে হৃদয় কাতর!
সূর্যদিন ডুবে গেলে নদীতীরে একা বসে ভাবি:
রক্ত, যুদ্ধ, ভয়াবহ মেশিন, দামামা
খুনির কাহিনি দিয়ে গড়া
কেবলি মেশিন বাজে! সকাতরে আজ তাই বলি:
মেশিনের চেয়ে ঢের খাঁটি এই পাতাটিকে মানুষ দেখুক
রক্তদৃশ্যে ভরা এই নাটক এড়িয়ে আমি দেখতে চাই
তোমার হৃদয়ে কতো ফলের বুদ্বুদ
কতো গান উচ্ছ্বসিত, মর্মরিত
বসন্তের বনানী-কেবিনে
তাই এতো কাছে আসি, তাই আজও জিরোবার ছলে
কতো কতো বনানীবিলাস
মেশিন ছাপিয়ে উঠে বুকে এসে ঝাঁপ দিতে চায়

সোহেল হাসান গালিবের কবিতা 

ভুল 

একটা বিষণ্ন কদম গাছ।
গাছের গায়ে আঁচড় কেটে কেউ 
লিখে গেছে 'জুই'।

যেন ভুল বানানে ফুলের ভুল নামকরণ।

ঐ নামের গভীর ক্ষত বেয়ে আজ নামছে
বৃষ্টির নরম শীতল ফোঁটা।

দূরে আমি দাঁড়িয়ে আছি
পকেটে চন্দ্রবিন্দু নিয়ে। দাঁড়িয়ে আছি
সমস্ত জীবন।

নির্বাসন

অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে হঠাৎ যে পাখিটির
ইচ্ছে হলো, এবার গুটিয়ে নেবে ডানা—তারও চেয়ে
বিপন্ন কি তুমি? ‘আরক্তিম’ শব্দটির মতো, ধীরে,
ফুটিল যে লজ্জাবতী—যদি বলো তারই কাছে গিয়ে
না হয় শুধাব সব কথা। আমারও যে কী হয়েছে—
জ্বর কিংবা জ্বর নয়, কেবলই কাঁথার মধ্যে ঢুকে
শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। কর্মফল-প্রাজ্ঞ কোনো এক
শামুকের মতো আত্মলীন হয়ে শুনে যাই শুধু
অপরের কলরব—এও এক নির্বাসন—নয়?

উল্টে যাওয়া কচ্ছপের চেয়ে অসহায় এ জীবন—
পড়ে আছি চিৎ হয়ে, উদভ্রান্ত জাহাজের ডেকে।
চোখ বন্ধ করে ইস্পাতের গায়ে রৌদ্রের মেজাজ
ঠিকই টের পাই আমি। কিছুই করার নেই তবু!
কানে পৌঁছুবার আগে কথাটাকে কান ধরে টেনে
ফিরিয়ে আনার মতো সবই কি অসাধ্য হয়ে গেছে!
স্রোত কিন্তু ঘুরে দাঁড়াবে না, হে তরণি, এ অবাধ্য
ঢেউয়ের ডগায় উঠে সরু সাপিনির মতো তুমি
জলের জমিনে দেখি, ছোবল বসাও একবার...

মাহদী হাসানের ছড়া 

কোপাই


এই হৃদয়ে বাজছে আজও কোপাই নদীর সুর,
ভালোবাসার বসত ভিটে মনটানে লাভপুর।
ছিপছিপে তার গায়ের গড়ন দৃষ্টি মনোহর,
প্রতি ঘাটের মাতাল হাওয়ায় কোপাই স্বনির্ভর।

গ্রীষ্ম এলে বুক ফেটে যায় হাঁটুর সমান জল,
শীর্ণ বুকে খেলায় মাতে খোকাখুকুর দল। 
বর্ষা মেয়ে ছন্দ তোলে— যেনো নূপুর পায়,
আমার ভেতর একটা কবি খুব কাঁপে লজ্জায়।

পড়ছে মনে— কাহারপাড়া, সেই অমলিন ঢং,
দাওয়ায় বসে পা দুলিয়ে থাকতো মেখে অঙ।
শরৎ এলে খোঁপায় গোঁজে শুভ্র কাশের ফুল,
মনটা আমার সাতার কাটে আনন্দে মশগুল।

অবসরে পড়ছে মনে— সেই হাঁসুলি’র বাঁক,
সন্ধ্যে হলেই সেথায় নামে বাউল পাখির ঝাঁক।
সেই পাখিরা গাইতো দুলে জীবনবোধের গান,
কোপাই নদী সুর মেলাতো জুড়িয়ে দিত কান।

ওর নাড়ীতে ঘুম এসে যায় উদার বালুর চর,
লাল আঁচলে মায়ের গন্ধ সইতো না আর তর।
তৃষ্ণা মনে আসতো নেমে চোখের পাতায় ঘুম,
এই কপালে জুটত আমার— মন্দাকিনীর চুম।

ভাটার টানে যায় হারিয়ে উদাস মনের দুখ,
শান্তিনিকেতনের সুরে জোয়ার আনে সুখ।
স্বচ্ছজলে সাতার কাটে সাঁওতালি সব ফুল,
ধন্য কোপাই ভিজিয়ে দিলো কোমর সমান চুল।

একটা রবি স্বপ্ন বোনে কলম হাতে তার,
শণের ফাঁকে ছন্দ তোলে সেই পাহারাদার।
একলা পথিক রাত জেগেছি পার করেছি দিন,
মৃদু ঢেউয়ে তৃপ্ত হিয়া বাড়ায় কেবল ঋন।


মোহাম্মদ জসিমের অনুগল্প 

নদীভাঙন

শহরটিতে কোন নদী নেই। নদীর গল্প শুনেছে সে। অনেক গল্প। 
একদিন শহরটি অন্য আরো অনেক ছোট-বড় শহরের বুকের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে নদীর খোঁজে গেল। ‌নদী দেখতে সুন্দর—নদীতে ঢেউ, জেলেনৌকা, মাছের গদি, ঠান্ডা হাওয়া, কাশবনে পাখি, নীলাভ আকাশ। এইসব গল্প তার মাথার মধ্যে ঘুরছে।
বহুদিন হেঁটে শেষপর্যন্ত নদীর দেখা পেয়েছিলো সে। মিথ্যে শোনেনি সে। নদী আসলেই সুন্দর। নদীপাড়ের গ্রাম আর শহরেরা আসলেই সুখি। ভাবলো সে।
একটু পড়েই নদী শুরু হলো নদীর পাগলামি। একেক খাবলায় অনেকটা করে শহরের শরীর কামড়ে খেতে লাগলো। ধিরে ধিরে গ্রাস করতে লাগলো পুরো শহরটিকে।
শহরটি অবাক! ধুর শালা! এত কষ্ট করে নদী দেখতে এসেই নিজেই নদী হয়ে যাচ্ছি এখন...
----
শয়তানঃ০১
শয়তানের সাথে আমার প্রথম দেখা একদম শৈশবে। কেবল হাঁটতে শিখেছি, দৌড়ের অভ্যাস করছি। আমার সমবয়সী ছিলো দিলু কাকার ছোট ছেলে রতন। আমরা একসাথে খেলতাম।
শয়তান এসেছিলো বৃদ্ধের ছদ্মবেশে। রতনের ছিলো একটা লাল রঙের বল। বলটির প্রতি আমার বিশেষ কোন লোভ ছিলো না। একসাথে খেলতে পারলেই খুশি। 
বৃদ্ধটি আমাকে বললো- নে, বলটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালা। বলটা তোর হয়ে যাবে।
আমি কোনদিনই কিছু ছিনিয়ে নেয়ার মতো সাহসী ছিলাম না। তবু শয়তানের কথায় প্ররোচিত হয়ে চোখ বন্ধ করলাম, বলটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দিলাম দৌড়। সম্বিত ফিরতেই দেখি- বল না, বৃদ্ধের হাতটিকে মুঠোয় নিয়ে দৌড়ুচ্ছি আমি।
আমার দ্বিধান্বিত মুখ দেখে মিটিমিটি হাসছেন বৃদ্ধ। যা-ই হোক, বল ছিনিয়ে নিতে না পারলেও আমার হাতটি যে ছাড়িসনি এটাই অনেক।
বৃদ্ধের এই রহস্যময় হাসির অর্থ বুঝতে পারিনি তখন।

No comments:

Post a Comment