Monday, August 2, 2021

 



হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দশটি কবিতা 





গাছের বাড়ির ঠিকানা
-----------------------

গাছের ডালে যারা ঘর বেঁধেছিল
গাছের পাতায় পাতায় যারা রেঁধেছিল ভাত
তারা বিংশ শতাব্দীর মাথায় একবার মাত্র
মাথা উঁচু করেছিল সূর্যোদয়ের মুহূর্তে
তারপরই নেমেছিল মুষলধারে বৃষ্টি
পৃথিবীর পথ থেকে মুছে গিয়েছিল 
পিতামহ প্রপিতামহদের পায়ের রেখা 
পথের ব্যাকরণে অভ্যস্ত নয় এমন কিছু ধূর্ত শৃগাল
রাতারাতি পথ পেতে দিয়েছিল শীতচাদরের
অভ্যন্তরীণ গুহায় অভ্যস্ত শিকারী হাতে

একবিংশের লালায়িত জিভে আটকে গিয়েছিল
পৃথিবীর যাবতীয় সবুজের বনজ বিন্যাস
জয় ভেবে পাথুরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে আঁকা হয়েছিল
উদ্ধত মিনারের অহংকারী অলংকার

আরণ্যক জীবনের দেহাতি মানুষের সন্তানসন্ততিরা
এখনও ভোরের থালায় সাজায় মধ্যাহ্নভোজন
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, গাছের গানে ঘুমিয়ে পড়ার আগে
এসো পিতাদের কাছে জেনে নিই গাছের বাড়ির ঠিকানা ।


                


কেঁদে ফেললে
---------------

কেঁদে ফেললেই সূর্য ডুবে যায়
চারপাশে কেমন যেন একটা অন্ধকার নেমে আসে
কোথাও কোনো শব্দ শোনা যায় না
যে কথার সূত্রে শুরু হয়েছিল যাত্রা
রোদ্দুর জানলায় বসে বসে 
সেই হাওয়া বারবার গায়ে এসে লাগে
শোনা যায় বেশ কিছু কথা
যাদের উৎসবিন্দুতে দাঁড়িয়ে তুমি 
কোনো এক সকালে তোমার পৈত্রিক ভিটেয়
শুরু করে দিয়েছিলে অবাধ্য খননকার্য
একটু একটু করে আত্মম্ভরিতার পর্দা উঠতে থাকে 
দরজার ফাঁক দিয়ে পালকের মতো উড়তে উড়তে
ভেসে আসে পায়ে পায়ে হাঁটা দিনের রক্তিম রাজহাঁস
শতাব্দী প্রাচীন দুয়ারে বসে বসে বার্ধক্য হাওয়া
তোমার কথার ভারে ডুবে গিয়েছিল অমোঘ ঘুমে
আজ নির্জন অন্ধকারের ঐশ্বর্যে শরীরে স্পন্দন
আলোর সংকেতে গভীর কন্দর থেকে উঠে আসে
সোনালী প্রজাপতি তোমার ধানের উঠোনে
ঠিক এরপরেই নড়ে ওঠে সদর দরজার পাল্লা
ততক্ষণে তোমার মাটির কেল্লা আকাশ আলোয় হাসছে।


               


চারদেয়ালের স্বরবৃত্তে
-----------------------

চারদেওয়ালের স্বরবৃত্তে দোল খেতে খেতে 
জীবনের সবকিছু আবিষ্কার করে ফেলার মত্ততায় 
জানলা খুলে বাকি পৃথিবীর শরীর দ্যাখে
দেওয়ালের বর্গাকার ছিদ্রের গভীর নিদাঘ
কল্পনারও বাইরে গ্রাম্য ঝোঁপের মধ্যে আটকে ছিল
ধুলোপথের দিকে তাকিয়ে কে আর সারাদিন
সব কাজ ফেলে রেখে চোখ রগড়ায়
যুক্তি বুদ্ধি উড়িয়ে দিয়ে শুধু ক্ষমতার রেখায় 
আবছা করে দিয়েছিল বর্গাকার অন্য পৃথিবী
ধুলোর মানচিত্রেই তো কথা বলে
পৃথিবীর যাবতীয় পরিশ্রমী মুখ
আবছা পৃথিবীই প্রগাঢ় হয় চারদেওয়াল জুড়ে
কথা বলে আন্দোলিত দু'বাহুর ঝড়



               
আঙুলের চলাচল
-------------------

যতটুকু গায়ে গা লাগালে 
একটা ধুলো ওড়ানো পায়ে চলা রাস্তা তৈরি হয়
ততটুকু শরীরও আমাদের মধ্যে নেই বা
বলা ভালো মাংসের ঘনত্বে ভিন্নতা থাকায়
আমরা আজও কাছে আসতে পারি নি

দরজা জানলাহীন ঘরের মধ্যে এত ঠাণ্ডা
এখানে কখনও ভুল করেও মেঘ পা দেয় না
জানলাকে এখনও ঘরের মুখ বলে সবাই লোক হাসায়

কয়েক ফোঁটা চোখের জলে 
যতটুকু আকাশ পরিস্কার হয় 
সেখানে নামমাত্র পা-টুকু লাগিয়ে কিছু মনমরা দুপুর
হেলে যাওয়া আকাশকে তুলে ধরে
আর অনেক বেলায় কুয়াশা কেটে গেলে
একটা সরু সুতোর মতো রাস্তা চোখে পড়ে
কয়েকজনের অবিন্যস্ত পা ------ চলার ধরনই বলে দেয় 
তাদের কোনো গন্তব্য নেই ------ কিছু আঙুলের চলাচল


           

কালবৈশাখী
--------------

উড়তে উড়তে ডানা খুলে গেছে
এমন কিছু মানুষের স্বপ্ন নিয়ে
যে ক'টা ঘর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে
তাদের সকলের ঠিকানা একেবারে রাস্তার শুরুতেই
তর্জনী থাকলেও তা কাজে লাগানো হয় নি

মোড়ের জাঁকজমক নদীর মতো গড়িয়ে 
সব মাথা ভিজে যাবে যারা ভেবেছিল
তাদের বাক্যের সবকটি শব্দ ফুটো হয়ে গেছে
ভেজে নি তারাও
ধুলোওড়া রাস্তায় শুধু নাক জ্বলে

জ্বলনের কোনো গন্ধ নেই বলে
কেউ কেউ মোড়ে দাঁড়িয়ে বুক উঁচু করে

ধুলো উড়লে দিশাহীন বাক্যে এখনও তা কালবৈশাখী ।


                    
উর্বরতার অঙ্ক
---------------
নদীর মতো করে যারা চেয়ে আছে
পৃথিবীর পথে পথে
তাদের সংখ্যা খুবই কম বলে
এক বৃষ্টিতে পৃথিবীর চাষ হয় না

শেষ বর্ষায় সব বৃষ্টি কুড়িয়ে নিয়ে গেছে যারা
তাদের আয়ু রোদ্দুর দিনের চৌকাঠ পর্যন্ত
খড়ির দাগ এখনও চিনিয়ে দিচ্ছে 
পৃথিবীর যাবতীয় গলিপথ

তবে আর কয়েকটা মাত্র আর্দ্র দিন
আর কিছু নিথর গাছপালা
বৃষ্টি নামলেই মুছে যাবে সমস্ত অপেক্ষার রঙ
চোখ চিরে অস্থির পায়ে কে চেনাবে গলিপথ ?

জল পেরিয়ে পেরিয়ে উঠে আসবে
বেশ কিছু পরিশ্রমী পা
রাজপথে এসে শুধু দাঁড়ানোর অপেক্ষা
জেনে যাবে হৈ পথে কোনো চাষ নয়
জাগাতেই শুধু জেগে জেগে হেঁটে যায়

নারকোলের জলের মতো কিছু গোপন পা
মাটিতে মাটিতে শুধু উর্বরতার অঙ্ক কষে ।



                

সরে আসার পর
------------------

সরে আসার পর
তোমার কিন্তু অন্য মাটি

এতদিন নিজের মতো করে ছড়িয়েছিলে হাত পা
তোমার ভেতর ঘরের কত খবর 
হাওয়ায় ভেসে ভেসে কোথায় না কোথায় গিয়েছিল

সব সরে আসে না
কিছু আটকে জানলায়, কিছু দরজায়,
কিছু হাটে বাজারে
রাস্তাতেও কত গড়িয়েছে দেখেছে সবাই

সরে আসার কঠিন মাটি 
তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না
উঠতে বসতে জেনে নেবে
কতটা কঠিন করেছ নিজেকে ।


       


আমি গল্প হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
-------------------------------

বটগাছের ঘুমের মধ্যে
আমি গল্প হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

কিছু দূর হেঁটে আসার পর
এমন এক গভীর প্রদেশে পা রাখলাম
চোখেই ধরে না পাহাড় জল মাটি

চাওয়ার জন্যে হাত পেতেছি
কোথায় থাকবে ডালপালা ঘরবাড়ি

ফিরে আসার পথে দেখি
দাঁড়াবার জায়গাটুকুও অন্য পরিচয়ে ঋজু ।


            


সমুদ্রের পাতা
---------------

সমুদ্রের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে 
আমি প্রতিদিন নতুন বইয়ের গন্ধ পাই
আমাদের পূর্বপুরুষরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত
মাটির পোকা থেকে আকাশ সবটুকু
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমুদ্রের লোনা জলে দাগ কেটে গেছে 
সমুদ্রের ধারে দুলে দুলে কেউ কেউ নামতা পড়ে

চোখের সামনে খোলা আছে
পৃথিবীর যাবতীয় ইতিহাসের প্রাত্যহিক দিনলিপি
তবুও সমুদ্রের রঙটুকুও না দেখে
আমরা সবকিছু মুখস্থ বলার চেষ্টা করি । 



                   


হাত পকেটের গল্প
-------------------

নদীজল থেকে হাওয়া উঠে আসার মতো
হাসতে হাসতে খুব সহজেই পকেটে ঢুকেছিল হাত 
পকেট নামেই যাদের কাছে পরিচিত
তারা বেশ চোখ বড় বড় করেই 
একটু টাল খেয়ে গিয়েছিল
ঝোড়ো দিনে হঠাৎ করেই 
যারা এসে চোখে চোখ রেখেছিল তাদের কাছে 
হাত পকেট কোনোকিছুই নেই বলে মনে হল

কিন্তু তবুও হাত পকেট উভয়েই থাকে
ঠিক যেভাবে ছয় ঋতুর গায়ে লেপ্টে থাকে বর্ষা
চামড়া পোড়া রোদের পর হঠাৎই
মেঘের চাদর গায়ে আসে বৃষ্টি
কেউ কেউ জানলা দিয়ে দু'হাত বাড়িয়ে দেয় 
আবার অনেকেরই জানলা বুজে গিয়ে
বুকের ভেতর বেজে ওঠে বিক্রম  সিং




No comments:

Post a Comment