Sunday, July 26, 2020

বুক রিভিউ :
এক নদী অভিমান / তন্ময় রায় 



যে উচ্চারণগুলো জীবনের কান ঘেঁসে বেরিয়ে যায় না, তার আশেপাশে বাস করে, যে উচ্চারণগুলো আমি বা আপনি করতে চাই কিন্তু পারি না, আসুন এই ‘স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবন’-এ ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের সঙ্গ নেওয়া যাক। প্রবীর চন্দ্র দাস-এর লেখা এই e-book-এর প্রতিটি কবিতাই শিরোনামহীন, পড়তে পড়তে মনে হয় আসলে একটিই কবিতা পড়ছি, সেই দিক থেকে দেখলে, এটি শুধুমাত্র ‘কবিতা সংকলন’-এর ধারণা টপকে কাব্যগ্রন্থের দিকে যাত্রা করেছে।

পৃষ্ঠা অনুযায়ী বিন্যাসে, কবিতা, পৃষ্ঠার বামদিকে, মাঝখানে এবং ডানদিকে অবস্থান করছে। যেন অনেকটা পাঠকের সাথে কবির, কবিতা আদানপ্রদান চলছে, কখনো পাঠকের কোর্টে বল কখনো নিজের কাছে রেখে খেলিয়ে নেওয়া আবার কখনো  সেই বল জীবনকে উৎসর্গ ক’রে এগিয়ে যাওয়া। বাম, ডান বা মাঝখান যে দিক দিয়েই যাওয়া হোক না কেন জীবনের উত্তাপ কবির প্রতিটি উচ্চারণকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। উৎসর্গপত্র থেকেই এর আঁচ পাওয়া যায়-
“যার ঘামে ভেজা পিঠটা আমার কাছে হিমালয়ের প্রথম সিঁড়ি এবং বন্ধু রাজীব”

সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চেতনা সঞ্জাত কবিতার যাত্রাপথে, আয়নায় নিজেকে উলঙ্গ করতে পারা এবং ঢিল মেরে সেই আয়নাকে টুকরো ক’রে, তাতে নিজের প্রতিটি বিম্বের ভিন্নতার তল্লাশি পাঠক হিসেবে আমাকে রসদ দেয়। সস্তার জীবনগুলোর হাজারো দ্বন্দ্ব কবির কলমে দিব্যতা পায়। আপনাকে ত্রিকালদর্শী বানিয়ে পরক্ষণেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া -
“আচ্ছা পুরুষ কখনো বাবা হতে পারে!
নাকি সব বাবারা পুরুষের মতো দেখতে
ধরুন আপনি ত্রিকালদর্শী নন,
আপনাকে না জানিয়ে
লিঙ্গ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে
এবার বলুন তো আপনি পুরুষ না বাবা।”

অক্ষর দিয়ে শব্দ বানিয়ে গড়ে তোলা গল্প নয়, “প্রতিটি অক্ষর আসলে এক একটা কাহিনী”। সেই কাহিনীর কিছু প্রসাদ-
“ভেতরে আগুন থাকলেই
অস্তিত্বের খাবার তৈরি করা যায় না”
বা
“নিজের শরীরের পোড়া গন্ধে
কতগুলো সংগঠিত মুখ নাকে রুমাল চেপে বিশ্লেষণ করবেন
এ আগুন গুহামানবের...”
বা
“হ্যাঁ আপনি ঠিকই ভাবছেন
আর পাঁচজন যেভাবে ফ্রিজের ঠাণ্ডা রুটি
হাত পুড়ে সেঁকে নেয়
আপনাকেও কয়লার ধোঁয়া পেরিয়ে সেঁকে নিতে হবে জীবন।”
‘আপনি’-কে আর পাঁচজন থেকে আলাদা ক’রে, জীবন সেঁকার মামলায় আবার সেই ‘আর পাঁচজন’-এ মিশিয়ে দেওয়াতে কবির মুচকি হাসি টের পাই।
“আপনি নিজের জন্য কিছুই করতে পারলেন না
যাবার সময় ভোটার তালিকায়
নামের বানান ভুল করে চলে গেলেন”
এই ‘আপনি’-র পরিচয়-মাহাত্ম্য-টাই ক্ষীর!

রোজকার জীবন থেকে কবি আয়ু রোজগার করেন, আয়ুতে প্যাঁচানো আগুন লুকোতে ব্যবহার করেন পাঁজর! আমার পাঠের পাঁজর লক্ষ্য করে কবির বল থুড়ি পঙক্তি ধেয়ে আসে -
“কতগুলো ছাপোষা যকৃৎ সহজ গণিত চাইছে” !!
আমার এতক্ষণ পাঠে তৈরি হওয়া ধারণা চুরমার হয়। নতুন দরজা খুলতে শুরু করে।
“আমি কুড়িয়ে পাওয়া একটি বুদ্ধিমান খুঁজছি”
বা
“নিজেকে প্রমাণ করতে গেলে
একটা আয়তক্ষেত্র যথেষ্ট নয়”
বা
“লোকটা শেষ অবধি মাটি খুঁড়ে পুঁতে রেখেছিল গল্পের পাহাড়”
খোঁজের প্রচেষ্টার সাথে অস্থিরতা দ্বারা সংক্রামিত হই। রসদের হৈ চৈ দ্বিতীয় প্রহরেও জেগে থাকে।
“একটা রাত হজম করতে গেলে
যতটুকু প্রয়োজন চিবিয়ে খেও”
এসবের মাঝে আমিও ভেতরে কোথাও রাতের আনাগোনা টের পাই, টের পাই গভীরতার মেঘে “বৃষ্টি হবে হবে এমন সময় / জারি হল ১৪৪ ধারা”। না, রাজনীতি নয় এবারও কবিকে চুমু খেয়ে গেল জীবন আর মাথা উঁচু করে জীবন বাঁচার চেষ্টা।
গল্পটা স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবন নিয়ে নাকি শুকিয়ে যাওয়া বুকের দুধ নিয়ে নাকি তাদের নিয়ে যারা ‘জ্যোৎস্নার মতো ঝকঝকে রাষ্ট্র’-এর কথা ভাবেন, তার খুলাসা করতে গিয়ে আমি মুখোমুখি হই সেই ব্যক্তিটির যে জেনে গেছে “কারোর কাছেই জটিল করে কিছু চাইতে নেই” আর যার জীবনের প্রতি আবেদন-
“তোমাকে সহ্য করে যে শব্দ
খালি মুখে বসে আছে
তুমি তার কাছে ফিরে এসো জীবন”।

আর মাত্র কয়েকটি কথা, কারণ কবি বলেছেন, “কথা দীর্ঘ হলে শব্দের কঙ্কাল বেরিয়ে আসে”; এই রকম প্রচুর উদ্ধৃতি দেওয়ার মতো লাইন এই বইতে আছে। স্বাভাবিক ছন্দেই তারা আসুক এটাই কাম্য; তবে তাদের কেউ কেউ ক্ষেত্রবিশেষে আরোপিত মনে হল। দর্শনের সাথে কবিতার বিরোধ কিছু নেই, কিন্তু কবি যদি কিঞ্চিৎ সচেতন হন, তাহলে লেখা আরও নির্ভার হয় এই আর কি…
প্রচ্ছদ নিয়ে আর একটু ভাবনাচিন্তা করা যেতে পারত। 


স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবন - প্রবীর চন্দ্র দাস
মিস্টার বুক পাব্লিকেশন ( mrbook.in)
মূল্য- ৩০ টাকা। 

1 comment: