Tuesday, August 3, 2021

 ঝুরোগল্প




কাজল সেন 


যখন একা 


অনেক চিন্তাভাবনার পর মিষ্টুনি শান্তাপ্রসাদকে বলল, আমার মনে হয়, আপাতত কিছুদিন আমাদের আলাদা আলাদা থাকা ভালো। অনেকদিন তো একসঙ্গে থাকলাম! দিনে দিনে তিক্ততাই শুধু বেড়েছে, কিছুটা একঘেয়েমিও বাসা বেঁধেছে। কিছুদিন দূরে দূরে থাকলে হয়তো আমাদের সম্পর্কের এই অচলায়তনতা কেটে যেতেও পারে। তুমি কী মনে কর?

শান্তাপ্রসাদ খুবই শান্ত প্রকৃতির। শান্ত স্বরেই বলল, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কে তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই, কোনো চুক্তিও হয়নি! আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল, যতদিন একসঙ্গে থাকতে চাইব, থাকব। যেদিন চলে যেতে ইচ্ছে করবে, চলে যাব। আজ তোমার যদি মনে হয়ে থাকে, চলে যাবার সময় হয়ে গেছে, চলে যেতে পারো।  

মিষ্টুনি বাধা দিয়ে বলল, আমি কিন্তু একেবারে চলে যাবার কথা বলিনি। কিছুদিন আলাদা আলাদা থাকার কথা বলেছি। 

-তাতে কী লাভ হবে? আমাদের সম্পর্কের তিক্ততা বা একঘেয়েমি কেটে যাবে?  

মিষ্টুনি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি কিন্তু তোমাকে কোনো দোষারোপ করছি না। তিক্ততা বা একঘেয়েমি প্রত্যেকের নিজস্ব মনের ব্যাপার। আমার মনে হচ্ছে, আমার কিছুদিন একা থাকার খুব প্রয়োজন। আমি স্বেচ্ছায় একাকীত্বকে উপভোগ করতে চাই। 


শান্তাপ্রসাদ বোঝে, সম্পর্কের সমীকরণ যদি সরল না হয়ে ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে, তাহলে সম্পর্কের বাঁধনটাই আলগা হয়ে পড়ে। জোর করে তা বাঁধতে গেলে তিক্ততা ও একঘেয়েমি এসে বিরক্ত করবেই। সম্পর্ক গড়ে তোলার আগেই তাই  মিষ্টুনি ও শান্তাপ্রসাদ কথা বলে নিয়েছিল, তারা কোনো বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হবে না, সন্তানের বাড়তি বোঝাও বহন করবে না। মিষ্টুনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত  ছিল, কেননা সে সন্তানধারণে অক্ষম ছিল, কোনো একটা জটিল শারীরিক কারণে জরায়ু বাদ দিতে হয়েছিল। শান্তাপ্রসাদকে সে কথা জানিয়েছিল। কথাটা জেনে খুশিই হয়েছিল শান্তাপ্রসাদ। 


মিষ্টুনি স্বভাবতই খুব নরম মনের মেয়ে। শান্তাপ্রসাদের শান্ত প্রকৃতির আশ্রয়ে স্বস্তিবোধ করেছিল। দুজনেই যথেষ্ট শিক্ষিত এবং দুটি আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে উচ্চপদে কর্মরত। সারাদিনে কেউ কাউকেই নিকট সান্নিধ্যে পায় না। যেটুকু সান্নিধ্য তা গভীর রাতের শয্যায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন তারা অবশ্য একসঙ্গেই কাটায়। কোথাও বেড়াতে যায়, অভিজাত রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ-ডিনার করে, মদ্যপান করে। এভাবে একরৈখিক জীবন অতিবাহিত করতে করতে কখন যে উৎপাত করতে শুরু করে তিক্ততা ও একঘেয়েমি, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মিষ্টুনি। একটু একটু করে সে হাঁফিয়ে ওঠে। মনে হয়, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর যেন টানতে পারছে না নিজেকে।  


শান্তাপ্রসাদ বলে, তুমি আমার থেকে দূরে একা থাকতে চাইছ, ভালো কথা। কিন্তু তুমি কি মনে কর, একা থাকলেই তোমার মনে একাকীত্বের বোধ জন্মাবে? 

মিষ্টুনি বলে, তা আমি জানি না। আজ প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল, বিয়ে না করেও আমরা একসঙ্গে আছি। এরমধ্যে কোনোদিন আমি তোমাকে ছেড়ে একা থাকিনি। কিন্তু কী জানো, একসঙ্গে থেকেও তো আমরা মনে মনে এতদিন  একাকীত্ব বোধই করেছি। এবার তাই চাইছি দূরে সরে থেকে সেই একাকীত্ব উপভোগ করতে। 


 

1 comment: