Tuesday, August 3, 2021

ধারাবাহিক উপন্যাস 

জলের চিহ্ন

মি তা লি   চ ক্র ব র্তী



প্রথম পর্ব


এদিককার বাড়িগুলো খুব সুন্দর বেশ সাজানো গেটে গেটে অগ্নিশিখা কিংবা ঝুমকো লতা দিয়ে বাহারি করা,আবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে ছিল শ্রীরূপা পাশ থেকে দিগন্তবলে উঠল এগুলো সব প্রবাসী বাঙালিদের।ড.বিধানচন্দ্র রায় কল্যানীর রূপকার জানিস তো! সেই সময়কার সুবিধাভোগী লোকজনের সন্তানেরা সবাই চাঁদের মানে আমেরিকার নাগরিক। তাদের দেশের বাড়ি এইসব। চোখকান খোলামেলা রাখ দুই একজন বিদেশীর দেখা পেতে পারিস বেড়াতে এসেছে হয়তো।এরকম মজাকরেই কথা বলে দিগন্ত হাসল শ্রীরূপা একটা হালকা হলুদ রংয়ের শার্ট পড়েছে দিগন্ত খুব মানিয়েছে ওকে ।শ্রীরূপা শাড়িই পড়েছে। দিগন্তের পছন্দ মতো মভকালার আজ সারাদিন একসঙ্গে কাটাবে দু'জন। সারাজীবন কাটানোর কথা ছিল হয়নি, আর হবেও না ।শ্রীরূপার মেয়েটা এবার ফোরে উঠবে দিগন্ত ও ফিরে যাবে তার নিজের শহরে নিজের সংসারে ।হয়তো দেখা হবেনা দুজনের । দিগন্ত ভুলে যেতে চাইবে শ্রীরূপার  অপূর্ব দুটি চোখ। জীবনের সন্তর্পণতা হারিয়ে যাবে।এখনো দিগন্তের ছোঁওয়ায় কেমন উদ্দাম হয়ে ওঠে ওই গভীর চোখের শ্যামলা মেয়ে। কিছু প্রত্যাশা করে কি!! জানেনা দিগন্ত আর জানতে চাওয়ার পরিস্থিতি ‌আদৌ থাকবেনা হয়তো।দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার কারনে দেখা হবে কখনো হয়তো তাতে কি আর এই দিন গুলো ধরা যাবে!



মাঘ মাসের সোনাগলানো রোদে পাশাপাশি দুজন হেঁটে চলে শব্দ বিহীন।

শ্রীরূপা দিগন্তের মামার শালীর মেয়ে। মামার বিয়েতে পঞ্চদশী শ্রীরূপাকে প্রথম দেখেছিল দিগন্ত। ভালো লেগেছিল কিন্তু ওই পর্যন্তই বিয়ে বাড়িতে যেমন হয় আরকি,,

উনিশ বছরের দিগন্ত তখন কুহেলির প্রেমে বিভোর।তার চোখে তখন কুহেলির নেশা জড়ানো কুহেলি কত্থক ডান্সার, কুহেলি শহরের নামী স্কুলে পড়ে,উঠতি যুবকদের স্বপ্ন কুহেলি ও দিগন্তের প্রেমে একদম বিভোর স্কুল পালিয়ে দেখা করে‌দুজনে এভাবেই কাটতে থাকে দিন।তারপর‌ নার্সিং পড়তে চলে গেল কুহেলি। দিগন্ত ততদিনে এম,কম , পড়ছে প্রেম চলল চিঠিপত্রে।কুহেলির প্রথম পোষ্টিং হল মালদা সেখানেই প্রতিশ্রুতি মান সার্জন ত্রিদিব নাথ এর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলে বুদ্ধিমতী কুহেলি‌। দিগন্তের অজ্ঞাত সারে।

এদিকে শ্রীরূপার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়েছে‌বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে পড়তে পড়তেই সাধারণ বাঙালি বাড়ির রীতিমতো দেখাশোনা আরম্ভ হয়েছে।ভাই এর পড়াশোনার খরচ আছে আর মেয়েকে তো পরের ঘরে দিতেই হবে।গান গাইত শ্রীরূপা,তেমন লক্ষ্য করার মতো নয় খুবই সাধারণ মেয়ে সে।তবে কারো কারো ‌সাধারণ বৌ হয়।তারাও সাধারণ খুব সাধারণ তাদের বাড়ির বউরা গান জানেন কিন্তু গাইতে ভুলে যেতে হয়। ভাত রাঁধে তারা অফিসের ভাত, সঙ্গে ডাল, মাছের ঝোল, একটা তরকারি মোচা,কুমড়ো কিংবা কচুর শাক নানারকম ভাজা।রুটি করতে জানতে হয় বেশ নরম করে আটা ঠেসে ঠেসে যাতে বয়স্ক শ্বশুর মশাই প্রৌঢ়া শাশুড়ি ছোট্ট বাচ্চা আর উপার্জনশীল স্বামী সবাই সুস্থ থাকে। ভালো হজম হয়,রাতে ঘুমটা ভালো ভাবে হয় ।আর স্বামী  যদি খুশি থাকেন তবে বছরে দুই চারটে ভাল শাড়ি ছোটখাটো ‌গয়নাবছরে একবার বেড়াতে যাওয়া মেয়ের জন্মদিন।পূজোর সময় বাপের বাড়ি জামাকাপড় পাঠানো কিংবা অসুস্থ বাবাকে দেখতে যাওয়ার এইসব  যাপন চলে পাশাপাশি সুমসৃন।

ভাই এর পড়া চলছে সে তো আছেই বাবা মায়ের অবলম্বন। সুতরাং,,,




দ্বিতীয় পর্ব


বড়মামার‌ মেয়ের বিয়েতে আবার দেখা হয়ে গেল দিগন্ত আর শ্রীরূপার ।দিগন্ত এখনো একাই আছে, বাবা চলে গেছেন পরপারে; মা আর ছেলের ছোট্ট সংসার। ছোটখাটো একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে সে, কিন্তু মনে মনে হেরে যাওয়ার নিঃস্বতা বয়ে চলে একান্তে; প্রথম প্রেমের কাছথেকে পাওয়া চোট গভীর ক্ষত রেখে গেছে তার মনে।এমন এক আলগা বাঁধনছেড়া সময়ে আবার দেখা হলো শ্রীরূপার সাথে।ভরন্তপূরন্ত সংসারী এক নারী কোলে ফুটফুটে মেয়ে । ভরপুর সংসার,কপালে সিঁদুর  

আবার জমে ওঠে আনন্দ পরিবেশ আর সুখস্মৃতির রোমন্থন। আনন্দ আর আলাপ আলোচনায় আত্মীয়তার সম্পর্ক গুলি ঝলমল করে ওঠে।সকলেই বোঝাতে চায় সুখ। কিন্তু দিগন্তের মা ম্লান মুখে থাকেন। চোখ এড়ায়না শ্রীরূপার;  দিগন্তের সাথে কথা হয় কতদিন পর,,, দুজনে এই প্রথম। কথায় কথায় জমে ওঠে বন্ধুত্ব। অনুষ্ঠান শেষে আবার যে যার মতো ‌ফিরে আসে।

কয়েক দিন পর হঠাৎ দিগন্ত ফোন করে,কথা হয় দুজনের সাধারণ কুশলবিনিময় তারপর দিগন্ত প্রশ্ন করে, ফোন করলাম বলে‌ "তোর কোন  ডিস্টার্ব হলো না তো?" জবাবে শ্রীরূপা রবীন্দ্রনাথের দুই লাইন বলে ফেলে, "রাতের সব তারাই আছে/দিনের আলোর গভীরে,,",

দিগন্ত পরের দিন ফোন করে আবার, আবার, প্রতিদিন ফোনে কথা হয়,,, কি এক হৃদয়াবেগ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দুজনেরই ‌অপেক্ষা থাকে আর থাকে আবেদন ;কোনমতেই যেন খারিজ করা যায়না সেই বিধ্বংসী আবেগ।


প্রথম প্রথম উৎকন্ঠা ছিল শ্রীরূপার কিন্তু দিগন্তের আকুল করা এস এম এসগুলো তার মনকে প্ররোচিত করতে ছাড়তনা। নিজেকে অচেনা লাগছে শুরু করেছিল  মেয়ে, মেয়ের বাবা, প্রিয়জনেরা সবাই তার থেকে কেবল নিয়েই গেল সারাটা দিন ধরে সবার সুখসুবিধার খেয়ালে কেটে যায় সময় তার নিজের জন্য কখনো কোন ভাবনা তো আসেনি; তাই দিগন্তের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেনি সে । এতদিন বুঝতেই পারেনি বুকের ভিতর হাজার বছরের তৃষ্ণা কেমন পাষাণ হয়ে ছিল। দিগন্তের পাঠানো এসএমএস এর আর্মিরা তাকে পাগল করে তোলে কিন্তু মনের মধ্যেকার মনটা তাকে সাবধান করে ।সবাই বুঝতে পেরে যায় যদি ! সুতীব্র দ্বিবিধায় বারবার ভেঙে চুরে যায় তার মন।অন্যকারো স্ত্রী সিঁদুর পরে, তার জন্য রান্না করে অথচ পরপুরুষের জন্য মনে মনে মরে যাচ্ছে। তৃষিত মন  ফোনের জন্য অপেক্ষা করে।এস এম এস করে দিগন্ত কত ভালো বাসা ভরা সেইসব আকুতি।যদি ওর ওই আর্তি গুলো সত্যি হয়!হতেও তো পারে মনটা ভরে যায় শ্রীরূপার।রিপ্লাই পাঠায়, রিপ্লাই ফিরে আসে ক্লান্তিকর দিনাতিপাত সেরে অবচেতনে সজীব আনন্দবাসের কল্পনায় মেতে ওঠে অবুঝ মন। এমনকি মন বসেনা প্রিয় সিরিয়ালে । শাশুড়ি মা অবাক হয়ে বলেন "তোমার হল কি বৌমা ! কেমন যেন অন্যমনস্ক থাকোৎআজকাল?শরীর  পরীর ভালো আছে তো?"


ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment