Tuesday, August 3, 2021

 পাবলো নেরুদার কবিতা

অনুবাদঃ মানিক সাহা




পাবলো নেরুদা (১৯০৪ - ১৯৭৩) প্রকৃত নাম রিকার্ডো এলীসার নেফতালি রিয়েস বাসোয়ালতো। ১৯০৪ সালে দক্ষিণ চিলির এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আর মারা যান ১৯৭৩ সালে, মাত্র ৬৯ বছর বয়সে। তিনি জন্মেছিলেন যে নাম নিয়ে, তা ছিল বেশ দীর্ঘ—রিকার্দো এলিয়েসের নেফতালি রেইয়েস বাসোয়ালতো। নেরুদার বাবা চাইতেন না তাঁর পুত্র কবিতা লেখার মতো অলস ও অফলদায়ী কাজ করুক। তাই নিজেকে আড়াল করতে তিনি পাবলো নেরুদা ছদ্মনাম গ্রহন করেন। চেকোস্লাভাকিয়ার ১৯ শতকের প্রধান ও প্রভাবশালী কবি ও সাংবাদিক ইয়ান নেরুদাকে স্মরণ, সম্মান ও অনুসরণ করে তিনি সেই নামটি বেছে নিয়েছিলেন। 


১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজেতা একজন চিলিয় কবি, নেরুদা মাত্র তেরো বছর বয়েসে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন যখন তিনি বিভিন্ন ধরণের কবিতা লিখতে শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল পরাবাস্তববাদী কবিতা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য, প্রকাশ্য রাজনৈতিক ইশতেহার, গদ্য আত্মজীবনী এবং ভালোবাসার কবিতা।নেরুদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় যখন তাঁর বয়স মাত্র সতের বছর এবং খুব দ্রুত তাঁর কবিতার উন্নতি ঘটতে থাকে। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত Twenty Love Poems ang a Song of Despair শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভ করেন। তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি সবথেকে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে এখনো সমান বিক্রিত ও জনপ্রিয়কাব্যগ্রন্থ।



অনুদিত এই কবিতা 'Twenty Love Poems and a Song of Despair' থেকে নেওয়া হয়েছে।


*মধ্য গ্রীষ্মের সকাল*


মধ্য গ্রীষ্মের সকাল

ঝড় ঝঞ্ঝায় পরিপূর্ণ। 


বিদায়ের সাদা রুমালের মতো মেঘ ভাসে,

বাতাস তাদের হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে উড়ে যায়।


আমাদের প্রিয় নৈঃশব্দ্যের উপর

বাতাসের অগণন হৃদয় কম্পিত হয়।


যুদ্ধ এবং গানে পরিপূর্ণ ভাষার মতো

গাছপালার আনাচে-কানাচে উৎসব এবং ঐশ্বরিক স্পন্দন

প্রতিধ্বনিত হয়।


বাতাস মৃত পাতাগুলিকে দ্রুত আক্রমনে ছিন্ন করে

পাখীদের বিমোহিত তীরগুলির দিক বদলে দেয়।


বাতাস তাকে এক ঢেউয়ে ফেলে দেয় যাতে কোন ঝড়না নেই

এমন এক বস্তুতে ফেলে যা ভারহীন, তীর্যক অগ্নিশিখা।


তার অসংখ্য চুম্বনের ভার আছড়ে পড়ে, ডুবে যায়,

অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে গ্রীষ্ম-বাতাসের দরজায়।





 *তেমন করেই তোমাকে আমি ভাবি* 


গত শরতকালে তুমি যেমন ছিলে তেমন করেই তোমাকে আমি ভাবি।

তুমি ছিলে ধূসর আড়াল, আর তোমার হৃদয় ছিল অচঞ্চল।

তোমার দৃষ্টিতে ছিল গোধূলির অস্তরাগ 

আর তোমার হৃদয়ের জলে পাতা ঝড়ে পড়েছিল টুপটাপ করে।



লতানো গাছের মতো আমার দু'হাত আকড়ে ধরে

কণ্ঠে ছিল পাতার মর্মর - ধীর, শান্তিময়।



আমার তৃষ্ণা তখন পুড়ছিল বিস্ময় ও সভ্রমের মায়াবী আগুনে

আর আমার আত্মাকে জড়িয়ে নিয়েছিল কোমল নীল কচুরিপানা।


তোমার দৃষ্টির সঞ্চার আমি অনুভব করি, বুঝতে পারি শরতকাল এখনো সুদূরবর্তী: 

ধূসর অবগুণ্ঠন, কাকলি, পাখীর নীড়ের মত মন

যার দিকে আমার গভীর বাসনা গন্তব্য খুঁজে নেয়

আর আমার সুখী চুম্বনগুলি ঝড়ে পড়ে  তপ্ত অঙ্গারের মত।


জাহাজ থেকে দেখা আকাশ। পাহাড় থেকে দেখা খোলা প্রান্তর:

আলোয়, ধোঁয়ায় গড়া তোমার স্মৃতি যেন এক নিস্তরঙ্গ দিঘি!

তোমার দৃষ্টির সীমা অতিক্রম করে, দূরে আরো দূরে, গোধূলির অস্তরাগ।

আর তোমার হৃদয়ে পাক খেয়ে উড়ে যাচ্ছে শুকনো পাতার দল।





 *বিকেলগুলির পিঠে হেলান দিয়ে* 


বিকেলগুলির পিঠে হেলান দিয়ে তোমার সাগরনীল চোখের দিকে

প্রতিদিন আমার করুণ জালগুলি ছুড়ে দিই।


শেষ বিকেলের ছটায় আমার একাকীত্ব দীর্ঘতর ও তপ্ত হয়

তার হাতগুলি ডুবন্ত মানুষের হাতের মতো নড়তে থাকে।


তোমার অমনোযোগী চোখের দিকে আমি লাল সংকেত পাঠাই

বাতিঘরের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ানো সমুদ্রের মতো দুটি চোখ।


আমার সুদূরবর্তী নারী, তুমি কেবল অন্ধকার বিছিয়ে দাও,

মাঝে মাঝে সেই অন্ধকার থেকে আশঙ্কার দ্বীপ ভেসে ওঠে।


বিকেলগুলির পিঠে হেলান দিয়ে - যে সাগর তোমার সাগরনীল চোখে কেঁপে ওঠে -

তাতে আমার করুণ জাল ছুড়ে দিই।


তোমাকে ভালোবাসার সময় আমার হৃদয়ের মতো জ্বলে ওঠা

আকাশের প্রথম তারাটিকে রাতের পাখীরা এসে ঠুকরে খায়।


রাত তার ছায়াঘোটকীর পিঠে চড়ে 

স্থলভূমির উপর দিয়ে নীল জড়ির সুতো ছড়িয়ে দেয়।

No comments:

Post a Comment