Wednesday, June 20, 2018

পার্থসারথি লাহিড়ির  চোখে কবিতা করিডোর এর আড্ডা :


৯ই মে,২০১৮ “কবিতা করিডোর” এর অনুষ্ঠান। এরকম অনেক সময় হয়, অনেক ক্ষেত্রেই হয়। বিশেষকরে ঘটনাটা বেশি বেশি ‘করে ঘটে মানুষের ক্ষেত্রে যেতে ইচ্ছে করে, সংস্পর্শ পেতে ইচ্ছে করে। আমার ক্ষেত্রে এটা হয়েছে অতনুর দৌলতে, ওর গল্পে। আমার কিন্তু এরকমও হয়, অকারণে হঠাৎ মনে হয় একে আমার পছন্দ হল না। যদিও এটা আমি প্রকাশ করিনা।
“কবিতা করিডোর” মানে তো শুভঙ্কর পাল, সব্যসাচী, সঞ্জীব, সুব্রত, রামকৃষ্ণ, গোপেশ ... অনেকদিন আগেই ঠিক করে ফেলেছিলাম অতনু সুবীর, মানিকদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে যাব। ভোর ৭ টায় গাড়ি ধরতে হবে জলপাইগুড়ি এন.বি.এস.টি সি-র ডিপো থেকে। না হলে গাড়িতে জায়গা পাওয়া যাবে না। সময় মতো উঠতে হবে বলে আগের দিন রাতে বারবার ঘুম ভেঙে গেছে, বারবার ঘড়ি দেখেছি কটা বাজে? টোটোতে যখন উঠলাম তখন ঝাঁচক্‌চকে রোদ্দুর, বেগুন্টারিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতেই দেখলাম কেমন যেন আলো কমে আসছে, আমি চশমার কাঁচকে সন্দেহ করে সেটাকে মুছতে মুছতে কি প্রচন্ড হাওয়া, টোটোটাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় আরকি আর মুহূর্তে আন্ধকার করে রাত নেমে এলো আবার। এভাবে অসময়ে দিনের দ্বিতীয় রাত্রিকে টেনে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে কেবল কালবৈশাখী কীভাবে আটকাই এই এলোপাথাড়ি আকাশ ধোয়া জল? ভিজতে ভাললাগে কিন্তু এই সময়? সেলফোন বেজে উঠল ইথারে অতনুর আওয়াজ “আমরা গাড়িতে উঠে গেছি তোরা কোথায়?” স্বপ্নে কখনও কখনও বিপন্ন বোধ হয়। ওর ফোন কলটাও সেরকম একটা বিপন্নতা ছেয়ে দিল। স্ট্যান্ডে পৌঁছে গিয়েও কোন গাড়ীটা বারোবিশা যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। সব খুইয়ে ফেলার একটা আশঙ্কা থেকে আমি ওর ফোনকলটার উত্তর করলাম “ কোন গাড়ীটা”? যথারীতি গাড়ী খুঁজে যখন গাড়িতে উঠলাম তখন আমি আর দুর্জয় ভিজে একশা আমার মনে হল বিপর্যয় আমাকে একটুও ভয় দেখাতে পারেনি যতখানি না বিপন্ন করেছে বাস মিস করার আশঙ্কা। গাড়ী ছাড়ল। আমার মনে হল গাড়ীটা বেশ গম্ভীর। গম্ভীর গলায় স্টার্ট নেবার কারন হিসেবে কন্ডাক্টরবাবু জানালেন এই বাসটা রকেট হিসেবে কোলকাতা যাতায়াত করত কিন্তু জলপাইগুড়ি ডিপো থেকে সেই রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সে এখন লোকালে চলে কিন্তু তার এক সময়ের আভিজাত্যটাকে ভুলতে পারেনি। সাথে সাথে আমার ছবি বিশ্বাসকে মনে পড়ে গেল, “জলসাঘর” আমাদের যাত্রাপথ আর কালবৈশাখীর যাত্রাপথ যে একই সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। প্রতিটা স্টপেজেই সে তার নিশান ছেড়ে গেছে। রাস্তার পাশে বারোবিশা ব্যবসায়ী সমিতি লেখা একটা হোটেলে ঢুকে দেখি বিদ্যুৎ নেই। আসার সময়েই দেখেছি বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে আছে। জানলাম সমস্ত বারোবিশা বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে। সারাদিনে কবে বিদ্যুৎ আসবে ঠিক নেই তবে এখন হোটেলে মজুত যে জল আছে তাতে আমাদের স্নান ও অন্যান্য প্রাতঃক্রিয়াদি সম্পন্নের জন্যে যথেষ্ট। ইতি মধ্যে সব্যসাচী, সঞ্জীব, সুব্রত, শুভঙ্করা এসে গেছে। আমি সঞ্জীব, রামকৃষ্ণ, গোপেশদের গায়ে গায়ে লেগে থাকলাম। আমার প্রথম বারোবিশা। আমি ওদের থেকে বারোবিশাকে চিনছিলাম। দ্বিধাবিভক্ত বিশাল চওড়া রাস্তার দুধারে গড়ে উঠেছে ব্যবসায়িক জনপদ। একদিকে ভুটান অন্যদিকে অসমরাজ্য। ওরা আমাকে এখানকার ম্যাপ চিনিয়ে দিচ্ছিল। বললাম নদী? সুন্দরী নদীর নাম সংকোশ।
এসেছিলেন দেবজ্যোতি-দা, পাপড়ি গুহ নিয়োগী, শৌভিক বনিক, গৌরব চক্রবর্তী, রেটিনা রশ্মি ও আরও চেনা অচেনা অনেকে। তাছাড়া আরও একজন এসেছিলেন একদম পঞ্চম, আর চারজনকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে। তার চশমাটা দেখে জয়জয়ন্তী সিনেমার অপর্ণা সেনকে মনে পড়ে গেছিল। নামটা ভুলে গেছি। এটা লিখতে গিয়েই সত্যমকে মনে পড়ে গেল। সারাক্ষণ গোপেসের সাথে ছিল বসে। ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই সত্যম হাত বাড়িয়ে দিল। আহা, করমর্দনের টাইম স্প্যানটা যে কা’র ভেতরে হিংসার জন্ম দিতে পারে। অস্বীকার করতে একটুও দ্বিধা নেই, বয়সের কথা ভেবে আমি নিজেকে সংযত করে নিলাম। “যেখানে রোদেরা নরম”,  সত্যমের কবিতার বই, “শুভেচ্ছা”-য় ওর নাম লিখে দিতে সত্যমের চোখ চকচক করছিল।
রাতে আড্ডা হওয়ার কথা। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে দেখি আলো নেই আর আসার সম্ভাবনাও নেই। জল দূরঅস্ত। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দুদিন তিনদিন লেগে যেতে পারে। ভাবলাম, আমার কোন অসুবিধা নেই। একদিন স্নান আর একরাত ঘুম না হলে আমার কিছু যায়-আসে না, তাছাড়া আসার সময় খোলা আকাশের নিচে হৈহৈ একপ্রস্ত স্নান আমার হয়ে গেছে। বলতে সাহস হল না – এক রাত তো ...  বললেই অতনু ঠিক বলে উঠত - তুই এখানে থাক আমরা অন্য যায়গায় যাচ্ছি। একা হয়ে যাওয়ার ভয় কে না পায়? তাই মুখের উপর মারফি রেডিওর তৎকালীন বিজ্ঞাপন টাঙিয়ে দিলাম – চুপ। বাড়ি বদলের উদ্দেশ্যে বার হয়ে পৌঁছে গেলাম “শান্তিবন বাংলো”। জানা গেল অপর্যাপ্ত জল আছে এখানে। জেনারেটর চলবে সারে বারোটা অবধি। আর কি, বাড়ি বদল সম্পন্ন করে বসে গেল সেই রাতের ঠেক রাতের গল্প, রাতের কবিতা। সঞ্জীব, শুভঙ্করের পরিচিত কেয়ারটেকারকে বলে কয়ে জেনারেটার চলল রাত ২টো অবধি, চলল গল্প, কবিতা পড়া আর তার আলোচনা সমালোচনা। তুলনামূলক আলোচনা, বাংলা ভাষার কবিতা, বিদেশী ভাষার কবিতা, বিদেশের কবিতা। গোপেস ছবির জগতের মানুষ সে তুলে আনল চার চারটি রিয়ালিজমের বিতর্ক, কবিতা আর ছবির মিলনের জায়গা। এক সময় চলে এলো কবিতার অবচেতন ও অবচেতনে যুক্তির অনুপ্রবেশ। দেখুন, যুক্তি বড় আপেক্ষিক আর এই আপেক্ষিকতা নিয়েই রাতদুপুরে শোরগোল। এই যুক্তির আপেক্ষিকতা “বাদ” নির্ভর। আবার এই বাদ, টু সাম এক্সটেন্ড আদর্শ। আদর্শবাদকে আমি এক প্রকারের মৌলবাদ বলি। সবাই সবার সাথে একমত ছিল না কিন্তু একমত ছিল কবিতা আর ছবি আঁকা আঁকিতে। অতনু, সত্যম, দুর্জয়, শুভঙ্কর, রামকৃষ্ণ, কবিতা পড়ল। আর গোপেস বলল ছবির কথা। মিলেমিশে ৯ই মে ২০১৮ রাত ছিল এক অনবদ্য ঋদ্ধ হওয়ার রাত. দেবজ্যোতি-দার থাকার কথা ছিল। আমরা তাকে খুব মিস করলাম।    

No comments:

Post a Comment