Saturday, July 25, 2020

ছোটগল্প : সুবিনয় দাসের কলমে 
                            আতঙ্ক 
                                    সুবিনয় দাস 
 সকাল থেকেই রমেন বাবুর মুড খানা অফ হয়ে আছে। গত রাতের ঘুমটাও ভালো করে হয় নি, তার উপর দিন দশেক হল বদ্ধ জীবন। শেয়ার বাজার যেভাবে হু হু করে নিচে নামছে, মিউচুয়াল ফান্ডে যেকয়টি টাকা ছিল তাও বুঝি আর বাঁচানো যাবে যাবে না। এরই মধ্যে গিন্নির গলা,
   ‘কি গো পান আর সুপরি যে আনতে বললাম, তা কখন আনবে শুনি?’
 মাথাটা আরও বিগরে গেল।
  ‘গত কালই না বাজার করলাম দুটো ব্যাগ ভরে, তখন বলতে পারলে না? যতো সব!’
 তবুও তিনি জানেন পান-সুপরি না এনে রক্ষে নেই, তাই বির বির করতে করতে টিনের বেরায় হেলান দেওয়া সাইকেলে চড়ে বাজারের উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে গেলেন। বাজারে গিয়ে সম্বিৎ ফিরল, মনে পড়লো মাস্কের কথা। মাথাটা এতটাই গরম হয়েছিল মাস্কের কথা তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। অন্যদিন বাজার করতে যাওয়ার সময় রমেন বাবুর সাজসজ্জা যোদ্ধা নাইটের থেকে কোন অংশে কম নয়। পায়ে জুতো, জামার ভিতর মোটা গোল গলা গেঞ্জি, নাকে প্রথমে রুমাল তার ওপর মাস্ক। কিন্তু আজ তিনি সমরসজ্জা ছাড়াই যুদ্ধক্ষেত্রে। বাজারে পৌঁছে তিনি একটু ভয়ই পাচ্ছিলেন, আর রাগে যে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয় তা তিনি হাড়ে  হাড়ে টের পেলেন। এখন আর বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই দ্রুত খরচ গুলো নিয়ে বাড়ি ফেরাই শ্রেয়। বাজারে এমনিতেই হাতে গোনা ছাড়া তেমন কেউ মাস্ক-ফাস্ক পরেন না। আর যারাওবা চাপে কয়েকজন পরেন তাঁরা গলার মেডেল বানিয়ে রাখেন। পান বিক্রেতা জিজ্ঞেস করল,
      ‘কি দেব কালি বাংলা না লোকাল পান?’
রমেন বাবু কালি বাংলা পানের দিকে নির্দেশ করে যেই একটু ঝুঁকলেন পাশে কে যেন সমগ্র আকাশ পাতাল এক করে এক মহা সশব্দে কর্ণবিদারি হাঁচি দিলেন। হাঁচির ড্রপলেট গুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়লো, রমেন বাবুর কপালে গালেও এসে পড়লো কয়েক বিন্দু ড্রপলেটের অংশ। আতঙ্কে, বিক্ষোভে পিছু ফিরতেই লোকটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
     ‘কি দাদা মাস্ক ব্যবহার করেন না! আমি অনেকক্ষণ থেকেই পরছি, তাই এখন একটু গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি, আর এই মুহূর্তেই এসে গেল। হি হি হি’
     -‘তাই বলে মানুষের গায়ে’
 এইটুকু বলেই চুপ হয়ে গেল রমেন বাবু। দোষটা তারই, সে আজ মাস্ক পরেনি। বাড়ি ফিরে আসে তিনি। এক গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত, ভয়ভিত, সন্ত্রস্তিত। লোকটি সুস্থ তো, আগে তো লোকটিকে কখনো দেখেনি, কোথায় বাড়ি ওঁর? নানা চিন্তা তাঁকে গ্রাস করতে থাকে। খাওয়া ও ঘুম দুইই তাঁকে ছেড়েছে।
    এই ঘটনার দিন দুয়েক পরের কথা। সন্ধ্যাবেলা রমেন বাবু ঘরে ল্যাপটপে কি কাজ করছিল, এই মুহূর্তে বিছানায় থাকা ফোনটি বেজে উঠে। ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল সঞ্জয়ের ফোন।
        ‘হ্যাঁরে বল, কেমন আছিস, অনেকদিন পর’
ওপার থেকে কাঁপা কণ্ঠে উত্তর আসে,
        -‘কেমন আছি, সেকথা ছাড়। আগে বল খবর শুনেছিস’।
        -‘কি খবর ? খুলে বল। গলা কাঁপছে কেন তোর’?
       -‘পাশের গ্রামে পজিটিভ ধরা পরেছে চার জনের, দিল্লী গিয়েছিল ট্রিটমেন্টের জন্য, সাবধানে থাকিস’।
  রমেন বাবুর মাথায় বুঝি বাজ পড়লো। তাঁর মনে হতে লাগলো জীবন হয়ত আর কয়েকদিনের অতিথি। এভাবে কেটে গেল আরও সাতদিন, ঘটনা ঘটার পর আজ নয় নম্বর দিন। দু বছরের ছেলেকেও সে জড়িয়ে ধরতে পারে না। স্ত্রীর কাছাকাছি ঘেঁষে না। আরও দিন পাঁচেক আছে। তাঁর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দিনগুলো নরক যন্ত্রণার থেকে কম মনে হতে লাগলো না। নিজেকে কখনো কখনো সে মৃতই ভাবে। কষ্ট হয় বাচ্চা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে, অজান্তেই চোখ জলে ভরে যায়। তবুও আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে একাকি, নিসঙ্গ প্রহর গনা ছাড়া আর উপায় কি তাঁর কাছে। 

No comments:

Post a Comment