Monday, August 2, 2021

বিকাশ দাস ( বিল্টু ) -এর ধারাবাহিক গদ্য






ফেলে আসা স্মৃতি ও অমরের মা : দেশভাগ ও টুকরো টুকরো ছবি


                   ( এক )

                অমর এর মা এক বর্ণময় চরিত্রের অধিকারীনি। আমাদের প্রতিবেশী। জন্ম ওপার বাংলায়। ওপার বাংলার ময়মনসিংহ জেলার পুলের ঘাটে। বয়সের ভারে এখন নুজ্ব্য তার শরীর। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটেন। কোমর-হাঁটু একাকার। কানে কম শুনেন।  কদমছাট চুল।

        মায়ের মুখে শুনেছি তিনি মনের পর মন ধান ভেনেছেন গাইলে। সারারাত ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করেছেন। আসরে আসরে গীত গেয়েছেন। স্বামী মারা যাওয়ায় পরে মাঠে মাঠে কোদাল চালিয়েছেন। কি বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা!- সব লেপ্টে রেখেছেন শিথানের তলে।

         বয়স আশি ছড়ালেও কি হবে। চোখের উজ্জ্বল দ্যুতি বর্তমান। ছেলে-পুলে, নাতি-পুতির ভরা সংসারে এখনও নিজেই নিজের কাজ করেন। কাঁথা সেলাই করেন নতুন নাত বউ এর সাধের খবর শুনে। 

          সেলাই করতে করতে মাসির মুখে ফুঁটে ওঠে আলোর আভা। আমরা জট বেঁধে সন্ধ্যায় গোল হয়ে বসি। দেশভাগের গল্প শুনি। কাঁটা দিয়ে ওঠে শরীর। শিহরিত হই। দপ করে নিভে যেত কুপির আলো। দমে থাকেননি মাসি। গড়গড় করে বলেই যেতেন অতীত আয়নার স্মৃতির জলছবি। কিশোরগঞ্জ ও মাইঝাটি। পুলের ঘাট। হাওয়র বাওর। সারি সারি সুপারি বাগান। টিনের ঘর। লেপা উনুন ও আগুন। 

             সেই আগুনের আঁচ বুকে নিয়ে ডিঙি নৌকায় ব্রহ্মপুত্র পার। ব্রহ্মপুত্র এর ওসার জলে অথই ঢেউ। ঢেউ সামলে ট্রেন। ট্রেনে করিমগঞ্জ। চেকপোস্ট। খোয়া যাওয়া সোনা দানা। ব্লাউজের ভিতরে বগলে রাখা এক দলা সোনা, শেষ সম্বলটুকু হাতে করে এখানে এসে থিতু হওয়া। 

                  আজও কথায় কথায় তিনি আয়ুব খানের বলেন কথা বলেন। যোগেন মন্ডলকে খুব ভালো করে জানেন। স্মৃতি সত্তায় ভেসে ওঠে কত কথা। পুলের ঘাটের পাগলটার কথা তিনি কথায় কথায় বলেন। 
                   ' লাগলো গুলি পুলের গাঁট '


                         ( দুই )

            আদতে অমর এর মা আমাদের দূর সম্পর্কের মাসি। মাসির অসম্ভব সুন্দর ছিল গানের গলা। এখনও বিড়বিড় করে গান। ময়মনসিংহ গীতিকা প্রায় মুখস্থ। প্রথাগত পড়াশোনা ছাড়াও তিনি অবলীলায় বলে দিতেন গানের কলি। 

              আমরা মাসির কাছে সন্ধ্যায় আসর জমাতাম। তখনও কারেন্ট আসেনি। কিচ্ছা শুনব বলে গোল হয়ে বসে কুপি বাতির আলোতে মাসিক ঘিরে ধরতাম। মাসি কি সুন্দর করে হাস্তর বলতেন। এখন বড় হয়ে বুঝেছি মাসির কথাগুলো আদতে ময়মনসিংহ প্রবাদ বাক্যের অংশবিশেষ। 

               ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মাসি গাইতেন:
          আমরার আবু কান্দে রে হউর বাড়ি যাইতো
          আম দিতাম কাডল দিতাম ফতফত খাইতো

              - সত্যি সত্যি সেই বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পড়তো। মায়া ম্যাজিকের মত কাজ করতো মাসির সুর। সুর করে গাওয়া কলিগুলি। 

                রাগে গজগজ করে পাশের বাড়ির বউকে ঝাড়ি মারার সময় মাসিকে বলতে শুনি: 

           '  দুইদিনের বৈরাগী / বাতেরে কয় অন্ন '

বলেই মাসি ফিক করে হেসে উঠতেন। মুখে পান দিয়ে চুনটা বেড়ার কোণে মুছে আমাদের বলতেন : ' শুনবি তোরা। যা আইজ রাইত হইছে। গুমা। '

 
আমরা মাসির মুখেই শুনেছি -

' গিরস্থ ভাই মইরা গেলে
বাড়ি পড়ে পরা
কেউ বা টানে চালের ছন
কেউ বা টানে বেড়া '

                বুঝতাম না এর ভাবার্থ কি। এখন সময়ের দোরগোড়ায় বুঝতে বাকি নেই। সত্যি স্বামী মারা যাওয়ার পরে নানান প্রতিবন্ধকতা জেভাবে ঘিরে ধরে। 

               মাসি সময় পেলেই নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসতেন। দেশকে ভীষন ভাবে ভালোবাসতেন। ওপারের অনেক কথা আজও মনে করার চেষ্টা করেন। অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর যন্ত্রনা কাটিয়ে ওঠার আগেই এপারে আসার কিছুদিন বাদে স্বামীকে হারানোর শোক তাঁকে পেয়ে বসে। তীব্র যন্ত্রনা যেভাবে ঘিরে ধরে। বদল হয়নি একটুও ভাগ্যের। তাই হয়ত তিনি বলতেন-
             ' যতই করো অচি মুচি
              কপালে আছে আদকুছি '

1 comment:

  1. দাদা অনবদ্য ��❤️
    -মিন্টু দাস

    ReplyDelete