টরেয়া রে টরেয়া,হাতিবান্ধার টরেয়া
সুবীর সরকার
১।
মাইল মাইল দিগন্তের ভিতর,দিগন্ত পেরিয়ে আরো আরো দিগন্তের ভিতর,নদীঘেরা মানুষঘেরা অরন্যঘেরা গানঘেরা বাজনাঘেরা জীবনের অনন্ততা ছুঁয়ে কোথাও কি যাবার থাকে মানুষের!প্রশ্ন নয়,প্রত্যাশাহীন সংশয় হয়ে কবে কার কতকালের জীবন যেন মায়াকুহকময়তায় জীবনেরই বন্দনাগান।চড়িয়ে যাওয়ায় ছড়িয়ে যাবার আবহমানের আবহমানতায় চিরসত্য হয়ে জীবন যেন নুড়িভাষা নদীর অঞ্চলকথার অত্যাশ্চর্য চোরাটান।
২।
দিগন্তের মধ্যেখানেই তো নেমে আসে মানুষ।কত কত মানুষ।ভালোমন্দ হাসিকান্না অসুখবিসুখ নাচগান শীতবর্ষা হাটগঞ্জ পাইকারব্যাপারি বাথানটাথান টাড়িবাড়ি নিয়ে উজ্জলতর সব মানুষের যাপন দিয়েই তো একটানা বুঁনে চলা নকসিকাঁথা।পালাগানের মাষ্টার টরেয়া বর্মন পেরিয়ে যেতে থাকে সুপারিবন শুকনো বাঁশের সাঁকো।হাতিবান্ধার ধানহাটিতে নাচতে থাকে বুধেশ্বরী বুড়ি।ঢোল বাজিয়ে উড়ানি কইতরের গান বাঁধে হরিকান্ত।সবকিছু নিয়েই তো জীবনের জীবন হয়ে উঠবার প্রয়াস।
৩।
ধলা মুরগিটা বাচ্চা ফুটাইচে...
নদির কাছাড়ে কাছাড়ে ঘুরে বেরান মুন্সি করিম।প্রবীন চোখের ওপর তার আসমানের ছায়া।ডান হাতে কনুই-এর নিচে দীর্ঘ ক্ষতের কাটাকুটি।তুষভাণ্ডার জমিদারবাড়ির চড়ক মেলা থেকে কত কত কালখণ্ড পুরনো এক শীতকালীন সন্ধ্যেয় বড়খাতার তিস্তা সন্নিহিত জঙ্গলপথে এক চিতাবাঘ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।গাছের শুকনো ডাল দিয়েই করিম মুন্সির মরণপন লড়াই।সেই থেকে মুন্সি করিম দশ চল্লিশ গঞ্জগাঁয়ে মিথের মতোন।সেই থেকে তিনি ঘুরে বেড়ান অন্তহীন এক জীবনের ভেতর।
৪।
সে তো ৫০/৭০ বছর আগেকার কোন পৃথিবী। কালখণ্ড থেকে
বেরিয়ে আসা টুকরোগুলিকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই বুঝি
গায়ত্রী সিং জলঢাকার চর পেরোতে পেরোতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে মধ্য শীতের রোদমায়ায় অসম্ভব
এক পুলক জাগে। মাথায় শোলার টুপি। হাতে দোনলা বন্দুক। গোঁসাইহাট ফরেস্ট থেকে শিকারফেরত
গায়ত্রী, হীরা সিং-এর কাঁধে হাত রাখলেই বিশাল প্রান্তর যেন ডেকে নিতে থাকে গিলাডাঙ্গা এস্টেটের
ভিতর। গায়ত্রী তার অন্যমনস্কতাকেও অগ্রাহ্য করে;গভীর কোনো গান ভেসে আসতে থাকে_
‘হামার দেশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়’
গানের ভিতর কেমন এক যাদু থাকে।মায়া থাকে। গান ছড়িয়ে পড়ে গানে গানে ভরে ওঠে টাড়িবাড়িখেতখামারবৃক্ষনদী। অন্যমনস্কতা থেকে ফিরে আসবার মরীয়া প্রয়াস গায়ত্রীর। পৃথিবীর ভিতর পুরাণসকল ঢুকে পড়তে থাকলে পুরাতন পৃথিবীর পটভূমির ভিতর এসে জড়ো হতে থাকে রাজার হাতি,শিকারজুলুস কিম্বা গায়ত্রী সিংএর জোতজমি।
৫।
গায়ত্রীর চোখের তারায় তারায় আন্ধার আতির জোনাই জ্বলে ওঠে। অতীতময়তায় দিন কাটে তার। কোথাও চলে যাওয়া ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি আর ফিরিয়ে আনতে পারে না সে। চলমানতা দিয়েই তো তার দীর্ঘ যাপন,যা তাকে স্মৃতিকাতরতার দিকে ঠেলে দিলে তার কিছুই করার থাকে না আর। জলঢাকার তরমুজবাগিচায় কুয়াশাশিশিরের কুহকে শেয়ালেরা ডেকে ওঠে। বিভ্রমে ঢুকে পড়তে পড়তে গায়ত্রী আবার বুঝি জাগিয়ে তোলে,পুনরুদ্ধার করে গিলাডাঙ্গা এস্টেট। হেমন্তের ফসলবোঝাই মহিষের গাড়ি। বিষাদু মইষালের বাওকুমটা বাতাসের গান। কোথাও বুঝি চলে যেতে হয় মানুষকে! পুরাতন পৃথিবীর ভিতর দীর্ঘনিঃশ্বাসেরা ঘনবদ্ধ হয়। জিপগাড়ির ভাঙা পাদানীতে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে হীরা সিং। সময় অতিক্রম করতে গিয়ে বুঝি একপর্বে গায়ত্রী সময়াতীতের ধারাবাহিকতাতেই আটকে পড়ে!
৬।
আঞ্চলত মুছিনুং হয় তোর
সোনা মুখের ঘাম...
নয়ারহাটের জমজমাটির ভিতর দাঁড়িয়ে আমাকে শুনতে হয়েছিল গায়ত্রী সিং-এর গল্প। ২৫ বর্গমাইল বিস্তৃতির পূর্বতন গিলাডাঙ্গা এস্টেটের পুরনো নতুন সব মানুষের কাছেই যিনি মিথের মত। মিথ ভেঙে দিয়ে তৈরী হওয়া নতুনতর মিথের জালকে আটকে গিয়েও নিজেকে স্মরণযোগ্য করে রাখবার প্রয়াসটুকুন তাকে চলমানতা দিতে না পারলেও;সে কিন্তু মাথায় শোলার টুপি হাতে বন্দুক সহ আদ্যন্ত এক গায়ত্রী সিং হয়েই যেন উঠে আসছেন জলঢাকার পুরাতন চরের খুব খুব গভীর থেকেই।
No comments:
Post a Comment