Tuesday, January 30, 2018

কবিতা বিষয়ক গদ্য : অনিন্দ্য রায় 







  বিশেষ্য কবিতা : স্মৃতি ও সম্ভাবনা  
অনিন্দ্য রায়


        “রাস্তা
বাস
ট্রাম
গাড়ী
        #
রাস্তা
ফুটপাত
দোকান
আলো
চিৎকার
#
রাস্তা
ফেরিঅলা
মানুষ
#
  রাস্তা
রাস্তা
রাস্তা”
   (রাস্তা / পুষ্কর দাশগুপ্ত)
 এই কবিতাটিতে, ব্যাকরণের প্রেক্ষিতে দেখলে, বিশেষ্য ছাড়া আর কোনো পদ নেই । এবং অন্য কোনো পদের সাহায্য ছাড়াই কবিতাটি সম্পূর্ণ ।
“ যে শব্দে কোনো ব্যক্তি, বস্তু, স্থান, জাতি, গুণ, ধর্ম, অবস্থা, কার্য, সমষ্টির নাম বুঝায়, তাহাকে বিশেষ্যপদ বলে ।
 বিশেষ করিয়া বলা হয় বলিয়া নামটি বিশেষ্য । আর, একটিমাত্র শব্দের দ্বারা কাহাকেও বিশেষ করিতে হইলে তাহার নামটি বলা ছাড়া উপায় নাই । সুতরাং ‘বিশেষ্য’ কথাটির অর্থ হইতেছে কোনোকিছুর নাম ।”
বামনদেব চক্রবর্তী
এই বিশেষ করে বলতে গিয়ে ওই একটিমাত্র শব্দে যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তার কোয়ালিটি ও অ্যাকটিভিটির ম্যাক্সিমাম যতটা সম্ভব নামের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা যায় প্রয়াস থাকে সেটাই। অন্যন্য পদগুলির ব্যবহারও বিশেষ্যকেন্দ্রিক। বিশেষ্যকে রিপ্লেস করার জন্য সর্বনাম, একে কোয়ালিফাই করার জন্য বিষেষণ, এর অ্যাকশন বর্ণনা করতে ক্রিয়াপদ । কিন্তু এই অন্যন্যদের বাদ দিয়েও বিশেষ্য নিজেই নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। কারণ প্রতিটি বিশেষ্যর গায়ে লেগে থাকে তার সংস্কারগত অর্থ ।  ভাষাতাত্ত্বিক Ferdinand de Saussure চিহ্নের অযৌক্তিক চরিত্রের ( arbitrary nature of signs ) কথা বলেছেন যেখানে  signifier ও signified-এর মধ্যে যুক্তিসিদ্ধ সম্পর্ক নেই, মানুষের ভাষাতে ধ্বনি ও অর্থের মধ্যের সম্পর্ক, তাঁর মতে arbitrary । ভাষাকাঠামোর এই মৌলিক দর্শন মেনে নিয়েও আমরা জানি,ধ্বনি → শব্দ → অর্থ, ও এই তিনের সম্পর্কবিন্যাসের ভেতরেই আমাদের ভাষা ও ভাষাভিত্তিক কমিউনিকেশনের ভিত্তি রচিত হয় । ‘গোলাপ’ বললে আমরা একটি নির্দিষ্ট ফুলকেই বুঝি, শুধু নামই নয়, তার আকার ও গন্ধের আভাসও পাই। ‘গাড়ি’ বললে তার চলমানতার ধারণাও আসে একইভাবে । বিশেষ্য, কেবলমাত্র বিশেষ্য কোনোকিছুকে ‘বিশেষ’ ভাবে ব্যক্ত করে বাক্যের সম্পূর্ণভাব প্রকাশ করতে পারে । একইভাবে কেবলমাত্র বিশেষ্য দিয়েই প্রকাশিত হতে পারে কবিতা, আমরা বলি নাউন পোয়েট্রি, বিশেষ্য কবিতা । যেভাবে একটি স্টিল ফটোগ্রাফ হয়, যেভাবে একজন পেইন্টার স্টিল লাইফ আঁকেন , অবজেক্টগুলো কম্পোজ করা হয় নির্দিষ্ট ভাবে আর তা তৈরি করে অনির্দিষ্ট অর্থ।  ভাষাগতভাবে অবজেক্ট তো নামই ,  নাউনই। সেইভাবে , নাউনগুলোর অবস্থান তৈরি করবে কবিতাকে । কবি ব্যবহার করবেন কোলাজ ও মন্তাজের টেকনিক ।
“ফুল
 গন্ধ
 হাওয়া
 নেশা
 ঘুম”
( মিড় - ২২ / সজল বন্দ্যোপাধ্যায় )
ভাববাচক বিশেষ্য ( abstract noun) -এরব্যবহার কবিতাটিকে বিমূর্ততাও দেবে। ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য ( verbal noun)  নিয়ে আসবে ক্রিয়াশীলতাকে ।
কিন্তু আকর বিশেষ্যটি মাত্র নয় । ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তাকে প্রয়োগ উপযুক্ত করে নিতে হয়।
“ এই ধরণের শব্দ বিভক্তিযুক্ত হইয়া বাক্যে প্রযুক্ত হইলেই তাহাকে বিশেষ্যপদ বলে।”
বামনদেব চক্রবর্তী
শুধুমাত্র নামগুলি পরপর নয়। তাদের মধ্যে সম্পর্কও স্থাপিত হয় এইভাবে।
“চোখ
নীচে ক্লান্তি
ভেতরে ভয়
পাতায় ভালোবাসা।
( ঋক্‌ অথবা শায়েরী, ১ / ঈশ্বর ত্রিপাঠী)
“ পরবর্তী বিশেষ্যের সহিত কোনো সম্বন্ধ থাকিলে ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তিযুক্ত পুর্ববর্তী বিশেষ্যপদকে সম্বন্ধপদ বলা হয় ।”
বামনদেব চক্রবর্তী
“গভীর রাত
তীব্র গতি
         খড়ের গাড়ি
        গরুর চোখ
                 গাছের গুঁড়ি
                 খড়ির দাগ ।।”
(দ্রুতি / সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
 ‘ গভীর’ ও তীব্র – এই দুটি বিশেষণ বাদ দিলে কবিতাটি বিশেষ্য দিয়েই রচিত, কয়েকটি সমন্ধপদ ।
  কিছু বিশেষণ আর মূলত বিশেষ্য দিয়ে রচিত এই অংশটি।
                 হাড় । নিঃশ্বাস । লৌহ শলাকা ।
সাধারণ পথ ।
ছাই, নদীখাত
শুকনো, দগ্ধ ।
কালো ছাইঢাকা
                   চোখ ।
        ....
( ধ্বংসভূমি / জয় গোস্বামী)

আবার ‘ছাড়াতে ছাড়াতে’ এই ক্রিয়াপদ, ‘আর’ এবং ‘ তারপর’ এই অব্যয় বাদ দিলে এই কবিতার বাকি সব শব্দই বিশেষ্য।
টুথপেস্ট । সাবান । তোয়ালে । চা । টোস্ট । সিগারেট
পাইপ । সিগার । ট্রেন । ট্রাম । বাস । ব্যাকরণ ।
ঠাট্টা-ইয়ারকি । টেলিফোন । সাহিত্যের ইতিহাস ।
সিগারেট । পাইপ । সিগার । চা । জর্দা-পান । মা ।
দোকানবাজার । বাড়ি । বউ । তারপর । ঘড়িতে
এলার্ম । তারপর । তোয়ালে সাবান টুথপেস্ট । টোস্ট  চা ।
সিগার পাইপ সিগারেট । পিঁয়াজের খোসা ছাড়াতে
ছাড়াতে সবটাই পিঁয়াজ । আর পিঁয়াজের খোসা । হরতন
রুইতন চিড়িতন ইস্কাপন। রুইতন চিড়িতন ইস্কাপন হরতন ।
তারপর । তারপর । তারপর ....
(ভ্রমণবৃতান্ত/ সজল বন্দ্যোপাধ্যায় )
এক নতুন সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা, নাউন পোয়েট্রি, বিশেষ্য কবিতা বা নাম কবিতা। শুঘু বিশেষ্যটুকু না তাতে বিভক্তি যোগ করবেন সে সিদ্ধান্ত কবির নিজস্ব। আর সমসাময়িক ভাষায় ও সাহিত্যে বিশেষ্য-বিশেষণ-ক্রিয়াপদ নির্দিষ্ট খোপে খোপে ব্যবহৃত হয় না । ‘নীল’ শব্দটি বিশেষণ হিসেবে যেমন ব্যবহৃত হয় , হতে পারে একটি রঙের নাম হিসেবেও।  এখানে ব্যবহার হবে  কেবল বিশেষ্য হিসেবেই।
“অম্লজান , ক্ষরজান

লৌহ ,তাম্র , দস্তা , সিসা , স্বর্ণ , রৌপ্য

কামনা , কুসুম

ক্ষুধা , তেষ্টা"
                              ( একটি তেঁতুল পাতায় এর বেশি সুজন ধরে না )       •


হ্যাঁ, কবিতা এভাবে হয় ?
“হরতন      ময়ূর, ঘুঘু, ছাতারে

ইস্কাবন     শালিখ, চড়ুই, হাট্টিমা

চিড়িতন     কবুতর, টিয়া, দাঁড়কাক, বেনে-বউ

রুইতন     ডাহুক, পানকৌড়ি, প্রেম”
( আমার হাতের তাস )       •
এভাবে হয় না?
“চারা, অনিদ্রা, অশ্রু, কোদাল, খুরপি, পাপ, অস্থি, নাস্তি, মৃত্যু, বীজগণিত, ধারাপাত,         বর্ণপরিচয়, চুম্বন, শোণিত, সাপুড়ে, ফুসফুস,ম্যান্ডোলিন, গীতবিতান, প্যাস্টেল, প্রেমিক, ধরিত্রী, জন্ম, শয্যা, জ্বর, জলপটি,  রৌদ্র, জ্যোৎস্না, প্রজাপতি . . . .”
( বাগান করতে যা যা লাগে )       •
    কোনো সীমাবদ্ধতাই স্বীকার করেন না কবি। ভাবনার, কল্পনার, ভাষার, পার্টস অফ স্পিচের, প্রকাশভঙ্গীর, আঙ্গিকের সমস্ত লিমিটেশন পেরিয়ে যেতে চান তিনি। পেরিয়ে যানও। জেদ করেন যে কনো ধরণের কাব্যিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে, তাকে অতিক্রম করতে। সেরকমই একটা চ্যালেঞ্জ শুধুমাত্র বিশেষ্য দিয়ে, concrete বা abstract  যে কনো কিছুর নাম দিয়ে,  যে কোনো ধরণের বিশেষ্য দিয়ে রচিত কবিতা যা সবরকমের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠবে।


        ( • চিহ্নিত কবিতাগুলি  নিবন্ধটির লেখকের লেখা )

No comments:

Post a Comment