Tuesday, January 30, 2018

মুক্তগদ্য : জ্যোতির্ময় মুখার্জি



চিত্র ঋণ : Jen Delyth

রুমাল
জ্যোতির্ময় মুখার্জি


(পকেটে একটা রুমাল রেখো ।যদি কখনো থেমে যাই তখন পকেট থেকে রুমাল বের করে একবার নেড়ে দিলেই আবার চলতে শুরু করবো।
………………............ প্রভাত চৌধুরী)


রুমাল শব্দটা শুনলেই অবধারিত ভাবে যে বস্তুটা এসে উপস্থিত হয় তাহলো বিড়াল, যদিও এই বস্তুটির উপর আমার অনীহা চিরকালীন তবু ইদানীং একটি cute বেড়ালী ছানায় মজে গেছি, ভাগ্নীর দৌলতে নাম তার আ্যন্জেলা, তাকে কিছুক্ষণ অন্তত না দেখলে মনটা কেমন নাই নাই করে, আমি প্রমাণিত ভাবে কুকুর ভক্ত।

কুকুরের কথা এলেই আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে যায়, তার একটি বিখ্যাত ডায়ালগ্ আছে,
'ইস্, আমি যদি কুকুর হতাম!!' এই অবিশ্বাস্য চাহিদার উৎসটি বেশ মজার, তখন আমার ইলেভেনের ছাত্র, গুসকরার স্পোর্টিং গ্রাউন্ডে সার্কাস এসেছে, তিন বন্ধুতে গেছি সার্কাস দেখতে, হাতির সুঁড়ের দুলুনি উপেক্ষা করে বসেছি একেবারে প্রথম সারির vip চেয়ারে, সেই extra টাকা খরচের একটি গোপন উদ্দেশ্য ছিল, এখনো সেটা গোপনই থাক। যাইহোক সার্কাস চলেছে, হাতি পেরিয়ে যাবার সময় ভয়ে পালাতে হয়েছে কয়েকবার, সুন্দরীদের চোখে টুকটাক চোখও রাখতে পারছি,(এখন বুঝি তাদের চোখে আমরা ছিলাম নিতান্তই নাবালক)
এমন সময় কয়েকটি কুকুর নিয়ে একটি মেয়ের খেলা শুরু হলো, আ্যলশেসিয়ানের সাথে যুবতীর অদ্ভুত কেমেস্ট্রি, একসময় সে কুকুরটিকে চুমু খেল আর জড়িয়ে ধরলো বুকে.... হঠাৎ বাঁ পাশ থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস 'ইস্ আমি যদি কুকুর হতাম!!!!!'

এই সুযোগে তোমাকে একটা মৌন সন্ন্যাসীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, বয়সে তিনি ছিলেন আমার থেকে অনেকটাই বড়ো, আমার জন্মের সময়ই তো সে পরিপূর্ণ যুবক, আমার ছুটুবেলাটা কেটেছে তার কোলে নয় পিঠে চেপে, তাঁর অগাধ প্রশ্রয় আর কঠোর নজরদারিতেই কেটে গেছে আমার সেই হামাগুড়ি টু হামি খাওয়া বেলা। নাম তাঁর ভুলো (একটাই নাম, স্কুলে ভর্তি হয় নায়, তাই ভালো নাম নেওয়ার সুযোগ ঘটেনি তাঁর)

তিনি ঠিক কুকুর ছিলেন না, মহাপুরুষের আদলে তাঁকে মহাকুকুর বলা যায়, তিনি আমার নমস্য। তাঁর একস্ট্রা ক্যারিকুলার আ্যক্টিভিটিজের অন্যতম ছিল লেগসেক। হ্যাঁ , অতি ভদ্র এই কুকুরটি (থুকুচি, মহাকুকুরটি) লেগসেক বিশারদ ছিলেন, যে কেউ তাঁর দিকে হাত বাড়ালে অনায়াসে বাড়িয়ে দিতেন তাঁর ডান পা, মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে গ্রহণ করতেন অভিবাদন। তাঁর একটি বিষয়ে প্রবল আ্যলার্জি ছিল, ভৌ ভৌ ডাকটিকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন (শাপিত দেবতা !?) মৌন সন্ন্যাসীটি সারা দিন ও রাত ঘোলাটে চোখে মেপে চলতো প্রকৃতিকে চরম ঔদাসীন্যে, অথচ এই সন্ন্যাসীটিই প্রয়োজনে হয়ে উঠতো অব্যর্থ শিকারি, হিংস্র রক্ষক, ভক্ষক নয় কোনোদিন, মড়াই খুলে যখন আমাদের ধান বিক্রি হতো বেরিয়ে আসতো আগুনতি ধেরে ও নেংটি ইঁদুর, কোন ধেরেকে কখনো জীবন নিয়ে ফিরে যেতে দেখিনি, অদ্ভুত তীব্রতায় প্রতিটিকে ধরতো, মারতো, ফেলে দিত খেতোনা,(খাদ্যের প্রয়োজনে ও জীবনের ভয়েই পশুরা আক্রমণ করে, এইভাবে অকারণে হত্যা দেবতা ও তা থেকে মানুষের করায়ত্ব, তাহলে কি সত্যিই তিনি শাপিত দেবতা বা মানুষ ?) কিন্তু অদ্ভুত ভাবে নিংটি বা ছোট ইঁদুরদের মারতো না এরিয়ে যেত, শিশুদের প্রতি তাঁর ছিল একটা গভীর টান, আমাকে কেউ মারতে এসেছে বা কোনো বাচ্চা পড়ে গেছে গরু বা হনুমানের সামনে, আমার বা কোনো শিশুর চিৎকার বা কান্না শুনলেই ক্ষীপ্র ভুলো ধারণ করতো অনরূপ, সে বোবা নয় মৌন জানা যেত তখনই, বিপদ থেকে উদ্ধার করে আবার তিনি উদাসীন মৌন। স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চাদের কাছে সে ছিল প্রিয়, ঢিলের আঘাত কোনোদিন তাঁকে খেতে হয়নি, তিনি সঙ্গে থাকা মানে আমার ও আমাদের বুক ফুলে উঠতো তেরো হাত, ঘোড়ার অভাবে তাঁর পিঠে চেপে ঘোরা ছিল আমার দৈনন্দিন বিলাসিতা।

ঘোড়ায় চেপে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে উদ্ধার করে আনবো এক সুন্দরী(সুন্দরীর ফর্মেনশন তখন শুধুই মুখ) রাজকুমারী, পৌঁছে যাবো ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর দেশে, চাঁদমামা শুকতারা  ঠাকুরমার ঝুলির দৌলতে এমন গোপন ইচ্ছা তখনও বেঁচে ছিল (নেটের আঘাতে চরুই পাখির মতো তখনো হারিয়ে যায়নি আমাদের প্রাকৃতিক শৈশব) ঘোড়া ছিল না কিন্তু ঘোড়ায় চাপার স্বাদটা উসুল করে নিয়েছিলাম আঠারো আনা মোষের পিঠে চড়ে। আমাদের চারটি মোষ ছিল (হালের মোষ), দুটি বাঙালি মোষ, যেমন আমরা দেখি চারপাশে, আর দুটি ছিল তার দেড়গুন ইয়া বড়ো লম্বা(ভাগলপুরী মোষ ?) কিন্তু একেবারে মাটির মোষ, খুব শান্ত। বাকি দুটোর কাছ ঘেঁষতাম না, কিন্তু এই দুটি ছিল আমার খুব প্রিয় এবং আমি তাদেরও। তারা যখন গাড়ি টানতো মনে হতো হাঁটছে, যেন বলতো, ক্যা হুয়া রে ? ইত্নেসি লোড হ্যাঁ না, কুঝ পরোয়া নেহি ....
মুনিষ(গারোয়ান) লাগতো না, ধান বোঝাই করে ছেড়ে দিলেই হলো, অনয়াসে পৌঁছে যেত বাড়ি, আমি শুয়ে থাকতাম বোঝার উপরে, দুলকি চালে আকাশ দেখতাম, কখনো বা জোয়ানের উপরই ডিগবাজি খেতাম(সঙ্গে কেউ থাকতো না, তাই বকুনির ভয় থাকতো না) কখনো বা গারোয়ানের খড়ের চেয়ারে বসে হুকুম দিতাম, হা হোম্ হোম্, ঠকঠকিয়ে উঠতো জোয়ান পাঁচনের বাড়িতে(আঘাতে), তারা চলতো কিন্তু আপন খেয়ালে দুলকি চালে, সাইড্ দিতো ফিতে মেপে, রাস্তার আয়তনটাও তাদের খুঁড়স্থ, বড়ো গাড়ি এলে দাঁড়িয়ে যেত ঠিক সেই জায়গায় যেখান দিয়ে অনায়াসে গলে যেতে পারে আগত অতিথিটি।

বিকেলে মুনিষ কাকু (সম্বোধনে চিরদিন শুধু কাকু) এসে পুকুরে নিয়ে যেত গা ধোয়াতে, আমিও এই সুযোগে চেপে পড়তাম তাদের পিঠে, কাকু তুলে বসিয়ে দিতো পিঠে .....চল মেরে ঘোড়া ঠকঠক ঠকঠক ....

পরে এমন হলো আমি নিজেই আমার প্রিয় মোষদুটিকে খুলে নিয়ে চলে যেতাম পুকুরে, কাকু অন্য দুটিকে নিয়ে আসতো, কাকুকে আর কষ্ট করে পিঠে চাপিয়েও দিতে হতো না, এই কাজটি করতো আমার 'ঘোড়া' নিজেই, মাথাটা নামিয়ে দিত, আমি শিং ধরে উঠে পড়তাম মাথায় তারপর ঘাড় বেয়ে পিঠে, পাশাপাশি যখন চলতো দুজনে তখন এর পিঠ থেকে ওর পিঠে সুরুৎ করে চলে যাওয়াটাই ছিল একটা মজার খেলা। আর হ্যাঁ , আমাদের রাজ্য জয়ে আমরা কিন্তু মোটেই তিনজন ছিলাম না, আমরা থাকতাম চারজন, আমার সেই অভিভাবক সন্যাসীটিও আমার বাঁদড়ামিকে প্রশ্রয় দিয়ে সঙ্গে থাকতো সবসময়।

ক্রমে আমার সাহস বেড়ই চললো, পিঠে চড়েই নেমে যেতাম জলে, রাজকুমার হয়তো ঘোড়ায় চড়েছে, কিন্তু সাঁতরে চলা ভাসমান দুটি মোষের পিঠে ডিগবাজি মারার সুযোগ সে পায়নি, তাই আমার ঘোড়ায় চড়ার অভিজ্ঞতা ষোলো নয় আঠারো আনা। একদিন হলো কি এরকম ডিগবাজি মারতে টুপ করে খসে পড়লাম জলে, ব্যাপারটা কীহলো বোঝার আগেই ভয়ে খেয়ে গেলাম, বাড়িতে জেনে গেলে কীহবে ?! মৃত্যু নয়, মারের ভয়েই আমি খাবি খেতে লাগলাম(গ্রামের ছেলে হয়েও আমি এখনো সাঁতার জানিনা, জানি এটা অন্যায় নয়, এটা একটা ক্রাইম), হাত বাড়িয়ে মোষের পা পেলাম, সেটা ধরেই উঠে আসতে চাইলাম উপরে, কিন্তু এ কী ! আমার প্রিয় সখা দিলো একটা চাট্ (লাথ) মেরে, জলের মধ্যে তাই আঘাতটা গুরুতর ছিল না কিন্তু যেটা গুরুতর ছিল সেটা হলো হাতটা গেল ছেড়ে, এদিকে আমার অবস্থা তখন হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়া সেই ভুঁড়িওয়ালা লোকটার মতো, তেষ্টা ছাড়া জল খাওয়া কিন্তু সত্যিই বিরক্তিকর, যাক বাড়িতে আর মার খেতে হবে না এইভেবে যখন বিরাট একটা স্বস্তির জলজ ঢেকুর তুললাম, ঠিক তখনই কেউ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে মুখোমুখি দাঁড় করালো সেই আদিম ভয়টার, বাড়িতে জানলে কীহবে ? যদিও আমি সেন্সলেস ছিলাম, বুক চেপে জল বার করেছে, অনেক কোলাহল হয়েছে, আমি কিছু জানতেই পারিনি, জ্ঞান ফিরলে আমার প্রথম কথাটাই ছিল বাড়িতে কিছু বলোনা, না বাড়িতে সে ও তারা বলেনি, যিনি বাঁচিয়েছিলেন তিনি কয়েক বছর আগে মারা গেলেন, এটা ছিল লাভ, আর লোকসানটা হলো, ঘোড়ায় চড়ার সাধের সেদিনই ইতি গজ....মুনিষ কাকুর সৌজন্যে।

প্রশ্নটা হলো, আমি তো ছিলাম জলের নিচে, তিনি বুঝলেন কীকরে ? হাত গুনে নয় নিশ্চয় ....তাহলে ?
পরে জানি, আমাকে দেখতে না পেয়ে মোষদুটি হুটোপুটি শুরু করে, আর চিৎকার ...ভোলু ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে , পাশ দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন, মোষেদের হুটোপুটি ও চি়ৎকারে পুকুরের দিকে তাকান, মোষের পিঠে আমি নাই দেখে বুঝে নেন বিপদটা, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন জলে আর ভুলোর সাহায্যে তিনি বুঝে নেন আমি ঠিক কোনখানে আছি, তিনি অদ্ভুত একটা কথা বলেন, তিনি জলে মোসগুলো শান্ত হয়ে যায়, ভুলো ঠিক সেই জায়গায় ভেসে থাকে যার ঠিক নিচে আমি ছিলাম, তাহলে আমাকে কে বাঁচালো ? আমার জীবন তিনটি না-মানুষ আর একটি মানুষের দান। তাঁরা আজ আর কেউ বেঁচে নেই, আমি বেঁচে থেকে বেশ গল্পে করছি তোমার সাথে।

গল্পটা যদিও এখানে শেষ নয়, তবু আজ থাক, রুমালের যে খেইটা হারিয়ে ফেলেছি সেটা ধরা বাকি তো বাকি আছে এখনো........

2 comments:

  1. পশুর প্রতি ভীষন আকর্ষণে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম, বেশ লাগলো...

    ReplyDelete