জমিন
মূল রচনাঃ হিমাংশু যোশী
অনুবাদ- বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
গোঁসাই মা মারা
যাবার পর ছেলেটাকে দেখভাল করার মতো তেমন কেউ ছিল না। এক রত্তি ছেলে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকত আকাশের দিকে। নাকে শিকনি ঝরত, চোখে পিঁচুটি।এসব
মুছিয়ে কাজল পরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই।কোলে
নেওয়ার কেউ নেই।খিদে পেলে মহিলাদের দিকে চেয়ে থাকত অদ্ভুত চোখে।সে জানত সেখানে জমিন আছে। খিদে
তেষ্টা মেটায়। আশ্রয় দেয়।
বিনিয়ার ভালো লেগেছিল ছেলেটাকে। কোলে নিয়েছিল।“ আহারে! এই টুকুন
বাচ্চা।” বাচ্চাটা
জড়িয়ে ধরেছিল বিনিয়ার শাড়ি। কিছুতেই
ছাড়বে না। কোল থেকে নামালেই চিল চীৎকার। শেষ পর্যন্ত গোঁসাইজীকে
বলে ছেলেটাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল বিনিয়া – পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়েকে যদি পালতে পারি তো তোকে কেন পারব নি রে ব্যাটা।
সেই থেকে বিরজু বিনিয়ার ছেলে। বড় মায়া পড়ে গেছে।কিন্তু এত আদরেও ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেল।ছোটবেলা থেকেই
উদাস উদাস চোখ।আপনভোলা।তখন যে এমন হবে বিনিয়া জানত না। আর জানলেই কি ফেলে দিতে পারত সে ? হাজার
হোক মায়ের মন। লোকে বলে কোথা থেকে এই পাগল ছেলে
জুটালি বিনিয়া ? তোর তিন তিনটা জোয়ান ছেলে থাকতে এ
আপদ ঘরে আনার কি দরকার ছিল? বিনিয়ার
কখনও স্বপ্নেও এ কথা মনে হয় নি। তাই
ছেলের যখন মাথার গোলমাল দেখা দিল তখন সে ছাগলদুটো বিক্রি করে শহরের বড় ডাক্তারকে
দেখিয়েছিল প্রথমে। বিরজু এখন বদ্ধ উন্মাদ। অথচ ছেলেটার জন্য কত মানত করেছে বিনিয়া। গাঁও বুড়ার কাছে মুরগী মানত করা থেকে আরম্ভ করে শিবথানে দণ্ডি দেওয়া কি সে
করেনি। ডাক্তার বদ্যি তাবিজকবচ ঝাড়ফুক
কিছুতেই কিছু হল না। ছেলেটার কপালটাই ফাটা।
সবার ছেলেই সুয়াং খাটিয়ে রোজগার করে।এই গ্রাম
দেশে এটাই দস্তুর। বিরজু কিছুই করে না। সে দিন নেই রাত নেই কেবল ঘুরে বেড়ায়। মুখে সবসময় একটা তালপাতার বাঁশি থাকে। ফির ফির শব্দ করে আর বিরজু আপনমনে হাসে। রাস্তায় পড়ে থাকা পোড়া বিড়িগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে পকেটে রাখে , কখনও আবার নিজের মনেই সুখটান দেয়। শ্মশানে কোন গাছের উপর লটকে থাকা ছেঁড়া জামা পেড়ে বেঁধে নেয় নিজের শরীরে। নইলে শীত হোক বর্ষা হক উদোম গায়ে ঘুরে বেড়ায় একটা জ্যারজ্যরে এবং সম্পুর্ন
ময়লা গামছা পরে। রাস্তাঘাটে কাওকে দেখতে পেলেই বলে – চা খাওয়াবেন না বাবু, বিড়ি খাওয়াবেন না বাবু।
বিনিয়ার বয়স বাড়ে। শরীরে বাতের ব্যথায় সে সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। কোমর বেঁকে গেছে ধনুকের মতো।চুল পাকতে পাকতে পুরোপুরি সাদা। চোখে আজকাল কম দেখে। সন্ধ্যে
নামলে ঘর থেকে বেরুতে পারেনা। মুখে
অজস্র বলিরেখা। বিরজুর কোন হেলদোল নেই। তার বয়স বাড়ে না। পাগলামি বাড়তে থাকে শুধু।
এর মধ্যেই একদিন গাজনের মেলা বসল ফুলদোল
গাঁয়ের হাট তলায়। পরবের গন্ধ পেলে পিঁপড়ের মতো ছুটে
আসে মানুষ।আনন্দে ভাসতে থাকে চারপাশ। সেই
উপলক্ষ্যেই নানা রকম মেলা আর যাত্রাগান। কিষান
মহারাজের লীলাও দেখানো হচ্ছে টিকিট দিয়ে। বিরজুর
কাছে কোন পয়সা নেই টিকিট কেনার। সবাই
ঢুকছে দেখে তারও মনে হল সে লীলা দেখবে। জোর করে
ঢুকতে চাইলে ওকে বাধা দিল মেলার লোকজন।
কে একজন বলল- ও পাগল মানুষ আছে ভাই, পয়সা কুথায়
পাবে।
এতেও দয়া হল না কমিটির লোকগুলির , বলল- পাগল তো
এত সখ কেনে বাপু ?
বিরজু তবু নাছোড়। সে দেখবেই। শেষমেশ ওকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের
করে দিল আসর থেকে।
গ্যাসবাতির আলো জ্বলছে চারদিকে। ঝলমল করছে প্যান্ডেলের ভেতরে গানবাজনার আসর। বিরজুর ভালো লেগে গেল এইসব। সে কি
করবে তখন ? বাইরে বেরিয়ে এল এবং প্যান্ডেলের
ফুটো দিয়ে দেখতে লাগল ভিতরের জমজমাট কাণ্ডকারখানা। সারারাত না খেয়ে সে কিষান মহারাজের লীলা দেখল। সকালে বাড়ি ফিরবার পথে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজানোর ভঙ্গিমা করতে
লাগল। বটগাছের ঝুরি ধরে ঝুলতে ঝুলতে দোল
খেতে থাকল। আবার গোপিনীদের মতো বুক আড়াল করে
বিলাপ করতে শুরু করল। দুপুরে সে যখন বাড়ি ফিরল।বিনিয়া কেঁদে আকুল।চোখের জল
মুছতে মুছতে বলল- আমার হয়েছে যত জ্বালা। নে এখন চালসেদ্ধ বানিয়ে দিয়েছি। পিণ্ডি
খা, খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর।
চালসিজা। কিষান মহারাজকে তুই চালসিজা দিচ্ছিস মা। আমি ননী খাব, মাখন খাব।
আঃ। শখ কত। বাপ যেন চোদ্দটা গাই পুষেছে।
প্রচুর খিদে পেয়েছিল তাই চালসেদ্ধগুলোই মাখনের
মতো সুস্বাদু মনে হল বিরজুর। কিন্তু
এরপর তার পাগলামি বেড়ে গেল আরও। গোরু
দেখতে পেলেই সেগুলোকে পাঘা থেকে খুলে সে চরাতে নিয়ে যেত মাঠে।একটা বাঁশি থাকত হাতে। সবুজ মাঠের মধ্যে গোরুগুলো চরতে শুরু করলে সে বাঁশি বাজাতে বাজাতে কদম গাছে
দোল খেত।একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে
প্রতিবেশীদের গোয়াল ঘর থেকে সব গরুগুলো নিয়ে সে চলে গেল নদীর দিকে। সবাই ছিঃ ছিঃ করতে লাগল বিনিয়াকে। ছেলেকে
চুরি চামারির বিদ্যে শেখানো হচ্ছে লজ্জা করে না। এই তোমার পাগল ছেলে, এ যে
দেখছি সেয়ানের চেয়েও সেয়ান। বিনিয়া
কিছুই বলল না। চুপচাপ অপমান সয়ে কান্নাকাটি করতে
লাগল- আসুক বিরজু, আজ ওরই একদিন কি আমারই একদিন।
সন্ধ্যেলায় গরুগুলো নিয়ে বিরজু ফিরে এল। প্রতিবেশীরা দেখল- গরুগুলো আজ বেশ আনন্দে আছে।পেট
ভরে খেয়েছে নদীতীরের সবুজ যত ঘাস। বিরজু বলল- কিষনা মহারাজকে মাখন মিছরি
খাওয়াও।প্রতিবেশীদের একজন বলল- আমাদের তো গাই নেই, কেবল গরু। মাখন কোথায় পাব। তুই মিছরি খা। বিরজুকে
একখণ্ড মিছরির টুকরো ধরিয়ে দিল ওরা। সারাদিন
খিদেয় ক্লান্ত ছিল বিরজু। অমৃতের
মতো মনে হল মিছরিখন্ড। প্রতিবেশীরা বলল- আরও দেব , কাল আবার
আসিস।
এই রুটিনের অন্যথা হল না। দিনের পর দিন বিনা পয়সার রাখাল পেয়ে ওরা বর্তে গেল। রুগ্ন গোরুগুলি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠল এক মাসেই। নদীতীরে গরু চরাতে চরাতে একদিন অবাক কাণ্ড করে ফেলল বিরজু।মেয়েরা নদী পাড়ে জামাকাপড় রেখে নাইতে নামলে তাদের কাপড়গুলি চুরি করে গাছের
উঁচু ডালে টাঙ্গিয়ে দিল। ফল যা হবার তাই হল। সেদিন উত্তম মধ্যম জুটল কপালে। বিরজু
বলল- তোমরা মারছ যে, আমার দোষ কুথায় বল ?
তুই আমাদের কাপড় লুকিয়ে বেইজ্জতি করছিস, তাই।
সে তো কৃষ্ণও করেছে। তুমরা জানো না এ কে লীলাখেলা বলে ?
দাঁড়া তোর লীলাখেলা বার করছি। মেয়েরা তাকে বেধড়ক মারতে শুরু করে দিল।
কৃষ্ণলীলা কি এরকম হয় নাকি ? কৃষ্ণই সখিদের হাতে মার খায়। সে সাতপাঁচ কিছুই বুঝতে পারল না। তার মাথা
ঝিমঝিম করতে লাগল।
এর মধ্যেই খবর উড়তে লাগল আকাশে বাতাসে
হরিণপুরায় রামলীলা হবে। সাত আট দিন ধরে চলবে। রাস্তায় যেতে যেতে চৌধুরী চাচার সাথে দেখা হয়ে গেল বিরজুর। চৌধুরী চাচা খুব ভালোবাসে বিরজুকে। বিরজু
তাই সাহস করে বলল- চাচা, রামলীলায় আমি কিষাণ মহারাজ সাজব। তুমি বেবস্থা করে দিও
রামলীলায় কিষান মহারাজ কুথায় পাবি ? এই পালায় রাম আছে, লছমন আছে, রাবোন ভি আছে। তুই কি হবি বল?
বিরজুর এক জেদ সে কিষান মহারাজই হবে।যে মেয়েগুলো তাকে মারধোর করেছে তাদের দেখিয়ে দেবে সে সত্যিকারের কিষাণ
মহারাজ।
হরিণপুরায় রামলীলার আসরে গিয়ে অভিনয় দেখতে
দেখতে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ল যে দশরথের মৃত্যুতে সে সত্যিই কেঁদে ভাসিয়ে দিল।সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় রাবণকে প্রচুর গালাগাল দিল।রাজসিংহাসন , ঐশ্বর্য সম্পদ কিছুই তাকে
আকর্ষণ করতে পারল না। এসব বিষয়ে ভরতকে ভাল লাগলেও তার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র হয়ে গেল
হনুমান।তার মাথার ব্যামো আরও বেড়ে গেল।কাপড়ের একটা লেজ বানিয়ে সে বানর সেজে চারদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। লঙ্কা দহনের দিন তো উন্মাদের মতো ‘জয় শ্রীরাম’ ‘ জয় বজরং বলী’ হুঙ্কার দিয়ে মাতিয়ে তুলল। দু’চার জন ওকে আটকানোর চেষ্টা করল তাই নইলে হয়ত আগুন জ্বালিয়ে সবকিছু ছারখার করে দিত।
পরদিন থেকে বিরজু হনুমানের নেশায় এতটাই মাতাল হয়ে গেল যে কিষান মহারাজ, ময়ূর পালক গোরু চরানোর কথা তো ভুলে গেলই, এমনকি যে বাঁশিটি ছিল তার প্রাণপ্রিয় সেটাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরের জলে। মাঝে মাঝে নিজের লেজটা দেখে হাত বুলায় পরম আদরে আর নিজের মনেই চীৎকার করে – এবার রাবণ আসুক, ওকে আমি দেখে নেব। সীতাকে হরণ করার আগেই শালা রাবণের দশটা মাথা আমি পুড়িয়ে ছারখার করে দেব। জয় বজরং বলী, জয় বজরং বলী।
যে লোকটা রামলীলায় রাবণ সেজেছিল তার বাড়িতেই কাজ করত বিনিয়া। সেদিন ভাতের হাড়ি চড়ে নি। ওর বাড়ি থেকে দু’সের চাল নিয়ে আসতে হয়েছিল বিনিয়াকে। নইলে এতগুলো পেটের গাভা সে ভরাবে কীভাবে। বিরজু বাড়ি ফিরেই দেখে মা নেই। হনুমান সাজলেও পেটে খিদে তো আছে। সে জানে মা মানেই খিদের উপশম। কিছুক্ষণ পর বিনিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করল- এত দেরি ? কুথায় গেছিলি তুই?
বিনিয়া চুপ করে ছিল। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
বিরজু বলল- তুই ওদের বাড়ি কেন গেলি? ওর কাছে ভিখ চাইলি কেন ? এ চালের ভাত আমি খাব নি।
না পোষায় না খাবি। নিজে সুয়াং খাটিয়ে খা গে যা, কে বারণ করেছে তোকে।
পাগল হলেও কথাটা আঁতে লাগল বিরজুর। সে ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে গেল রাগে।কিছুদূর যাওয়ার পর সে ভগীরথ চাচাকে দেখতে পেল। ভগীরথ চাচা মানে যে হনুমান সেজেছিল রামলীলায়। তাকে পেন্নাম করে বলল- চাচা, তুমিই আমার গুরুদেব। আমাকে দিশা দেখিয়েছ।
তারপর গল্প করতে করতে তারা অনেকদূর হেঁটে এল। গাঁয়ের জমিদার এবং মুখিয়া সাহেবের বাড়ির কাছাকাছি এসে একটা হট্টগোল শুনতে পেল দুজনেই।কিছু একটা বিপর্যয় ঘটেছে বুঝতে পেরে ভয়ে কাঁপতে লাগল ভগীরথ চাচা। বিরজু বলল- আমরা হনুমানজী, আমাদের কি কাঁপলে চলে? চল ছামুতে এগিয়ে দেখি।
এগিয়ে আসতেই পুরো বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেল দুজনের কাছেই। একটি মাঝবয়সী বউ থর থর করে কাঁপছে।তার উপরের অংশ সম্পূর্ণ অনাবৃত।
কি হয়েছে কি ?
দেখেন বাবু, মুখিয়া সাহেব আমাকে চালচোর বলছে। আমি চাল চুরি করিনি তা কবুল করার পরও উনি আমার শাড়ি খুলে দেখতে চাইছেন কুথাও চাল লুকিয়ে রেখেছি কি না। আপনারাই বিচার করেন বাবু, গরীব বলে কি আমাদের মান ইজ্জত নেই ?
বিরজু আর নিজেকে সামলাতে পারল না ‘জয় বজরংবলী” বলে চেঁচিয়ে উঠল জোরে।
এই বিরজু থাম। ভগীরথ চাচা ধমক দিল।
সেই ধমককে কোন রকম পাত্তা না দিয়েই বিরজু বলল- আমি বিরজু নই, আমি হনুমানজী, তুমিও হনুমান আছো চাচা। দেখাও তোমার খেল। সীতার বেইজ্জতি হলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আমি এর ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব আজই তবেই আমার নাম হনুমান।
এই পাগলা চুপ কর। এটা রামলীলা নয়, তুই কার সাথে কথা বলছিস জানিস, ও আমাদের মুখিয়া আছে। ওর হাতেই থানা পুলিশ।
বিরজু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ভগীরথচাচার দিকে। এই লোকটা কদিন আগে লঙ্কা ছারখার করেছিল। আজ তার তেজ বিক্রম কিছুই নেই।
ই তুমি কি বলছ চাচা, রামলীলা কি তবে মিছা কথা ?
ওসব লিখতে হয় মানুষকে মাতানোর জন্য। জীবনের হিসাব নিকাশ আলাদা।
কাপড়ের লেজটা নিজের হাতে খুলে ফেলল বিরজু।জীবন আর লীলা যদি আলাদাই, তাহলে কি দরকার এমন উদমা আলকাপ সাজার।রাবণ মারার খেমতাই যদি না থাকে তবে মিছা গল্প আওড়ানোর ফুটানি কিসের? যত রাগ জমেছিল বুকের ভিতরে সব উগরে দিল বিরজু এক দলা থুতুতে – থুঃ।
সন্ধ্যের সময় বাড়ি এসে নিজের পুরানো দুর্গন্ধময় চাদরটা একটা থলিতে ভরল বিরজু। মায়ের দিকে তাকিয়ে তার জল আসছিল চোখে। এই তার সসাগরা দুনিয়া। এই তার কাছে সত্য। এর বাইরে যে পরিচিত দুনিয়া সেখানে বর্ণে বর্ণে মিথ্যার বসতি। টুক করে মাকে সে একটা প্রণাম করল এই প্রথম।মায়ের মন সন্দেহপ্রবন এবং শঙ্কাসন্ধানী। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বিনিয়া বলল- কুথায় চললি, বাপ ?
বিরজু উদাস গলায় বলল- যেখানে মিথ্যাবাদীরা থাকে সেই গাঁয়ে আর মিনিটও নয়, তুইও আমার সাথে চল মা।
বিনিয়া বলল- তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারবি ?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই বিরজু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অন্ধকারে।
এরপর আর অনেকদিন বিরজুর খোঁজখবর পাওয়া গেল না। ছেলের জন্য কান্নাকাটি করতে করতে একসময় চোখের জল শুকিয়ে এল বিনিয়ার। সময় নির্মম থাবা বসাতে শুরু করল তার শরীরে। এখন কোন রকমে একটা লাঠি ধরে আস্তে আস্তে চলাফেরা করে সে। দিনের বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে বসেই কেটে যায়। চোখে ঝাপসা অস্পষ্ট দৃষ্টি। তবু তার
মধ্যেই দরজায় কোন শব্দ হলেই সে কানখাড়া করে শোনে। কখনও কখনও নিজের মনের মধ্যে কথার বুদ্বুদ ওঠে – ফিরেছিস বিরজু? এতদিন না
খেয়ে কি দশা হয়েছে রে তোর ? আয় আজ নিজের হাতে তোকে রান্না করে খাওয়াই। কিন্তু কোথায় কি। বিরজুর
কোন চিহ্নই নেই। একা একা নিজের মনেই বিরজুর ছায়া
দেখে বিনিয়া।গাঁয়ের কেউ কেউ কখনও কখনও গুজব
রটায় – হরিণপুরার দিকে আজ বিরজুর মতন
একজনকে দেখলাম ভিক্ষা করছে রাস্তায় রাস্তায়। কেউ বা
বলে – ওকে জেলে নিয়ে গেছে পুলিশ , আমি নিজের চোখে দেখেছি।এদের মধ্যে অত্যধিক উৎসাহী দুএকজন লোক থাকে। তারা বলে – পরশু রেললাইনের ধারে অবিকল
বিরজুর মতন একটা লোক রেলে কাটা পড়েছে। ডানহাতের
জুড়ুলটা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম , এ আমাদের
বিরজু ছাড়া আর কেউ নয়।
এসব কথা বিনিয়ার কানে আসে। সে গাঁও বুড়ার থানে মানত করে – আমার বিরজুকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো ঠাকুর। আমি তোমাকে জোড়া পাঁঠা দেব।
এই সব খবরাখবরের মধ্যেই একদিন সন্ধ্যেবেলায়
দরজার কে যেন ডেকে উঠল – মা।
বিনিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল- কে ? বিরজু এসেছিস বাবা ?
দরজা খুলে দেখল এক হাড় জিরজিরে সাধু দাঁড়িয়ে আছে দুয়ারে। লাঠি হাতে। ছেঁড়া চাদর।মাথায় ধুলিধুসর চুল।গালে
রামছাগলের মতো দাড়ি। চোখের নীচে চমশার মতো ফুটে আছে
কালো দাগ।
বিনিয়া চেঁচিয়ে উঠল বিরজু, আয় ব্যাটা ঘরে আয়।
সাধুবাবা বলল- আমি বিরজু ফিরজু নই, আমার নাম
দাড়ি বাবা।আমি সবাইকে জমি দান করতে বলি, জমিন দাও যার যেমন সাধ্যি আছে জমিন দাও। মহারাজের হুকুম।
আমাদের জমিন কুথায় রে ব্যাটা। আমরা পরের খেতে মজুর খাটি। তবে আমাদের পেট চলে। আমরা
কুথায় জমিন পাব।
বিরজু অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তার গলা থেকে স্বর বের হচ্ছিল না।বিনিয়া
তাকিয়েছিল ছেলের দিকে – তোর এমন চেহারা হয়েছে কেনে
রে বাবা? আয় তোকে ভালোমন্দ রান্না করে
খাওয়াই।
বিরজু শোনে না। তাকে মাইলের পর মাইল যেতে হবে জমিন মাগতে।
শোনা যায় হরিণপুরার দিকে এক সাধু এসেছিল জমিন
ভিক্ষা করতে। তাকে ভালো লেগে যায় বিরজুর। সে চ্যালা বনে যায় সাধুর। তারপর
থেকেই সে দাড়িবাবা।
এরপর অনেকদিন কেটে যায়। কোথায় এক জোতদারের কাছে জমিন চাইতে গিয়ে লাঠির ঘায়ে আহত ও রক্তাক্ত হয়ে
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকে বিরজু।জোতদারের
লেঠেল বাহিনী তাকে মাথায় হাতে পায়ে সর্বত্র বেধড়ক মারে। রাস্তা থেকে তুলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয় কয়েকজন যুবক। তারপর খবর দেয় বিনিয়াকে।হাসপাতালের বেডে শুয়ে বিরজু তখনও বলে চলেছে – জমিন দাও।জমিন দাও।আমি দেশ থেকে দেশ ঘুরেছি। জমিন নেই
মানুষের হাতে।গরীব ভুখা মানুষকে জমিন দাও। ই আকাশ , ই বাতাস ই জমিন কারোর একার লয়। ই ভগবানের দান।ই সব পরমেশ্বরের। ই সব মহারাজের। জমিন তার হাতে দাও।বাবা
নিজের জন্য চাইছেন না। ভুখা মানুষের জন্য চাইছেন। আজ ভালয় ভালয় দিয়ে দাও, নইলে কাল লড়াই হবে।এই মাই , তুই কি দিবি দে? বাবা চলে যাচ্ছে।
বিরজুর গলার আওয়াজ ক্রমেই ক্ষীন হতে হতে
মিলিয়ে যাচ্ছিল। বিনিয়া বলল- লড়াই কেন হবে রে ব্যাটা ? আমার কাঁথা বিছানা, চাদর ধোতি, ছেঁড়া খাট যা আছে সব সব
তোকেই দিলাম।
বিরজু আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না, সে তখন মালিকানাহীনএক অনন্ত ঐশ্বর্যের দেশে পা রেখেছে। যেখানে জমিন অবাধ , আলহীন
এবং কারও কুক্ষিগত নয়।
লেখক পরিচিতি
হিন্দী ভাষার বহুচর্চিত এবং প্রসিদ্ধ
সাহিত্যিক হিমাংশু যোশীর জন্ম ৪ মে ১৯৩৫ উত্তরাখণ্ডের আলমোড়া জেলার যোশজুড়া গ্রামে। বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ছোটবেলা
কেটেছে অসহনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে তবু অপরাজেয় মনোবল তাঁকে জয়ী করেছে জীবনের লড়াইয়ে। হিন্দুস্থান সাপ্তাহিকে দীর্ঘ ২৯ বছর সিনিয়ার জার্নালিষ্ট হিসেবে কাজ
করেছেন।পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত wagrath পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বেশ কিছু উপন্যাস ১৮টি গল্পগ্রন্থের পাশাপাশি
৩টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। ২৪টিরও
বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যসম্ভার।দেশে বিদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচি এবং গবেষণার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে
তাঁর সৃষ্টি।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-
তুমহারে লিয়ে। তিন তারে। অগ্নিপর্ব। ছায়া মত ছুনা মন।কগার কি আগ। নঙ্গে পাবো কা নিশান সহিত আঠারহ
কহানী। মনুষ্য চিহ্ন তথা অন্য কহনিয়া।অন্ততঃ তথা অন্য কহনিয়া।
“জমিন” গল্পটি তাঁর “অন্ততঃ” গল্পের রূপান্তর।
No comments:
Post a Comment