Saturday, June 16, 2018

   কবিতার বারান্দায় ২৫শে বৈশাখের আড্ডা
                                                                
   সত্যম ভট্টাচার্য

কাজের দিনে জলশহরের ব্যস্ত কদমতলা মোড়।পকেটে রাখা মোবাইল রিং হচ্ছে।ও প্রান্তে শুভঙ্কর।২৫শে বৈশাখে বারোবিশায় অনুষ্ঠান হচ্ছে সারা দিনভর।সঙ্গে সঙ্গে শুধু দিন নয় রাতটাকেও যোগ করে নিলাম।২৫শে বৈশাখ দিনটা একান্তই বাঙালীর আর বাঙালী মানেই আড্ডা।আড্ডাই তার প্রাণ।তাই ফোনটা পাবার পর থেকেই কি কি হতে পারে সারা দিনে আর সাথে রাতেও তার একটা ছককষা মাথায় চলছিলই।শুধু বারে বারে মনে পড়ছিলো বছর এগারো বারো আগে বারোবিশায় শুভঙ্কর গোপেশ রামকৃষ্ণ ওদের সাথে কাটানো সময় একসাথে।দল বেঁধে কুমারগ্রাম দলদলি পেরিয়ে সঙ্কোশের হাটে,কালিখোলায় নদীর ধারে পাথরের ওপর কত গল্প-কত আড্ডা।মাঝে শুধু চলে গেলো কত কত দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর।তখন কত কি ছিলো না আমাদের।কিন্তু বুক ভরা প্রাণ ছিলো আর হা হা আড্ডা ছিলো।এখন এই এতটা সময়ের ব্যবধানে আবার কি মেতে উঠতে পারবো আমরা আগের মতো হৈ হৈ আনন্দে?সংশয়ে আবার ফোন করি শুভঙ্করকে।কে কে থাকছে রে?সব্বাই থাকছে।শুভঙ্করও উত্তেজিত।গোপেশ?হ্যাঁ।সুব্রত?হ্যাঁ।কতদিন দেখা হয় না।বলতেই মনে পড়ে গেলো আমরা সব একসাথে অটো করে জয়ন্তি-হাতিপোতা।ফিরে সন্ধ্যায় শামুকতলায় সুব্রতর বাড়িতে মাসিমা মেসোমশাই ভাত না খাইয়ে ছাড়বেন না।অতএব আমরাও চেটেপুটে।ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত।বাস ধরে সুব্রতর বাড়ি থেকে কামাখ্যাগুড়ি ।জেলাপরিষদের ঘরে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোর ভোর রসিকবিল।কামাখ্যাগুড়ি থেকে ভ্যানে।সকাল তখোনো চোখ মেলেনি ভালো করে।আবার কি ফিরে পাব সেরকম দিনগুলি?অল্পকিছু সময়ের জন্য হলেও।উত্তেজনায় অস্থির হয়ে পড়ি।
  শুভঙ্কর এখন নামকরা গৃহশিক্ষক বারোবিশার।কবিতাকরিডোর নামে একটি ওয়েব ম্যাগাজিন চালাচ্ছে কিছুদিন হোলো।দুই বাংলা ছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্তের বাঙালী লেখকদের জড়ো করে তাদের দিয়ে লিখিয়ে চলেছে।প্রশংসাও পাচ্ছে চারিদিকে।আর গোপেশ ভাস্কর-চিত্রশিল্পী।ওর ঠিকানা ভাটিবাড়ি বি এড কলেজ।সাথে নিজের কাজকম্ম।ওদের দুজনেরই যৌথ উদ্যোগে এই ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠান।কিন্তু আমি তো বর্তমানে থাকতে পারি না।শুধু ফিরে ফিরে যাই বছর বারো আগে বারোবিশা শান্তিবনে সেই কাটানো রাতে।পরদিন সকালে শুভঙ্করের বাড়িতে খেয়ে বারোবিশার রাস্তায়।সন্ধেতে কোন ফরেস্ট বাংলোয় চা।আহ অসাধারণ সুখস্মৃতি।চলে যাই down through the memory lane।আর এভাবেই দিনগুলি পেরিয়ে চলে আসে 9th May,২৫শে বৈশাখ।আগের রাতে অনেকটা সময় উত্তেজনায় ঘুম আসে না।
    কিন্তু সকালে উঠেই আকাশের মুখ ভার।কেমন হলদেটে আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে।একি ঝড়ের আভাস?তখোনো বুঝিনি যে এই অবস্থা হতে চলেছে।রাস্তা শুনশান।বাইক দাঁড় করিয়ে লিফট নিই।গাড়ি দাঁড়িয়েই আছে বারোবিশার।জায়গা রাখি চারজনের।এবারে সকালেই যেন রাতের আঁধার নেমে আসে।সাথে তুমুল ঝড়বৃষ্টি।কাকভেজা হয়ে সবাই শেষ মূহুর্তে বাসে।পথে দেখতে দেখতে ঝড়ের চিহ্ন।রাস্তা জুড়ে ভাঙা গাছের ডাল।ফোনে ফোনে খবর চরম দুর্যোগ চারিদিকে।ফালাকাটায় পৌঁছে গরম গরম চা আর পেরুতেই ঝলমলে রোদ, নীল আকাশ আর দূরে ভুটানের বরফ ঢাকা পাহাড়।একে একে পেরিয়ে যেতে থাকি শালবাড়ি,শিশুবাড়ি,শালকুমারহাট।চারিদিকে যেন সবুজের মেলা।সরু রাস্তা,কাঠের ব্রীজ পেরিয়ে অবশেষে আলিপুরদুয়ার।আর খানিকক্ষণেই বারোবিশা।নামতেই মন খারাপ হয়ে যায়।কোথায় সেই চারিদিকের সবুজ।ভারত সরকারের ফোর লেন রাস্তা সব শেষ করে দিয়েছে।কিন্তু সব ভুলে যাই শুভঙ্করের হাসিমুখের আতিথেয়তায়।চলে আসে সুব্রত।কতদিন পর।আহা সবাই তাহলে এক হতে পারছি।আর খানিকক্ষণেই মালবাজার থেকে সব্যসাচী,কোচবিহারের দেবজ্যোতিদা,দিনহাটার মানিক।বারোবিশা ব্যবসায়ী সমিতির ছোট্ট থাকার ঘরে তখন চাঁদের হাঁট।হিপ হিপ হুররে, চিয়ার্স।
  আর জলপাইগুড়ি থেকে অলীক অতনু,লাহিড়ী পার্থ আর দমদার দুর্জয়।এরা থাকা মানেই যে কোনো সময় যা কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।কিন্তু দেখা গেলো শেষ অব্দি নির্বিঘ্নেই আমরা সকলেই দল বেঁধে পৌঁছে গেলাম পুরাতন বনেদিয়ানায় ভরপুর বারোবিশা ব্যবসায়ী সমিতির ঘরে।সকালের প্রচন্ড ঝড়ে একদিকের বারান্দার চাল উড়ে গেলেও অনুষ্ঠান যথারীতি শুরু হোলো সব্যসাচীর সুন্দর সঞ্চালনায়।দেখা হয়ে গেলো গোপেশ,রামকৃষ্ণ সবার সাথে।টিফিন রেডি।ওদিকে সুন্দর সুন্দর ছোট্ট বাচ্চারা তাদের অনুষ্ঠান নিয়ে।কেউ নাচে,কেউ আবার গানে বা আবৃত্তিতে।মাঝে মাঝে কবিদের সম্মাননা প্রদান,বক্তব্য,কবিতা পাঠ।দুটোই ঠিকঠাক চললো কোন তাল না কেটেই।ওদিকে ঘর আলো করে কোচবিহারের পাপড়ি,আলিপুদুয়ারের গায়েত্রী।সময় এগুচ্ছে।দুপুরে সবাই হৈ হৈ করে বারোবিশা বাজারের হোটেলে শুভঙ্করদের আতিথেয়তায় খাওয়া দাওয়া।কেউ কেউ যদিও কয়েকজন মিলে দূরে দূরে তবু ঘরের অনুষ্ঠান চললো রমরমিয়ে।কবিতায় মনে দাগ রেখে গেলো নবাগতা শ্রদ্ধা।মাঝে মন খারাপ করে দিয়ে চলে গেলো সব্যসাচী,সুব্রত,মানিক।মনে প্রশ্ন রাতের আড্ডা হবে তো?
  কিন্তু দৈব।সকালের আস্তানা ঝড়ের তান্ডবের কারণে সন্ধ্যায় পালটে আমরা সবাই এক প্রশস্ত ঘরে ফের শান্তিবনেই।সকাল থেকেই আমাদের সাথে এবারের সংযোজন সঞ্জীব।একে একে সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে ঘরে শুভঙ্কর,গোপেশ আর রামকৃষ্ণ।লেখালেখি পরা আর নিজেদের চিন্তাভাবনা ভাগ করে নেওয়া।লেখালেখি চারিদিকে কি চলছে বা কোন পথে যাওয়া উচিত এইসব।রাত এগোয়।অসামান্য আতিথেয়তার শেষ পর্বে গোপেশের আয়োজনে আমরা রুটি ,তরকা আর মাংসে রত হই।ব্যতীত শুভঙ্কর।ফোনে ফোনে আড্ডায় চলে আসে কত কত দূরের বন্ধুরা।
    প্রায় মধ্যরাত।আমরা বসে আছি শান্তিবনের বাইরে।একে একে চলে যাচ্ছে শুভঙ্কর,সঞ্জীব,গোপেশ,রামকৃষ্ণ।আর আমি ভাবছি এবারেও তো হোলো।আবার কতদিনের ব্যবধানে এরকমের দিন আর রাত কাটবে।কবে আবার ঝরে পড়বে আমাদের উপর এরকম আড্ডা-হৈ হৈ আকাশের অনন্ত নক্ষত্রের মতো।

1 comment: