Sunday, August 5, 2018

সুবীর সরকারের গদ্য 


ধানবাড়ি গানবাড়ি
সুবীর সরকার

‘আইতোত দেখং সোনার বালা
দিনত দেখং মুখত গোটা’
তো সেই মধ্যরাতের গানের আসরে,লোকনাটকের আসরে যে সুন্দরী তার নাচ, তার কোমড়ের ভাঁজে এক হিল্লোল এনে পুরো গানবাড়িকেই আবিষ্ট করে দিয়েছিল;সেই ভরা সভায় তুমুল লোকপালাকে মুখরিত কোন নদীর পাড়ের কাশিয়ার ফুলের শোভায় শোভায় আচ্ছাদিত করে পুরো গানের আসরটাকেই উৎসব মুখরিত করে দিতে পেরেছিল সেই সুন্দরী চানবালা বর্মনকে সকালের নুতন রোদের আলোয় আলোয় হেঁটে যেতে দেখে গঞ্জের মানুষজন কিঞ্চিত বিষ্মিত হয়েই ওঠে বুঝি বা!কি কান্ড!রাতের সেই রুপসী নাচুনির সকল রূপ তো একেবারেই উধাও!চানবালার মুখভরতি পুরোন ব্রণের অগভীর সব দাগ।গাত্রবর্ণ বেশ কালো।উচু দাঁত।হায় রে,রাতজীবনের সোনার ময়না এখন কোন আন্ধারে বুঝি উড়াল দেয়!এমনই হয়,এরকম হতে থাকে জনমভর চানবালার চার কুড়ি ছুঁই ছুঁই জীবনে।কি এক তাড়িত দুঃখের মতন জীবন তার।সেই ছোট থেকেই ঠাকুরদাদাদার ‘কুষান পালার’ দলে ঘুরে ঘুরে চানবালার নাচের জীবন,গানের জীবনের শুরু।রাতের পর রাত গানের আসরে আসরে,কত কত ধুলিমাখা মানুষের ভিতর তার জীবন পেরিয়ে আসা।সারাদিন অন্দরে কন্দরে ঘোরা,ঠাকুরদাদার সাথে হাট টাট ঘুরে বেড়ানো।আর রাত হলেই গানের আসরে আসরে,গানবাড়ির আদিমধ্যঅন্ত জুড়ে এক অন্য জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়া।চানবালা বড় হয় এভাবেই।ঠাকুরদাদাদা চলে যান।ইতিমধ্যে চানবালা বর্মণ নামিক্কার নাচুনিতে রুপান্তরিত হয়েছে দশ বিশ চল্লিশ গাঁগঞ্জে।চানবালার দল মানেই অপরূপ সব পালার আসর।মানুষের আবেগ মিশে থাকে সেই সব পালায় পালায়।আসর ভেঙে যায় শেষ রাত্রে।কিন্তু গানবাড়ি ফেরত মানুষের কন্ঠে আর স্মৃতিতে জেগে থাকে গান_
‘বেলা ডুবিলে হইবে রে আতি
সঙ্গে নাই মোর সঙ্গের সাথী
ছাড়িয়া দে মোর শাড়ির আঞ্চল
যায় বেলা’
সেই রাতের আসরে আসরে ঘুরে ঘুরে দুলে দুলে অদ্ভূত সব নাচগুলি গানগুলি চোখের মণিতে ভেসে ওঠা বিদ্যুৎরেখায় চানবালা তার মস্ত জীবনকেই জাগিয়ে রাখতে চায়।উত্তরের গঞ্জে গঞ্জে নাচগানের দুনিয়ায় সে তার স্বপ্নগুলিকে নুতনতর করে নিতে থাকে।রাতের জীবনের রহস্যে সে কেবল ডুবে মরে।এটাই তো তার নিয়তি।এই ভেসে যাওয়াটাই হয়তো সত্য।
চানবালার মনে পড়ে খুব মুকুন্দের কথা।মুকুন্দচরণ বাউদিয়া।কি আশ্চর্য দোতোরা বাজাতো।চানবালার গান আর নাচের ফাঁকে দুলে দুলে মুকুন্দের দোতোরা গানবাড়ির আবহই একেবারে বদলে দিত।মুকুন্দ দোতরা বাজাতে বাজাতে ঘাড়ে হলদিয়া গামছা ঝুলিয়ে যখন গাইতো_
‘গদাধরের পাড়ে পাড়ে রে
ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি
কি মায়া নাগাইলেন মাহুত রে
ও তোর গালায় রসের কাঠি
কি মায়া নাগাইলেন মাহুত রে’
আহা!উদ্দাম হয়ে উঠতো পুরো সভা।মেয়েরা চোখ মুছতো আবেগে।চেংড়ার দল দু’চার পাক নেচেই উঠতো।রাতের স্তব্ধতা ভেঙে চাপা পড়ে যেত দূরাগত রাতশেয়ালের ডাক।মুকুন্দর চোখে চোখ রেখে কেমন ভেসেই যেত বুঝি চানবালা!মুকুন্দর সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল চানবালার জীবন।কিন্তু মুকুন্দের বিবাহের প্রস্তাবে সায় দেয় নি সে।কেননা,বাঁধন তো তার জন্য নয়।সে কেবল নিজেকে বেধে রেখেছে লোকগানের সাথে।নাচের সাথে।হাজার হাজার প্রান্তবাসী জনমানুষের ধুলো ও ঘামের সাথে।রাতের গানবাড়ির মাদকতার টানে রাতের রহস্যে লীন করে দেওয়া এক জীবনযাপনের সাথে নিজেকে।মনের দুঃখে মুকুন্দ চলে গেল দল ছেড়ে দেবীর হাটের মহেশ গীদালের দলে সে এখন দোতোরা বাজায়।আর মুকুন্দের কথা মনে হলেই একা একাই গুনগুন করে চানবালা-
‘ওরে দুঃখ কপালের লেখা
মৃত্যু লেখা পায়রে
আহারে দারুণ বিধি
খন্ডন না যায়
মরি আই আই রে’
এভাবেই রাতের পর রাত গান নিয়ে নাচ নিয়ে গাননাচ নিয়ে চানবালার বাঁচা।বেঁচে থাকা।রাতের জীবনের দিকে প্লাবনের মতন ছড়াতে থাকা মনোশিক্ষার গীত-
‘আরে মানব দেহা ভাই মাটির ভান্ড
পড়িলে হবে খন্ড রে খন্ড
ভাঙ্গিলে দেহা আর জোড়া নেবে না’
বহতা নদীর মতন এক জীবন নিয়ে রাতের গানবাড়িতে গানের পর গান নাচের পর নাচে কেমন এক মুখরিত নদীদেশের চঞ্চলতা নিয়ে চানবালা কখন কিভাবে যেন বা রাতজীবনের একেবারে অন্দরেই নিজেকে তীব্র প্রবিষ্ট করে দেয়।যা থেকে সে আর কোন পরিত্রাণ চায় না।রাতের রহস্যের টানেলে সে নিজেকে প্রবেশ করালেও,চুড়ান্ত এক ‘কুষান পালার’ পরিসমাপ্তিতে আমরা কিন্তু চানবালাকে অসহায় দাঁড়িয়েই দেখি।মধ্যরাতের ঘনঘোরের ভেতর তখন বাজতে থাকে চিরকালীন সব গান_
‘যেদিন মাহুত জঙ্গল যায়
নারীর মন মোর কান্দিয়া রয় রে
হস্তীর কন্যা হস্তীর কন্যা বামনের নারী
মাথায় নিয়ে তাম কলসি ও
সখি হস্তে সোনার ঝারি
ও মোর হায় হস্তীর কইন্যা রে’
গান ও নাচের,পালা ও আসরের এই একবজ্ঞা জীবনেই বেশ কেটে যায় চানবালার জীবন।দিনের আলোর কোন রহস্য নেই তার কাছে।সে কেবল রাত্রির রহস্যের দিকে সওয়ারীহীন ঘোড়াদের মতন ছুটে যেতে থাকে,ছুটে যেতে চায় আরো আরো রাত্রি ও রাত্রিকালীন সব চিরায়ত গানবাড়ির দিকেই।

No comments:

Post a Comment