Wednesday, August 4, 2021

 পথ গুলিয়ে ফেললে 

সব্যসাচী ঘোষ 



আমাদের সেই ছেলেটির নাম হত দিবাকর। আরো অনেকের মত লিখতেই এসেছিল সে। তাঁর বাড়িটি হত রাজ্যটির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক একমাত্র কেন্দ্রটির থেকে প্রায় ৭০০ কিমি দূরের আধা মফস্বলে। সবার মত একটি নদীও ছিল তার। কি জানি তারই নাম হয়তো কালজানি।  

গত শতাব্দীর ৫০এর শেষ দিকে সে জন্মেচ্ছে। ইস্টিশনের কাছেই, হবে কোন এক রেল কোয়ার্টার। বাবা অনেকটা কিনু গোয়ালার গলির বাঁশি কবিতার নায়ক। আলো জ্বালাবার দায় বাঁচাতে গাছ গাছড়ার ব্যবসা খুলতেন।

কিশোরবেলায় বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শুনে ফেলত দিবাকর। তাই সে তখন আর সবাই এর মতন একটা অন্যরকম যৌবনকালের জন্যে ছিল অপেক্ষারত। অন্যরকম মানে অন্যরকম। যেখানে অন্য গান হবে, অন্য লেখা হবে আর অন্য বই পড়া হবে, লেখকেরাও হবে অন্য। হুড়মুড় করে গর্জন সত্তর উপস্থিত হত এরপরই। সে এক বড় পাগলামোর দশক এবং সে যুবক হত। সময়ের দোষ আজীবনের বদভ্যাসে বদলে যায়। কৈশোরের তারল্যের নেশা যৌবনে পান করত দিবাকর। বইয়ের গন্ধ ভাল লাগত। তাই কি ছাপাখানার অংশীদার হল সে। “যুক্তপ্রয়াস”। বই ছাপা হত, বাঁধাই হত। কম্পোজ কম্পোজ আর কম্পোজ। দিবাকরের আশির দশক চলেছে ছাপাখানার গা বেয়ে। রাত্রিতে ফুটপাথ প্রতি রাতেই বদলও হত।  

অমলকান্তির শেষ পরিণতি দিয়ে দিবাকরের শুরু, কার্যত শেষের শুরুও কি বলা যায় না তাঁকে? দুই দিনের বাসি পচা খবর ট্রেনে করে নামত দিবাকরদের আধা মফস্বলগুলোতে। ক্ষুধার্তের দল সেই বাসি পচাই পড়ত। আশির শুরুতে একজন বিকল্প ভাবলেন। নদীর এপার থেকেই নদীর এপারের খবর ছাপার কথা ভাবলেন। বাজার বুঝতে সমীক্ষা ও সুমারি চলল উত্তরের পাহাড়, বন, চা বাগান, চাষ জমি নিয়ে। দিবাকর সেই প্রত্যয়ী সংবাদপত্রে তখন সমীক্ষক যুবক। আত্মবিশ্বাস বাড়ত দিবাকরের। প্রশ্ন করত দিবাকর, “বই এর জন্ম দিতে ৭০০ কিমি দূরের শহরটিতে ছুটতে হবে কেন?” রাস্তাতে মিসক্যারেজের সম্ভাবনার ভয় পেতই নদীর উত্তরের কাগজ ঘসটানো মানুষেরা। দিবাকর এভাবেই একটি নতুন চাষজমির খবর পেত। “মনচাষা”র জন্ম এরপর হত। তাতে নতুন নতুন বই হত। নোয়াম চামস্কি বলেছিলেন চার কিমি গেলে ভাষা বদলে যায়, দিবাকর তো ভাষার শক্তিনিয়ন্ত্রক মহানগরটির থেকে ৭ শত কিমি দূরে, আর চামস্কির মার্কিন দেশ থেকে ১০ হাজার কিমির বেশি। দিবাকরের এই দূরগামী অবস্থানে হয়তো প্রভাবিত হয়েছিলেন ভাষাবিদ। এরপর চামোস্কি থেকে রামকিংকর বাঁধাই হতেন আধা মফস্বলের লেটার প্রেসে। এই প্রতিবেদকের বাবা সমীরণ ঘোষ তখন ঘোষিত ক্ষুধার্ত। উত্তরের প্রধান শহরটিকে তখন ১০ বছর শাসন করার অভিজ্ঞতা তাঁর। একা নন রাজা সরকার, মনোজ রাউত, অলোক গোস্বামী প্রমুখেরাও অগ্রণী হতেন। জুটি বেঁধে মাঝেমাঝে চলে আসছেন আরেক মফস্বলের ওষুধ বিপণির পরিবারের কবিতা পাগল ছেলে অভিজিৎ পরে অন্যমন। জল শহরে “ক্রুসেড” বাহিনী বিজয় দে এবং সমর রায় চৌধুরী “পাগলাঘোড়া”র সওয়ার হতেন। এদের সঙ্গে দেখা হলে অবাক করতেন দিবাকরই। তীব্র যোগাযোগে সে তখন আন্তর্জাতিক। মিথ্যে আর সত্যি যেন দিবাকরের পাশে দুই বিশ্বস্ত কুকুর। মহানগর তখন তাঁর নিয়মিত গন্তব্যে। বই হল উত্তরের কবির। বই হল দক্ষিণের কবির। বাঙালির চিরন্তন গড়ের মাঠে দিবাকরের বিজয়কেতন উড়তে দেখতে পেতেন অনেকেই। উত্তরের সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হলে সেদিন দিবাকরের ওতবড় স্টল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার পদক্ষেপগুলিও লেখা উচিৎ।    

৯০ এর দশক। যখন কম্পিউটারটাকে ঠিক কতদূরে বঙ্গোপসাগরে ফেললে সে বাংলার ঠিকানা হারিয়ে ফেলবে বলে আলিমুদ্দিন অঙ্ক কষছে ঠিক তখুনি ডিটিপি শব্দের আক্ষরিক প্রয়োগেও দিবাকর হতেন প্রদর্শক। কিন্তু সব হচ্ছিল ব্যবসাটাই শুধু হচ্ছিল না বুঝি। যেখানে শুধু সংস্থার প্রকাশনীর ব্যবসা দেখার একাগ্রতায়  সাহিত্যের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ধরা না দিয়ে ‘পিওন থেকে প্রকাশক’ হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণাঙ্গ দীর্ঘদেহী বাদল বাবু সেখানে শুধু সাহিত্যের আবেগে থরথর কম্পমান দিবাকর স্টলের বই বিক্রির টাকা একেক রাতেই ওড়াচ্ছেন। স্রেফ হিসাবের ভুলেই অংশীদারিত্বে ভাঙন তখন অবশ্যাম্ভাবী। শৃঙ্খল ছাড়া শ্রমিকের হারাবার আর কিছুই নেই স্লোগানকে দিবাকর একটু ভুল পড়েছিল। তাই শৃঙ্খলা লোপ পাচ্ছিল ধীরে ধীরে।   

ফলত যে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি নার্ট বল্টু নিয়মিত তৈল মর্দনে ঘোরে সেখানে দিবাকর কিঞ্চিৎ শুষ্ক হচ্ছিলেন। ক্রমশ আরও শুষ্ক। ভাল মানুষের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেও বোধহয় তীব্র অস্বস্তি হচ্ছিল ওঁর। বিয়ের পর তিন সন্তান। কিন্তু অপত্য স্নেহ জাগলো কই। এ ব্যর্থতা কার। নিশ্চিত পিতার। টাইটানিকের সঙ্গে হিমশৈলের ধাক্কা তখনই লেগে গিয়েছে।

এদেশ শিল্পীর জন্যে কেন কোন মমার্ত বানানো হয় না? বিডিও অফিস কেনো দ্যায় না প্রকাশকশ্রী, কবিশ্রী, লেখকশ্রীর দুয়ারে ভাতার ফর্ম? এপোড়া দেশ যে সেসব দেবে না সেকথা বহুদিন আগেই বুঝে গিয়েছিলেন এক দিদি। রবীন্দ্রনাথের যেমন ছিল “এক কর্মভারে অবনত অতি ছোট দিদি” এখানেও তেমনি থাকেন এক দিদি। দিবাকরের আঙুল যিনি ছাড়েন নি। জীবনের সবটা সঞ্চয় একসময়ে দিবাকরকে তুলে দিয়েছিলেন। শূন্যের দশক হত সেটা।


(দিবাকর ভট্টাচার্যের তিনটি কবিতার বই, ‘কলম্বাসের মোম’ , ‘খাকি বাতাসের কবিতা’ এবং ‘কথা উপকথা’।

দুটি গদ্যের বই “নির্দিষ্ট নাথ” এবং ‘ভাগাভাগির সময়’।)


(পরের সংখ্যায় শেষ কিস্তি)

1 comment:

  1. দারুণ সুন্দর লেখা।অনেক দিন দেখা হয় না।যাবএকদিন।
    খুব নির্মোহ ভাবে লিখেছিস।শৃঙ্খল ও শৃঙ্খলার জায়গাটাও চমৎকার। বললি আবার বললিও না। কলাবাড়ির পথ----
    দিবাকর দা স্বপ্ন দেখার সাহস করেছিল। আমাদের স্বপও নাই সাহসও নাই।

    ReplyDelete