Tuesday, June 19, 2018


প্রদীপ চক্রবর্তীর গদ্য 
..................................
আত্মস্বর কিছুতেই চাপা থাকছে না ....
...................................................


সীমাভাঙনের খেলা 
.............................

এক/

" আমি স্পষ্ট দেখছি বর্ষা ফেলে আসা সেই সাপুড়ে ,
গলির কানাচে দাঁড়িয়ে 
কেউটের ঝাঁপি থেকে - মণির মতো একটা - দুটো ললিপপ  
আমাদের শৈশবের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে ..."
( স্ফি্কস ও অচেনা অর্কিডেরা / বিষবর্ষাদিনে / সুদীপ সান্যাল )

একটা প্রশস্ত লম্বা টানেল | অতীতের শিকড় বেয়ে যে চলে গেছে ,আলো অন্ধকারের কুয়াশা নিয়ে এক অস্পষ্ট গোধূলিয়া মোড়ে | বিমূর্ত ,অবয়বহীন সেই ফেলে আসা শৈশব , যার ফ্রেমগুলো আপাত পৃথিবীর প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সংগে কোনো মিল নেই ..., নেই তার কোনো প্রত্যক্ষ বাস্তব | শিল্পশহর দুর্গাপুরে যে কিশোর বেড়ে উঠেছিলো , দামোদর নদের আঁকাবাঁকা উত্তাল সর্পিল গতির সঙ্গে বন্ধ কারখানার পাঁচিলের চারদিকে বেড়েওঠা জংলা গাছের ঝোপঝাড় নিয়ে | 
সন্ধে বেলায় প্রাচী গাছের শিকড় বেয়ে যে গন্ধ ওঠে , ভোরে সেই গন্ধই বদলে যায় ...| সে চুপচাপ ,সে বারোমাস বিভিন্ন রোগে ভোগা | জানলার এ ' পাশে বসে সে দেখে , জানলার ওপারে চলমান সদর রাস্তা | কারখানার সাইরেন বাজে | দলবেঁধে কারখানার কর্মীরা যায় , সাইকেল নিয়ে | সাইকেলের মৃদু কলিং , একই মানুষ , একইভাবে ,একই সময়ে দুপুরের নির্দিষ্ট sipting ডিউটি সেরে আসে যায় | সে বসে বসে দেখে ,একই মানুষের মুখের পৃথিবী , বিভিন্ন সময়ে বদলে বদলে যায় কি ভাবে ...! সে দেখে একই গাছে বছরভর , পাতার কিনারে হাওয়া , আলস্য জনিত অভ্যাসে বদলে বদলে যায় পাতার কত রঙের রকম ফেরে | কত বৃষ্টিদিনে সাইকেলের টায়ার ঘুরিয়ে খেলতে খেলতে চলে যায় ,তার বয়সী কত কিশোর | ডেগ্গুল, গোবর লাঠি , গাবু খেলা , গোল্লা ছুট , রুমাল চুরি , হুসহুস , লুকোচুরি, ডাংগুলি, ক ত কত খেলা | কোএডুকেশন বেসিক প্রাইমারি স্কুলে সে পড়ে | যখন সে লুকোচুরি খেলার সঙ্গী হয় , তখন ছুটতে ছুটতে শ্যাওলা মাখা পুরোনো নোনা ধরা পাঁচিলের আড়ালে ,সে একদিন দেখে ফেলে কবিতা আর সুলেখার ঝুঁকে পড়া বুকে দু জনের দু রকম রঙের তিল | আলতো লাল ,আর চকলেট মিহি কালো | সে প্রথমবার ভাবতে ভাবতে শিউরে ওঠে ,রোমাঞ্চিত হয় | সে তখনো শরীর বোঝে না ....তবু এক দম চাপা রোমাঞ্চে এক অকথিত দুর্জ্ঞেয় পাহাড়ি বৃষ্টির ঝরে পড়া অনুভব করে কিশোর স্নায়ুর প্রথম ব্যথিত নিঃশ্বাসে ... ... সেই প্রথমবার কি ভাষা হীন কবিতা হয়ে উঠেছিল তার রুগ্ন শরীর ?...সেই প্রথম .....

" সে চাঁদের আলো আমি দেখি নি---
কেবল শেষ - বৃষ্টির সন্ধ্যায় , -- দেখেছি ,
এক ভেজা - জ্যোৎস্না
টেলিগ্রাফের তার বেয়ে অপসৃয়মাণ জলবিদ্যুৎরা  
কীভাবে একে অপরের পিছু নেয় |
তারপর মিলেমিশে একাকার হয়ে রাস্তার স্রোতে খসে পড়ে |

আজো পড়ে |
আজো..."  
( স্ফিঙ্কস ও অচেনা অর্কিডেরা / সেফটিফিন আর চপ্পলের গল্প / সুদীপ সান্যাল )

সেই প্রথম বেদনাহত , এক দৈব বৃক্ষযুবতী স্বপ্নে আসে | লতাপাতা মাখা , বাতাসের ঢেউ অর্থহীনতার নিরুদ্দেশে নিয়ে যায় কিশোরটিকে | জ্বর নামে মধ্যরাতে | পোড়া শরীর কুড়িয়ে ,পৃথিবীর স্বচ্ছ এক নদী ,রাত্রীর সরাইখানায় প্রাকৃতজনের মতো মুছিয়ে দেয় মা নামক সর্বস্ব ও পৃথিবীর কাছে বিষাদিত এক নারী | ছাই থেকে তুলে নেয় মাথা | স্বপ্ন ঘোরে প্রতিটি জলবিন্দুর রঙ যা তার জ্বোরো কপাল ছাপিয়ে নেমে আসছে বুকে পিঠে ঘামে , তার মধ্যে অদ্ভুত এক সুর আর ভালোলাগার আলো রশ্মি চুঁইয়ে পড়ে , গড়িয়ে যাওয়া জলের ঢালে মাছরাঙা পাখিটার ডুব - ঘাই , পৃথিবীর গর্ভতাপ বাড়ে , মায়ের চোখ থেকে কখন যেন ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে যাওয়া বর্ষা জনহীন অপার্থিব ঘরের মধ্যে , যতদূর চোখ যায় , ফিনফিনে রাতের জানলা পেরিয়ে যতদূর চোখ যায় , ভোর রাতে কমলালেবুর কোয়া ভেঙে আকাশে চলকে ওঠে একসময় ....| পরে কিশোরটি যখন বড়ো হয় ,পরিণত হবার চেষ্টা করে , বুঝতে পারে সেদিন সেই জ্বর , গহন - রতি তৃপ্ত হলে হয় | জন্ম নেয় শূন্য বোধ | স্থিতি শান্ত স্বাধীন সংসার বন্ধন মুক্ত নক্ষত্রপুঞ্জের বলয়ের মধ্যে , ঘরের চেয়েও বড়ো জানলাটা চারদিকে গ্রহ মেঘে ঢেকে যায় তার ...

এভাবেই ভূতগ্রস্ত এক আত্মক্ষয়কারী নেশা চেপে বসে কিশোরের মনে | অবুঝ এক অনুভূতি ,এক আগ্নেয় সুপ্ত মুখের কিছুটা উন্মেষিত হয় | তাকে অনন্য এক পাগল ,দিকদিশাহীন তৃতীয় পৃথিবীর সামনে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে সেই থেকে চলে যায় ....সে অপেক্ষা করে ....অপেক্ষাকরে .....অপেক্ষা করেই যায় ....অপেক্ষা তার ফুরায় না ..... তার গল্প অসংখ্য গল্পের কোলাজে ঢুকে তার ছোট বেলায় দেখা সেলিম বাবা 'র দূর দিক্চক্রবালভেদী , বায়োস্কোপের মতো রাসপ্রিন্টের বাতিল ফিল্ম গুলোর অংশ হয়ে ,সাদা কালোয় ছড়িয়ে পরে আকাশের আরো গহন আকাশে ....

*** " মাঠের নাম ধরে সবুজ চিরে যায় 
রুমালচোর খেলতে বসে ছেলেটা দু - দুবার কিল খেয়ে দেখে 
রুমালের ঘাম ঝরে গেছে বিকেল গড়িয়ে বান্ধবী ধুলোয় ..."
( রুমাল )

*** " গতির জড়তা নিয়ে একমুখী পাথর জানে 
চুরমার হওয়ার আগে আয়না শেষ প্রতিবিম্ব ফেরত দিয়ে যাবে ..." ( এন্ড অফ উইক- এন্ড )

*** " তার আচমকা গন্ধের মতো ন্যাপথলিন জীবন নিয়ে 
অবসন্ন মনে থাকো 
খোলা জানলা থেকে রঙ এসে 
ক্ষত আরও সবুজ করে দেয়
জলীয় সামুদ্রিক স্বাদ ঠোঁটে লেগে 
অবসন্ন মনে থাকো 
গাছ বলে ভুল করি না এখন  " 

                  ( তোমার ঘা - এর রঙ ঈষৎ সবুজ হলেও )
***( সুদীপ সান্যালের স্ফিঙ্কস ও অচেনা অর্কিডরা , নামক কবিতা বই থেকে )






No comments:

Post a Comment