Monday, June 15, 2020

বোশেখ মাস ও লকডাউন (ব্যক্তিগত গদ্য )
সত্যম ভট্টাচার্য


খুব ভয় লাগছে, সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, খুব ভয় লাগছে আমার।যেভাবে সবাই হেরে যাচ্ছে এই করোনা ভাইরাসের কাছে দিনের পর দিন, যেভাবে বিশ্বের তাবড় তাবড় আধুনিক পরিকাঠামোর দেশগুলো স্রেফ হাল ছেড়ে দিচ্ছে, ভাবতে সত্যিই খুব ভয় লাগছে যে সেখানে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের অশিক্ষিত-অজ্ঞ-নিরক্ষর মানুষের দেশ এই ভারতবর্ষের কি হাল হবে।তাই স্রেফ নিজের বেচে থাকার জন্য চোখ ঘোরাতেই হচ্ছে অন্যদিকে।

বৈশাখ মাস এবার এভাবেই চলে গেল।কোথায় পয়লা বৈশাখ, কোথায় হালখাতা,কোথায়ই বা বাজার ম ম করা পাকা আমের গন্ধ।খুব মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে দোকান ঘুরে ঘুরে হালখাতা করে তারপর মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেসব প্যাকেটে কমন আইটেম থাকতো লাড্ডু আর কচুরি। কিন্তু সেই সব ঠান্ডা কচুরি খেয়ে পেটভর্তি গ্যাস হয়ে গেলেও সেকালে ওসব কিছুই মনে হত না।স্রেফ এক ফুঁয়ে উড়ে যেতো সব। যতদূর মনে পড়ে এ সময়টায় পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো আমাদের। তখন মাঝেমধ্যেই দাদুরা ঘুরতে আসতো বাড়িতে, তাদের একশোটা পাকা চুল তুলে দিলে একটাকা মিলতো।কয়েকটা তুলেই বলতাম একশোটা হয়ে গেছে। দাদুরাও সব বুঝে ঝিমুতে ঝিমুতে একটাকা দিয়ে দিতো। সেই এক টাকার যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।  রাতে ভাইবোনেরা একসাথে দাদুর কাছে পড়তে বসা ছিলো  লন্ঠনের আলো্য, ছিলো পড়া শেষ হলে দাদুর মুখে গল্প শোনা। সে গল্প শোনার লোভে তাড়াতাড়ি অঙ্ক কষার চক্করে প্রায় সবারই অঙ্ক ভুল হয়ে যেতো। সে সব ঘু ঘু ডাকা ঝিম ধরানো দুপুরে মন যেন চলে যেতো কোথায় ভেসে ভেসে। শরীরে শিহরণ জাগতো অরণ্যদেব-ডায়ানা-ডেনকালি-তুফান-বাঘা আর অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদে ।সময় না কাটা সে সব দুপুরে আলমারি(যাকে আমরা সেকালে মিটসেফ বলতাম)তার কোনো নিভৃত কোন থেকে ক্রমশ কমে যেতো আচার অথবা গুড়ো দুধ।এরপর যখন ডানা গজালো ধীরে ধীরে, কাউকে কাউকে  দেখে অন্যরকম ভালো লাগতে শুরু করলো,তখন ঘু ঘু ডাকা দুপুরে তার নামে লেখা হতে লাগলো কবিতা।সে সব দিনে তখন সবসময় সাথে  সমরেশের অর্জুন, সুনীলের কাকাবাবু,স্বপনকুমার ,অথবা আরো কত কত বই,সেই সব দিনের চিরসঙ্গী।
আমাদের ছোটবেলায় গ্রীষ্মের ছুটি দেওয়া হত দীর্ঘ এক মাসের।আর মফস্বলের  নিম্নবিত্ত বাঙালী পরিবারে কোথায় তখন গরমের ছুটিতে বাইরে ঘুরতে যাবার কনসেপ্ট। তাই সেই ছুটি আর শেষই হতে চাইতো না তখন। দিন কাটতো ঘরে এরকম বন্দী হয়েই প্রাইয়।তারপর যখন টিভি এলো,সকালে ছুটি ছুটি চালু হল।তাতেই হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ, সোনার কেল্লা আমাদের প্রথম দেখা। ভালো জায়গা পাবার জন্যে শুরুর বেশ খানিক আগে চলে যেতাম সে বাড়িতে যেখানে ছুটি ছুটি দেখবো। যে বন্ধুর বাড়িতে টিভি থাকতো,সে সময় তাই তার খাতির একটু যেন বেড়ে যেতো। সে ফুটবলে তখন নিয়মিত গোল করতো আর ক্রিকেটে শুরুর দিকে ব্যাট।সে সব না দিলে সে বিরস বদনে বলতো-না রে, বাবা না করেছে টিভি দেখতে। এসমস্ত ভাবি দিনরাত আর ভাবি কবে সকালে উঠে শুনবো সব ঠিক হয়ে গেছে। শুনবো ওষুধ বেরিয়ে গেছে এই মহামারীর রোগের।কাল থেকে বাড়িতে বাড়িতে আসবে লিস্ট নিতে যেমন ভোটার লিস্টের সময় আসে।কিন্তু না,সে সব হয় কিছুই হয় না।সকালে মোবাইল অন করতেই একগাদা ভয় দেখানো খবর ঢুকে পড়ে,টিভি খুললেই দেখি চারিদিকে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। সাবান দিয়ে ঘষে হাত ধুতে ধুতে  দেখি হাত লাল হয়ে থাকে আজকাল।

2 comments:

  1. পড়তে‌ পড়তে ছোটোবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম।

    ReplyDelete
  2. পুরোনো স্মৃতি গুলো আবার তাজা হয়ে উঠল

    ReplyDelete