Saturday, July 25, 2020

প্রবন্ধ : সুজিত রেজের কলমে


প্রবন্ধের শিরোনাম  : কবিতা  মাঘরজনীর সবিতা
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -

 -

কবিতা একলা মানুষ ও একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরের একসুরে গাওয়া গান  :

             " অন্তর মাঝে বসি অহরহ
               মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ ,
               মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
                            মিশায়ে আপন সুরে।
               কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই ,
               তুমি যা বলাও আমি বলি তাই ,
               সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই ,
                           কোথা ভেসে যাই দূরে।
                         ( অন্তর্যামী : রবীন্দ্রনাথ )

কবিতা শিল্পের সংসারে একাকিত্বের শিল্পিত সংরাগ  :
          " সেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে
                নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল। 
      তাকে বলি : এই তো তোমারই
                ঠিকানালেখা চিঠি, ডাকে দেব, 
      তুমি মন পড়া জানো নাকি ?
                        এলে কোন ট্রেনে ? 
       আসলে এ নির্জনতা নয়। ফুটপাথে
                        কেনা শান্ত, নতুন চিরুনি। 
       দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ
                         কালো চুল লেগে আছে।" 
                        ( রাক্ষস : উৎপলকুমার বসু )

কবিতা সামাজিক স্খলন-বিচ্যুতির পরিণামী ক্রোধের তলদেশ থেকে উত্থিত আগুনের ফুলকি  :

       " যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে
                                           ভয় পায় 
                      আমি তাকে ঘৃণা করি 
         যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক
                                          হয়ে  আছে 
                      আমি তাকে ঘৃণা করি 
         যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি 
          প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ
                                               চায় না 
                        আমি তাকে ঘৃণা করি----- 
            ( এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না :
                               নবারুণ ভট্টাচার্য  )
                           
কবিতা সম্পর্কের উন্নতি-অবনতি-স্থিতাবস্থার সাপেক্ষে স্থিতধী অথবা অস্থির চিত্তঘোর :

          " ভালোবাসা সবই খায়-----
                          এঁটোপাতা, হেমন্তের খড় 
          রুগ্ন বাগানের কোণে পড়ে থাকা
                           লতার শিকড় 
          সবই খায়, খায় না আমাকে 
          এবং হা করে রোজ আমারই
                         সম্মুখে বসে থাকে । "
                         (   সব হবে  :
                            শক্তি চট্টোপাধ্যায় )
                   
কবিতা অধরা সৌন্দর্যের সন্নিধানে অহেতুক বিহারবিলাসী প্রবণতা  :
               
            " শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
              কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
              শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝঙ্কার
              আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
              শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।।  "
                    ( প্রেমের কবিতা : বুদ্ধদেব বসু )

কবিতা মেধা-মনন-হৃদয়ের ঘোর লাগা শব্দকুহক ও মায়াজালবদ্ধ ধ্বনিপুঞ্জে স্খলিত জ্যোৎস্না  :
     
   " কবিতা কী শুধু দণ্ড দুই কারিগরি কুশলতা
     চিত্র ও সঙ্গীতময় শব্দের মচ্ছব
     কেবল ছন্দের সম্মোহন আর অণৃত ভাষণ?"
                   ( হে কবিতা কোথায় ট্রিগার  :
                                 কবিরুল ইসলাম )

কবিতা অভূতপূর্ব , অনাস্বাদিত বিস্ময়-ব্যাপ্তির মনোরম একোক্তি  :
   
     দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের
                       অন্ধকারে হয়েছে হলুদ , 
     হিজলের জানালায় আলো আর
                      বুলবুলি করিয়াছে খেলা, 
     ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো
                       রোমে মাখিয়াছে খুদ, 
     চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা
                       রূপ হয়ে ঝরেছে দু'বেলা 
     নির্জন মাছের চোখে---- পুকুরের পাড়ে
                         হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে 
      পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ---- মেয়েলি হাতের
                         স্পর্শ লয়ে গেছে তারে ; 
       
 কবিতা রমণীয় , কমনীয় , রসময় রচনা  :

      " তোমার যোগ্য গান বিরচিব বলে
         বসেছি বিজনে, নব নীপবনে,
         পুষ্পিত তৃণদলে।
         শরতের সোনা গগনে গগনে ঝলকে ;
         ফুকারে পবন, কাশের লহরী ঝলকে ;
         শ্যামসন্ধ্যার পল্লবঘন অলকে
         চন্দ্রকলার চন্দনটীকা জ্বলে। "
                     ( নান্দীমুখ : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ) )


মহামুনি বাল্মীকির নিখাদ দুঃখবাদী উচ্চারণে কবিতার নিদ্রাভঙ্গ :

 মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
 যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমবীবধঃ কামমোহিতম্।।

তারপর কালিদাসের পূর্ব মেঘের উত্তর মেঘে সরণ---- অজয়ে এসেছে বন্যা জয়দেবের ভাঙা সংস্কৃত ছন্দের টানে ----বিদ্যাপতির ব্রজবুলিতে মিশে গেছে সেই তরঙ্গনাদ----চণ্ডীদাসের রামী মাথায় তুলে নিয়েছে রৌদ্রকরোজ্জ্বল ফুলিয়া-পুঁটুলি।


সৃষ্টির সোনার তরী ধীরে সমীরে যমুনা তীরে,ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি মেখেছে। সমান্তরালে সৃষ্টি ও স্রষ্টার অন্যোন্য সম্পর্ক নির্বাপনে , রহস্যময় সৃষ্টি ব্যাখ্যাত নয় জেনেও , নিরাসক্ত পরিচ্ছিন্ন তাত্ত্বিক-মনে জেগেছে অনন্ত-অন্তহীন কৌতূহল। কবে তার ইতি সকলেরই অজানা। তাই বোধহয় , অ্যারিস্টটল বলেছিলেন :" কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি , ইতিহাসের চেয়েও বড়।" সমসাময়িক ( আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী ) আচার্য ভরতও একই মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। এর কারণ , কাব্যচেতনা বিজ্ঞানের মতোই সর্ববাদীসম্মত। এমনকি , যেখানে বিজ্ঞান-দর্শনের শেষ , সেখান থেকেই কাব্যের বহতার সূত্রপাত। কবি তাই ঋষিতুল্য , মেধাবী , ক্রান্তদর্শী , মনীষী , প্রাজ্ঞ এবং   সর্বজ্ঞ । কবি মনুষ্যচরিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বোদ্ধা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্বুদ ঝঙ্কৃত সুর কবির কানেই অনুরণিত হয়। কবিকে বিশ্ববিধাতার চেয়েও অধিক শক্তিধর বলে মনে করেছেন অনেকেই। তাঁদের অভিমত, ঈশ্বর বিশ্ববিধানে নিয়মনিগড়িত , কিন্তু  কবি-কল্পতাঁদের অভিমত, ঈশ্বর বিশ্ববিধানে নিয়মনিগড়িত , কিন্তু  কবি-কল্পনার ভাবরাজ্য সর্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র। প্রতিভাগুণ কবির সহজাত ; যদিও বুৎপত্তি ও অভ্যাসের দ্বারা প্রতিভা অমিত শক্তি অর্জন করে। এই শক্তি তূরীয় , দিব্য , অতিলৌকিক , ঐশ্বরিক, অনিঃশেষ , ইহজন্মীয় ও জন্মান্তরীয়। কবির রচনা তাই হৃদ্য, সুন্দর , রমণীয় , বিচিত্র , মনোরম , অত্যাশ্চর্য ও অদ্ভুত।

যার ব্যাখ্যায় , খ্রিস্টপূর্ব আমলেই , প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্যে  সাহিত্যতত্ত্ব - নন্দনতত্ত্ব- সমালোচনাশাস্ত্র- সৌন্দর্যশাস্ত্র- কাব্যজিজ্ঞাসা- কাব্যমীমাংসার সূত্রপাত। নাট্যশাস্ত্র ( ভরত ), কাব্যাদর্শ ( দণ্ডী ), কাব্যালঙ্কার ( ভামহ ), কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তিঃ  ( বামন ),  দশরূপক,          ( ধনঞ্জয় ), ধ্বন্যালোক ( আনন্দবর্ধন ), কাব্যপ্রকাশ ( মণ্মট ), কাব্যালঙ্কার ( রুদ্রট ),
কাব্যালঙ্কার সারসংগ্রহ ( উদ্ভট ), অভিনবভারতী ( অভিনব গুপ্ত ), রসগঙ্গাধর ( জগন্নাথ ), বক্রোক্তিজীবিতম্ ( কুন্তক ), কাব্যমীমাংসা        ( রাজশেখর ), ঔচিত্যবিচারচর্চা  ( ক্ষেমেন্দ্র ), সাহিত্যদর্পণ ( বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ), দশরূপক       ( ধনঞ্জয় ), সরস্বতীকণ্ঠাভরণ ( ভোজরাজ ),   (  উজ্জ্বলনীলমণি ( শ্রীরূপ গোস্বামী ) প্রভৃতি গ্রন্থ প্রাচ্য আলঙ্কারিকদের উপাচার। প্রতীচ্যেও সমান্তরাল প্রবাহ   :   Poetics  ( অ্যারিস্টটল ), Ars Poetica ( হোরেস ), Sublime ( লংগিনাস ), An Apology for Poetry ( ফিলিপ সিডনি ), A Philosophical Enquiry into the Origins of the sublime and the  Beautiful ( এডমান্ড বার্ক ), An Essay on Criticism ( আলেকজান্ডার পোপ ), What is Poetry (জন স্টুয়ার্ট মিল ), Preface to the Lyrical Ballads , Poetry and Poetic Diction ( উইলিয়ম্ ওয়ার্ডসওয়ার্থ ),  A Defence of Poetry ( পি বি শেলি ), Biographia Literaria  ( সামুয়েল টেলর কোলরিজ ), The Four Ages of Poetry          ( টমাস্ লভ্ পিকক ), What  is Poetry ( জন স্টুয়ার্ট মিল ), The Poet ( রালফ্ ইমারসন ), The Poetic Principle    ( এডগার অ্যালান পো ), Poetry for Poetry's Sake , Oxford Lectures on Poetry ( ব্রাডলি ), The Study of Poetry ( ম্যাথু আর্নল্ড ), Practical Criticism (আই এ রিচার্ডস্ ),  The Idea of Great Poetry ( এবারক্রম্বি ), Poetry and Abstract Thought  (পল ভ্যালেরি ) The Hero as Poet ( কার্লাইল ) Principles of Criticism  ( ডাবলিউ বি ওয়ার্সফোর্ড ।


সপ্তম শতাব্দীর আলঙ্কারিক ভামহর কাছেই আমরা প্রথম কাব্যের সংজ্ঞা পাই  : " শব্দার্থ সহিতৌ কাব্যম্।" পরবর্তী সময়ে আচার্য রুদ্রট   ( " ননু শব্দার্থৌ কাব্যম্।" ), মণ্মট ( " তদদোর্থে সগুণাবনলঙ্কৃতৌ পুনঃ ক্কাপি।" ), বিদ্যাধর ( " শব্দার্থৌ বপুরস্য।" ), এমনকি কালিদাসের ( " বাগর্থৌ ইব সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপত্তয়ে।" )     ভাষ্যে ভামহরই প্রতিধ্বনি। তবুও ভামহর  ' সহিতৌ ' শব্দ নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকে। কাব্যের স্থানে ' সাহিত্য ' পরিভাষা প্রথম প্রয়োগ করেন আচার্য রাজশেখর  : " শব্দার্থয়ো র্যথাবৎ সহভাবেন বিদ্যা সাহিত্যবিদ্যা "। ভামহর ' সহিত ' শব্দের গুণবাচক বিশেষ্য রূপে ' সাহিত্য ' শব্দনির্মাণ। রাজশেখরের মতে , শব্দার্থের যে সম্পর্ক , তাই-ই সাহিত্য। শব্দ ও  অর্থের বাহুল্যশূন্য মিলনে গড়ে ওঠা অলৌকিক বিন্যাসভঙ্গিকে আচার্য কুন্তক সাহিত্য বলেছেন।বক্রোক্তিবাদী কুন্তকের স্পষ্ট অভিজ্ঞান :"বাচকো বাচ্যং চ ইতি দ্বৌ সম্মিলিতৌ কাব্যম্ "।
সহিতৌ ও সম্মিলিতৌ সমার্থক। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে  : " সহিত শব্দ হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি। অতএব ধাতুগত অর্থ ধরিলে সাহিত্য শব্দের মধ্যে একটি মিলনের ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। সে যে কেবল ভাবে-ভাবে, ভাষায়- ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন তা নহে ----- মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানের, দূরের সহিত নিকটের, অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগ-সাধন সাহিত্য ব্যতীত আর কিছুর দ্বারাই সম্ভবপর নহে " ( সাহিত্য )।

মনুষ্য হৃদয়ের  ভাবজাত বচনের  রচনই  হল কবিতা। শব্দার্থ হল ভাষা বা বচন। শব্দ স্মৃতি। শব্দ অভিজ্ঞতা। শব্দ গান। শব্দ বাইরের দরজা।।   কাব্যভাষার অর্থবোধক ও স্বাধীন একক মুক্ত রূপিমই হল শব্দ।  শব্দ থেকে শব্দাতীত জগৎ ছোঁয়ার দক্ষতাই হল কবির রচন। বচনের রেচনেই রচনের সিদ্ধি। বচনের রেচন- সংঘটনের উপরেই স্রষ্টার মূল্যায়ন হয়। সাহিত্যের ভাষা ' highly organized '। সাহিত্যের ভাষার লক্ষ্য ' expression '। পবিত্র সরকার লিখেছেন  : " এখানে ভাষা বক্তব্যকে অতিক্রম করে নিজেই সামনে এসে দাঁড়ায়।বলে ----- ' আমাকেও লক্ষ্য করো  , এখানে 'আমি ' অর্থের চেয়ে কম লক্ষণীয় নয়,কখনও কখনও অর্থের চেয়ে 'আমিই ' বেশি করে চোখে পড়তে চায়।" ( কবিতার ভাষা ) এই কারণেই সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে নিভাষা।

অষ্টম শতাব্দীর আলংকারিক আচার্য বামনের " কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলঙ্কারাৎ " মন্তব্য এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করে যে , সমগ্র কাব্যালোক- কূটমন্তব্যগুলিই অলঙ্কার-শাস্ত্র রূপে পরিচিতি পেয়ে যায়। অলঙ্কার-সংজ্ঞায় ষষ্ঠ শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডীর অভিমত  : " কাব্যশোভাকরান্ ধর্মান অলঙ্কারান্ প্রচক্ষতে।" অর্থাৎ , কাব্যের শোভাই অলঙ্কার। তাঁর মন্তব্যে সংস্কৃত ' অলম্ ' ধাতুর বাচ্যার্থ ' ভূষণ ' বিধৃত। বামনেও তা পুনরাবৃত্ত  : " সৌন্দর্যম্ অলঙ্কারঃ "যদিও অনেকেই অলঙ্কারের সংকীর্ণ অর্থ শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার মান্যতা দিয়ে বামনের অলঙ্কারবাদকে অতিব্যাপ্ত ও অব্যাপ্ত দোষে দুষ্ট বলে আক্রমনেও উৎসাহিত হলেন। অলঙ্কার থাকলেই বাক্য কাব্য হয়----- তা  যে অতিব্যাপ্ত বচন , সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কেননা নিরলঙ্কৃত বাক্যের সার্থক কাব্য হয়ে ওঠার পর্যাপ্ত উদাহরণ মেলে। আবার অলঙ্কৃত বাক্যের ব্যর্থ কাব্যে পর্যবসিত হওয়ার ঝুরি ঝুরি দৃষ্টান্তও আছে।

বামন তাই " কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ" গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানালেন :" রীতিরাত্মা কাব্যস্য"। এই প্রথম কাব্যের স্বরূপ আলোচনায় 'আত্মা' শব্দের সংযোগ ঘটল। ফলে দেহ ও দেহাতীত ধারায় কাব্যচেতনার উন্মেষও ঘটল। পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিকে বামন রীতি বলে চিহ্নিত করলেন। অলঙ্কারকে রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু বললেন।
বামন তাই " কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ" গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে জানালেন :" রীতিরাত্মা কাব্যস্য"। এই প্রথম কাব্যের স্বরূপ আলোচনায় 'আত্মা' শব্দের সংযোগ ঘটল। ফলে দেহ ও দেহাতীত ধারায় কাব্যচেতনার উন্মেষও ঘটল। পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গিকে বামন রীতি বলে চিহ্নিত করলেন। অলঙ্কারকে রীতির আনুষঙ্গিক বস্তু বললেন। অর্থাৎ , অলঙ্কার ব্যবহার বা বর্জন কবি- ব্যক্তিত্বের মর্জি। ফলত অলঙ্কার গৌণ হয়ে পড়ল। রীতির ইংরেজি পরিভাষা রূপে style শব্দ ব্যবহার হলেও দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। style ব্যক্তিত্ব-সম্পৃক্ত ; রীতি ভৌগোলিক অনুষঙ্গ জাত। বস্তুবাদীরা কাব্যের স্বরূপ নির্ণয়ে  অলঙ্কার ও রীতিবাদীদের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। তাঁদের মতে , " কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভর করে বস্তু বা ভাবের বিশিষ্টতার উপর।" বস্তু হল বক্তব্য, ভাব মনুষ্য-চিত্তবৃত্তি। গভীর বক্তব্য এবং মহৎ ভাবের উপাচারে কাব্যের শ্রেষ্টত্ব নির্ণীত হয়। বস্তুবাদীরা মনে করেছেন , মহাকবিদের সৃষ্টিতে বিষয়বস্তুর অতলান্তিক রূপ এবং মহৎ ভাবেরই স্ফুরণ ঘটে  অভিনব শব্দার্থ , অলঙ্কার , রচনাভঙ্গির চলাচলে। কিন্তু ধ্বনিবাদীরা সম্পূর্ণ বিপরীত পথে জোরের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন  :" শ্রেষ্ঠ কাব্যের প্রকৃতিই হল বাচ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। "

কাব্যের এই বাচ্যাতিরিক্ত ধর্মান্তরের অভিব্যঞ্জনার পারিভাষিক রূপ ধ্বনি।ধ্বনি- কারিকার প্রবক্তা অজ্ঞাত। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা          ' ধ্বন্যালোক '-এর বৃত্তিকার নবম শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য আনন্দবর্ধন। দশম-একাদশ শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য অভিনব গুপ্তের লোচন টীকায় যার সর্বভূতেষু রূপ প্রাপ্তি। ধ্বন্যালোক গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছদেই লেখা হয়েছে  : "  কাব্যাস্যাত্মা  ধ্বনিঃ "। শব্দার্থের মধ্য দিয়ে যে- কথাবস্তু প্রকাশ পায় , তা কাব্য হলে , অভিধান- নির্ভর কাব্যচর্চার জগৎ উন্মুক্ত হত। এই পথ অবারিত না হওয়ার কারণ , শ্রেষ্ট সৃষ্টি বাচ্যার্থ নির্ভর হয়েও বাচ্যাতিরিক্ত বিষয়ের ব্যঞ্জনা দান করে। রবীন্দ্রনাথের গান " ফাগুন লেগেছে বনে বনে " ছাপাখানায় ' আগুন ' হয়ে যাওয়ার কারণ ব্যঞ্জনাবোধের অভাব। আনন্দবর্ধন কাব্যব্যঞ্জনাকে রমণীদেহের লাবণ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন  :
            প্রতীয়মানং পুনরন্যদেব   
                   বস্ত্বস্তি বাণীষু মহাকবীনম্।
            যত্তৎ প্রসিদ্ধাবয়বাতিরিক্তং
                   বিভাতি লাবণ্যম্ ইবাঙ্গনাসু।।
শেলিও লিখেছেন  : " A great poem is a fountain for ever over-flowing with the waters of wisdom and delight ; and after one person and age has exhausted all its divine influence which their peculiar relations enable them to share , another succeeds , and new relations are ever developed , the source of an unforeseen
and unconceived delight. " ( A Defence of Poetry)

তবে যে-কোনো ব্যঞ্জনাই ধ্বনি নয়। ধাঁধা-হেঁয়ালির ব্যঞ্জনা যেমন ; একবার পর্দা সরে গেলে আগ্রহ হারায়। কৌতূহল সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়। কাব্যের ধ্বনির রেশ থেকে যায়। ঘণ্টাধ্বনির স্বননের মতো। " যে-বাঁশিতে বাতাস কাঁদে , সেই
বাঁশিটির সুরে সুরে " দূরে দূরে ভেসে বেড়ায়। ডিজে-নৃত্যে শরীর ক্লান্ত হয় , শাস্ত্রীয়-নৃত্যে দেহমনে অনির্বচনীয় স্ফূর্তির সঞ্চার ঘটে। শব্দ ও অর্থ ব্যঙ্গ্যতে প্রতিষ্ঠিত হলে ধ্বনি হয়ে ওঠে।
আনন্দবর্ধন ধ্বনির তিনটি সরল শ্রেণিবিভাগ করেছেন  : বস্তুধ্বনি , অলঙ্কারধ্বনি ও রসধ্বনি। বস্তু বা অলঙ্কারের ব্যঞ্জনায় বাচ্য কাব্য হয়ে ওঠে না। কাব্যের ধ্বনি রসধ্বনি। রসের ব্যঞ্জনায় বাক্য কাব্য হয়। রস ' সহৃদয়হৃদয়সংবাদী '। রস ও কাব্য অলৌকিক মায়াজগৎ গড়ে তোলে।  ভাবের রসমূর্তি দানে কবিকে লৌকিক পরিমিতত্ব অতিক্রম করতে হয়। কবির এই গুণকেই দার্শনিক ক্রোচে Poetic ldealization বলেছেন। Poetic ldealization জাত ভাব-বর্ণনা ( বিভাব-অনুভাব ) সহৃদয়ের বাসনালোকে  অলৌকিক রসমণ্ডিত হয়ে ওঠে।ওয়ার্ডসওয়ার্থ ' Lyrical Ballads '-এর মুখবন্ধে সেটাই লিখেছেন  : " Poetry takes its origin from emotion recollected in tranquility "তারও আগে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ( চতুর্দশ শতাব্দী) ' সাহিত্যদর্পণ ' গ্রন্থে জানিয়ে গেছেন  :
      বিভাবেনানুভাবেন ব্যক্তঃ সঞ্চারিণা তথা।
      রসতামেতি রত্যাদি স্থায়ী ভাবঃ সচেতসাম্।।


ভরতের " নাট্যশাস্ত্র " থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ত্রিশটির বেশি কাব্যতত্ত্বমূলক মৌলিক গ্রন্থ এবং একাধিক টীকা-টিপ্পনি জাত আলঙ্কারিকদের মূল ভাবনা  :

ক) গুণপ্রস্থান  : শব্দ ও অর্থের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ গুণমানের বৈচিত্র্যময় প্রকাশেই কাব্যের উৎকর্ষতা। কাব্যশোভার ধর্মবিশেষই হল গুণ।যেমন - শ্লেষ , প্রসাদ , সমতা ,সুকুমারতা , ওজঃ, কান্তি , মাধুর্য ,সমাধি প্রভৃতি।                       
 খ) অলংকারপ্রস্থান  : শব্দ ও অর্থের শিল্পিত মণ্ডনকলাই কাব্যসৌন্দর্যের আকর।প্রতিভা অনন্ত,অলঙ্কারও অনন্তপ্রকার।অলঙ্কাররসাদিরও  পুষ্টি ঘটায়।
গ) বক্রোক্তিপ্রস্থান  : কবির বাঙ্ময়ের প্রধান আকর্ষণ বক্র উক্তি অর্থাৎ উক্তিবৈচিত্র বা শব্দের শিল্পিত প্রয়োগসুলভ বাগবৈদগ্ধ্য।প্রারম্ভিক উপলব্ধিময় দৃষ্টির মৌলিক ঐক্য, প্রাণগত সমগ্রতা ও  সারূপ্যের ভিত্তিতে নির্মিত গুণ, অলঙ্কার , ধ্বনি সবই বক্রোক্তির অন্তর্ভুক্ত।
ঘ) ধ্বনিপ্রস্থান  : গুণ ,অলঙ্কার,বক্রোক্তি প্রভৃতি বিশিষ্ট  বাগব্যবহারলব্ধ  অর্থ যে সৌন্দর্য , চারুত্ব বা রমণীয়তা নামক মানসিক রসাস্বাদন ঘটায় , তাই ধ্বনি। শ্রেষ্ঠ কাব্যে কাব্যার্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সহৃদয় পাঠকের অনুভববেদ্য হয়।
ঙ) রসপ্রস্থান  : সহৃদয় চিত্তের আনন্দময় সম্বিৎ রস। কাব্যের বিভাব-অনুভাব এবং স্থায়ী- সঞ্চারী চিত্তবৃত্তির সংযোগে সহৃদয়ের বাসনালোকে রসের নিষ্পত্তি।
প্রতীচ্যের স্রষ্টা- কূটতার্কিকদের অনেকেই কাব্য- কবিতা নিয়ে নানান সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন। প্রাচ্যবাদীদের মতোই সেইসব কলাকৈবল্যবাদী ব্যক্তিক কূটভাষ কখনও কাব্যের শরীর অথবা আত্মাভিত্তিক। প্রসঙ্গত কতকগুলি স্মরণ করা যাক  :
 
মালার্মে  : কবিতা রচিত হয় শব্দে , আইডিয়ায়
                নয়।
ইয়েটস  : কবিতা হল---- রক্ত , কল্পনা আর                         বোধের যৌথযাত্রা।
কার্লাইল  : কবিতা হল মিউজিক্যাল থট।
জনসন  : কবিতা হল মেট্রিক্যাল কম্পোজিশান।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ  : কবিতা সব জ্ঞানের শ্বাসপ্রশ্বাস
               আর সূক্ষ্ম আত্মা।
কোলরিজ  : গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে
               সাজানো।আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট
               শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।
শেলি  : কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই
             সার্থক হয় যখন কবিমনের পরিতৃপ্তিতে
             পূর্ণতা আসে।
কিটস্  : কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম                             অপরিমেয়তায় , একটি মাত্র ঝংকারে
             নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই
             সর্বোত্তম চিন্তা। যা ক্রমশ ভেসে উঠছে
             তার স্মৃতিতে।
মেকল  : কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প ,
             যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে ,
             যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।
টি এস এলিয়ট : কবিতা রচনা হল বক্তব্যকে                   কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।

অর্থাৎ  কবিতার দুটি দিক---- অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ। অন্তরঙ্গে বিষয়ের বুদবুদ ; বহিরঙ্গে প্রকাশ- প্রসাধন। হাঁটা ও হাঁটার ভঙ্গি এক নয়। দুয়ের মধ্যে ঝুলবারান্দা আর রান্নাঘরের তফাৎ। একটায় রুচি অপরটিতে ভাঁড়ার উপচে পড়া জীবনফসল।  তুল্যবিচারে , বিষয় অপেক্ষা প্রকাশ মুখ্য। বহু দীর্ঘজীবী কবির জীবনফসল অপরিমেয় কিন্তু ঝুলবারান্দায় বসলে তাদের ঠাণ্ডা লাগে।  তাই কবিতায় অপ্রকৃতের কাছে হার মেনে প্রকৃত বারবার হার মানা হার গলায় পরিয়ে দেয়। যেমন , ভোরের বর্ণনায় দীনবন্ধু   লিখেছেন  :

" ভোর হল রে ফর্সা হল ফুটল কত ফুল।
কাঁপিয়ে পাখা নীল পতাকা জুটল অলিকুল"।।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  :
   " আলোর রং যে বাজল পাখির রবে "।

নজরুল লিখেছেন ;
 " ভোর হল দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে।
   ওই ডাকে জুঁই শাখে ফুল-খুকি ছোটো রে।।
   রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই।
   দারোয়ান গায় গান শোনো ওই রামা হৈ "।।

জীবনানন্দ লিখেছেন  :

 ভোর , 
 আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো                                                      কোমল নীল 
 চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ
                  টিয়ার পালকের মতো সবুজ। 
 একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে ; 
 পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে                                          গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো 
 কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে 
 যে-মুক্তা আমার নীল মদের
                             গেলাসে রেখেছিল। 

 চারটি বর্ণনার মধ্যে জীবনানন্দের কবিতাংশ সহৃদয়-চিত্তে উপভোগ-মাত্রা অনায়াস অতিক্রম করে।সত্যেন্দ্রনাথ,নজরুলের রচনা চিত্রকাব্যের অতিরিক্ত কিছু নয়। আলোর রং বেজে ওঠার মধ্যে যে ইন্দ্রিয়-বিপর্যয় , তা রবীন্দ্র-রচনের কলাকৈবল্য। কিন্তু জীবনানন্দীয় বচনের রেচন পাঠকের মদির কল্পনাশক্তির প্রত্যাশার ঘনিষ্টতা দাবি করে। চিত্র ও চিত্রকল্পের যোজন তফাৎ উপলব্ধ হয়।

যত ধুলো খাই , তত প্রেম পাই। যতদিন মানুষ ততদিন প্রেম , যতদিন প্রেম ততদিন মানুষ। প্রেমের কবিতা লিখতে লিখতে কখন তা পরমের ছোঁয়ায় বিনিসুতোর মালা হয়ে যায়।  চিরন্তন এই অনুভূতি প্রকাশে চণ্ডীদাস লিখেছেন  :
   " পিরিতি বলিয়া এ তিন আখর
                      এ তিন ভুবন সার
   এই মোর  মনে  হয়  রাতিদিনে
                      ইহা বই নাহি আর।"

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  :
   " অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে 
      আমরা দুজন ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের                                                         স্রোতে।"

জীবনানন্দ লিখেছেন :
" হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি
                                              পৃথিবীর পথে ,
  সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে
                                               মালয় সাগরে
  অনেক ঘুরেছি আমি , বিম্বিসার অশোকের
                                               ধূসর জগতে "

বিষয় একই , কিন্তু বচনের রেচন  ভিন্নমাত্রিক।
শব্দ - নৈঃশব্দ্য , চিত্র - চিত্রকল্প, রূপ-অরূপ, গ্রন্থিবন্ধন- গ্রন্থিমোচন, পূর্ণতা- শূন্যতা, মোহ- মোচড়, নিরাভরণ-আভরণ, আলো-আলেয়া সবই কবিব্যক্তিত্বের প্রজ্ঞা-মেধা-বোধ-বোধি-মন- মনন-আত্মরতি-আত্মক্ষয় সঞ্জাত নির্বাচন।
বাঙ্ময়ের নব নব বিনির্মাণ এবং সৌন্দর্যচেতনার মানস প্রতিভাসে তা এতটাই রহস্যপূর্ণ যে, যুক্তি- বুদ্ধি- বিচারের শাণিত সরণিতে সমীক্ষণ হা হতোস্মি  :
             
       কবিতার কোনও কোনও শব্দ নিরর্থক
       কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা
       শুধু নয় , সেই শব্দে অমোঘ টান অবিরত
       যেন অনন্ত ঈশ্বরের ডিজাইন।
                   
                          ( অনিকেত : লেখক )
   
   
   
   

No comments:

Post a Comment