অনুবাদ গল্প
আংটির মালকিন
মূল রচনাঃ নাদিন গর্ডিমার
অনুবাদঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
( জন্ম ১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর তিনি দক্ষিন আফ্রিকার গোয়েটনে জন্মগ্রহণ করেন । বিশ্বের বর্ণবাদবিরোধী সরব যোদ্ধাদের মধ্যে তিনি অন্যতম । বর্ণবাদকেন্দ্রিক এবং পরবর্তী সময়ের সমস্যা এবং শঙ্কাগুলোই তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ।লিখেছেন ছোটগল্প , উপন্যাস এবং প্রবন্ধ । প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্য তিরিশটিরও বেশি । তার মধ্যে পনেরটি উপন্যাস ।বার্গার্স ডটার , দ্য লেট বুর্জোয়া অয়ার্ল্ড , জুলাই’স পিপল এবং মাই সানস স্টোরি ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয় এবং সফল উপন্যাস । ১৯৭৪ সালে দ্য কনজারভেশনিস্ট উপন্যাসের জন্য তিনি বুকার পুরস্কার পান । ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ।নোবেল কমিটি তাঁকে একজন মহৎ মহাকাব্যিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন । বর্ণবাদী সরকারের হাতে বারবার নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁর বই । তবু আদর্শে অবিচল থেকেছেন তিনি। ২০১৩ সালে নব্বই বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।)
সব ফালতু। দুদিনের জন্য আসবে তারপর জীবন তছনছ করে দিয়ে চলে যাবে। এখন বোতল খুলে বিরহযাপন ছাড়া তার কোন কাজ নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে বুঝল তার কপালে আর যাই থাক বউ ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। এরপর সে একা একা থাকার কথাই ভাবল । এর চেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।
সে দেখল ঘরটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। দামি পেন্টিং, কাচের মূল্যবান সামগ্রী, সৌখিন জিনিস, ঘর সাজানোর নানা উপকরণ এমনকি সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা বিদেশী মদের যে বোতল ছিল যাওয়ার সময় তাও নিয়ে চলে গেছে তার স্ত্রী। শুধু অদরকারি ভেবে তাকেই পরিত্যাগ করেছে চিরকালের মতো । তাকে একা নয়, তার সাথে কিছু বইপত্তর রেখে গেছে। যে বইগুলো সে তার প্রথম স্ত্রীর সাথে ঘুরতে ঘুরতে বইয়ের বিভিন্ন দোকান থেকে নানা সময়ে কিনেছিল। সে দেখল প্রতিটি বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় তার প্রথম স্ত্রী ভালোবেসে তার নাম লিখে রেখেছিল। সে মায়া বাড়াল না। ঘরটাকে সাফসুতরো করার জন্য বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এখন নারীসঙ্গ ছাড়াই কেটে যায় তার প্রতিটি দীর্ঘ রাত। অন্ধকার ছিঁড়ে ফালাফালা করতে করতে সে বুঝতে পারল এরা আসলে সবাই ভবঘুরে। প্রমোদবালিকার মতো তারা বেড়াতে এসেছিল, চলে গেছে। ভ্রমণের আনন্দ কি সে নিজে চায়নি? চেয়েছিল। চাইলেও সে সুদীর্ঘ যাত্রাপথে যথার্থ সহযাত্রী চেয়েছিল।
ঘরে তার মন বসছিল না। বাধ্য হয়ে সমুদ্রের ধারে একটি পরিচ্ছন্ন হোটেলে উঠল সে। যেখান থেকে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে সে দেখতে পায় ডোরাকাটা রঙিন দাগের পাথরের ওপর মহিলারা নোনা বিবর্ণ জাজিমে শুয়ে থাকে আনন্দে আর শরীরে সুগন্ধি তেলের প্রলেপ পড়ে । মাথার চুল সাজিয়ে রাখে কৃত্রিম ফুলের মালায়। জল থেকে যখন স্নান সেরে মহিলারা উঠে আসে, তখন চুল থেকে স্বচ্ছ জলের ফোঁটা নেমে আসে মসৃণ আভায়। তাদের আঢাকা শরীরে বিচ্ছুরিত আলোর প্রতিফলন চোখ জুড়িয়ে দেয়। একেবারে ছবির মতো হাতের তালু থেকে কানের লতি পর্যন্ত সামনে-পেছনে আলোর চমকানি। তাদের স্তন উন্মুক্ত। তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে তারা অধোমুখ-ত্রিভুজাকৃতির উজ্জ্বল কাপড় পরে। যা চোখকে টেনে নিয়ে যায় দুই নিতম্বের মাঝখান দিয়ে টানা একটা সুতোর দিকে। লোকটির যতদূর দেখতে পায় – মহিলারা সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে বলে তাদের সম্পূর্ণ নগ্ন বলেই তার মনে হচ্ছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও জড়িয়ে যায় দৃশ্যের বাঁধনে।
খালি চোখে পুরুষশূন্য মনে হলেও সে দেখতে পেল দু একজন পুরুষও রয়েছে সেখানে। তবে সে এখন আর তাদের দেখতে পাচ্ছে না। চোখ বুজে সে সমুদ্রের ঘ্রাণ নারীর মেয়েলি আশ্চর্য গন্ধ – সুগন্ধি তেলের সৌরভে ভরে নিতে চাইল স্মৃতিকোষ। সফেন তরঙ্গগুচ্ছের মাঝখানে সে নিজেকে মেলে দিল। তারপর সাঁতার কেটে সে যেতে লাগল অগভীর দূরের দিকে যেখানে যুবতী মায়েরা তাদের শরীরের সাথে লেপটে নিয়েছে সন্তান। তাদের ভেজা শরীর থেকে এক মায়াবী গন্ধ ভেসে আসতে লাগল।এই তেজস্বী রূপের দিকে তাকিয়ে সে মোহিত হয়ে যেতে লাগল। জলের মধ্যে সে নিজেকে চঞ্চল্ভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগল। তারপর উঠে এল রৌদ্রকিরণে আচ্ছাদিত বালির উপর। সেখানে প্রাচীন ভাস্কর্যের মতো শুয়ে আছে নারীরা। সে তাদের পাশে গিয়ে একসময় শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে দেখল তার মাথার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সুন্দরী ফর্সা রমণীরা। তাদের পায়ের মসৃনতা জুড়ে রয়েছে এক নিরাভরণ প্রান্তর। ভিজে চুলের জল এসে পড়তে লাগল তার গায়ে।
এভাবে একা থাকতে থাকতে সে একসময় সাগরের বুকে পাথর ছুড়তে শুরু করল । জলে সেই পাথরের স্পর্শে আন্দোলনের ঢেউ উঠল কিছুক্ষণ তারপর মিলিয়ে গেল। বাচ্চাদের মতো এইভাবে খেলা করতে করতে একটা পাথরের দিকে তার চোখ চলে গেল। পাথরটার মধ্যে রয়েছে এক অদ্ভুত রহস্যের দাগ, লুকানো অভ্রর বিক্ষিপ্ত অংশে আলোর আশ্চর্য মায়া। এর কেন্দ্রে রয়েছে সমুদ্রের তৈলাক্ত মসৃণ হাতে গড়া কাচের মতো সমতলবিশিষ্ট হীরকের মতো বিষমকোণী চতুর্ভুজ।
পাথরের মতো হলেও তা আসলে যে সে পাথর নয়। গোলাকার স্বচ্ছ হলুদাভ রত্ন কাটার বাদামি পাথর, সেখানে রয়েছে নীল আর সবুজ কাচের বোতল, যা নীলাভ সবুজ মুক্তো আর পান্নার মতো দেখতে। ছোট বাচ্চারা সেগুলো ঝুড়িতে সংগ্রহ রাখছে । চারদিকের এতসব ঐশ্বর্যের সমারোহের ভেতর থেকে একদিন বিকেলে সৈকতে একটি সত্যিকারের আঙটি তার হাতে এসে ধরা পড়ল। রঙিন কাচের টুকরোর মধ্যে হীরের একটি নীলকান্তমণি আংটি।সে সহজেই বুঝতে পারল এটি কোন মহিলার মহিলা হাত থেকে খুলে রাখেনি। তাই যদি হত তাহলে তা নামানো থাকত কোন পাথরের উপর। এখানে যারা রোদের মধ্যে উপুড় হয়ে আছে তাদের কারোরই এমন অবস্থা নয় যে এত দামি আঙটিকে তাচ্ছিল্য করতে পারে। কোনো ধনীর দুলালি, বড়লোকের আয়েশি স্ত্রী সাঁতার প্রতিযোগিতায় বা নৌবিহারে ডুব দিতে গেয়ে ফ্যাশনের ছলে শরীরের অপ্রোজনীয় পোশাকের মতো খুলে রেখেছিল এই আংটি।তারপর ভুলে গেছে। অথবা অসতর্ক মুহূর্তে আংটিটি হাতের আঙুল থেকে পিছলে পড়ে গেছে। হয়তো তখনই টের পায়নি। বাড়ি ফিরে এসে বুঝতে পেরেছে ওটা হারিয়ে গেছে। আর পাওয়া যাবে না ।হয়তো বা ছুটে গেছে ইন্স্যুরেন্স নীতিতে কী আছে জানতে। এদিকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধীরে ধীরে আংটিটি মাটির ভেতর ডুবে যেতে যেতে এটি সত্যিকার অর্থে একটি সুন্দর আংটিতে পরিনত হয়েছে। আংটিটি যদিও প্রায় ছয় ইঞ্চি মাটির নিচ থেকে এলোপাতাড়ি আঙুলের খোঁচায় তুলে আনা হয়েছে। তবু সে এটার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন এখনই এর মালিক জেনে ফেলবে সমস্ত তথ্য। আর তাকে জেলে ভরে দেবে চুরির অপরাধে। তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। আনন্দে , ভয়ে, উদ্বেগে।
ওদিকে সেই মহিলাদের কেউ তাকে দেখছে কীনা সে লক্ষ্য করতে লাগল। দেখল কেউ কেউ তাকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে তাদের নগ্ন মোমের মতো শরীরে তেল মাখছে, বিন্দুমাত্র বিকার নেই তাদের। বরং তাদের আচরণে কোথাও যেন উপচীয়মান আনন্দেরই বহিঃপ্রকাশ আছে। আংটি হারালে যা স্বাভাবিক ছিল না। কেউ কেউ বাচ্চাদের শরীর মুছে দিচ্ছে মাতৃস্নেহের নরম লাবণ্যে । ছোট আয়নায় তাকিয়ে তাদের কেউ কেউ চোখের ভ্রু ঠিক করে নিচ্ছে। কেউ কেউ দেখে নিচ্ছে জলের সিক্ততায় কতখানি মাধুর্য উঠে এসেছে বুকে।
এই ভিড়ের মধ্যেই সে চুপিচুপি আংটিটা নিয়ে আসে হোটেলে। আর ভাবতে থাকে এটা কি ঠিক হচ্ছে? ন্যায়সম্মত হচ্ছে ? সে কেন চোরের মতো এরকম আচরণ করবে ? এটা পুলিশের হেফাজতে রাখলেই কি ভালো হত না ? সারিবদ্ধ প্রশ্ন তার মাথার ভেতর কিলবিল করতে লাগল। না, সে পুলিশের কাছে গেল না। একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিল; যার বয়ান ছিল এরকম- “ গতকাল দুপুরে নীল দিগন্তের সৈকতে একটি আংটি পাওয়া গেছে। উপযুক্ত প্রমাণ সহ যোগাযোগ করুন। নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেওয়া আছে নীচে। ” হোটেলের রুম নম্বর দিতেও সে ভুল করেনি। বিজ্ঞাপন প্রকাশের দিন থেকেই পরপর ফোন আসতে শুরু করল তার কাছে। ফোনে ফোনে সে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। সকালের দিকে কিছু পুরুষের ফোন এসেছিল। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম ছিল- ‘ আমার স্ত্রী আজ সৈকতে একটি হীরের আংটি হারিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে ওর এতই মনখারাপ যে কথা বলতে পারছে না।’
সে তখন বলল- কীরকম আংটি ?
পুরুষকণ্ঠগুলি থেকে একই ধ্বনি উচ্চারিত হল- হীরের দামি আংটি
সে বলল- আপনি বিশদে বলুন।
কেউ কেউ মিথ্যে বর্ণনায় ভরিয়ে তুলল গলার আওয়াজ। কেউ কেউ তৎক্ষণাৎ সংযোগ কেটে দিল।কিছু কিছু মহিলাও ফোন করল দুপুরের দিকে ।তাদের মধ্যে যারা মধ্যবয়সী বলে সে অনুমান করতে পারল তাদের স্বরে কথার চেয়ে কান্নার প্রকোপ ছিল বেশি। কারো কারো অতিনাটকীয়তা তাকে বিরক্ত ও ক্লান্ত করল। যেসব মহিলার বয়স কম এবং যাদের কণ্ঠস্বরের মধ্যে এক মায়াবী জ্যোৎস্না ছিল , তাদের প্রতিটি কথা যেন তাকে অদ্ভুত ভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। সে মুগ্ধ ও সম্মোহিত হতে লাগল এই জাদুতে। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে সে ডাকল হোটেলের ঘরে। বলল- আসুন, মনে হচ্ছে এই আংটি আপনার হতে পারে। আপনি যথার্থ প্রমাণ দিয়ে তা সংগ্রহ করুন।
‘আংটিটি ঠিক কেমন আপনি বলুন ।’
খোলা ব্যালকনি। সমুদ্র থেকে বাতাস বয়ে আসছে মৃদু। সে একটা আরাম কেদারায় মেয়েটির মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করল। মেয়েটির মুখ থেকে উপচে পড়ে চিত্রিত হাসি।যার অন্য তাৎপর্য আছে, সে খুব কৌশলী জবাব দেয়- জানেন তো , পুরনো আংটি আমার মায়ের। মা মারা যাওয়ার শুধু ঐ স্মৃতিটুকুই আমার কাছে ছিল, আর কিছু নেই। নিমেষেই হাসিকে কান্নায় রূপান্তরিত করে দেয় মেয়েটি। এরকম বেশ কয়েকজন মেয়ে আজ সকাল থেকেই এসেছে। তাদের সবাই প্রায় সুশ্রী, আকর্ষণীয়, কেউ কেউ অসম্ভব সুন্দরী। তাদের পোশাক মনোরঞ্জক এবং চিত্তচাঞ্চল্যকর। এদের সবার উদ্দেশ্য ভুলিয়ে ফুসলিয়ে কোনরকমে দামি আংটিটি হাতিয়ে নেওয়া।কেউ কেউ এসেছে অন্য উদ্দেশ্য নিয়েও। আংটি পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই। অন্যকিছু দিয়ে আপাতত দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নেওয়া যাবে। কেউ সঠিক বিবরণ দিতে পারেনি। বরং প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গেছে চতুর ভাবে। কল্পনার ভেতর দিয়ে এক মনগড়া সত্যের ইমারত গড়েছে। তবে এর মধ্যে একজন তার আংটির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিল যা বাস্তবের সাথে মিলে যায়। রঙ, আকার, আকৃতি, সবকিছু ঠিক ঠিক বলেছিল। কম বয়স হলেও তার চেহারায় সেরকম জৌলুস ও আভিজাত্য ছিল না। শরীরে তেজ উদ্দীপক কোন আলোড়ন দেখতে পায়নি লোকটি। অকাট্য যুক্তি প্রমাণগুলিকে বিশ্বাস করতে গিয়েও সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল- ‘আপনাকে অহেতুক এত প্রশ্ন করার জন্য আমি দুঃখিত। আংটিটা ঠিক এরকম নয়। আপনি অনেকদূর থেকে এসেছেন, আমার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই।’
মেয়েটি বলল- না, না, তেমন কিছু নয়। আমি তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সমুদের দিক থেকে শান্ত এক আলো এসে পড়ছে তার গালের উপর। গম্ভীর হয়ে আছে সে। ঠিক তখনই একজনের ফোন এল তার কাছে। সুন্দর সুরেলা গলা। জলতরঙ্গ বেজে উঠছে প্রতিটি শব্দের কম্পনে। সুনিয়ন্ত্রিত স্বর। কোন অভিনেত্রী বা গায়িকার মতো। যা সহজেই মনকে আবেশে ভরিয়ে দেয়। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সে বলে চলেছে- দেখুন এ আংটি আমার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি তা আশাও করি না। তবু যদি লেগে যায়...
সে বলল- আসুন , সব কথা ফোনে হয় না।
মহিলার বয়স চল্লিশ বা তার আশেপাশে।অথচ চেহারায় যেন সে চির তরুণী। প্রকৃত নিখুঁত সুন্দরী বলে কোন শব্দ হয় না। তবু এই মহিলাকে তার কাছাকাছি ধরে নেওয়া যায়। চুলে অন্ধকার বিদিশার নিশা। কপালে সুন্দর একটি টিপ। চোখের উজ্জ্বল সবুজ দৃষ্টি মাদকতায় ভরিয়ে দেয় যেকোন পুরুষের মন। নরম মোমের মতো মসৃন ত্বক তা যেন আরও সুন্দর হয়ে নেমে এসেছে বুকের উপত্যকায়। সে যেন আংটি পরার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে এরকম ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিল তার আঙুল । লোকটি তার সপ্রতিভ আঙুলে দেখল স্বপ্নময় লাবণ্যের ছোঁয়া। মহিলাটি চোখের উপর চোখ রেখে বলতে শুরু করল- আসলে যে জিনিসের সাথে আত্মিক বন্ধন তাকে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। তাকে যথার্থভাবে দেখাতে গেলে বুক চিরে দেখাতে হয়। এটা প্লাটিনাম আর সোনার মেলবন্ধনে তৈরি।দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে করতে কখনও মনে হয়নি তাকে লোভীর মতো একদিনেই সব দেখে নিই। মনে হয়েছে সে তো আমারই আছে, সারাজীবন ধরে দেখলেই হবে একটু একটু করে। ফলে আমি এই মুহুর্তে সবকিছু বলতে পারব না। কিছু হীরকখণ্ড ছিল, অনেকগুলো পান্না আর চুনির রঙিন পাথর। লালমণি চুনী। সব পাথর যে অবিকৃত আছে এমন নয় ঝরে গেছে, পড়ে আছে। রঙও মলিন হতে পারে।
হোটেলের ড্রেসিং টেবিলের বাঁ দিকের ড্রয়ার খুলল লোকটা। একটা খাম বার করল নিঃশব্দে- দেখুন তো এই খামের মধ্যে যে আংটি আছে , সেটা আপনার কী না। মহিলার চোখে স্থির অবনত দৃষ্টি। সে দ্রুত আংটিটি তুলে নিল খাম থেকে। ডান হাতের মধ্যমায় পরতে গিয়ে সে দেখল ঢুকছে না কোনমতেই।জাদুকরের মতো হাত সাফাইয়ের ভঙ্গিতে লোকটির দিকে পিছু ঘুরে সে দ্রুত সংশোধন করে নিল প্রাথমিক ভুল। এখন তার অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে সেই আংটি।
লোকটি বলল- আজ রাতে আপনাকে আমার সাথেই খেতে হবে। একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না।
মহিলা অনামিকার দিকে তাকাল ,কী সুন্দর মানিয়েছে আংটিটি। তার মুখে ফুটে উঠল সম্মতির ইশারা। চাঁদ উঠছে। তার বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের জলে।
লোকটি বলল- আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, অনেকদিন পর এই আংটির যথার্থ মালকিনকে আজ খুঁজে পেলাম।
আংটির মালকিন
মূল রচনাঃ নাদিন গর্ডিমার
অনুবাদঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
( জন্ম ১৯২৩ সালের ২০ নভেম্বর তিনি দক্ষিন আফ্রিকার গোয়েটনে জন্মগ্রহণ করেন । বিশ্বের বর্ণবাদবিরোধী সরব যোদ্ধাদের মধ্যে তিনি অন্যতম । বর্ণবাদকেন্দ্রিক এবং পরবর্তী সময়ের সমস্যা এবং শঙ্কাগুলোই তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় ।লিখেছেন ছোটগল্প , উপন্যাস এবং প্রবন্ধ । প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্য তিরিশটিরও বেশি । তার মধ্যে পনেরটি উপন্যাস ।বার্গার্স ডটার , দ্য লেট বুর্জোয়া অয়ার্ল্ড , জুলাই’স পিপল এবং মাই সানস স্টোরি ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয় এবং সফল উপন্যাস । ১৯৭৪ সালে দ্য কনজারভেশনিস্ট উপন্যাসের জন্য তিনি বুকার পুরস্কার পান । ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ।নোবেল কমিটি তাঁকে একজন মহৎ মহাকাব্যিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন । বর্ণবাদী সরকারের হাতে বারবার নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁর বই । তবু আদর্শে অবিচল থেকেছেন তিনি। ২০১৩ সালে নব্বই বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।)
সব ফালতু। দুদিনের জন্য আসবে তারপর জীবন তছনছ করে দিয়ে চলে যাবে। এখন বোতল খুলে বিরহযাপন ছাড়া তার কোন কাজ নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে বুঝল তার কপালে আর যাই থাক বউ ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। এরপর সে একা একা থাকার কথাই ভাবল । এর চেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।
সে দেখল ঘরটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। দামি পেন্টিং, কাচের মূল্যবান সামগ্রী, সৌখিন জিনিস, ঘর সাজানোর নানা উপকরণ এমনকি সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা বিদেশী মদের যে বোতল ছিল যাওয়ার সময় তাও নিয়ে চলে গেছে তার স্ত্রী। শুধু অদরকারি ভেবে তাকেই পরিত্যাগ করেছে চিরকালের মতো । তাকে একা নয়, তার সাথে কিছু বইপত্তর রেখে গেছে। যে বইগুলো সে তার প্রথম স্ত্রীর সাথে ঘুরতে ঘুরতে বইয়ের বিভিন্ন দোকান থেকে নানা সময়ে কিনেছিল। সে দেখল প্রতিটি বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় তার প্রথম স্ত্রী ভালোবেসে তার নাম লিখে রেখেছিল। সে মায়া বাড়াল না। ঘরটাকে সাফসুতরো করার জন্য বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল।
এখন নারীসঙ্গ ছাড়াই কেটে যায় তার প্রতিটি দীর্ঘ রাত। অন্ধকার ছিঁড়ে ফালাফালা করতে করতে সে বুঝতে পারল এরা আসলে সবাই ভবঘুরে। প্রমোদবালিকার মতো তারা বেড়াতে এসেছিল, চলে গেছে। ভ্রমণের আনন্দ কি সে নিজে চায়নি? চেয়েছিল। চাইলেও সে সুদীর্ঘ যাত্রাপথে যথার্থ সহযাত্রী চেয়েছিল।
ঘরে তার মন বসছিল না। বাধ্য হয়ে সমুদ্রের ধারে একটি পরিচ্ছন্ন হোটেলে উঠল সে। যেখান থেকে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে সে দেখতে পায় ডোরাকাটা রঙিন দাগের পাথরের ওপর মহিলারা নোনা বিবর্ণ জাজিমে শুয়ে থাকে আনন্দে আর শরীরে সুগন্ধি তেলের প্রলেপ পড়ে । মাথার চুল সাজিয়ে রাখে কৃত্রিম ফুলের মালায়। জল থেকে যখন স্নান সেরে মহিলারা উঠে আসে, তখন চুল থেকে স্বচ্ছ জলের ফোঁটা নেমে আসে মসৃণ আভায়। তাদের আঢাকা শরীরে বিচ্ছুরিত আলোর প্রতিফলন চোখ জুড়িয়ে দেয়। একেবারে ছবির মতো হাতের তালু থেকে কানের লতি পর্যন্ত সামনে-পেছনে আলোর চমকানি। তাদের স্তন উন্মুক্ত। তলপেটের নিম্নাংশের ওপরে তারা অধোমুখ-ত্রিভুজাকৃতির উজ্জ্বল কাপড় পরে। যা চোখকে টেনে নিয়ে যায় দুই নিতম্বের মাঝখান দিয়ে টানা একটা সুতোর দিকে। লোকটির যতদূর দেখতে পায় – মহিলারা সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে বলে তাদের সম্পূর্ণ নগ্ন বলেই তার মনে হচ্ছে। সে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও জড়িয়ে যায় দৃশ্যের বাঁধনে।
খালি চোখে পুরুষশূন্য মনে হলেও সে দেখতে পেল দু একজন পুরুষও রয়েছে সেখানে। তবে সে এখন আর তাদের দেখতে পাচ্ছে না। চোখ বুজে সে সমুদ্রের ঘ্রাণ নারীর মেয়েলি আশ্চর্য গন্ধ – সুগন্ধি তেলের সৌরভে ভরে নিতে চাইল স্মৃতিকোষ। সফেন তরঙ্গগুচ্ছের মাঝখানে সে নিজেকে মেলে দিল। তারপর সাঁতার কেটে সে যেতে লাগল অগভীর দূরের দিকে যেখানে যুবতী মায়েরা তাদের শরীরের সাথে লেপটে নিয়েছে সন্তান। তাদের ভেজা শরীর থেকে এক মায়াবী গন্ধ ভেসে আসতে লাগল।এই তেজস্বী রূপের দিকে তাকিয়ে সে মোহিত হয়ে যেতে লাগল। জলের মধ্যে সে নিজেকে চঞ্চল্ভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগল। তারপর উঠে এল রৌদ্রকিরণে আচ্ছাদিত বালির উপর। সেখানে প্রাচীন ভাস্কর্যের মতো শুয়ে আছে নারীরা। সে তাদের পাশে গিয়ে একসময় শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে দেখল তার মাথার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সুন্দরী ফর্সা রমণীরা। তাদের পায়ের মসৃনতা জুড়ে রয়েছে এক নিরাভরণ প্রান্তর। ভিজে চুলের জল এসে পড়তে লাগল তার গায়ে।
এভাবে একা থাকতে থাকতে সে একসময় সাগরের বুকে পাথর ছুড়তে শুরু করল । জলে সেই পাথরের স্পর্শে আন্দোলনের ঢেউ উঠল কিছুক্ষণ তারপর মিলিয়ে গেল। বাচ্চাদের মতো এইভাবে খেলা করতে করতে একটা পাথরের দিকে তার চোখ চলে গেল। পাথরটার মধ্যে রয়েছে এক অদ্ভুত রহস্যের দাগ, লুকানো অভ্রর বিক্ষিপ্ত অংশে আলোর আশ্চর্য মায়া। এর কেন্দ্রে রয়েছে সমুদ্রের তৈলাক্ত মসৃণ হাতে গড়া কাচের মতো সমতলবিশিষ্ট হীরকের মতো বিষমকোণী চতুর্ভুজ।
পাথরের মতো হলেও তা আসলে যে সে পাথর নয়। গোলাকার স্বচ্ছ হলুদাভ রত্ন কাটার বাদামি পাথর, সেখানে রয়েছে নীল আর সবুজ কাচের বোতল, যা নীলাভ সবুজ মুক্তো আর পান্নার মতো দেখতে। ছোট বাচ্চারা সেগুলো ঝুড়িতে সংগ্রহ রাখছে । চারদিকের এতসব ঐশ্বর্যের সমারোহের ভেতর থেকে একদিন বিকেলে সৈকতে একটি সত্যিকারের আঙটি তার হাতে এসে ধরা পড়ল। রঙিন কাচের টুকরোর মধ্যে হীরের একটি নীলকান্তমণি আংটি।সে সহজেই বুঝতে পারল এটি কোন মহিলার মহিলা হাত থেকে খুলে রাখেনি। তাই যদি হত তাহলে তা নামানো থাকত কোন পাথরের উপর। এখানে যারা রোদের মধ্যে উপুড় হয়ে আছে তাদের কারোরই এমন অবস্থা নয় যে এত দামি আঙটিকে তাচ্ছিল্য করতে পারে। কোনো ধনীর দুলালি, বড়লোকের আয়েশি স্ত্রী সাঁতার প্রতিযোগিতায় বা নৌবিহারে ডুব দিতে গেয়ে ফ্যাশনের ছলে শরীরের অপ্রোজনীয় পোশাকের মতো খুলে রেখেছিল এই আংটি।তারপর ভুলে গেছে। অথবা অসতর্ক মুহূর্তে আংটিটি হাতের আঙুল থেকে পিছলে পড়ে গেছে। হয়তো তখনই টের পায়নি। বাড়ি ফিরে এসে বুঝতে পেরেছে ওটা হারিয়ে গেছে। আর পাওয়া যাবে না ।হয়তো বা ছুটে গেছে ইন্স্যুরেন্স নীতিতে কী আছে জানতে। এদিকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধীরে ধীরে আংটিটি মাটির ভেতর ডুবে যেতে যেতে এটি সত্যিকার অর্থে একটি সুন্দর আংটিতে পরিনত হয়েছে। আংটিটি যদিও প্রায় ছয় ইঞ্চি মাটির নিচ থেকে এলোপাতাড়ি আঙুলের খোঁচায় তুলে আনা হয়েছে। তবু সে এটার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন এখনই এর মালিক জেনে ফেলবে সমস্ত তথ্য। আর তাকে জেলে ভরে দেবে চুরির অপরাধে। তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। আনন্দে , ভয়ে, উদ্বেগে।
ওদিকে সেই মহিলাদের কেউ তাকে দেখছে কীনা সে লক্ষ্য করতে লাগল। দেখল কেউ কেউ তাকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে তাদের নগ্ন মোমের মতো শরীরে তেল মাখছে, বিন্দুমাত্র বিকার নেই তাদের। বরং তাদের আচরণে কোথাও যেন উপচীয়মান আনন্দেরই বহিঃপ্রকাশ আছে। আংটি হারালে যা স্বাভাবিক ছিল না। কেউ কেউ বাচ্চাদের শরীর মুছে দিচ্ছে মাতৃস্নেহের নরম লাবণ্যে । ছোট আয়নায় তাকিয়ে তাদের কেউ কেউ চোখের ভ্রু ঠিক করে নিচ্ছে। কেউ কেউ দেখে নিচ্ছে জলের সিক্ততায় কতখানি মাধুর্য উঠে এসেছে বুকে।
এই ভিড়ের মধ্যেই সে চুপিচুপি আংটিটা নিয়ে আসে হোটেলে। আর ভাবতে থাকে এটা কি ঠিক হচ্ছে? ন্যায়সম্মত হচ্ছে ? সে কেন চোরের মতো এরকম আচরণ করবে ? এটা পুলিশের হেফাজতে রাখলেই কি ভালো হত না ? সারিবদ্ধ প্রশ্ন তার মাথার ভেতর কিলবিল করতে লাগল। না, সে পুলিশের কাছে গেল না। একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিল; যার বয়ান ছিল এরকম- “ গতকাল দুপুরে নীল দিগন্তের সৈকতে একটি আংটি পাওয়া গেছে। উপযুক্ত প্রমাণ সহ যোগাযোগ করুন। নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেওয়া আছে নীচে। ” হোটেলের রুম নম্বর দিতেও সে ভুল করেনি। বিজ্ঞাপন প্রকাশের দিন থেকেই পরপর ফোন আসতে শুরু করল তার কাছে। ফোনে ফোনে সে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। সকালের দিকে কিছু পুরুষের ফোন এসেছিল। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম ছিল- ‘ আমার স্ত্রী আজ সৈকতে একটি হীরের আংটি হারিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে ওর এতই মনখারাপ যে কথা বলতে পারছে না।’
সে তখন বলল- কীরকম আংটি ?
পুরুষকণ্ঠগুলি থেকে একই ধ্বনি উচ্চারিত হল- হীরের দামি আংটি
সে বলল- আপনি বিশদে বলুন।
কেউ কেউ মিথ্যে বর্ণনায় ভরিয়ে তুলল গলার আওয়াজ। কেউ কেউ তৎক্ষণাৎ সংযোগ কেটে দিল।কিছু কিছু মহিলাও ফোন করল দুপুরের দিকে ।তাদের মধ্যে যারা মধ্যবয়সী বলে সে অনুমান করতে পারল তাদের স্বরে কথার চেয়ে কান্নার প্রকোপ ছিল বেশি। কারো কারো অতিনাটকীয়তা তাকে বিরক্ত ও ক্লান্ত করল। যেসব মহিলার বয়স কম এবং যাদের কণ্ঠস্বরের মধ্যে এক মায়াবী জ্যোৎস্না ছিল , তাদের প্রতিটি কথা যেন তাকে অদ্ভুত ভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। সে মুগ্ধ ও সম্মোহিত হতে লাগল এই জাদুতে। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে সে ডাকল হোটেলের ঘরে। বলল- আসুন, মনে হচ্ছে এই আংটি আপনার হতে পারে। আপনি যথার্থ প্রমাণ দিয়ে তা সংগ্রহ করুন।
‘আংটিটি ঠিক কেমন আপনি বলুন ।’
খোলা ব্যালকনি। সমুদ্র থেকে বাতাস বয়ে আসছে মৃদু। সে একটা আরাম কেদারায় মেয়েটির মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করল। মেয়েটির মুখ থেকে উপচে পড়ে চিত্রিত হাসি।যার অন্য তাৎপর্য আছে, সে খুব কৌশলী জবাব দেয়- জানেন তো , পুরনো আংটি আমার মায়ের। মা মারা যাওয়ার শুধু ঐ স্মৃতিটুকুই আমার কাছে ছিল, আর কিছু নেই। নিমেষেই হাসিকে কান্নায় রূপান্তরিত করে দেয় মেয়েটি। এরকম বেশ কয়েকজন মেয়ে আজ সকাল থেকেই এসেছে। তাদের সবাই প্রায় সুশ্রী, আকর্ষণীয়, কেউ কেউ অসম্ভব সুন্দরী। তাদের পোশাক মনোরঞ্জক এবং চিত্তচাঞ্চল্যকর। এদের সবার উদ্দেশ্য ভুলিয়ে ফুসলিয়ে কোনরকমে দামি আংটিটি হাতিয়ে নেওয়া।কেউ কেউ এসেছে অন্য উদ্দেশ্য নিয়েও। আংটি পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই। অন্যকিছু দিয়ে আপাতত দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নেওয়া যাবে। কেউ সঠিক বিবরণ দিতে পারেনি। বরং প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গেছে চতুর ভাবে। কল্পনার ভেতর দিয়ে এক মনগড়া সত্যের ইমারত গড়েছে। তবে এর মধ্যে একজন তার আংটির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিল যা বাস্তবের সাথে মিলে যায়। রঙ, আকার, আকৃতি, সবকিছু ঠিক ঠিক বলেছিল। কম বয়স হলেও তার চেহারায় সেরকম জৌলুস ও আভিজাত্য ছিল না। শরীরে তেজ উদ্দীপক কোন আলোড়ন দেখতে পায়নি লোকটি। অকাট্য যুক্তি প্রমাণগুলিকে বিশ্বাস করতে গিয়েও সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল- ‘আপনাকে অহেতুক এত প্রশ্ন করার জন্য আমি দুঃখিত। আংটিটা ঠিক এরকম নয়। আপনি অনেকদূর থেকে এসেছেন, আমার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই।’
মেয়েটি বলল- না, না, তেমন কিছু নয়। আমি তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সমুদের দিক থেকে শান্ত এক আলো এসে পড়ছে তার গালের উপর। গম্ভীর হয়ে আছে সে। ঠিক তখনই একজনের ফোন এল তার কাছে। সুন্দর সুরেলা গলা। জলতরঙ্গ বেজে উঠছে প্রতিটি শব্দের কম্পনে। সুনিয়ন্ত্রিত স্বর। কোন অভিনেত্রী বা গায়িকার মতো। যা সহজেই মনকে আবেশে ভরিয়ে দেয়। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সে বলে চলেছে- দেখুন এ আংটি আমার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি তা আশাও করি না। তবু যদি লেগে যায়...
সে বলল- আসুন , সব কথা ফোনে হয় না।
মহিলার বয়স চল্লিশ বা তার আশেপাশে।অথচ চেহারায় যেন সে চির তরুণী। প্রকৃত নিখুঁত সুন্দরী বলে কোন শব্দ হয় না। তবু এই মহিলাকে তার কাছাকাছি ধরে নেওয়া যায়। চুলে অন্ধকার বিদিশার নিশা। কপালে সুন্দর একটি টিপ। চোখের উজ্জ্বল সবুজ দৃষ্টি মাদকতায় ভরিয়ে দেয় যেকোন পুরুষের মন। নরম মোমের মতো মসৃন ত্বক তা যেন আরও সুন্দর হয়ে নেমে এসেছে বুকের উপত্যকায়। সে যেন আংটি পরার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে এরকম ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিল তার আঙুল । লোকটি তার সপ্রতিভ আঙুলে দেখল স্বপ্নময় লাবণ্যের ছোঁয়া। মহিলাটি চোখের উপর চোখ রেখে বলতে শুরু করল- আসলে যে জিনিসের সাথে আত্মিক বন্ধন তাকে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় না। তাকে যথার্থভাবে দেখাতে গেলে বুক চিরে দেখাতে হয়। এটা প্লাটিনাম আর সোনার মেলবন্ধনে তৈরি।দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে করতে কখনও মনে হয়নি তাকে লোভীর মতো একদিনেই সব দেখে নিই। মনে হয়েছে সে তো আমারই আছে, সারাজীবন ধরে দেখলেই হবে একটু একটু করে। ফলে আমি এই মুহুর্তে সবকিছু বলতে পারব না। কিছু হীরকখণ্ড ছিল, অনেকগুলো পান্না আর চুনির রঙিন পাথর। লালমণি চুনী। সব পাথর যে অবিকৃত আছে এমন নয় ঝরে গেছে, পড়ে আছে। রঙও মলিন হতে পারে।
হোটেলের ড্রেসিং টেবিলের বাঁ দিকের ড্রয়ার খুলল লোকটা। একটা খাম বার করল নিঃশব্দে- দেখুন তো এই খামের মধ্যে যে আংটি আছে , সেটা আপনার কী না। মহিলার চোখে স্থির অবনত দৃষ্টি। সে দ্রুত আংটিটি তুলে নিল খাম থেকে। ডান হাতের মধ্যমায় পরতে গিয়ে সে দেখল ঢুকছে না কোনমতেই।জাদুকরের মতো হাত সাফাইয়ের ভঙ্গিতে লোকটির দিকে পিছু ঘুরে সে দ্রুত সংশোধন করে নিল প্রাথমিক ভুল। এখন তার অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে সেই আংটি।
লোকটি বলল- আজ রাতে আপনাকে আমার সাথেই খেতে হবে। একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না।
মহিলা অনামিকার দিকে তাকাল ,কী সুন্দর মানিয়েছে আংটিটি। তার মুখে ফুটে উঠল সম্মতির ইশারা। চাঁদ উঠছে। তার বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের জলে।
লোকটি বলল- আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, অনেকদিন পর এই আংটির যথার্থ মালকিনকে আজ খুঁজে পেলাম।
No comments:
Post a Comment