জীবনানন্দ দাশ // ঈশিতা ভাদুড়ী
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে –
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে –
শম্ভু মিত্রের আবৃত্তিই জীবনানন্দ দাশকে করিয়েছিল কিশোরীর সঙ্গে পরিচয়। যদিও তখন আমার কাছে জীবনানন্দ দাশ সীমাবদ্ধ ছিলেন শুধুই ‘বনলতা সেন’এ। পরবর্তীকালে রূপসী বাংলা, ধূসর পান্ডুলিপি, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, সুদর্শনা ইত্যাদি গ্রন্থ ধীরে ধীরে কবির সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করল।
রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের যে ভাষা ছিল, তার থেকে মুক্ত হয়ে জীবনানন্দ যে ভাষা সৃষ্টি করে গেছেন তাকে সর্বকালের আধুনিক ভাষা বলতে কোন দ্বিধা নেই। তাঁর লেখনীতে নিপুণ বাক্যবিন্যাস আমাদের হৃদয়কে বারংবার আন্দোলিত করে -
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলা লেবুর, করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
- রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হয়ে এই যে তিনি একটি নতুন মোড় নিয়ে এলেন বাংলা কবিতার জগতে, এখানেই তাঁর উত্তরণ। এখানেই তিনি অনবদ্য।
জীবনানন্দকে লাজুক কবি বলা হয়, লাজুক না বলে অন্তর্মুখী কবি বলাটাই যথাযথ। নিজস্ব কল্পনার জগতে ছিল তাঁর বসবাস, সচেতন অন্তর্মুখীতাই তাঁর কবিতাকে দিয়েছে সর্বকালের উচ্চারণ –
মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছুকাল অন্ধকার বিছানার কোলে।
একথা না মেনে উপায় নেই যে, জীবনানন্দ আধুনিক কবিতার মূল কেন্দ্রভূমিতে যে পতাকা উত্তোলন করে গেছেন সেটি তাঁর মৃত্যুর সাতান্ন বছর পরেও কেউ অবনমিত করতে পারে নি। এখনও সেটি অহঙ্কারের সঙ্গেই বিরাজ করছে। বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনা হয় কল্লোল যুগে। সেই সময়ই জীবনানন্দ কল্লোল-গোষ্টীর পরিকাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ ভিন্নধারায় নিজেকে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। সেইসময় তাঁর নীলিমা কবিতাটিই প্রথম সকলের দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৩৪-এ লিখিত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৭তে, সেটি সেই সময়ের দেশকাল সচেতন এক লিরিক, তদানীন্তন বাংলার চিরায়ত রূপ এবং তার সঙ্গে আত্মআবিষ্কারেরও এক অনুভব। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত ‘বনলতা সেন’ তাঁর সার্থকতম অবদান বলে স্বীকৃত।
যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হলে
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য করে চলে...
তাঁর কাব্যকুশলতা এমনই যে, লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতার প্রথম অনুচ্ছেদে সৃষ্ট চিত্রকল্প ধীরে ধীরে পরবর্তী অনুচ্ছেদকে অন্য রূপকল্পে ন্যস্ত করে দেয়, মন্ত্র-উচ্চারণের মতন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বিপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
তাঁর অনুভূতির মেদুরতা এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রসারতাই তাঁকে সার্থক কবির পূর্ণরূপ দিয়েছে। এখানে লক্ষ্যনীয় ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ – এই প্রশ্ন প্রয়োগে কবিতাটিকে কবি একটি অন্য মাত্রা দিয়েছেন। তাঁর এই স্বতন্ত্র বুদ্ধিদীপ্ত উচ্চারণ এবং ভাষার গভীরতাই তাঁকে একটি নিজস্ব স্থান করে দিয়েছে বাংলা কবিতার জগতে।
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুনিমা সান্যালের মুখ
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব – পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।
- পংক্তির স্বাধীনতা স্বীকার করে নিয়ে তাঁর কবিতা যে এক স্বতন্ত্রতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর, একথা অনস্বীকার্য। তাঁর সব ধরণের কবিতাতেই আমরা ব্যতিক্রমী জীবনানন্দকে বারংবার খুঁজে পেয়েছি।
কবি লিখেছিলেন
স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো...
জীবনানন্দ যদিও অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত এই তিনটি ছন্দই ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়, এমন কি গদ্য কবিতাও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে লিখেছেন, কিন্তু অক্ষরবৃত্তে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত –
নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারদিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে – গঙ্গা ফড়িং সেও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।
জীবনানন্দের লেখায় আমরা মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত মানুষের কথাও শুনেছি অনেক, সাধারণ জীবন যাপনের ছবিও –
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের পরে হাত
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্খায় ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
আমরা পেয়েছি যারা ইহাদের চিহ্ণ বারোমাস...
অথবা
জমি উপরায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা
নতুন লাঙল তার পড়ে আছে পুরানো পিপাসা...
- এভাবেই বারংবার তাঁর লেখনীতে সর্বশ্রেণীর মুখও উঠে এসেছে।
একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিণ্ণরকণ্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে...
কবিতা বিষয়টির মধ্যে আশ্চর্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন জীবনানন্দ। অনুভব, কল্পনা এবং মননশীলতার সম্মেলনে সৃষ্ট জীবনানন্দের লেখনীতে তাই যখন পেয়ে যাই একের পর এক আশ্চর্য কবিতা, মন্ত্রমুগ্ধের মতন কেঁপে উঠি আমরা।
জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম ছিল স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মতন –
সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা,
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।
কোনো কষ্টকল্পিত শব্দের ব্যবহার নেই তাঁর কবিতায়। সাবলীলভাবেই আবেগের প্রকাশ, একইসঙ্গে শব্দ-বিন্যাস এবং ভাষার ঋজুতাই তাঁর কবিতাকে অনবদ্য করে তুলেছে।
শেষ করার আগে তাঁরই কবিতা থেকে বলে উঠি –
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা রায় — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে –
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে –
শম্ভু মিত্রের আবৃত্তিই জীবনানন্দ দাশকে করিয়েছিল কিশোরীর সঙ্গে পরিচয়। যদিও তখন আমার কাছে জীবনানন্দ দাশ সীমাবদ্ধ ছিলেন শুধুই ‘বনলতা সেন’এ। পরবর্তীকালে রূপসী বাংলা, ধূসর পান্ডুলিপি, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, সুদর্শনা ইত্যাদি গ্রন্থ ধীরে ধীরে কবির সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করল।
রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের যে ভাষা ছিল, তার থেকে মুক্ত হয়ে জীবনানন্দ যে ভাষা সৃষ্টি করে গেছেন তাকে সর্বকালের আধুনিক ভাষা বলতে কোন দ্বিধা নেই। তাঁর লেখনীতে নিপুণ বাক্যবিন্যাস আমাদের হৃদয়কে বারংবার আন্দোলিত করে -
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলা লেবুর, করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
- রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হয়ে এই যে তিনি একটি নতুন মোড় নিয়ে এলেন বাংলা কবিতার জগতে, এখানেই তাঁর উত্তরণ। এখানেই তিনি অনবদ্য।
জীবনানন্দকে লাজুক কবি বলা হয়, লাজুক না বলে অন্তর্মুখী কবি বলাটাই যথাযথ। নিজস্ব কল্পনার জগতে ছিল তাঁর বসবাস, সচেতন অন্তর্মুখীতাই তাঁর কবিতাকে দিয়েছে সর্বকালের উচ্চারণ –
মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছুকাল অন্ধকার বিছানার কোলে।
একথা না মেনে উপায় নেই যে, জীবনানন্দ আধুনিক কবিতার মূল কেন্দ্রভূমিতে যে পতাকা উত্তোলন করে গেছেন সেটি তাঁর মৃত্যুর সাতান্ন বছর পরেও কেউ অবনমিত করতে পারে নি। এখনও সেটি অহঙ্কারের সঙ্গেই বিরাজ করছে। বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনা হয় কল্লোল যুগে। সেই সময়ই জীবনানন্দ কল্লোল-গোষ্টীর পরিকাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ ভিন্নধারায় নিজেকে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। সেইসময় তাঁর নীলিমা কবিতাটিই প্রথম সকলের দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৩৪-এ লিখিত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৭তে, সেটি সেই সময়ের দেশকাল সচেতন এক লিরিক, তদানীন্তন বাংলার চিরায়ত রূপ এবং তার সঙ্গে আত্মআবিষ্কারেরও এক অনুভব। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত ‘বনলতা সেন’ তাঁর সার্থকতম অবদান বলে স্বীকৃত।
যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হলে
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য করে চলে...
তাঁর কাব্যকুশলতা এমনই যে, লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতার প্রথম অনুচ্ছেদে সৃষ্ট চিত্রকল্প ধীরে ধীরে পরবর্তী অনুচ্ছেদকে অন্য রূপকল্পে ন্যস্ত করে দেয়, মন্ত্র-উচ্চারণের মতন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বিপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
তাঁর অনুভূতির মেদুরতা এবং অন্তর্দৃষ্টির প্রসারতাই তাঁকে সার্থক কবির পূর্ণরূপ দিয়েছে। এখানে লক্ষ্যনীয় ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ – এই প্রশ্ন প্রয়োগে কবিতাটিকে কবি একটি অন্য মাত্রা দিয়েছেন। তাঁর এই স্বতন্ত্র বুদ্ধিদীপ্ত উচ্চারণ এবং ভাষার গভীরতাই তাঁকে একটি নিজস্ব স্থান করে দিয়েছে বাংলা কবিতার জগতে।
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুনিমা সান্যালের মুখ
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব – পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।
- পংক্তির স্বাধীনতা স্বীকার করে নিয়ে তাঁর কবিতা যে এক স্বতন্ত্রতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর, একথা অনস্বীকার্য। তাঁর সব ধরণের কবিতাতেই আমরা ব্যতিক্রমী জীবনানন্দকে বারংবার খুঁজে পেয়েছি।
কবি লিখেছিলেন
স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলো...
জীবনানন্দ যদিও অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত এই তিনটি ছন্দই ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়, এমন কি গদ্য কবিতাও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে লিখেছেন, কিন্তু অক্ষরবৃত্তে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত –
নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারদিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে – গঙ্গা ফড়িং সেও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।
জীবনানন্দের লেখায় আমরা মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত মানুষের কথাও শুনেছি অনেক, সাধারণ জীবন যাপনের ছবিও –
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের পরে হাত
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্খায় ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
আমরা পেয়েছি যারা ইহাদের চিহ্ণ বারোমাস...
অথবা
জমি উপরায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা
নতুন লাঙল তার পড়ে আছে পুরানো পিপাসা...
- এভাবেই বারংবার তাঁর লেখনীতে সর্বশ্রেণীর মুখও উঠে এসেছে।
একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিণ্ণরকণ্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে...
কবিতা বিষয়টির মধ্যে আশ্চর্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন জীবনানন্দ। অনুভব, কল্পনা এবং মননশীলতার সম্মেলনে সৃষ্ট জীবনানন্দের লেখনীতে তাই যখন পেয়ে যাই একের পর এক আশ্চর্য কবিতা, মন্ত্রমুগ্ধের মতন কেঁপে উঠি আমরা।
জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম ছিল স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মতন –
সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা,
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।
কোনো কষ্টকল্পিত শব্দের ব্যবহার নেই তাঁর কবিতায়। সাবলীলভাবেই আবেগের প্রকাশ, একইসঙ্গে শব্দ-বিন্যাস এবং ভাষার ঋজুতাই তাঁর কবিতাকে অনবদ্য করে তুলেছে।
শেষ করার আগে তাঁরই কবিতা থেকে বলে উঠি –
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা রায় — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে
আলোচনার অহেতুক জটিল শব্দাবলী রহিত, বুকের অন্তস্থল থেকে উৎসারিত, একটি যথার্থ আলোচনা।
ReplyDeleteলেখিকাকে শুভেচ্ছা।
আইজাক সাহা
Anek kotha bola jai English literature uni atmostho korechilen kobita bujhten o likhte o janten. Aj bojha jai he was ahead of time a true postmodern fervour in his poetry.Besides use of desoj sabdo,Journey,suggestive word.annanyosadharan.sarbopori subaltern subtle Bodh.bangla kobitar itihas e keu pare Ni parbe o na
ReplyDelete