Monday, August 2, 2021

 

জমিন

মূল রচনাঃ হিমাংশু যোশী

অনুবাদ- বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়



 

 

গোঁসাই মা মারা যাবার পর ছেলেটাকে দেখভাল করার মতো তেমন কেউ ছিল নাএক রত্তি ছেলে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকত আকাশের দিকেনাকে শিকনি ঝরত, চোখে পিঁচুটি।এসব মুছিয়ে কাজল পরিয়ে দেওয়ার কেউ নেইকোলে নেওয়ার কেউ নেই।খিদে পেলে মহিলাদের দিকে চেয়ে থাকত অদ্ভুত চোখেসে জানত সেখানে জমিন আছেখিদে তেষ্টা মেটায়আশ্রয় দেয়

বিনিয়ার ভালো লেগেছিল ছেলেটাকে। কোলে নিয়েছিল আহারে! এই টুকুন বাচ্চাবাচ্চাটা জড়িয়ে ধরেছিল বিনিয়ার শাড়িকিছুতেই ছাড়বে না। কোল থেকে নামালেই চিল চীৎকার। শেষ পর্যন্ত গোঁসাইজীকে  বলে ছেলেটাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল বিনিয়াপাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়েকে যদি পালতে পারি তো তোকে কেন পারব নি রে ব্যাটা

সেই থেকে বিরজু বিনিয়ার ছেলেবড় মায়া পড়ে গেছে।কিন্তু এত আদরেও ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেল।ছোটবেলা থেকেই উদাস উদাস চোখ।আপনভোলাতখন যে এমন হবে বিনিয়া জানত নাআর জানলেই কি ফেলে দিতে পারত সে ? হাজার হোক মায়ের মনলোকে বলে কোথা থেকে এই পাগল ছেলে জুটালি বিনিয়া ? তোর তিন তিনটা জোয়ান ছেলে থাকতে এ আপদ ঘরে আনার কি দরকার ছিল? বিনিয়ার কখনও স্বপ্নেও এ কথা মনে হয় নিতাই ছেলের যখন মাথার গোলমাল দেখা দিল তখন সে ছাগলদুটো বিক্রি করে শহরের বড় ডাক্তারকে দেখিয়েছিল প্রথমেবিরজু এখন বদ্ধ উন্মাদঅথচ ছেলেটার জন্য কত মানত করেছে বিনিয়াগাঁও বুড়ার কাছে মুরগী মানত করা থেকে আরম্ভ করে শিবথানে দণ্ডি দেওয়া কি সে করেনিডাক্তার বদ্যি তাবিজকবচ ঝাড়ফুক কিছুতেই কিছু হল নাছেলেটার কপালটাই ফাটা।

    সবার ছেলেই সুয়াং খাটিয়ে রোজগার করেএই গ্রাম দেশে এটাই দস্তুরবিরজু কিছুই করে না। সে দিন নেই রাত নেই কেবল ঘুরে বেড়ায়মুখে সবসময় একটা তালপাতার বাঁশি থাকেফির ফির শব্দ করে আর বিরজু আপনমনে হাসে। রাস্তায় পড়ে থাকা পোড়া বিড়িগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে পকেটে রাখে , কখনও আবার নিজের মনেই সুখটান দেয়শ্মশানে কোন গাছের উপর লটকে থাকা ছেঁড়া জামা পেড়ে বেঁধে নেয় নিজের শরীরেনইলে শীত হোক বর্ষা হক উদোম গায়ে ঘুরে বেড়ায় একটা জ্যারজ্যরে এবং সম্পুর্ন ময়লা গামছা পরেরাস্তাঘাটে কাওকে দেখতে পেলেই বলেচা খাওয়াবেন না বাবু, বিড়ি খাওয়াবেন না বাবু

বিনিয়ার বয়স বাড়ে। শরীরে বাতের ব্যথায় সে সোজা হয়ে হাঁটতে পারে নাকোমর বেঁকে গেছে ধনুকের মতো।চুল পাকতে পাকতে পুরোপুরি সাদাচোখে আজকাল কম দেখেসন্ধ্যে নামলে ঘর থেকে বেরুতে পারেনামুখে অজস্র বলিরেখাবিরজুর কোন হেলদোল নেইতার বয়স বাড়ে নাপাগলামি বাড়তে থাকে শুধু

এর মধ্যেই একদিন গাজনের মেলা বসল ফুলদোল গাঁয়ের হাট তলায়পরবের গন্ধ পেলে পিঁপড়ের মতো ছুটে আসে মানুষ।আনন্দে ভাসতে থাকে চারপাশসেই উপলক্ষ্যেই নানা রকম মেলা আর যাত্রাগানকিষান মহারাজের লীলাও দেখানো হচ্ছে টিকিট দিয়েবিরজুর কাছে কোন পয়সা নেই টিকিট কেনারসবাই ঢুকছে দেখে তারও মনে হল সে লীলা দেখবেজোর করে ঢুকতে চাইলে ওকে বাধা দিল মেলার লোকজন।

কে একজন বলল- ও পাগল মানুষ আছে ভাই, পয়সা কুথায় পাবে

এতেও দয়া হল না কমিটির লোকগুলির , বলল- পাগল তো এত সখ কেনে বাপু ? 

বিরজু তবু নাছোড়। সে দেখবেইশেষমেশ ওকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল আসর থেকে

গ্যাসবাতির আলো জ্বলছে চারদিকেঝলমল করছে প্যান্ডেলের ভেতরে গানবাজনার আসরবিরজুর ভালো লেগে গেল এইসব। সে কি করবে তখন ? বাইরে বেরিয়ে এল এবং প্যান্ডেলের ফুটো দিয়ে দেখতে লাগল ভিতরের জমজমাট কাণ্ডকারখানাসারারাত না খেয়ে সে কিষান মহারাজের লীলা দেখলসকালে বাড়ি ফিরবার পথে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজানোর ভঙ্গিমা করতে লাগল। বটগাছের ঝুরি ধরে ঝুলতে ঝুলতে দোল খেতে থাকলআবার গোপিনীদের মতো বুক আড়াল করে বিলাপ করতে শুরু করলদুপুরে সে যখন বাড়ি ফিরলবিনিয়া কেঁদে আকুলচোখের জল মুছতে মুছতে বলল- আমার হয়েছে যত জ্বালানে এখন চালসেদ্ধ বানিয়ে দিয়েছিপিণ্ডি খা, খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর

চালসিজাকিষান মহারাজকে তুই চালসিজা দিচ্ছিস মাআমি ননী খাব, মাখন খাব

 আঃ। শখ কতবাপ যেন চোদ্দটা গাই পুষেছে।

প্রচুর খিদে পেয়েছিল তাই চালসেদ্ধগুলোই মাখনের মতো সুস্বাদু মনে হল বিরজুরকিন্তু এরপর তার পাগলামি বেড়ে গেল আরওগোরু দেখতে পেলেই সেগুলোকে পাঘা থেকে খুলে সে চরাতে নিয়ে যেত মাঠে।একটা বাঁশি থাকত হাতেসবুজ মাঠের মধ্যে গোরুগুলো চরতে শুরু করলে সে বাঁশি বাজাতে বাজাতে কদম গাছে দোল খেতএকদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রতিবেশীদের গোয়াল ঘর থেকে সব গরুগুলো নিয়ে সে চলে গেল নদীর দিকেসবাই ছিঃ ছিঃ করতে লাগল বিনিয়াকেছেলেকে চুরি চামারির বিদ্যে শেখানো হচ্ছে লজ্জা করে নাএই তোমার পাগল ছেলে, এ যে দেখছি সেয়ানের চেয়েও সেয়ানবিনিয়া কিছুই বলল নাচুপচাপ অপমান সয়ে কান্নাকাটি করতে লাগল- আসুক বিরজু, আজ ওরই একদিন কি আমারই একদিন

সন্ধ্যেলায় গরুগুলো নিয়ে বিরজু ফিরে এল। প্রতিবেশীরা দেখল- গরুগুলো আজ বেশ আনন্দে আছেপেট ভরে  খেয়েছে নদীতীরের সবুজ যত ঘাসবিরজু বলল- কিষনা মহারাজকে মাখন মিছরি খাওয়াওপ্রতিবেশীদের একজন বলল- আমাদের তো গাই নেই, কেবল গরুমাখন কোথায় পাব। তুই মিছরি খাবিরজুকে একখণ্ড মিছরির টুকরো ধরিয়ে দিল ওরা। সারাদিন খিদেয় ক্লান্ত ছিল বিরজু। অমৃতের মতো মনে হল মিছরিখন্ডপ্রতিবেশীরা বলল- আরও দেব , কাল আবার আসিস

এই রুটিনের অন্যথা হল নাদিনের পর দিন বিনা পয়সার রাখাল পেয়ে ওরা বর্তে গেলরুগ্ন গোরুগুলি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠল এক মাসেইনদীতীরে গরু চরাতে চরাতে একদিন অবাক কাণ্ড করে ফেলল বিরজুমেয়েরা নদী পাড়ে জামাকাপড় রেখে নাইতে নামলে তাদের কাপড়গুলি চুরি করে গাছের উঁচু ডালে টাঙ্গিয়ে দিলফল যা হবার তাই হলসেদিন উত্তম মধ্যম জুটল কপালেবিরজু বলল- তোমরা মারছ যে, আমার দোষ কুথায় বল ?

তুই আমাদের কাপড় লুকিয়ে বেইজ্জতি করছিস, তাই

সে তো কৃষ্ণও করেছেতুমরা জানো না এ কে লীলাখেলা বলে ?

দাঁড়া তোর লীলাখেলা বার করছিমেয়েরা তাকে বেধড়ক মারতে শুরু করে দিল

কৃষ্ণলীলা কি এরকম হয় নাকি ? কৃষ্ণই সখিদের হাতে মার খায়সে সাতপাঁচ কিছুই বুঝতে পারল নাতার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল 

এর মধ্যেই খবর উড়তে লাগল আকাশে বাতাসে হরিণপুরায় রামলীলা হবেসাত আট দিন ধরে চলবেরাস্তায় যেতে যেতে চৌধুরী চাচার সাথে দেখা হয়ে গেল বিরজুরচৌধুরী চাচা খুব ভালোবাসে বিরজুকেবিরজু তাই সাহস করে বলল- চাচা, রামলীলায় আমি কিষাণ মহারাজ সাজবতুমি বেবস্থা করে দিও

রামলীলায় কিষান মহারাজ কুথায় পাবি ? এই পালায় রাম আছে, লছমন আছে, রাবোন ভি আছেতুই কি হবি বল?

বিরজুর এক জেদ সে কিষান মহারাজই হবেযে মেয়েগুলো তাকে মারধোর করেছে তাদের দেখিয়ে দেবে সে সত্যিকারের কিষাণ মহারাজ

হরিণপুরায় রামলীলার আসরে গিয়ে অভিনয় দেখতে দেখতে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ল যে দশরথের মৃত্যুতে সে সত্যিই কেঁদে ভাসিয়ে দিলসীতাকে হরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় রাবণকে প্রচুর গালাগাল দিলরাজসিংহাসন , ঐশ্বর্য সম্পদ কিছুই তাকে আকর্ষণ করতে পারল না। এসব বিষয়ে ভরতকে ভাল লাগলেও তার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র হয়ে গেল হনুমানতার মাথার ব্যামো আরও বেড়ে গেলকাপড়ের একটা লেজ বানিয়ে সে বানর সেজে চারদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগললঙ্কা দহনের দিন তো উন্মাদের মতোজয় শ্রীরাম’ ‘ জয় বজরং বলীহুঙ্কার দিয়ে মাতিয়ে তুললদুচার জন ওকে আটকানোর চেষ্টা করল তাই নইলে হয়ত আগুন জ্বালিয়ে সবকিছু ছারখার করে দিত

পরদিন থেকে বিরজু হনুমানের নেশায় এতটাই মাতাল হয়ে গেল যে কিষান মহারাজ, ময়ূর পালক গোরু চরানোর কথা তো ভুলে গেলই, এমনকি যে বাঁশিটি ছিল তার প্রাণপ্রিয় সেটাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরের জলেমাঝে মাঝে নিজের লেজটা দেখে হাত বুলায় পরম আদরে আর নিজের মনেই চীৎকার করেএবার রাবণ আসুক, ওকে আমি দেখে নেবসীতাকে হরণ করার আগেই শালা রাবণের দশটা মাথা আমি পুড়িয়ে ছারখার করে দেবজয় বজরং বলী, জয় বজরং বলী

 যে লোকটা রামলীলায় রাবণ সেজেছিল তার বাড়িতেই কাজ করত বিনিয়াসেদিন ভাতের হাড়ি চড়ে নিওর বাড়ি থেকে দুসের চাল নিয়ে আসতে হয়েছিল বিনিয়াকেনইলে এতগুলো পেটের গাভা সে ভরাবে কীভাবেবিরজু বাড়ি ফিরেই দেখে মা নেইহনুমান সাজলেও পেটে খিদে তো আছেসে জানে মা মানেই খিদের উপশমকিছুক্ষণ পর বিনিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করল- এত দেরি ? কুথায় গেছিলি তুই?

বিনিয়া চুপ করে ছিলতার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না

বিরজু বলল- তুই ওদের বাড়ি কেন গেলি? ওর কাছে ভিখ চাইলি কেন ? চালের ভাত আমি খাব নি

না পোষায় না খাবিনিজে সুয়াং খাটিয়ে খা গে যা, কে বারণ করেছে তোকে

পাগল হলেও কথাটা আঁতে লাগল বিরজুরসে ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে গেল রাগেকিছুদূর যাওয়ার পর সে ভগীরথ চাচাকে দেখতে পেলভগীরথ চাচা মানে যে হনুমান সেজেছিল রামলীলায়তাকে পেন্নাম করে বলল- চাচা, তুমিই আমার গুরুদেবআমাকে দিশা দেখিয়েছ

তারপর গল্প করতে করতে তারা অনেকদূর হেঁটে এলগাঁয়ের জমিদার এবং মুখিয়া সাহেবের বাড়ির কাছাকাছি এসে একটা হট্টগোল শুনতে পেল দুজনেইকিছু একটা বিপর্যয় ঘটেছে বুঝতে পেরে ভয়ে কাঁপতে লাগল ভগীরথ চাচাবিরজু বলল- আমরা হনুমানজী, আমাদের কি কাঁপলে চলে? চল ছামুতে এগিয়ে দেখি

এগিয়ে আসতেই পুরো বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেল দুজনের কাছেইএকটি মাঝবয়সী বউ থর থর করে কাঁপছেতার উপরের অংশ সম্পূর্ণ অনাবৃত

কি হয়েছে কি ?

দেখেন বাবু, মুখিয়া সাহেব আমাকে চালচোর বলছেআমি চাল চুরি করিনি তা কবুল করার পরও উনি আমার শাড়ি খুলে দেখতে চাইছেন কুথাও চাল লুকিয়ে রেখেছি কি নাআপনারাই বিচার করেন বাবু, গরীব বলে কি আমাদের মান ইজ্জত নেই ?

বিরজু আর নিজেকে সামলাতে পারল নাজয় বজরংবলীবলে চেঁচিয়ে উঠল জোরে

এই বিরজু থামভগীরথ চাচা ধমক দিল

সেই ধমককে কোন রকম পাত্তা না দিয়েই বিরজু বলল- আমি বিরজু নই, আমি হনুমানজী, তুমিও হনুমান আছো চাচাদেখাও তোমার খেলসীতার বেইজ্জতি হলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়আমি এর ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব আজই তবেই আমার নাম হনুমান

এই পাগলা চুপ করএটা রামলীলা নয়, তুই কার সাথে কথা বলছিস জানিস, আমাদের মুখিয়া আছেওর হাতেই থানা পুলিশ

বিরজু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল ভগীরথচাচার দিকেএই লোকটা কদিন আগে লঙ্কা ছারখার করেছিলআজ তার তেজ বিক্রম কিছুই নেই

তুমি কি বলছ চাচা, রামলীলা কি তবে মিছা কথা ?

ওসব লিখতে হয় মানুষকে মাতানোর জন্যজীবনের হিসাব নিকাশ আলাদা

কাপড়ের লেজটা নিজের হাতে খুলে ফেলল বিরজুজীবন আর লীলা যদি আলাদাই, তাহলে কি দরকার এমন উদমা আলকাপ সাজাররাবণ মারার খেমতাই যদি না থাকে তবে মিছা গল্প আওড়ানোর ফুটানি কিসের? যত রাগ জমেছিল বুকের ভিতরে সব উগরে দিল বিরজু এক দলা থুতুতেথুঃ

 সন্ধ্যের সময় বাড়ি এসে নিজের পুরানো দুর্গন্ধময় চাদরটা একটা থলিতে ভরল বিরজুমায়ের দিকে তাকিয়ে তার জল আসছিল চোখেএই তার সসাগরা দুনিয়াএই তার কাছে সত্যএর বাইরে যে পরিচিত দুনিয়া সেখানে বর্ণে বর্ণে মিথ্যার বসতিটুক করে মাকে সে একটা প্রণাম করল এই প্রথমমায়ের মন সন্দেহপ্রবন এবং শঙ্কাসন্ধানীকিছু একটা আঁচ করতে পেরে বিনিয়া বলল- কুথায় চললি, বাপ ?

বিরজু উদাস গলায় বলল- যেখানে মিথ্যাবাদীরা থাকে সেই গাঁয়ে আর মিনিটও নয়, তুইও আমার সাথে চল মা

বিনিয়া বলল- তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারবি ?

এই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই বিরজু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অন্ধকারে

এরপর আর অনেকদিন বিরজুর খোঁজখবর পাওয়া গেল নাছেলের জন্য কান্নাকাটি করতে করতে একসময় চোখের জল শুকিয়ে এল বিনিয়ারসময় নির্মম থাবা বসাতে শুরু করল তার শরীরেএখন কোন রকমে একটা লাঠি ধরে আস্তে আস্তে চলাফেরা করে সেদিনের বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে বসেই কেটে যায়চোখে ঝাপসা অস্পষ্ট দৃষ্টিতবু তার মধ্যেই দরজায় কোন শব্দ হলেই সে কানখাড়া করে শোনে। কখনও কখনও নিজের মনের মধ্যে কথার বুদ্বুদ ওঠেফিরেছিস বিরজু? এতদিন না খেয়ে কি দশা হয়েছে রে তোর ? আয় আজ নিজের হাতে তোকে রান্না করে খাওয়াইকিন্তু কোথায় কি। বিরজুর কোন চিহ্নই নেইএকা একা নিজের মনেই বিরজুর ছায়া দেখে বিনিয়াগাঁয়ের কেউ কেউ কখনও কখনও গুজব রটায়হরিণপুরার দিকে আজ বিরজুর মতন একজনকে দেখলাম ভিক্ষা করছে রাস্তায় রাস্তায়কেউ বা বলেওকে জেলে নিয়ে গেছে পুলিশ , আমি নিজের চোখে দেখেছিএদের মধ্যে অত্যধিক উৎসাহী দুএকজন লোক থাকে। তারা বলেপরশু রেললাইনের ধারে অবিকল বিরজুর মতন একটা লোক রেলে কাটা পড়েছে। ডানহাতের জুড়ুলটা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম , এ আমাদের বিরজু ছাড়া আর কেউ নয়

এসব কথা বিনিয়ার কানে আসেসে গাঁও বুড়ার থানে মানত করেআমার বিরজুকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো ঠাকুর। আমি তোমাকে জোড়া পাঁঠা দেব

এই সব খবরাখবরের মধ্যেই একদিন সন্ধ্যেবেলায় দরজার কে যেন ডেকে উঠলমা

 বিনিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল- কে ? বিরজু এসেছিস বাবা ?

 দরজা খুলে দেখল এক হাড় জিরজিরে সাধু দাঁড়িয়ে আছে দুয়ারেলাঠি হাতেছেঁড়া চাদরমাথায় ধুলিধুসর চুলগালে রামছাগলের মতো দাড়ি। চোখের নীচে চমশার মতো ফুটে আছে কালো দাগ

বিনিয়া চেঁচিয়ে উঠল বিরজু, আয় ব্যাটা ঘরে আয়

সাধুবাবা বলল- আমি বিরজু ফিরজু নই, আমার নাম দাড়ি বাবাআমি সবাইকে জমি দান করতে বলি, জমিন দাও যার যেমন সাধ্যি আছে জমিন দাওমহারাজের হুকুম

আমাদের জমিন কুথায় রে ব্যাটা। আমরা পরের খেতে মজুর খাটিতবে আমাদের পেট চলেআমরা কুথায় জমিন পাব।

বিরজু অনেকক্ষণ চুপ করে রইলতার গলা থেকে স্বর বের হচ্ছিল নাবিনিয়া তাকিয়েছিল ছেলের দিকেতোর এমন চেহারা হয়েছে কেনে রে বাবা? আয় তোকে ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াই

বিরজু শোনে নাতাকে মাইলের পর মাইল যেতে হবে জমিন মাগতে

শোনা যায় হরিণপুরার দিকে এক সাধু এসেছিল জমিন ভিক্ষা করতেতাকে ভালো লেগে যায় বিরজুরসে চ্যালা বনে যায় সাধুরতারপর থেকেই সে দাড়িবাবা

এরপর অনেকদিন কেটে যায়কোথায় এক জোতদারের কাছে জমিন চাইতে গিয়ে লাঠির ঘায়ে আহত ও রক্তাক্ত হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকে বিরজুজোতদারের লেঠেল বাহিনী তাকে মাথায় হাতে পায়ে সর্বত্র বেধড়ক মারেরাস্তা থেকে তুলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয় কয়েকজন যুবকতারপর খবর দেয় বিনিয়াকে।হাসপাতালের বেডে শুয়ে বিরজু তখনও বলে চলেছেজমিন দাও।জমিন দাওআমি দেশ থেকে দেশ ঘুরেছিজমিন নেই মানুষের হাতেগরীব ভুখা মানুষকে জমিন দাওই আকাশ , ই বাতাস ই জমিন কারোর একার লয়ই ভগবানের দান।ই সব পরমেশ্বরের। সব মহারাজেরজমিন তার হাতে দাওবাবা নিজের জন্য চাইছেন নাভুখা মানুষের জন্য চাইছেন। আজ ভালয় ভালয় দিয়ে দাও, নইলে কাল লড়াই হবেএই মাই , তুই কি দিবি দে? বাবা চলে যাচ্ছে

 

বিরজুর গলার আওয়াজ ক্রমেই ক্ষীন হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছিলবিনিয়া বলল- লড়াই কেন হবে রে ব্যাটা ? আমার কাঁথা বিছানা, চাদর ধোতি, ছেঁড়া খাট যা আছে সব সব তোকেই দিলাম

বিরজু আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না, সে তখন মালিকানাহীনএক অনন্ত ঐশ্বর্যের দেশে পা রেখেছেযেখানে জমিন অবাধ , আলহীন এবং কারও কুক্ষিগত নয়

 

 

লেখক পরিচিতি

হিন্দী ভাষার বহুচর্চিত এবং প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক হিমাংশু যোশীর জন্ম ৪ মে ১৯৩৫ উত্তরাখণ্ডের আলমোড়া জেলার যোশজুড়া গ্রামেবাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীছোটবেলা কেটেছে অসহনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে তবু অপরাজেয় মনোবল তাঁকে জয়ী করেছে জীবনের লড়াইয়েহিন্দুস্থান সাপ্তাহিকে দীর্ঘ ২৯ বছর সিনিয়ার জার্নালিষ্ট হিসেবে কাজ করেছেন।পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত wagrath পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন

বেশ কিছু উপন্যাস ১৮টি গল্পগ্রন্থের পাশাপাশি ৩টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন২৪টিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যসম্ভারদেশে বিদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচি এবং গবেষণার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর সৃষ্টি

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-

 তুমহারে লিয়েতিন তারেঅগ্নিপর্বছায়া মত ছুনা মনকগার কি আগনঙ্গে পাবো কা নিশান সহিত আঠারহ কহানীমনুষ্য চিহ্ন তথা অন্য কহনিয়াঅন্ততঃ তথা অন্য কহনিয়া

জমিনগল্পটি তাঁরঅন্ততঃগল্পের রূপান্তর।  

 

No comments:

Post a Comment