Tuesday, January 30, 2018

গল্প : অর্ক চট্টোপাধ্যায় 

উড়োজাহাজ ও মৃত্যু: একটি ব্যক্তিগদ্য

অর্ক চট্টোপাধ্যায়  


উড়োজাহাজের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছিল। আকাশে উড়তে উড়তে এক সময়ক্ষেত্র থেকে আরেক সময়ক্ষেত্র পেরিয়ে যাওয়ার সময় হারিয়ে যাচ্ছিলো জীবন, মুছে যাচ্ছিলো দোনলা আকাশের বুকে। দুটো দেশ, দুটো অঞ্চল, দুটো ভৌগোলিক সময়ক্ষেত্রের মধ্যিখানে একরাশ শূন্যতা। বিমান থেকে দেখা অগাধ জল। দেখছে তো দেখছেই, জলের কোনো শেষ নেই যেন। ডানার জন্য কাতর চোখের সামনে জলের ওপর জল। জলের নীচে জল। সময়ের বাইরে সময়। বছরের বাইরে বছর। 

লোকটা কোনোদিন জানতে পারেনি তার কাছে সময়টা ঠিক কি ছিল, যখন তার মা মারা যায়। মা মারা যায় ভারতীয় সময়ে। লোকটা তখন অতলান্তিক পেরোচ্ছে। সময়ক্ষেত্রের হিসাবে ঠিক কোথায় ছিল সে, যখন তার মা চলে যায়। উড়োজাহাজ সময় মুছে দিয়েছিল। মার মৃত্যুমুহূর্তটা তাই কোনোদিন কোন নির্দিষ্ট সময়ে স্থাপন করতে পারেনি লোকটা। শুধু এইটুকু বুঝেছে, উড়োজাহাজের সঙ্গে মৃত্যুর কোনো এক যোগ রয়েছে। 

তারপর আবার। ইন ট্রানজিট মৃত্যুসংবাদ। অ্যান্ড দ্য সেকেন্ড ফ্লাইট বিকেম আ ফ্লাইট ইন মেমোরি। এবার অবশ্য সময়ক্ষেত্র অপাঠ্য ছিল না। ভারতীয় সময়ে যখন মৃত্যু নেমে আসে, লোকটা তখন ক্রাফটে বসে। সঙ্গে ফোন না থাকায় খবরটা পরে আসে। ইন ট্রানজিট। কানেক্টিং ফ্লাইটে বসে বসে 'ক্রাফট' শব্দের অন্য অর্থ নিয়ে ভাবতে থাকে লোকটা। বিমান তাকে লেখার দিকে নিয়ে যায়। মৃত্যুর জন্য লেখা। মৃত্যুর মত। দ্য ক্রাফট অফ ফ্লাইট। দ্য ক্রাফট ওফ ডেথ। 

লোকটার কাছে দুটো মৃত্যুর মধ্যে সংযোগ শুধু বিমান ছিল না। প্রথম সময়-অনির্ণেয় মৃত্যু লোকটার মায়ের আর দ্বিতীয় সময়-নির্ণেয় মৃত্যু তার ছোটদাদুর। মা অনেকাংশেই বড়ো হয়েছিল এই মানুষটার কাছে। শেষজীবনে নিজের বহুবিধ অসুস্থতার মধ্যেও ওঁর স্বাস্থ্য নিয়ে মাকে চিন্তিত হয়ে পড়তে দেখেছে। মা মারা যাওয়ার পর ছোটদাদুর মৃত্যু লোকটার কাছে তাই দুশ্চিন্তার মৃত্যু। মার দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ নেই। মানুষ নেই। স্বাস্থ্য নেই। নেই দুশ্চিন্তাও। 

যদিও লোকটা নবারুণ নয়, তবু নবারুণের 'পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট' গল্পের শিরোনাম মনে পড়ছিল। তার ছোটদাদু তার দেখা অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময়কার আজন্ম মার্কসিস্ট। আমৃত্যু। লোকটাও বামপন্থী, তবে কমিউনিস্ট পার্টি করেনি। লোকটা যতদিনে বড় হয়েছিল, সে পার্টি বোধ হয় শুধু নামেই কমিউনিস্ট ছিল। তাই নিয়ে একটা সময় কিছুটা মনোমালিন্যও হয়েছে ওর ছোটদাদুর সঙ্গে। সময়ের ব্যাপার। সময়ে কেটেও গেছে। ছোটদাদু বলতে লোকটার কাছে পান্ডব গোয়েন্দার গল্প, যার লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ওঁর বন্ধু। ছোটবেলায় ছোটদাদুর বাড়ি গেলেই পাওয়া যেত নতুন পান্ডব গোয়েন্দার বই। তারপর একসময় লোকটা বড়ো হয়ে গেল। পান্ডব গোয়েন্দা বড়োই সরল মনে হতে লাগল। লোকটা জটিল হয়ে উঠছিল। তবু তার জটিল শরীরের জন্য সহজ জহরকোট নিয়ে পুজোয় পুজোয় বাড়ি চলে আসতো ছোটদাদু। যতদিন পর্যন্ত ওঁর চলচ্ছক্তি ছিল। জহরকোট আর পান্ডব গোয়েন্দার কথা বারবার ফিরে আসছিল মৃত্যুর ছায়া পড়া ওই দ্বিতীয় বিমানযাত্রায়। 

অনেক কষ্ট করে বানানো বৃদ্ধাশ্রমে একাই থাকতো ছোটদাদু, ছোটদিদা চলে যাওয়ার পর। ১০০ টা ডায়ালিসিস হয়েছিল সব মিলিয়ে নাকি ১৫০টা? লোকটা ঠিক জানে না। তবে অনেক। অনেক। শেষের দিকে যতবার গেছে দেখা করতে, লোকটার মনে হয়েছে এই বুঝি শেষ দেখা। কিন্তু শেষ দেখা কি আর হয়? দেখা হয় শেষ হয় না নয়তো শেষ দেখা অধরা থেকে যায়। তবে লোকটার মগজে ঘর করে রয়েছে স্পর্শস্মৃতি। 

ডায়ালিসিসের রক্ত বইছে ছোটদাদুর শরীরে। হাতের ওপর যেখানে ইনজেকশন আর চ্যানেলের দাগ, সেখানে টগবগ করে রক্ত আসাযাওয়া করছে। অন্যের রক্ত। যেন অতিশয়োক্তির উচ্ছাসে ঘোষণা করছে, 'তোমার শরীরে বইলেও আমি তোমার রক্ত নই!' রক্তের অপরতায় আবছা হয়ে আসছে অবিভক্ত কমিউনিস্টের চোখ। শরীর বিভক্তিকরণের কথা বলছে। লোকটার মায়ের শরীরে মৃত্যুর শেষ দস্তক ছিল রক্তের এই অপরতা।  ব্লাড ট্রান্সফিউশন থেকে হেপাটাইটিস সি-এর বীজ ঢোকে অসুস্থ শরীরে।   

এই স্পর্শস্মৃতি রয়ে যাবে লোকটার কাছে। কার রক্ত কার শরীরে প্রাণ নিয়ে আসবে আর কার শরীরে মৃত্যু, তার অ্যালকেমি সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের মতো অনির্ণেয়, অনাগত এক সময়ক্ষেত্র। উড়োজাহাজ হয়তো কোনো একদিন তেমন কোনো রানওয়েতে নামবে। যেখানে মৃত্যু আর সময় বিভেদবিন্দুতে স্থাপিত হয়েছে।

উৎসর্গ: অমিয় চট্টোপাধ্যায় 

গান্ধীনগর, ২০১৮।
চিত্র ঋণ : Edvard Munch

1 comment:

  1. পড়লাম । মৃত্যু তো বিমান হানার মতো । শুরু আর শেষে গল্পের আবছায়া । মধ্যশরীরে রক্তস্রোতের মতো স্মৃতির উজান । ভালো ।

    ReplyDelete