Wednesday, June 6, 2018

অনিন্দ্যরায়


        নিমব্রহ্ম সরস্বতী ঃ নিতান্তকথা অনুবাদ




                 “ দ্যাখো, এইবেলা আমি নিম বিষয়ে ভাবছি । যদিচ, সকলি, 
    আলো ও শীত-তীব্রতা মিলিয়ে ছাত্রী পাঠ্য সন্দর্ভ কিছু হয়
কিনা নিয়ে তুমুল তোলপাড় হবো ভেবে চির স্ত্রীমুখ দেখে
সংযত, হেসে সুখে রোজকার মতো চুড়ান্ত প্রৌঢ় – চা খাচ্ছি
#
বেশ ।
#
হাল ধরে বহুক্ষণ, - ওরকম কত দিন যে গিয়েছে । গিয়েছে
বিকেল, শুকনো । রাত্রি গিয়েছে । টেনে হিঁচড়ে নিয়ে
যাওয়া ভুক্তাবশিষ্টের মাংস, খাঁড়ি, ভাঁজ ও মোহনাদর্শন
শেষে সাদা সত্য লাভ । - এসব ঘটেছে বহুতর ছলাৎছল
ঘাটের অর্চিষ্মান খাবি বেপথুমতি আপন্নের ঘাটে ।
#
তাই, এইবেলা আমি নিম বিষয়ে বিবিধ উপসর্গ অনুসর্গ
যোগে দেখছি সুখদ ব্রহ্ম, দেখছি সরস্বতৈ হ্রীং ক্লীং ।  “
                           ( নিমব্রহ্ম সরস্বতী )
 সরস্বতী, বাগদেবী, শীতমাস মাঘের শুক্লা পঞ্চমীতে বিদ্যালয়ে পূজিতা, বাঙ্‌নির্যাস, ব্রহ্মার কন্যা ও ভর্তিকা  । সরোযুক্ত, নদীবিশেষ । বুদ্ধশক্তি। স্ত্রী ।
 এবং নিম, এক দারু, তেঁতো, তার পাতার স্বাদ সুখদায়ক নয়, অসুখে পথ্য। যখন তার কাষ্ঠে বানানো দেবতার মূর্তি, দারুব্রহ্ম, জগন্নাথ, যে বিগ্রহের হাত নেই।
 নিম- যখন উপসর্গ, প্র্যয় অর্থে ( উদাহরণঃ নিম-রাজি), একটু যেন নঙ্‌ । নিম - যখন বসে ব্রহ্মের আগে,  নিমব্রহ্ম।
 ব্রহ্ম। স্বর্ণময় অণ্ড থেকে উৎপত্তি, এই অণ্ডের উর্ধকপালে স্বর্গ, অধঃকপালে পৃথিবী, মধ্যে আকাশের সৃষ্টি । অথবা উৎপত্তি বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে। ইনি পদ্মযোনির একতম, মরালবাহন । ইনি জ্ঞান, অভ্রান্তবাক্য। শব্দ । বীজমন্ত্র, হ্রীং ক্লীং । 
 সুখদ, সুখদায়ক, বিষ্ণুস্থান, স্বর্গবেশ্যা।  যোগে দেখায় ব্রহ্মকে।
 বেপথু,কম্পন ও রাগজন্য সাত্ত্বিকভাগ।আপন্ন, প্রাপ্ত বা লব্ধ ( উদাহরণঃ শরণাপন্ন, যখন শরণের পরে ব্যবহৃত হয়)
 নিমব্রহ্ম সরস্বতী, শব্দদুটি এইসব অনুষঙ্গ নিয়ে আসে কবিতাটি পড়তে পড়তে। কবিতাটিও এই সব সংকেত ও ইমেজখণ্ড আমাদের চেতনায় ছড়িয়ে দেয়, হ্যাঁ, ছড়িয়ে দেয়, স্ক্যাটার করে; কোনো একটি নির্দিষ্ট অবয়ব তৈরি করে না। টুকরো করে, কবি তাঁর ভাবনা ও ভাষ্য টুকরো টুকরো হয়ে, ‘দ্যাখো।  এইবেলা আমি নিম বিষয়ে ভাবছি’ এই শুরু করে ভাবনাকেই লিপিবদ্ধ করেন এবং সেই ভাষাকাঠমো কোনো লিনিয়ার স্টেটমেন্ট নয়, ন্যারাটিভ নয় যে কাহিনী হয়ে উঠবে, কার্যকারণের যুক্তিশৃঙ্খল থেকে মুক্ত এক প্রবাহ, যা চেতন থেকে অবচেতনের সীমানা ভেঙে দেয়।
পাঠককে স্টিমুলেট করে, প্ররোচিত করে অংশগ্রহনে।
কবি নিত্য মালাকার, তাঁর কবিতার বই ‘নিমব্রহ্ম সরস্বতী’,পূর্বোক্ত কবিতাটি এই বইতেই রয়েছে।
  শীতের সকালে, হয়তো মাঘী শুক্লা পঞ্চমীর সকালে, এক প্রৌঢ় চা খেতে খেতে সরস্বতী পুজোয় ব্যস্ত ছাত্রীদের দেখেন,  শরীর দেখেন, সংযত যদিও, কন্যাসমাদের শরীর ব্রহ্মা-সরস্বস্তীর পুরাণকথা মনে করায় তাঁকে, মনে  করায় স্মৃতি, ‘ওরকম কত দিন যে গিয়েছে’, এই সকালের বিপরীতে মনে পড়ে বিকেল, এবং রাত্রি ‘হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া ভুক্তাবশিষ্টের মাংস, খাঁড়ি, ভাঁজ ও মোহনাদর্শন’, আহার ও কাম, ‘এসব ঘটেছে বহুতর ছলাৎছল’ – এরকম এক দৃশ্যের আভাস দেয়। মুহূর্তে তা ভেঙে দেয়, অন্যতর দৃশ্যের জন্ম হতে থাকে।
 এইভাবে পাঠকের চেতনায় বিদ্যুচ্চমক, স্পার্ক ব্যপ্ত হয়।
 আমরা তাকেই বলি কবিতা।
 তো, কবিতা কী? 

কবিতা অবুঝ বুলি বনের পাখির
কবিতা অনন্যোপায় বিপদের হুইশিল
না-জানা না-বোঝার তুক, -
      কবিতা তোমার
সতত দূরত্বশীল পশ্চিমের লঘুচাঁদ
      কৃষ্ণা নবমীর
#
কবিতা উষ্ণ প্রসবণধারা কিশোরের নিশিস্বপ্ন
কিশোরীর মহাভয় রজোদর্শন
কবিতা নিরন্তর ক্ষুধা স্বয়ং স্রষ্টার
( কবিতা )
এই ক্ষুধাই তাঁকে আর্ত করে, লিখিয়ে নেয়। কবি ভুলতে পারেন না তাঁর যাপন, কবিজন্মের ডেস্টিনি, হ্যাঁ, ‘লিখে লিখে কালক্ষয়’,ক্ষয় সর্বতো গ্রাস করে তাঁকে, ঝরে পরে ; পতনের বিপরীতে অ্যান্টিডোট খোঁজেন, তাও তো লিখনেরই বৃত্তিতে। 

তুমি অন্তরায় হলে খুব ভালো হত
অথচ, এই যে স্ফুর্তি ক্ষোভপ্রকাশের দুঃখ –
      কলমে উপায় খুঁজছি
#
লিখে লিখে কালক্ষয়, - তোমাকে ভুলব কবে
#
জুগুপ্সার ধুসর বিকেল থেকে কী-যে সেই পাখি
প্রথমে চিবোয় মাথা, খুশি হলে চলে যায়
পরদিন আবার এসে পাঁজরার ভেতরে ঢুকে
গানের কলিটি খায়
অন্তরার লোভে আবার অন্যদিন এসে শিশ্নটিকে
পৌরুষের অবশিষ্টাংশ খায়
#
তবু, এরপরও আমার সমূহ থাকে, কেন
( তুমি অন্তরায় হলে )

 ‘তুমি’ কি কবিতা তাঁর কাছে, সর্বস্বগ্রাসী ঘাতক কবিতা, যে কবিকে, প্রকৃত কবিকে ভক্ষণ করে! প্রথমে চিবোয় মাথা’, তারপর  পাঁজরার ভেতরে গানের কলিট,আরও পরে এসে শিশ্নটি, পৌরুষের অবশিষ্টাংশ খায় ।
 আর কবি? কবিতার মুখোমুখি স্বয়ং ?


যে-কাঁটাটি রোজ পায়ের পাতার নিচে
অস্তিত্ব জানান দেয়, তার নাম আমি
#
যে কাঁটাটি রোজ ঝামেলা পয়দা করে
উদ্যোগ বা উদ্যমের পথে – তার নাম আমি
#
যে কাঁটাটি রোজ বেজায় আলসেমি করে
দুই পা এগোয় তো এক পা পেছোয়
এবং ফন্দি খোঁজে, বন্ধু-সোদর খোঁজে
বাঁশবাগানে বসে রাত্তিরে ভরসার ডাল খোঁজে
একবারই ঝুলে পড়বার জন্য – জনান্তিকে চুপ
শেষ কথাটি কী যেন ছি্ল – অগত্যার রূপ
#
আমি ...
( আমি )
 এই ‘তুমি’ ও ‘আমি’র ইন্টারঅ্যাকশন, কবিতা ও কবির নিয়ত ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া, দ্বন্দ্ব,  দ্যূতক্রীড়া ও প্রেম, পরস্পরকে জড়িয়ে নাছোড় বেঁচে থাকা, কারিকা ও কলমের ঘরে রক্তাক্ত সহবাস

রাতে রোজ ঘুমোনোর আগে কিছু স্মৃতিকথা থাকে যেন
রাতে রোজ ঘুমোনোর আগে যেন মস্তিষ্কলোকে
শব্দ, শব্দবন্ধ বা খোঁড়া বাক্যটিকে নিয়ে
শুই, শুতে পারি
যেহেতু বিশ্বাস-প্রত্যয় বলতে যা বোঝাইয় মনস্বী
প্রবন্ধগ্রন্থে প্রভূত-প্রবল
কারিকা ও কারয়িত্রীদের কলমের ঘরে-
#
আমার তো খোঁড়ার পা, অন্ধের যষ্ঠি সাথী
অংশত বোবা
ফলতঃ প্রার্থনা থাক পাপটুকু তেবিলের ড্রয়ারে থাক
পুণ্যটুকু বুকে
  (যাপন কথা ঃ ১ )
এই মিথস্ক্রিয়াই জন্ম দেয়, একটি কবিতার বই জন্ম নেয় এর পাপ থেকে, পুণ্য থেকে। এভাবেই কবিতা ও কবির মনন, বেঁচে থাকা, চারপাশের ঘটমান অথবা অঘটন একীভূত হয় । অগোছালো এবং নিয়ন্ত্রিত উচ্চারণ তাঁকে কোলাহলের ভেতর আলাদা স্বর হিসেবে প্রকাশিত করে । প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ, ভাবনা ও বাস্তব, মুখরতা ও নৈঃশব্দ যুগপৎ মিশে থাকে তাঁর উচ্চারণে । এই মিশে যাওয়াটাই আমাদের নিয়ে যায় এক চরাচরে যেখানে বলা ও না-বলার মধ্যে আশ্চর্য আলোছায়াময় আশ্চর্যে ।
নৈঃশব্দই চূড়ান্ত শব্দ বাক্য উৎসের অবিরাম পর্যটন কথা
একা একার সাথে পথে ও বিপথে
পরস্পর আমাদের ব্যবহার ও বিপরীত ভাষা সত্ত্বেও
সাহচর্যে, হাসিতে ও চোখের ভাষায় পড়ছি আমরা
এ-ওর ভূগোল ইতিহাস
পড়ছি নিতান্তকথা অনুবাদ কর্মশালায় গিয়ে
বিপ্রদের চন্দননগরে
এবং ফেলেছি গাড়ায় পা
অন্ধের সতত প্রশ্নকুশল যষ্টি যেখানে স্তব্ধমূর্তি
তাঁর পাদদেশে প্রণত আমাকে আজ এখানে এনেছে
                         ( অন্ধদোসর )
এ যেন পাঠকের উদ্দেশ্যে তাঁর কথা, “পরস্পর আমাদের ব্যবহার ও বিপরীত ভাষা সত্ত্বেও সাহচর্যে, হাসিতে ও চোখের ভাষায় পড়ছি আমরা এ-ওর ভূগোল ইতিহাস ।”
“নিতান্তকথা অনুবাদ”ই কবিতা লেখা, হ্যাঁ, তাই তো কবিতা, যা কবি ও পাঠককে দোসর বানায়, মুখোমুখি বসায়, দুজন অন্ধ একে অপরের চোখে পড়ে নেয়  জীবনের অর্থ অনর্থের প্যাটার্ন।
 একটি কবিতার বই, ছাব্বিশটি কবিতা। কবির পাঁচটি করিতার বইয়ের পর ‘কবিতা সংগ্রহ’, তার পরে এই বইটি,‘নিমব্রহ্ম সরস্বতী’। কবির সমগ্রকে চেনা যায় না একটি বই থেকে, তবু তাঁর কবিতার একটি দরজা হয়ত খুলে যায় । পাঠক প্রবেশ করেন কবির চেতনগৃহে ।  এই বইটি তেমনই এক নির্মিতি, এক আশ্রয় আমাদের কাছে। বাংলা কবিতার সামগ্রিকে স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল ।
 প্রকাশক ‘অহিরা’র পক্ষে তপন চৌধুরী । মলাট পার্থপ্রতিম দাস । প্রথম প্রকাশ রাসযাত্রা ১৪২২ । টাইটেল পেজসহ ৩২ পৃষ্টা । 
 পাঠক, ছাব্বিশটি চাঁদের আলো দু মলাটের মধ্যে রাখা আছে, আপনি উন্মোচন করুন, স্নান করুন সেই জ্যোৎস্নায় । 
……
ও হ্যাঁ, একটি তথ্য, কবির জন্মসাল ১৯৪৭, আমাদের দেশের স্বাধীনতা আর বাংলার দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বছর, এই দুই ঘটনার সমানবয়সী তিনি, নিত্য মালাকার, যে ফুল নিয়ত প্রস্ফুটিত তাদের গ্রন্থন করেছেন তিনি।

No comments:

Post a Comment