Saturday, July 25, 2020

সুকান্ত দাস (সিনেমা  নিয়ে কথা )
জেমস বন্ডঃ একটি সংক্ষিপ্ত আত্মভ্রমণ



জেমস বন্ডকে যে সময় থেকে চিনি সেটা আমার পক্ষে কৈশোর। বাড়ির কেউ বাইরে ঘুরতে গেলে বিশেষ করে তামিলনাড়ু বা দিল্লী স্টেশন থেকে হরেক কিসিমের ইংরেজি ম্যাগাজিন কিনে আনতো। ৯০ এর দশকে বাঙ্গালীর এক বিশেষ অভ্যাস ছিল ট্রেন চলতে শুরু করলে নিদেনপক্ষে একটি হলেও বিলাতি ম্যাগাজিন কেনা চাইই চাই। সেরকমই কোন এক ম্যাগাজিনের পাতায় পুরোটা জুড়ে বিজ্ঞাপন ছিল এরকমঃ Pierce Brosnan in and as James Bond : Golden Eye.
কিশোর মনে গোল্ডেন আই মানে যে মহাকাশ সম্পর্কিত বিশেষ একটি প্রোগ্রাম হতে পারে তার কোন ধারণাই ছিলনা তবে নামটায় রোমাঞ্চ জেগেছিল। এভাবে একটা পরিচয়পর্ব হল। পরিচয় বাড়ল ২০০১ এ ডাই অ্যানাদার ডে এর বিজ্ঞাপন দেখে। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি যত রকমেরই নিউজপেপার হোক না কেন জেমস বন্ডের কোন ছবি বের হলেই পেপার কাটিং রেখে দিতাম। বড় হওয়ার সাথে সাথে খোঁজ পর্ব বেড়ে গেল। মনে প্রশ্ন জাগা বড় খারাপ অভ্যাস যা কিনা গভীর আত্মানুসন্ধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছিল।

শিরোনামায় ইয়ান ফ্লেমিং
প্রতিটি লেখকের মানস প্রতিমা তার আখ্যানকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। ইয়ান ফ্লেমিং এর ছিল নৌ বাহিনীর দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা। সমুদ্রের নীল জল, হাঙ্গর, টর্পেডো, সাবমেরিন নিয়ে এত ঘনঘন এবং তরতাজা দৃশ্যায়ন আর বুঝি কোথাও মোটা দাগে চিত্রিত হয়নি। অশেষ প্রেমের ধারক বাহক ছিলেন। চাকরি শেষে ১৯৫২ তে লিখতে বসলেন নভেল। যুদ্ধের বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে চাক্ষুস করেছেন সামনের থেকে। পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র নির্মাণ ও কাহিনির অবতারণা তাকে লেখক হিসেবে শিরোপা এনে দেয়। নিজের অভিজ্ঞতা তো ছিলই সাথে আশপাশের সহকর্মীদের কর্মপ্রণালীর সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। এক একজন এর চরিত্র থেকে বন্ড এর উপাদান সংগ্রহ করেছেন। যেমন জেমস বণ্ড নামটি নিয়েছিলেন এক আমেরিকান পক্ষিবিদকে অনুসরণ করে। জ্যাক টারনার স্টিফেন্স, সিডনি কটন, প্যাট্রিক ডালজেল, ভাই পীটার ফ্লেমিং প্রমুখ যুদ্ধ-বিশেষজ্ঞ ও ইন্টিলিজেন্স সার্ভিসের ব্যক্তিত্বদের বুদ্ধিমত্তা ও সাবলীল যুদ্ধ কৌশল সমাহিত হয়ে আছে এই একটি চরিত্রের মধ্যে। একারণেই বন্ড ধূর্ত। সে আত্মপ্রত্যয়ী। প্রাচুর্য প্রচুর। 
ফ্লেমিং প্রচুর সিগারেট খেতেন মদ্যপানেও পিছিয়ে ছিলেন না। আয়ু সাথ দেয়নি। ফেলুদার চারমিনার যেমন ছিল সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব চয়েস বন্ডেরও তেমনি ভদ্‌কা মারতিনি। শ্যেকেন নট স্ট্যরড্‌। বিবাহিত জীবন মধুচন্দ্রিমা পর্যন্ত গড়ায়নি। স্ত্রী হত্যা হয়ে গেছে। পুলিশ অফিসার সন্দেহ করছেন খারাপ কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। বণ্ড বলছে না কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছুটি না। বাস্তবের বিচ্ছেদ কি হয় নৌ বাহিনীর লেফটিন্যান্ট কমাণ্ডার ফ্লেমিং ভালোই জানতেন তাই কিচ্ছু হয়নি বলাতে পারাটা যেন এক অমোঘ স্বীকারোক্তি।

জেমস বন্ড ও ভারতবর্ষ
১৯৬২ তে ডঃ নো যখন মুক্তি পায় আমাদের দেশ তখন সাম্রাজ্যবাদের ধ্বজা গুড়িয়ে সবে গুছিয়ে বসতে শুরু করেছে। দু দুটো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা জওহরলাল নেহেরুর অধীনে হয়ে তৃতীয়বারে পা দিয়েছে। হিন্দি-চিনি ভাই ভাই এর মোহ ততদিনে শেষ। আকসাই চিনের দখল নিয়ে হয়ে গেছে রক্তক্ষয়ি সংগ্রাম (সমসাময়িক ঘটনা যেহেতু ৫ অক্টোবর ডঃ নো প্রকাশ পায়। সিনো-চায়না যুদ্ধ শুরু হয় ২০ অক্টোবর)। এদিকে ব্রিটিশ রাজের আনুগত্যপূর্বক এজেন্সি এম আই সিক্স এর ডাবল জিরো সেকশনের এজেন্ট পৃথিবীর এ প্রান্ত ও প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছে। শন কনারির আবির্ভাব স্বপ্নের নায়কের মতোই। টানটান চিত্রনাট্য, অসাধারণ এডিটিং, সময়ের সাথে এগিয়ে রাখা দৃশ্যায়ন এবং ক্যামেরার গুণমান ভাবতে বাধ্য করায়। বিশ্লেষণের জন্য অন্য পরিমাপক চাই। লকডাউনের সুবাদে ভারতীয় এপিকের মধ্যে এপিকতম ১৯৮৭ সালের টিভি সিরিয়াল রামায়ণ নতুন করে দেখা গেল। গ্রাফিক্স নিয়ে কেউ বালখিল্যতা করলেও আরামসে সমর্থনযোগ্য। আমরা যেভাবে এল ও সি বা পাকিস্তান নিয়ে যুদ্ধ দেখাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় প্রতিটি পশ্চিমী সিনেমার প্রাণভ্রমর। ফ্লেমিং এঁকেছেনও প্রাণ ঢেলে। একটা যুদ্ধ বা দুটি দেশের বিরোধ যে শুধু দেশগত নয় ব্যক্তির স্বার্থকে ঢাল করতে লেলিয়ে দেওয়া হয় হিংস্র কুকুর এটা তিনি দেখিয়েছেন বহুবার। যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি আরেকটি বড় অর্থনীতির ফাঁদ। এর জন্য যুদ্ধের জিগির তুলে ধর্মীয় প্রোপাগান্ডায় মেতে ওঠে কিছু শ্রেণীর নিম্ন রুচির মানুষ। দেশের সম্পদ নির্গমনের ড্রেইন থিয়োরি, পা চাটা অন্ধ ভৃত্যের অন্ধ অপত্য প্রেম, উচ্চাকাঙ্খার ব্রিটেন আবার নীতিশীলতার সভ্য দিক গুলো রাজকীয়তার সাথে তুলে ধরা –- সব উঠে এসেছে মোটা দাগে।
১৯৮৩ তে যখন অক্টোপুসি মুক্তি পায় ভারতবর্ষকে অনেকটা বড় জায়গা জুড়ে ধরা হয়েছিল (অনেকেই বলেন ইয়ান ফ্লেমিং ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে আসাকে ভুলতে পারেননি আবার আরেক যুক্তি বলে যেহেতু অক্টোপুসি তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশ পেয়েছিল তাই স্থান নির্বাচন পরিচালক এর মস্তিষ্ক প্রসূত)। তার কিছুদিন আগেই ইন্দিরা গান্ধির হাত ধরে রাজস্থানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে। রাজস্থানের শিব নিবাস প্যালেস থেকে পিচোলা লেকের অপরূপ সব সৌন্দর্যায়ন ক্যামেরাবন্দী হলেও পায়ে হাঁটা পথে নামতেই সামাজিক মেরুকরণের বাস্তব রূপ ধরা পড়ে। টাকা ছড়িয়ে দেবার যে দৃশ্যটি পরিচালক দেখিয়েছেন নোট বন্দীর সময় এরকমই কিছু ঘটনা আমাদের খবরে এসেছিল। আমরা যে আমাদের অবস্থান একদম বদলাইনি এই সিনেমা আমাদের ইতিহাসের পাঠ পুনরায় মনে করিয়ে দেয়।

চরিত্রগত দৃষ্টিভঙ্গি
যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফ্লেমিং বন্ডকে সাজিয়েছিলেন তাতে তিনি পরিষ্কার করে বলেই দেন যে নির্লিপ্ত ও রোমান্টিকতা বর্জিত একজন পুরুষ হিসেবে তাঁর মানসপুত্রকে দেখতে চান। তিনি চেয়েছিলেন তার মানস পুত্র যত তাড়াতাড়ি পারবে আত্মঅনুশোচনা থেকে বেড়িয়ে আসবে। আবার ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে অনুশোচনা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে পরিচালকদের চাহিদা অনুযায়ী বন্ডকে বদলাতে হয়েছে।
শন কনারি – খয়েরি চোখের স্কটিশ রক্তজাত প্রকৃত বন্ড। প্রেম অভিঘাত সব কিছু মিলিয়ে প্রকৃত অর্থেই এজেন্ট হয়ে ওঠা।
জর্জ ল্যাজেনবি - আরোপিত এবং বেমানান। যেহেতু তিনি ঠিক করেই ছিলেন তিনি একটির বেশী বন্ড চরিত্র করবেন না। সেদিক থেকে না করলেও পারতেন।
রজার ম্যুর – চুড়ান্ত পর্যায়ের রোমান্টিক। ক্ষিপ্রতা কম। তবে বেশ উপভোগ্য।
টিমোথি ডাল্টন – মজ্ঝিম পন্থার। দ্য লিভিং ডে লাইটস ছাড়া দাগ কাটেনা।
পিয়ার্স ব্রোসনান – রজার ম্যুরের উত্তরসূরি। প্রচণ্ড প্রেমিক তবে ক্ষিপ্রতা বুদ্ধিমত্তা মিলিয়ে দিনের শেষে বন্ড।
ড্যানিয়াল ক্রেইগ – এই বন্ড ৫০ বছরের ইতিহাসে পাওয়া অন্য ধাতুর। প্রচণ্ড মারকাটারি। রোমান্টিকতার লেশমাত্র নেই। চোখে ক্ষিধে লেগে আছে সর্বক্ষণ। উদ্দেশ্য ভিন্ন বিধেয় স্থান পায়নি এযাবৎ চারটি গল্পে।

বিকল্প খোঁজ ও পরিশিষ্ট
পথের অনুসন্ধানের জন্য পথের পরবর্তী খোঁজ ধরা পড়ে। প্রতিটি গন্তব্যের আলাদা বিকল্পও থাকে। হতাশা থেকে তুলে নিয়ে আসেন জেমস। মৃত্যুর প্রতিটি প্রাক মুহূর্ত বেঁচে ওঠার চেষ্টা জারি রাখা উচিৎ। এই সফলতার স্বাদ তাঁর আছে। দেশভক্তি তার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি। স্পেক্টারে সে দৃশ্য আরও একবার ধরা পড়ে। রাজতন্ত্রের নাম করে যুদ্ধ বাধায় যারা জেমসের অভিযান তাদের বিরুদ্ধে। নেপোলিয়নকে ব্যক্তিগত ভাবে ঘৃণা করতেন কিনা বোঝা যায়নি তবে ডঃ নো তে নেপোলিয়নের ইচ্ছা ভাবনাকে হেয় করতে ছাড়েননি। এ প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ কথাটি এসে যায় কিন্তু মনে রাখতে হবে বন্ড ইংল্যান্ডের রানীর অধীনে কাজ করেন তাঁর কাছে তার দেশের ঋণ আগে এ কথা বলাই বাহুল্য।
নারীসর্গ তিনি অকুন্ঠ চিত্তে গ্রহণ করেছেন। যেন একটি শিল্প। শত্রুপক্ষের সাথেও বিছানা শেয়ার করতে তার দ্বিধা বোধ নেই। এজেন্টের যা যা কাজ বন্ড ও তাই করেন। কিছু ক্ষেত্রে তিনি মানবিক। তবে সেটা পরিচালকের মর্জি মাফিক। বরং এম একজন মেয়ে হিসেবে বলেছিলেন - এভাবে স্বার্থের জন্য নারী চরিত্রকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দিলেই কি হয়না?

বন্ডের উচ্চতা যেখানে এত বিশাল সেখানে এই কয়েকটি শব্দবন্ধনীতে একটি লার্জার দ্যান লাইফ কে প্রকাশ করা কখনই সম্ভবপর নয়। তবে সময়-দেশকাল-রাজনীতি-আন্তর্জাতিক চাপানউতোর কিভাবে ইতিহাসের ধারণা ও বিবর্তন বহন করে নিয়ে চলছে তা এই পাঁচটি দশকের অন্যতম দলিল।

4 comments:

  1. জেমস বন্ডের সঙ্গে আমারও পরিচয় কিশোরকালে ম্যাগাজিনের সূত্রে।
    এখনও কিছু ম্যাগাজিন রয়ে গেছে যেগুলি খুললে মনটা কেমন করে উঠে। তোর এই লেখাটা আমায় সেই সময়ে নিয়ে গেলো। ভালো লিখেছিস।

    ReplyDelete
  2. Khub sombriddho lekha...bhalo lglo

    ReplyDelete
  3. অনেক কিছু জানলাম... ধন্যবাদ সুকান্ত লেখার জন্য এবং শুভঙ্করদাকেও, লিখিয়ে নেওয়ার জন্য।

    ReplyDelete